১। জাতীয় সংহতির নামে
২। ভারতে মুসলিম শাসনের চরিত্র
৩। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর দাবি
৪। মধ্যযুগের ভারতে সংঘাতের বৈশিষ্ট্য
৫। ইসলামই ছিল দোষী
৬। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ১
৭। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ২
৮। মুসলিম সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিংবদন্তী
৯। হিন্দুদের পরাজয়ের নির্ণায়ক কারণ
১০। ইসলামী দেশে/রাজ্যে হিন্দুদের অবস্থান
১১। আত্তীকরণ ও সংশ্লেষ
১২। ইসলাম বনাম মানবতা
ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী
ইসলাম বনাম ইনসানিয়ত (মানবতা)
কিছু বন্ধু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই আমার এই সিরিজটি শুরু করা নিয়ে বিভ্রান্তি প্রকাশ করে। তাদের আশঙ্কা ছিল যে এই প্রক্রিয়ায় আমি এনসিইআরটি-এর প্রতি অন্যায় করতে পারি।
একজন সাংবাদিক বন্ধু এখন দয়া করে আমাকে জাতীয় সংহতির দৃষ্টিকোণ থেকে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক মূল্যায়নের জন্য নির্দেশিকা এবং সরঞ্জামগুলির একটি খাঁটি অনুলিপি দিয়ে গেছেন। আমি মাইমোগ্রাফ সমন্বিত নথিটি অধ্যয়ন করেছি এবং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনের সাথে এটির যত্ন সহকারে তুলনা করেছি। আমি দেখতে পেলাম, যে মিসেস কোমি কাপুরের প্রতিবেদন সরকারী অবস্থানের পুরোপুরি বিশ্বস্ত ছিল।
দেশের গণতান্ত্রিক সরকার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি শিক্ষা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় হওয়া এ জাতীয় বজ্জাতির পরিকল্পনা দেখে আমার হৃদয় গভীর দুশ্চিন্তায় ডুবে যায়। এটি চিন্তা-নিয়ন্ত্রণ এবং মগজ ধোলাইয়ের একটি প্রতারণামূলক প্রচেষ্টা। কমিউনিস্ট দেশগুলিতে প্রচলিত এই জাতীয় প্রক্রিয়াগুলোর শিক্ষার্থী হয়ে আমার দৃঢ় সন্দেহ, যে এই নথিটিও অনুরূপ মন থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এই মনই দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভাপতিত্ব করে আসছে এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীর ছদ্মবেশে অভিজাত ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের অবশিষ্টাংশ দ্বারা মদতপুষ্ট হয়ে সঞ্চারিত হয়ে চলেছে।
ভারত কোনও ফাঁকা স্লেট নয় যার ওপর যে কোনও মতাদর্শিক ভাষা ইচ্ছামত প্রতিলিপিত করা যেতে পারে, সেটা খোদাইকারী কোনও দৈত্যও হলেও নয়। কিন্তু ভারতের অবস্থায় ক্রমবর্ধমানভাবে হয়ে চলেছে। ভারত একটি অস্পষ্ট ধূসর ইতিহাসের দেশ। ইতিহাসের দ্বারা সঞ্চিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জাতীয় স্মৃতি এবং চেতনা কেবল তখনই উপেক্ষা করা যেতে পারে, যখন আমরা আত্মবিস্মৃতি দ্বারা তার মূল্য দিতে প্রস্তুত, যা জাতীয় সংহতিকরণের কাজটিকে প্রায় অসম্ভব করে দেয়।
জাতীয় সংহতির প্রকৃত ভিত্তি
