Hindu Temples: What Happened to Them – হিন্দু মন্দিরগুলির কী হয়েছিল – হিন্দু মন্দিরগুলির কী হয়েছিল? প্রাথমিক সমীক্ষা – ০৮

১। চোরাগোপ্তা সাম্প্রদায়িকতা
২। হিমশৈলের চূড়া
৩। কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রশ্ন
৪. ধর্ম যখন উপলক্ষ্য
৫। সত্যের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা
৬। ইতিহাসবিদ বনাম ইতিহাস
৭। নভেম্বর-৯ ইতিহাস পরিবর্তন করবে
৮। শিল্যান্যাস থেকে “বার্লিনের পাঁচিল” পর্যন্ত
৯। রাম-জন্মভূমি মন্দির সংক্রান্ত মুসলিম বিবৃতি
১০। বোবা সাক্ষী কথা বলুক
উপসংহার

১৯৯০ সালে ভয়েস অফ ইণ্ডিয়া এই বইটি প্রকাশ করে। হিন্দুত্ববুক্সের সাথে যৌথ উদ্যোগে এই বইটি পাঠকদের সামনে নিয়ে আসল বঙ্গদেশ। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা সরকার।

আগের পর্ব  [] – [] – [] – [] – [] – [] – []

অষ্টম অধ্যায় : শিল্যান্যাস থেকে ‘বার্লিনের প্রাকার’ পর্যন্ত

জয় দুবাসী

ইতিহাসের অনেক কিছুই ভারী অদ্ভুত, তবে এই আপাত পাগলামির পেছনে একটি শৃঙ্খলা রয়েছে। আমি আমার শেষ লেখায় বলেছিলাম যে ৯ই নভেম্বর ১৯৮৯ ভারতীয় ইতিহাসে একটি বিশেষ দিন হিসাবে জায়গা পাবে। আমি তখন অবগত ছিলাম না যে একই দিনে, যখন অযোধ্যাতে রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল, তখন বার্লিনবাসীরা বার্লিনের প্রাচীর থেকে ইট সরিয়ে ফেলছিল। অযোধ্যায় একটি মন্দির তৈরী হবার সময়, ইউরোপে পাঁচ হাজার মাইল দূরে একটি কমিউনিস্ট মন্দির ভেঙে ফেলা হছিল। এটি যদি ইতিহাস না হয় তবে ইতিহাস কী তা আমি জানি না। বার্লিন ওয়াল সম্পর্কে আমাদের ‘কমিউনিস্ট বন্ধুদের’ কোনো প্রতিক্রিয়া শুনিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে হিটলারের ফ্যাসিবাদী সাম্রাজ্যের মতো বার্লিনের দেওয়ালও বিপর্যস্ত, এর ফলে কম্যুনিস্ট বিশ্বে যে অশান্তি হয়েছিল তা নিয়েও আমার ‘কর্মী বন্ধুরা’ নীরব। আমাদের মহান “শ্রীযুক্ত সবজান্তা কেরালার অতি-বাকপটু পণ্ডিত” যিনি আমাদের হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার কুফল নিয়ে জ্ঞান বিতরণ করতেন, আজ তিনি কোথায়? পাঞ্জাবের দুর্দান্ত বক্তা হরকিষণ সিং সুরজিৎ কোথায়, যিনি মস্কোয় অভিযান হবার পর থেকে পুরোপুরি তাঁর ভবিষ্যৎদ্রষ্টা সত্তাটি বর্জন করেছেন? এমনকি তাঁদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এক ও একমাত্র বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, বার্লিন প্রাচীর সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি, যদিও তিনি অযোধ্যায় কী করা উচিত, বা কী করা উচিত নয় সে সম্পর্কে আমাদের ক্রমাগত পরামর্শ দিচ্ছেন। দুটি ঘটনা, একটি অযোধ্যা এবং অন্যটি বার্লিনের, অনেকটা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সুতো দিয়ে বাঁধা; দেখে মনে হয় তাদের মধ্যে কোনো যোগসূত্র থাকা সম্ভব নয়, অথচ তাদের যোগসূত্রটিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না। একদিকে নেহরু-পরবর্তী যুগের সমাপ্তি এবং ভারতে সত্যিকারের জাতীয় যুগের সূচনা এবং অন্যদিকে কমিউনিস্ট-উত্তর যুগের সমাপ্তি এবং ইউরোপে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক যুগের সূচনা—এটিই সেই অদৃশ্য যোগসূত্র। ইতিহাস ভারতে নেহরুকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ইউরোপে কমিউনিজমকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এটি কোনো আকস্মিকতা নয় যে দুটি ঘটনা একই সঙ্গে হয়েছে। নেহরুবাদ ও কমিউনিজম উভয়ই ‘নকল বিশ্বাসে’র উপর দাঁড়িয়ে ছিল, যদিও এর অন্তঃসারশূন্যতা দেখতে আমাদের অনেকটা সময় লেগেছে। আমাদের মধ্যে কয়েকজন এটি অনেক আগে দেখেছিলেন, তবে আরও অনেকে ছিলেন তথাকথিত বামপন্থী এবং প্রগতিশীল, যাঁরা সেগুলি দেখতে পাননি। তাঁদের চোখ থেকে তখনও ঠুলি খসে পড়েনি; তবে এখন এটা ঘটা কেবল সময়ের অপেক্ষা। ভারতের তথাকথিত উগ্রবাদী মানবতাবাদীরা সবার মধ্যে সবথেকে নকল, যাঁরা কমিউনিস্ট পোশাক ছেড়ে দিয়েছেন তবে চিন্তাভাবনায় কর্তৃত্ববাদী পদ্ধতিটি ছাড়তে পারেননি, যেটা কমিউনিজমের বৈশিষ্ট্য। সমস্ত জনপ্রিয় আন্দোলনে তাঁদের প্রতিক্রিয়াগুলি একটি স্বৈরাচারী রূপ নেয়। এই লোকেরা ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলনের’ সময় ব্রিটিশদের সহায়তা করেছিল। ঠিক তেমনই তাদের বন্ধুরা একসময়ে ভারতের স্বাধীনতার চেয়ে বিশ্বযুদ্ধে মিত্র-শক্তির জয়কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলো।

