কাশ্মীরে উড়ল গণতন্ত্রের পতাকা গুলাম নবির উচিত স্যালুট জানানাে

হিন্দু মহাসভা তথা ভারতীয় জনসঙ্ঘের মহান উদ্‌গাতা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়ের ভারতের জাতীয়তাবাদের মূল তত্ত্ব-‘আগে দেশ পরে ধর্ম এবং এক দেশ এক জাতি’-র প্রয়ােগে কেন্দ্রে দ্বিতীয় মােদী সরকার বিপুল। জনাশিস নিয়ে যখন জম্মু ও কাশ্মীরে এক দেশ, এক নিশান, এক বিধান, এক প্রধান নীতি প্রয়ােগে প্রাথমিক পদক্ষেপ নেবার কথা ঘােষণা করেছিলেন, তখন সর্বপ্রথম বিষাক্ত ছােবলের ভয় দেখিয়ে ফণা তুলে ফেস করেছিলেন কাশ্মীরের প্রধান বিরােধী দল পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি। রীতিমতাে উস্কানি দেওয়ার সুরে মন্তব্য করেছিলেন— “Any tampering of Article 370 and 35A will render treaty of accession null and void.” অর্থাৎ রীতিমতাে দেশদ্রোহের সুর তুলে বলতে চেয়েছেন— সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বাতিল করলে কাশ্মীর চুক্তিই বাতিল বলে পরিগণিত হবে। তার মানে কাশ্মীর ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল বলেই ধরে নেওয়া হবে। ৫ জুলাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যখন সত্যসত্যই সংবিধানের ওই ধারাগুলি বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দিয়ে এক দেশ এক বিধান’ নীতির বিজয় নিশান ওড়ালেন, তখন মেহবুবা মুফতির সুরে সুর মিলিয়েই জাতীয় কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদও সেই এক দেশদ্রোহের উস্কানি দিলেন। তিনি আরও স্পষ্ট করেই বললেন— এর ফলে কাশ্মীর ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল বলেই ধরে নেওয়া হবে। এমনকী লােকসভায় দাঁড়িয়ে জাতীয় কংগ্রেস নেতা এবং দেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী (যাঁর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে এবং পারিবারিক ভাবে বহু অর্থনৈতিক অপরাধের অভিযােগ রয়েছে) পি চিদাম্বরমও একটু কৌশল করেই বললেন— আমি ভয় পাচ্ছি, সত্যিসত্যিই ভয় পাচ্ছি যে এর পর জম্মু-কাশ্মীরে হাজার হাজার যুবক দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না যান।
ধরে নেওয়া যেতে পারে ভারতবর্ষের জাতীয় কংগ্রেস দলের এই দুই প্রধান নেতার বক্তব্য কংগ্রেসেরই বক্তব্য এবং সেখানেই প্রশ্ন উঠে আসে—তাহলে কংগ্রেস কি এতদিন যা চেয়ে এসেছে, আজও তাই চাইছে যে কাশ্মীরে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠুক এবং কাশ্মীর হয়ে উঠুক পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদতে ভারতবর্ষে লাগামছাড়া জঙ্গি সন্ত্রাসের খােলা আম-দরবার ?
গুলাম নবি আজাদ কাশ্মীরের বাসিন্দা। তার নিশ্চয়ই অজানা নেই, কোন রাজনৈতিক পটভূমিকায় প্রিন্সলি স্টেট জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তৎকালীন এই মর্ত্যের স্বর্গভূমির হিন্দু রাজা হরি সিংহ পাক আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্যই ভারতবর্ষের হস্তক্ষেপ দাবি করেছিলেন এবং ভারতের সঙ্গে তার রাজ্যের সংযুক্তিকরণের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। হরি সিংহ ব্রিটিশ প্রশাসক মাউন্টব্যাটেনকেও চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে, তার রাজ্যকে পাক-আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার জন্যই তিনি ভারতে যােগ দিতে চাইছেন।
পরবর্তী ইতিহাসটা ছিল এক চরম রাজনৈতিক চক্রান্তের যার কুশীলব ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং কাশ্মীরের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লা। রাজা হরি সিংহের মর্যাদাকে চরম অসম্মান করে এই দুই সহােদর রাজনীতিবিদ চেষ্টা করেছিলেন ভারতবর্ষের সংবিধান প্রণেতা ড. বি আর আম্বেদকারকে দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরকে স্পেশাল স্ট্যাটাস’দেওয়ার এবং এজন্য সংবিধানে ৩৭০ ধারার খসড়া তৈরি করার। কিন্তু বাবাসাহেব আম্বেদকর নেহরুর ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই কারণে যে, কাশ্মীর ভারতের অঙ্গরাজ্য, সুতরাং অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের মতােই জম্মু ও কাশ্মীরেরও‘এক বিধান’-এর শরিক হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নেহরুর বংশের শিকড় যেহেতু কাশ্মীরেই, প্রথম থেকেই তিনি বুঝেছিলেন, ভােটব্যাঙ্ক রাজনীতিতে সংখ্যালঘু ভােটকে কংগ্রেসের অনুকূলে জিইয়ে রাখতে হবে।
ফলত ৩৭০ ধারার খসড়া করে দেন। গােপালস্বামী আয়েঙ্গার। প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। পরে ষড়যন্ত্র করে কাশ্মীরের মাটিতেই তাকে হত্যা করা হয়। সে। এক অন্য ইতিহাস।