জাতীয় সংহতির জন্য একটি উপযুক্ত জলবায়ু কেবল সত্য ন্যায়বিচার ও মানব সংস্কৃতির গভীর উপলব্ধির ভিত্তিতে তৈরি করা যেতে পারে। আমরা যদি হয় সাময়িক রাজনৈতিক অভিযানের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে অথবা এক অগভীর ও স্ব-পরাজয়কামী ধর্মনিরপেক্ষতার দ্বারা পরিচালিত হয়ে এই মানদণ্ডগুলি উপেক্ষা করে অসহিষ্ণু আদর্শের অন্যায় দাবিতে আত্মসমর্পণ করি, তাহলে ফলস্বরূপ অবশ্যই জাতীয় বিচ্ছেদই হবে, এবং সেই সঙ্গে আগ্রাসী হিংস্র ইসলামিক জোট দ্বারা ঘিরে থাকলে ঘটবে জাতীয় দাসত্ব।
হিন্দুরা কখনও খুব ভাল রাজনৈতিক ঐতিহাসিক বা জীবনীকার ছিল না। তাদের ঐতিহাসিক আগ্রহ সর্বদা অসামান্য ব্যতিক্রমী নায়ক ও সাধুদের জীবন কাহিনীতে কেন্দ্রীভূত ছিল, যেখানে তারা নিছক স্থলজ চিত্রকে তুরীয় স্তরে অতিরঞ্জিত করত। গ্রীক, রোমানরা, চীনা ও মুসলমানরা যেমন তাদের রাজা এবং অন্যান্য আলোকিত চরিত্রগুলোর সময়কাল নির্দেশ করেছিল, তেমন ঐতিহাসিক তথ্যের জন্য আমাদের ঐতিহাসিক পুরাণের সমগ্র কলেবরটি অনুসন্ধান করা নিরর্থক। কলহন, জোনরাজা ও শ্রীবারের রচিত তিনটি রাজতরঙ্গিনী শুধুমাত্র ব্যতিক্রম। ইসলামী হানাদার বাহিনীর আবির্ভাবের আগে হিন্দু রাজনৈতিক ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আধুনিক বিদ্বানদের লিখিত প্রমাণ হিসাবে বহিরাগত ভ্রমণকারীদের বিবরণ ও কিছু আদিবাসী সাহিত্যের ওপর ভরসা করতে হয়। একমাত্র শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যের দিনগুলিতে ইচ্ছাকৃতভাবে বা অজান্তেই যে দৃষ্টিভঙ্গীর বিকৃতি ঘটেছে, সেটা বাদ দিলে ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন কিছু নেই যার সংশোধন প্রয়োজন আছে।
কেবলমাত্র ভারতবর্ষে ইসলামী হানাদারদের ব্যাপারেই শত শত মুসলিম দিনলিপিকার ও সংগ্রাহকের সংকলন করা প্রচুর ঐতিহাসিক উপাদান ধরা আছে। এই উপকরণগুলি সাবধানে সংগ্রহ করা হয়েছে, তুলনা করা হয়েছে, সম্পাদনা করা হয়েছে, ভাষ্য দেওয়া হয়েছে এবং পশ্চিমা ও ভারতীয় পণ্ডিতদের একটি দল দ্বারা অনুবাদ করা হয়েছে। এই পাণ্ডিত্য তথা বৃত্তির ফলশ্রুতি সম্পর্কে যে জানে এবং সৎ থাকতে চায়, তার পক্ষে স্বেচ্ছায় মেনে হওয়া অসম্ভব, যে সংশ্লিষ্ট পণ্ডিতরা মোটামুটি সকলেই শ্রমসাধ্য বিভ্রান্তিকর কাজ করেছেন। নেহেরুভিয়ান ধর্মনিরপেক্ষতার অধীনে বহুগুণ বেড়ে যাওয়া আরোপিত ভ্রাতৃত্বের প্রবক্তা মহম্মদ হাবিব ও রোমিলা থাপারের মতো এই দুই স্ট্যালিনিস্ট ঐতিহাসিক ছাড়া উল্লেখযোগ্য বিকৃতি ও অপব্যাখ্যার নিদর্শন খুঁজে পাওয়া কঠিন।
মধ্যযুগীয় মুসলিম ঐতিহাসিকদের রচিত ইতিহাসগুলি যদি বর্তমান গণতান্ত্রিক, সাম্যবাদী, মানবতাবাদী এবং ইসলামের বর্তমান ধর্মীয় ভণ্ডামির পক্ষে এতটা ক্ষতিকারক হয়ে থাকে, তাহলে তাতে আধুনিক পণ্ডিতদের দোষ নেই। গবেষকরা এই গল্পগুলোর একটাও উদ্ভাবন করেননি, যেগুলো তথাকথিত কাব্যিক অতিরঞ্জন হিসাবে সুনির্দিষ্টভাবে প্রচুর ছাঁটাই করার পরেও এতটা দানবীয় বিভীষিকাময় শুনতে লাগে।
