১। চোরাগোপ্তা সাম্প্রদায়িকতা
২। হিমশৈলের চূড়া
৩। কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রশ্ন
৪. ধর্ম যখন উপলক্ষ্য
৫। সত্যের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা
৬। ইতিহাসবিদ বনাম ইতিহাস
৭। নভেম্বর-৯ ইতিহাস পরিবর্তন করবে
৮। শিল্যান্যাস থেকে “বার্লিনের পাঁচিল” পর্যন্ত
৯। রাম-জন্মভূমি মন্দির সংক্রান্ত মুসলিম বিবৃতি
১০। বোবা সাক্ষী কথা বলুক
উপসংহার
১৯৯০ সালে ভয়েস অফ ইণ্ডিয়া এই বইটি প্রকাশ করে। হিন্দুত্ববুক্সের সাথে যৌথ উদ্যোগে এই বইটি পাঠকদের সামনে নিয়ে আসল বঙ্গদেশ। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা সরকার।
আগের পর্ব [১] – [২] – [৩] – [৪] – [৫] – [৬]
সপ্তম অধ্যায় : নভেম্বর ৯ ইতিহাসকে পালটে দেবে
জয় দুবাসী
আন্দোলনের পুরো উদ্দেশ্য হল ভারতের ইতিহাসকে একটি নতুন দিশায় চালিত করা, এর চেয়ে কম বা বেশি কিছু। সম্প্রতি আমাকে একজন প্রশ্ন করেন: “এই সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কী?”
স্থিতিশীলতা, ঐক্য নাকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি? আমি তাঁকে বলেছিলাম: “এগুলির কোনটিও নয়, এই সময়ের সবচেয়ে প্রয়োজন সাহস।” আমরা হিন্দুরা ভীতু এবং প্রায় কাপুরুষ জাতি হয়ে উঠেছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাসের ও সাহসের ভীষণ অভাব। আমাদের মধ্যে কারোর কোনওরকম প্রত্যয়ই নেই, এবং আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার মতো উচ্চ শব্দযুক্ত খালি বাক্যাংশের আড়ালে আমাদের লজ্জা গোপন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিগত বহু শতাব্দী ধরে হিন্দুদের ইতিহাস তৈরি হয়েছে অ-হিন্দুদের দ্বারা, প্রথমে মোগলদের, পরে ব্রিটিশদের। আজও হিন্দুরা তাদের নিজস্ব ইতিহাস লেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা আমার কাছে প্রায় গণহত্যার মতোই। যতক্ষণ না আমরা নিজের ইতিহাস লিখি ততক্ষণ এই জমি আমাদের হতে পারে না। ভারতীয় আইন ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং একজন বিশিষ্ট বিচারপতি উপেন্দ্র বক্সি বলেছেন যে, যেদিন প্রস্তাবিত রাম মন্দিরের ভিত্তি অযোধ্যায় স্থাপন করা হবে, তখন এটি ভারতের ইতিহাসের একটি নির্ণায়ক রূপ নেবে। তিনি সম্পূর্ণ সঠিক। রাম জন্মভূমি আন্দোলনের সম্পূর্ণ তাৎপর্য ভারতের ইতিহাসকে পাল্টে দেওয়া, এর চেয়ে কিছু কম নয়, কিছু বেশিও নয়।
যাঁরা এটি দেখবেন না, তাঁরা জানেন না ভারত কী। কয়েক শতাব্দীতে প্রথমবারের মতো, ভারতের ইতিহাস ভারতীয়রা তৈরি করছে, তাঁদের হিন্দুই বলুন, অথবা তাঁদের অন্য কোনও কিছুই বলুন, (যদি ‘হিন্দু’ শব্দটি আপনার হজম করতে কষ্ট হয়, যেমন নেহরুর হয়েছিল)। অযোধ্যা আন্দোলন ঐতিহাসিক আন্দোলন, এটির গুরুত্ব গান্ধীর ডান্ডি অভিযান বা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের চেয়ে অনেক বেশি। স্বাধীনতার অর্থ আপনার নিজস্ব পতাকা উড়ানো বা আপনার নিজস্ব সরকার থাকা নয়। স্বাধীনতা মানে আপনার নিজের ইতিহাস তৈরি করা, এটি সময়ের পাতায় নিজেদের রক্তে লেখা হয়ে যায়। আমি আগেই বলেছি, আমাদের ভাগ্য বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে তা থেকে আমাদের বিরত করে রেখেছে। এখন সময় এসেছে সময়ের পাতাগুলি খোলার, হিন্দুরা বাদে এই দুনিয়ার প্রতিটি মহান জাতি এত দিন যেভাবে নিজেদের ইতিহাসকে সুসংগঠিত করে এসেছে এবার হিন্দুরাও সেটা করতে পারে; এমন সাহস সঞ্চয় করার সময় এসেছে।