এখনও তারা একই কথা বলছে। তারকুন্ডে এবং অন্যান্য নকল ধারণা পোষণকারীদের মতে পূর্ণ হিন্দু জাতীয়তাবাদ, যা অযোধ্যা আন্দোলনের মধ্যে নিহিত, এর চেয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নেহরু সংস্করণ আরও গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি তারকুন্ডে ও তাঁর সহযোগীরা শিলাপূজন বন্ধের জন্য সহায়তা চেয়ে ধর্মাধিকরণের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যদি এই পূজন করেন তাহলে তা হলো একটি গণতান্ত্রিক বিষয়। যদি ভারতীয়দের নিজের দেশে মন্দির থাকার অধিকার না থাকে তবে কার আছে?

তবে এই ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিগণ এই বিষয়টিকে দেখেও দেখেন না। এই ব্যক্তিগণ তাঁদেরকে নিজেদের দৃষ্টিতে প্রকৃতির উচ্চ আসনে স্থাপন করেন এবং তাঁদের জন্য যে কোনও জনপ্রিয় আন্দোলন, যতই গণতান্ত্রিক এবং গণ-ভিত্তিক হোক না কেন, সেটা যদি তাদের নিজস্ব বিশ্বাসকে মেনে না নেয় তবে তা সন্দেহজনক বলে অভিহিত হয়। এটি সবচেয়ে খারাপ ধরনের স্ট্যালিনবাদ, এই কারণেই বার্লিন দেওয়াল তৈরি হয়েছিল, যা বিশ্বের অন্যতম কদর্য প্রতীক। অযোধ্যাতে কোনও মন্দির হলে তা অসামাজিক বলা হবে, তারকুন্ডে এই সিদ্ধান্ত নেবার কে? মানবেন্দ্রনাথ রায় কে এমন ছিলেন, যিনি ঠিক করতে পারেন যে গান্ধীর ভারত ছাড়ো আন্দোলন জাতীয় স্বার্থবিরোধী ছিল কি না? কারা এই মানুষেরা যাঁরা প্রথমে ইতিহাসকে ঠাট্টা করেন এবং তারপর ইতিহাসের বিচারে নিজেরাই রক্তাক্ত হন? তারা সোভিয়েত রাশিয়ার স্ট্যালিন এবং নাৎসি জার্মানের হিটলারের মতো একই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত, এবং তাঁরা আপনার এবং আমার মতো ‘অতিসাধারণ মানুষদের’ কিসে ভালো হয় তা নির্ধারণ করার জন্য সর্বদা বসে থাকেন। কালের বিচারে এঁরা ধূলিসাৎ হয়ে যান, ঠিক যেমনটা এখন হচ্ছে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের অত্যাচারীদের।