কিছু গবেষক তো আরও এগিয়ে গিয়ে অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন, যে বেশিরভাগ মুসলিম রাজা মোল্লা ও সুফিরা যে দানবীয় কীর্তিকলাপ থেকে পরম সন্তুষ্টি লাভ করেছিল, তা কোরান স্বীকৃত ইসলামের মূল পাঠগুলি দ্বারা, নবী বর্ণিত সুন্নাহ দ্বারা এবং প্রথম চার খলিফার কথা ও কাজ দ্বারা অনুমোদিত কিনা। তারা কম-বেশি সর্বসম্মতভাবে নিশ্চিত করেছেন, যে ইসলামের বিরাট ধর্মগ্রন্থ সম্ভার দ্বিধাহীনভাবে যা বলেছে, তাতে বিভ্রান্তির বা ভুলবোঝাবুঝির কোনও অবকাশ থাকে না। ইসলামের নায়করা বৈধভাবেই গর্ব করতে পারে, যে তারা আক্ষরিক অর্থে ও খুব বিশ্বস্তভাবে ইসলামের যাবতীয় শিক্ষা এবং নবী ও ধার্মিক খলিফাদের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকারকেই অনুসরণ করেছে।
শিক্ষার কোনও স্বাস্থ্যকর মানবিক ব্যবস্থা আমাদের মুসলিম সমাজ থেকে আগত যুবক-যুবতীদের সামনে এই সমস্ত তথ্য এবং তার সঙ্গে নীচের প্রস্তাবটি রাখতে পারে: মধ্যযুগের ভারতে ইসলামিক ঐতিহাসিকরা মুসলিম রাজা সাধু ও ধর্মবেত্তাদের কথা ও কাজগুলোকে প্রচুর কৃতিত্ব দিয়েছে। এই কথা ও কাজগুলো পৃথিবীর অন্যত্রও যেসব জায়গা ইসলামের সেনাবাহিনী দখল করে নিয়েছে, সেখানকার কথা ও কাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে তুলনীয়; আর এই কথা ও কীর্তিকলাপ কোরান প্রচারিত ইসলামের নীতি, সুন্না ও শরিয়তের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আমরা তোমাদের এই কথা ও কার্যকলাপগুলো কোনও অনৈস্লামিক ধর্ম বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে বলছি না; আমাদের একমাত্র আবেদন তোমরা মোল্লা ও সুফি অথবা আলিগড়ী উমেদার ও স্টালিনিস্ট ঘরানার ঐতিহাসিকদের চতুর ও অসার যুক্তির আশ্রয় না নিয়ে এগুলো স্বাভাবিক মানবিক যুক্তি, মানুষের স্বাভাবিক নীতিবোধ ও মানুষের সৌভ্রাতৃত্বের প্রাথমিক নীতি দিয়ে বিচার করো। অন্যান্য সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়েদের মতোই তোমাদেরও মনুষ্যোচিত সমান শুভাশুভবোধ, নীতিবোধ আছে; আমরা তোমাদের রায়ের জন্য অপেক্ষা করছি।
আমি বেশ আশাবাদী যে বেশিরভাগ মুসলিম যুবক এবং মহিলার ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্তত তরুণ মুসলিমদের মন ও হৃদয় স্বাভাবিক মানবিক মূল্যবোধের দিকে খুলে দেওয়ার এবং তাদেরকে ইসলামের কারাগার থেকে বের করে আনার ক্ষেত্রে এটা একটা সূত্রপাৎ হতে পারে। যবে থেকে প্ররোচনা বল প্রয়োগের ফলে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হয়েছে, তবে থেকে ভারতের অধিকাংশ মুসলিম এক অন্ধকার যুগে বাস করছে, অনেকেটা সেইভাবে যেভাবে পশ্চিমের খ্রিস্টানরা মধ্যযুগে ক্যাথলিক চার্চের সভাপতিত্ব বা খবরদারিতে বাস করত। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানরা যখন যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদ দ্বারা খ্রিস্টীয় মতবাদ ও ইতিহাসকে প্ররিশ্রুত করে এবং তাদের প্রাচীন পৌত্তলিক ঐতিহ্যের কিছুটা পুনর্জাগরণ ঘটায়, তখন যুক্তি ও ‘নবজাগরণ’ (Renaissance) যুগের অভিজ্ঞতা লাভ করে। ভারতে এবং অন্যত্রও মুসলমানদের অনুরূপ পুনর্জাগরণ না হওয়ার কোনও কারণ নেই, যেখানে তারা সংশ্লিষ্ট দেশে নিজেদের প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করবে এবং যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের পাশে দাঁড়ানো শুরু করবে।
ইসলাম কি কোনও ধর্ম?