কিন্তু আজ কংগ্রেস নেতারা অস্বীকার করছেন—আজও ভারত-পাকিস্তানের তিক্ত সম্পর্কের মূল বিষয় হয়ে রয়েছে জম্মু ও কাশ্মীরের দখলদারিতে যার বীজ পুতেছিলেন কংগ্রেস সর্বাধিনায়ক জওহরলাল নেহরু। এবং যদিও সংবিধানের ৩৭০ ধারা ছিল ‘স্পেশাল প্রভিশন’, তাহলে তার মেয়াদ অনেক আগেই কংগ্রেসের দীর্ঘ প্রশাসনিক কালে তুলে দেওয়ার দরকার ছিল। তা হয়নি। সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং সংবিধানের ব্যাখ্যাকারও যখন 76046901– Kashmir cannot be in any way different from those arising from the same fact of the other Indian states— তখনও কংগ্রেস কর্ণপাত করেনি। এর সাহায়্যে সাধারণ নাগরিক হয়তাে ভারতবর্ষের অন্যান্য নাগরিকদের চেয়ে কিছু সুবিধা বেশি পেতেন, কিন্তু তাঁরাও চাইতেন ভারতবাসীর মর্যাদা। কোনােভাবেই তারা শুধু ‘মুসলমান’ হয়েই বেঁচে থাকতে চাননি।
রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফলেই কাশ্মীর থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে হাজার হাজার কাশ্মীরি পণ্ডিত হিন্দু পরিবারকে। রাজনৈতিক কারণেই কাশ্মীরের সাধারণ মুসলমান সমাজকে পাক-সন্ত্রাসবাদের হাতের পুতুল হিসেবে ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। রাজনৈতিক কারণেই কাশ্মীরকে মর্যাদা দেওয়ার কথা কখনও ভাবেইনি কংগ্রেস। এবং রাজনৈতিক কারণেই রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেসের মদতেই কাশ্মীর পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসবাদের কারখানায়।
ভারতীয় সংবিধানের আর কোনও ধারা নিয়ে কখনও এত দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক ওঠেনি। ৩৭০ ধারা নিয়ে উঠেছে কারণ ৩৭০ ধারা এবং ৩৫এ ধারা যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির বিরােধী। জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয়তাবােধ বিরােধী। এই আইনটি ছাড়া সংবিধানে আর কোনও আইনই নেই যেখানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাও সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা ক্ষুন্ন হয়েছে বারে বারে। কারণ কাশ্মীর রাজ্যের অনুমতি ছাড়া কাশ্মীরে কোনাে আইন প্রণয়ন করতে পারে না লােকসভা। রাষ্ট্রপতি প্রয়ােজনে সেখানে জরুরি অবস্থাও জারি করতে পারেন না যদি না রাজ্য সম্মতি দেয়।
সুতরাং এক অর্থে বলা যেতেই পারে, সংবিধানের ৩৭০ ধারা এতদিন ধরে ভারতবর্ষের বাকি সব রাজ্যের মানুষকে, আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষের ১৩৫ কোটি ভারতবাসীকে ঠকিয়েছে। ভারতবাসীর করের টাকায় পােষ্য রাজ্য হিসেবে কখনও কোমর সােজা করে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি কাশ্মীর।
নরেন্দ্র দামােদরদাস মােদীর সুযােগ্য প্রশাসন এবং সংবেদনশীল রাজনীতি কাশ্মীরকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সুযােগ করে। দিয়ে দিয়েছে ৩৭০ ধারা বাতিল করে এবং জম্মু ও কাশ্মীরকে লাদাখ থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়ায়।
কংগ্রেসের উচিত ছিল, অন্যান্য বহু বিরােধী দলের মতাে কেন্দ্রের এই উদ্যোগকে সমর্থন জানানাে। বিক্ষুব্ধ গােষ্ঠীগুলিকে বােঝানাে যে, কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ কাশ্মীরের প্রতি বৈরিতা নয়। কাশ্মীরের উন্নয়নের পথে এক বিশাল পদক্ষেপ। তা না করে কংগ্রেসের অহেতুক বিরােধিতা যে শুধুমাত্র বিরােধিতার জন্যই তা প্রমাণ হলাে আরও একবার।
এই মুহূর্তে কাশ্মীরের সন্তান গুলাম নবি আজাদকে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়ােজন নরেন্দ্র মােদীর সহযােগিতায় মুরলীমনােহর যােশীর ১৯৯১ সালের ৪৭ দিনের একতা যাত্রার প্রসঙ্গ। একতা যাত্রার পরিক্রমা পথ ছিল কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর। কিন্তু কাশ্মীরে পৌঁছানাের পর জঙ্গি আন্দোলকারীরা একতা যাত্রাকে এগােতে দেয়নি। নরেন্দ্র মােদী নিজেই বলেছেন : “শ্রীনগরে আমাদের পতাকা পুঁততে বাধা দেয় জঙ্গিরা। তারা চায় ভারতকে ভাগ করতে। এবং তারা প্রকাশ্যে হুমকি দেয়, শ্রীনগরে পতাকা পুঁতলে, আমাদের হত্যা করা হবে। আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। তাদের জানিয়ে এসেছি, আমরা আসব এবং পতাকা পুঁতব।”
দেশের প্রথম মজবুত গণতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রী ৫ আগস্ট কাশ্মীরে প্রকৃত গণতন্ত্রের পতাকা পুঁতলেন। গুলাম নবির উচিত, সেই পতাকাকে স্যালুট জানানাে।
সুজিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.