যে মানুষরা ‘সবার জন্য ভালো-মন্দের’ বিষয়টি ভাবেন তাঁরা সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রজাতি এবং তাঁদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাগলা গারদে ভরে ফেলা উচিত। জওহরলাল নেহরু ছিলেন এমনই একজন মানুষ। তিনি জানতেন যে আপনার এবং আমার পক্ষে কী ভাল, ঠিক যেমন স্ট্যালিন এবং হিটলার জানতেন। জওহরলাল নেহরু প্রায় ২০ বছর ধরে এই অসহায় দেশে তাঁর ধ্যান-ধারণাকে জোর করে চালিয়েছেন। তিনি এবং তাঁর পরামর্শদাতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে আমাদের কতটা ইস্পাত থাকা উচিত এবং কত বিদ্যুৎ হবে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে কাকে অর্থ প্রদান করা উচিত এবং কার কী আমদানি করা উচিত, কাকে কোথায় কী কী উৎপাদন করতে হবে। টাটা-বিড়লা শিল্পগোষ্ঠী বা সরকারি বাবুদের কোনো একটা বিশেষ শিল্পের দায়িত্ব দেওয়া যায় কিনা সে বিষয়ে তাঁরা বিধি প্রণয়ন করেছিলেন। এই সিদ্ধান্তগুলির ভিত্তি কী ছিল? কিছুই না। কেবল একটি অহংকারী ধারণা যে “বড় ভাই আপনার পক্ষে কী ভাল তা জানেন” এবং তাঁকে আপনার খুব বেশি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা একেবারেই উচিত নয়।

যাঁরা অযোধ্যা ইস্যুতে ধর্মাধিকরণের দ্বারস্থ হয়েছেন তাঁরা হলেন সেইসব ‘শ্রীযুক্ত সবজান্তা’, যাঁরা আমাদের জন্য সব-ভাল জিনিসগুলি আগে থেকেই জেনে বসে আছেন। এই অহঙ্কারের ভিত্তি হলো, “জনগণ কোনও বিষয়ে কোনোকিছু জানে না আর তাই তাদের মতামতেরও কোনো গুরুত্ব নেই।” এটি মার্ক্সবাদী মতবাদের মূল ভিত্তি যা থেকে নেহরুর নকল সমাজতন্ত্র এবং তারকুন্ডের সমানভাবে নকল ‘বৈপ্লবিক মানবতাবাদ’ ধারণাগুলি সৃষ্টি হয়েছে। যেটা তাঁরা এখনও বুঝতে পারেননি, তবে মিখাইল গর্বাচেভ বুঝেছিলেন – সেটা হলো এই অহঙ্কারী ধারণাটাই ছিল মার্ক্সবাদের পতনের কারণ। একই কারণে ভারতে নেহরুবাদ ব্যর্থ হয়েছে। নেহরু শতবর্ষের নামে সরকারী অনুষ্ঠানের পিছনে মানুষের প্রায় কোনো উৎসাহই দেখা যায়নি। কারণ ভারতের সাধারণ মানুষ নেহরুবাদের শিকার, ঠিক যেমন রাশিয়ার সাধারণ মানুষ কমিউনিজমের শিকার, তেমনি। কোনো স্বাস্থ্যকর সমাজেই ভুক্তভোগীরা ঘটা করে অত্যাচারীদের শতবর্ষ উদযাপন করে না।

ভারতে বেশ কিছু নেহরুপন্থী রয়েছেন, শুধু যে ক্ষমতাশালী দলে তাই নয়1, (পাদটীকা ১), বিরোধী দলেও তাঁরা রয়েছেন এবং আমাদের সতর্ক থাকতে হবে তাদের সম্পর্কে। তবে এই প্রজন্ম তাদের পথ খুঁজে নিচ্ছে – একটু টালমাটাল পায়ে হলেও তারা নতুন পথেই হাটছে। নেহরু-উত্তর যুগটি গত ৯ নভেম্বর অযোধ্যাতে শুরু হয়েছে এবং আগামী দিনগুলিতে তা আরো দৃঢ় হবে। ঠিক সেভাবেই ইউরোপের বিভিন্ন জায়গাগুলিতে কমিউনিস্ট-উত্তর যুগ শুরু হয়েছে – আগামী দিনে তা আরো উদ্ভাসিত হবে। এটি কোনও সহজ কাজ নয়, তবে কোনও মহান কাজই কিন্তু সহজে হয় না।

অর্গানাইজার, নভেম্বর ২৬, ১৯৮৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.