কিছু লোক ইসলামকে তারই শিকার মুসলমানদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার প্রবণতা পোষণ করে এবং মুসলিমদের বর্বরতাগুলো জানতে পেরে তাদেরকেই দোষারোপ করে। এটি একটি অত্যন্ত গুরুতর বিভ্রান্তি, যা সংকীর্ণ বিচ্ছিন্নতাবাদী আত্মকেন্দ্রিক এবং বৈষম্যবাদী জাতীয়তাবাদ বা সাম্প্রদায়িকতার বিপ্রতীপে যারা এক সুবিস্তৃত মানব ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলার পক্ষপাতী তাদের এড়িয়ে চলা উচিত। এতে কোনও সন্দেহ রাখা উচিত নয়, যে একজন গড়পড়তা মুসলমান একজন গড়পড়তা হিন্দুর মতোই মানুষ হিসাবে ভাল বা খারাপ, বা সেই কারণেই অন্য যে কোনও জাতি ধর্ম বা সংস্কৃতির অন্তর্গত কোনও গড়পড়তা এক মানুষ। আমাদের উদ্বেগের বিষয় হল আদর্শ হিসাবে ইসলামের মূল্য, মানুষ হিসাবে মুসলমানের মূল্য নয়।
মুহাম্মদ নবী ছিলেন কিনা বা তাঁর কোরান বলে দাবি করা বস্তুটির সত্যিই স্বর্গীয় উত্স ছিল কিনা, এই গভীরতর প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার উপলক্ষ্য এটা নয়। ইসলাম ধর্ম না সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ এই আলোচনাটা আমিও আপাতত স্থগিত রাখছি এবং নিজের থেকে ভালো মনের মানুষকে নির্ধারণ করার দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছি। এখানে আমি কেবলমাত্র ইসলামের অব্যাহত কিছু ভান নিয়েই চিন্তাভাবনা করব – এমন কিছু ভণ্ডামি যেগুলো নিয়ে এদেশে বা অন্যত্র কোথাও প্রশ্ন তোলা হয়নি।
বহু বিদ্বান বা ধর্মপ্রাণ মানুষ সহজে যার শিকারে হয়, তা হল বহু-ঈশ্বরবাদের বিপরীতে ইসলামের প্রথম প্রচার একেশ্বরবাদ; অর্থাৎ ‘অনেকগুলি ভ্রান্ত দেবতাদের বিরুদ্ধে’ ‘একজন প্রকৃত ঈশ্বর’-এর করুণা। নিছক monotheism বা একেশ্বরবাদ শব্দটিই কিছু মানুষের মনের ওপর এমন সম্মোহক প্রভাব ফেলে, যে তারা তাদের চিন্তা প্রক্রিয়াকেই স্থগিত রাখে, এবং তিনটি পয়গম্বরবাদী পন্থ – ইহুদিধর্ম, খিস্টধর্ম ও ইসলামেরই সাধারণ এই ধারণাটির আসল অর্থ ও তার প্রভাবগুলোর দিকে তাকাতেই চায় না।
রাম স্বরূপ খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করেছিলেন এবং বেশ কয়েক বছর ধরে একেশ্বরবাদ ও বহু-ঈশ্বরবাদ নিয়ে সাধনা করেছেন। এই বিষয়ে The Word As Revelation: Names of Gods বইটিতে তাঁর যা বক্তব্য, আমি তার পুনরুৎপাদন করছি:
সত্যটি হল এক বা একাধিক ঐশ্বরের সমস্যা কোনও রহস্যময় চেতনা নয়, এটি ব্যক্তিগত ধর্মীয় মনে জন্ম নেয়। অথর্ববেদে (২.১.১) ঋষি ভেনা (Vena) বলেছেন, যে হৃদয়ের সেই গোপন স্থলে যেখানে পৃথিবীর বহুগুণত্ব একটি রূপ ধারণ করে; কিংবা যজুর্বেদে (৩২.৮) যেখানে বলা আছে, বিশ্ব রয়েছে একটি সত্যে। কিন্তু মানুষের অন্য কক্ষে যেখানে তার আত্মা নয় বরং তার মন নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে এক ও বহুর মধ্যে, ঈশ্বর ও বস্তুর মধ্যে, ঈশ্বর ও ঈশ্বরদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে, এবং অনেকের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। অন্যদিকে যখন আত্মা জাগ্রত হয়, ঈশ্বরেরা তার গভীরতায় জন্মগ্রহণ করেন যাঁরা একে অপরকে প্রতিষ্ঠিত ও গৌরবান্বিত করে।
হিন্দুরা তাদের ঈশ্বরকে ‘এক’ বা ‘বহু’ বলে ডাকে না। তাদের মতে তারা যা উপাসনা করে তা হল ‘একম সত্য’, যাকে বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে। এই বাস্তবতা সর্বত্র, সমস্ত কিছুর মধ্যে, প্রতিটি সত্তায়। এটি একই সাথে এক ও অনেক এবং এটি উভয়কে ছাড়িয়েও যায়। সবকিছুই এই বাস্তবতার একটি অভিব্যক্তি, একটি নাটক, একটি দৃশ্য, একটি প্রতিধ্বনি।
আধ্যাত্মিক জীবন একটাই, তবে তা বিশাল এবং অভিব্যক্তিতে সমৃদ্ধ। মানুষের মন এটিকে পৃথকভাবে ধারণ করে। যদি মানুষের মন বিভিন্ন গভীরতা উচ্চতা ও সূক্ষ্মতার স্তর ছাড়াই অভিন্ন হত; বা যদি সমস্ত মানুষের একই মন, একই মানসিকতা, একই কল্পনাশক্তি, একই চাহিদা থাকত; সংক্ষেপে যদি সব মানুষ একই রকম হত, তাহলেই সম্ভবত একজন ঈশ্বর যথেষ্ট ছিলেন। কিন্তু মানুষের মন স্থির পরিমাণ নয় এবং মানুষের ক্ষমতা ও প্রয়োজনগুলিও পৃথক। সুতরাং একমাত্র বহু ঈশ্বরবাদই এই বৈচিত্র্য এবং ঐশ্বর্যের প্রতি ন্যায়বিচার করতে পারে।
তাছাড়া বিভিন্ন ধরণের মানবিক চাহিদা এবং মানুষের মন, আধ্যাত্মিক বাস্তবতা নিজেই এত বিশাল অপরিসীম ও অনিবার্য, যে মানুষের যুক্তি ব্যর্থ হয় এবং কল্পনা ও রুচি স্তম্ভিত হয়ে যায়। সুতরাং, এই বাস্তবতাটি কোনও একটি নাম বা সূত্র বা বিবরণ দ্বারা নির্দেশিত হতে পারে না। এটিকে বহু দৃষ্টিকোণ থেকে অভিব্যক্ত হতেই হবে। কোনও একক ধারণা বা ধারণার ব্যবস্থা এটি পর্যাপ্তরূপে প্রকাশ করতে পারত না। এটিও বহু-ঈশ্ববাদের প্রয়োজনীয়তাই ইঙ্গিত করে।
বহু ঈশ্বরবাদী উপাদান ছাড়া বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদী ভগবান নির্জীব ও বিমূর্ত হয়ে ওঠেন। একটি খাঁটি একেশ্বরবাদী একক জীবন্ত আত্মাকে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয় এবং নিছক সমান ও সাধারণের প্রতি বৌদ্ধিক ভালবাসাকেই প্রকাশ করে।