নাম্বুদ্রিপাদ বা ইঙ্গ-ভারতীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকের মতো ক্ষুদ্র মনের মানুষরা, যাঁরা ক্রিসমাসের সময় বিশেষ সংস্করণ বের করেন, তবে কখনও দীপাবলীতে তা করেন না, তাঁরা এগুলি বুঝতে পারবেন না, কারণ তাঁরা ভারতীয় ইতিহাস জানেন না। তাঁরা যা কিছু সামান্য বোঝেন তার সবটাই বিদেশী ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে শেখা এবং দাস ক্যাপিটালের মতো বিদেশী বইগুলি থেকে সংগ্রহ করা।
আমাদের অবশ্যই এই লোকদের প্রতি করুণা করা উচিত। নাম্বুদ্রিপাদ মনে করেন যে অযোধ্যা আন্দোলন ‘সাম্প্রদায়িক’, এটি এমন একটি শব্দ যা তিনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে শিখেছিলেন। ব্রিটিশদের জন্য তাঁর কিছু বন্ধু গুপ্তচরবৃত্তি করেছিল। আর তিনি এগুলি তোতাপাখির মতো পুনরাবৃত্তি করেছিলেন যেভাবে শিশুরা স্কুলে পড়া মুখস্থ করে। কমিউনিস্টরা হলেন রাজনৈতিক তোতা যাঁরা একটানা বছরের পর বছর ধরে মার্ক্সের গাথা আওড়ে যান, ভুলে যান যে সেই মানুষটি (মার্ক্স) অনেকদিন আগেই তাঁর প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছেন। পুরো ইউরোপ জুড়ে, তাঁর আদর্শগুলি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। তবে ভারতীয় কম্যুনিস্টরা তাঁদের সকলের চেয়ে অর্ধ শতাব্দী পিছনে রয়েছেন। তাঁদের নিজস্ব বিশ্বাস ভেঙে পড়েছে এবং তাও এক শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশেরও কম সময়ে। এজন্য তাঁরা অন্য মতবাদকে অভিশাপ দিতে শুরু করেছেন। তবে আমরা হিন্দুরা গতকাল জন্মাইনি, এবং আমরা ব্রিটিশ যাদুঘরেও জন্মাইনি, অথবা প্রাচীন ইতিহাসের বইগুলির থেকেও উত্থিত হইনি যেগুলির কোণগুলি ছিঁড়ে, ভাঁজ হয়ে কুকুরের কানের মতো হয়ে গেছে।
আমাদের মধ্যে দিয়ে আমাদের সত্য ইতিহাসের প্রকাশ। আমরা অন্তত আরও পাঁচ হাজার বছর বাঁচব, নাম্বুদ্রিপাদের দেবতার মতো পঞ্চাশ বছরে শেষ হয়ে যাবো না। আমি কেবল এটা বুঝতে পারি না যে কোনও সম্প্রদায়ের নিজের জায়গায় নিজেদের মন্দির বানানোর মধ্যে সাম্প্রদায়িক কী আছে? রোমে কোনও গির্জা স্থাপনের অধিকার কি ক্যাথলিকদের নেই? সৌদিরা যদি মক্কায় মসজিদ তৈরি করতে চায় তবে কেউ কি বাধা দেবে? অযোধ্যাতে কেন মসজিদ থাকা উচিত? কেউ যদি মক্কায় রাম মন্দির নির্মাণের চেষ্টা করে তবে তাদের কেমন লাগবে? বাবরি মসজিদটি বাবরের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, যাঁর ভারতের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র ছিল না। তিনি এখানে একজন বিজয়ী হয়ে এসেছিলেন তবে বিজয়ীর অধিকার বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে যায়। এই দেশটি এখন আমাদের, বাবরের নয় এবং আমরা কোনও ভুলকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিতে না পারলে এই সমস্ত স্বাধীনতার মূল্য কী?