বিশ্বের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে, একেশ্বর দ্বারা বহু ঈশ্বরের প্রতিস্থাপন শুধু সংঘাত, ভাঙচুর, ধর্মান্ধতা, অত্যাচার ও ধর্মের নামে গোষ্ঠীযুদ্ধের (crusading) সৃষ্টি করেছে। তখনও অনেকটা আজকের মতো ‘মুক্তির জন্য যুদ্ধ’ ছিল, গরম ও ঠাণ্ডা ছিল, ছিল প্রকাশ্যে আক্রমণাত্মক বা ধূর্ততার আশ্রয় নেওয়া ধ্বংসাত্মক মানুষ। এ জাতীয় যুদ্ধের দ্বারা আরবের স্থানীয় উপজাতির দেবতা, ধরা যাক আল্লাকে বৃহত্তর মহত্তর ভূমিকায় তথা মর্যাদায় উত্তীর্ণ করানোর জন্য সাফল্য পেতে এই জাতীয় যুদ্ধ কার্যত কোনও ভূমিকা পালন করেনি।
ঈশ্বর ও প্রতিবেশী
রাম স্বরূপ প্রস্তাবটিকে আরও সরল করে এটিকে অন্য একটি প্রবন্ধে একটি সামাজিক প্রেক্ষাপটে রেখেছেন যা এখনও প্রকাশিত হয়নি। তিনি বলেন:প্রথম দৃষ্টিভঙ্গী সহনশীলতাকে উৎসাহ দেয়, যদিও তা ঈশ্বরের একাধিকতা ও বিভিন্ন উপায়ে উপাসনার কথা বলে। অন্য পদ্ধতিটি শুধু একটি ঈশ্বরের ও একটিই উপাসনা পদ্ধতির কথা বলে, কিন্তু অসহিষ্ণুতার জন্ম দেয়। একটি ধারণা বিজয়ের মাধ্যমে নিজেকে সাধারণীকরণের চেষ্টা করে এবং নিজেকে যথার্থ সত্য, প্রকৃত সর্বজনীন বলে।
তবে যদি আপনি আপনার ঈশ্বরের মাধ্যমে প্রতিবেশীর দিকে তাকান, তবে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীর দিকে পরিচালিত করে। তারপরে আপনি বলেছিলেন যে আপনার ঈশ্বর যদি আপনার পক্ষে যথেষ্ট ভাল হন, তবে তার আপনার প্রতিবেশীর পক্ষেও যথেষ্ট ভাল হওয়া উচিত। এবং যদি আপনার প্রতিবেশী যদি একই ঈশ্বরের একইভাবে উপাসনা না করে, তবে সে অবশ্যই শয়তানের উপাসনা করছে এবং সে হয় ধর্মান্তরণযোগ্য নতুবা বধ্য।
আধ্যাত্মিক রাজ্যে দুটি বিভাগ রয়েছে: ঈশ্বর এবং আপনার প্রতিবেশী। এবং এগুলি দেখার দুটি সংশ্লিষ্ট উপায়ও রয়েছে: আপনি আপনার প্রতিবেশীর মাধ্যমে ঈশ্বরের দিকে তাকাতে পারেন, অথবা আপনার ঈশ্বরের মাধ্যমেও প্রতিবেশীদের দিকে তাকাতে পারেন।
প্রথম পদ্ধতির মধ্যে আপনি ভাববেন, যে আপনার প্রতিবেশীর যদি আপনার মতো একই চাহিদা এবং সংবিধান ও উদ্দীপনা থাকে, তবে তাঁর ঈশ্বর, যেভাবেই তাঁর উপাসনা করা হোক এবং যে নামেই তাকে ডাকা হোক, তার কাছে একই অর্থবহ হবে যেমনটা আপনার ঈশ্বর আপনার কাছে। সংক্ষেপে, আপনার প্রতিবেশী যদি আপনার মতো ভালো হয়, তাহলে তাঁর ভগবানও অবশ্যই আপনার ভগবানের মতোই উত্তম।
একেশ্বরবাদ হল ছদ্মবেশী বস্তুবাদ
খ্রিস্টান ও ইসলামের ধর্মতাত্ত্বিকদের যদি একেশ্বরবাদের প্রামাণ্য প্রচারক হিসাবে বিবেচনা করা যায়, তবে এর অর্থ হল ঈশ্বর বা পরম শক্তি বা আমরা সেই চরম সত্যের নাম যাই রাখি না কেন ব্রহ্মাণ্ডের বাইরে থেকে যায়, অর্থাৎ সৃষ্টিকর্মের পরে এটি একটি মহাজগৎ বহির্ভূত হয়ে ওঠে। এই ধর্মতত্ত্ববিদরা ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ হিসাবে প্রশংসা করে, কিন্তু তাঁর সর্বত্র উপস্থিতির কথা ভাবতে পারে না। ঈশ্বর যে মানুষের হৃদয়ে (অন্তরায়মিন), মহাবিশ্বে (সর্বাণিবাস্বীন), প্রকৃতিতে, প্রাণীতে, উদ্ভিদে এবং এমনকি এমন পদার্থেও উপস্থিত থাকতে পারেন যেগুলো তারা বহুত্ববাদ হিসাবে ঘৃণা করে, এই চিন্তাটাই তাদের মতে নাস্তিকতার মতো ধর্ম অবমাননা কিংবা তার চেয়েও বেশি অপরাধ। ইসলাম বহুত্ববাদকে অর্থাৎ সৃষ্টিকে স্রষ্টার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করাকে যা আসলে সর্বভূতে ঈশ্বরের বিরাজমানতা দেখার মতোই, তাকে শির্ক বলে নিন্দা করে।
এই পদ্ধতিতে দেখলে একেশ্বরবাদের এক অনিবার্য পরিণতি হল মহাবিশ্বকে কোনও অন্তর্নিহিত ঐশ্বরিক ব্যাপার থেকে সম্পূর্ণরূপে রিক্ত করে দেওয়া এবং নিতান্ত উপাদানে পরিণত করা। মানুষ বা প্রাণী বা জড়জগতের মধ্যে অন্তর্নিহিত কোন ঈশ্বরত্ব নেই। একেশ্বরবাদ তাই আসলে ছদ্মবেশে বস্তুবাদ। যেটা সবচেয়ে খারাপ, তা হল এটি নিকৃষ্টতম পৌত্তলিকতার জন্ম দেয়, কারণ তা ঈশ্বরকে একটি ঐতিহাসিক ব্যক্তির করুণার মুখাপেক্ষী করে রাখে যাকে নবী বা পুত্র হিসাবে স্তুতি করা হয়, এবং যার ওপরে ব্রহ্মাণ্ড বহির্ভূত দেবতাকে নির্ভর করতে হবে তাঁর সৃষ্টিদের সাথে যোগাযোগের জন্য। যীশু বা একজন মুহাম্মদের প্রশংসায় যা গান ও উপদেশ শোনা যায়, সেগুলি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে সম্বোধন করা মন্ত্রগীতকে দ্রুত ছাড়িয়ে যায়।
আল্লা একজন ‘অহং’ ঈশ্বর
ইসলামের আল্লাহ মোটেই প্রাথমিক বাইবেল বর্ণিত ধারণার একেশ্বরবাদী ঈশ্বরও নয়। বরং রাম স্বরূপের মতে এটা একটা ‘অহং’ ঈশ্বর।
উপনিষদ বলেছে, ঈশ্বর যাকে ইচ্ছা তাকেই বেছে নেন। এটি গভীরতর অর্থে সত্য। এর অর্থ হল তিনি আমাদের চয়নের বা পছন্দ, ভালোলাগা বা মন্দ লাগা, তাঁর সম্পর্কে আমাদের ধারণাসমূহ – ঠিক ভুল, সত্য বা মিথ্যা যাই হোক – সবকিছুর অতীত।