ইতিহাসও এটাই, ক্ষমতার দম্ভে একজন বিজয়ীর দ্বারা কৃত একটি সুস্পষ্ট ভুল কাজকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা। আমি যখন বলেছিলাম যে আমরা ইতিহাসটি আবার লিখতে চলেছি তখন এটিই আমি বোঝাতে চাইছিলাম। আমি জোর দিয়ে আবারো বলতে চাই যে এটাই স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ। আমি বিদেশী বিজয়ীদের সময়কে আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক সময় হিসাবে বিবেচনা করি। তারা কোথা থেকে এসেছিল এবং তারা কে ছিল বা কীভাবে তারা এসেছিল তা বিবেচ্য নয়। গান্ধীও এটাই বলেছিলেন এবং এ কারণেই আমরা ব্রিটিশদের বের করে দেওয়ার শপথ করেছিলাম। ব্রিটিশরা যদি বিদেশি হত তবে মোগলরাও তাই ছিল, এবং তারা যা করে গেছে সেগুলিও তাই। আমরা পুরানো ব্রিটিশ সংস্থাগুলি দখল করেছি এবং সেগুলির ভারতীয়করণ করেছি। আমরা তাদের রেলপথ, তাদের বন্দর এবং আশ্রয়কেন্দ্র, তাদের ভবনগুলি, তাদের অফিসগুলি, এমনকি তাদের উপ-নিয়ন্ত্রিত বাড়িটিও দখল করেছি। আমরা চাইলেই তাদের ঐতিহ্যের বাড়িগুলি ধ্বংস করতে পারতাম, যা আমরা করিনি। মহাত্মা গান্ধী প্রকৃতপক্ষে সেই বাড়িটিকে একটি হাসপাতালে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। আমরা তাদের গীর্জা এবং ক্যাথিড্রালগুলিও গ্রহণ করতে পারতাম, ঠিক যেমনটা পূর্ববর্তী বিজয়ীরা করেছিলেন। আমরা তা করিনি, তবে আমি না করার কোন কারণ দেখছি না। যদি আমরা “বিজয়ের পর ধ্বংসের অধিকারকে” সঠিক হিসাবে মেনে নিই তবে এই পরিবর্তনগুলি না করার পেছনে কোনো কারণ থাকতে পারে না। আর যদি আমরা “বিজয়ের পর ধ্বংসের অধিকারকে” ভুল মনে করি তাহলে হিন্দুদের উপাসনাঘরগুলিও বিদেশীদের দ্বারা অশুচি করা উচিত হয়নি। এখন সেটির সংশোধন হওয়া উচিত। অন্যের জন্য যা ভাল, তা আমাদের পক্ষেও ভাল। দুজনের জন্য দুরকম আইন থাকতে পারে না।
কোনও ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে থাকবেন না – আমরা ইতিহাস পরিবর্তন করতে যাচ্ছি এবং আমরা এটি করা শুরু করে দিয়েছি ৯ই নভেম্বর ১৯৮৯ দিনাঙ্কে।
অর্গানাইজার, ১৯ই নভেম্বর ১৯৮৯