কিন্তু নিজেদের ঈশ্বরকে বেছে নেওয়ার মধ্যে একটা অনুভূতি কাজ করে। ঈশ্বর মানুষকে নিজের মতো করে তৈরি করেছেন। কিন্তু মানুষও ঈশ্বরকে নিজের প্রতিরূপ করেই তৈরি করে। আমাদের ঈশ্বর আমরাদেরই মতো। যদি আমাদের হৃদয় খাঁটি হয়, আমাদের ঈশ্বরও শুদ্ধ, আর আমাদের অন্তর অশুচি হলে আমাদের ঈশ্বররাও অশুদ্ধ হয়ে পড়েন।বেশিরভাগ পুরুষরা এমন ঈশ্বর চায়, যিনি তাদেরকে আমোদিত ও পরিতৃপ্ত করেন, যিনি তাদের জীবনযাত্রার যথার্থতা প্রমাণ করেন, যিনি তাদের নিজেদের ও আত্মীয়-বন্ধুদের চোখে শুদ্ধ করেন। তারা চায় তাদের রাজত্ব প্রসারিত হোক, তারা যুদ্ধ-লুঠ করতে চায় বিশেষত সোনা ও অল্প বয়সী মেয়েদের আকারে; তারা চায় তাদের শত্রুদের হত্যা করতে ও অবনমিত করতে চায়।
অহং ঈশ্বর সম্পূর্ণরূপে আপনা থেকেই তাদের নিজের মধ্যে চলে আসে, যখন আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলি নৈতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক ছদ্মবেশ ধারণ করে; যখন অহঙ্কারটি নিম্নস্তরের তৃপ্তির জন্য কোনও উচ্চতর নীতি ব্যবহার করে, সত্য নিজেই বিকৃত হয় এবং তখন অহং ইশ্বরের জন্ম হয়। আমরা অহং ঈশ্বরের উপাসনার সময় আসলে উচ্চতার ছলে নীচতাকে বন্দনা করি।
কলেমার আসল আমদানি হল আল্লাহ ব্যতীত কোনও উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ হলেন নবী। দেখে মনে হয় যে, ইসলামের নবীর এমন কোনও ঈশ্বরের প্রয়োজন ছিল না যার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি থাকতে পারে, যিনি মানুষ ও বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর নিজস্ব মতামত রাখতে ও প্রকাশ করতে পারেন এবং যিনি ঠিক ও ভুল সম্পর্কে নিজের রায় প্রয়োগ করতে পারেন। বিপরীতক্রমে নবীর দরকার ছিল ঈশ্বর নামক একটি ছদ্ম সত্তা, যা গার্হস্থ্য জীবনে হোক বা জনসমক্ষে – নবীর মোকাবিলা করা প্রতিটি পরিস্থিতিতে স্পষ্টভাবে কিন্তু দারুণ আড়ম্বরপূর্ণ ভাষায় নবীর ব্যক্তিগত প্রবর্তনগুলোই প্রতিধ্বনিত করবে। এই সিদ্ধান্তটি কালানুক্রমিকভাবে কোরান এবং তৎসহ নবীর গোঁড়া জীবনীগ্রন্থ পাঠের দ্বারা প্রত্যয়িত হয়েছে। নবীজী তাঁর সাধারণ মুহুর্তগুলিতে কী পরিকল্পনা করছিলেন বা ফন্দি আঁটছিলেন এবং তার অনতিপরেই তাঁর কাছে দৈববাণী (ওয়হি) অবস্থায় যা প্রকটিত হত, তার মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বেশ চিত্তাকর্ষক। কোরান সংকলনের কালানুক্রমিক বিভ্রান্তি এই যোগসূত্রটি আড়াল করতে বেশ সহায়তা করেছে।ইসলামের প্রথম প্রচার বা ভানের জন্য এই পর্যন্ত।
ডাকাতদের ভ্রাতৃত্ব
ইসলামের দ্বিতীয় ভান হল, এটি অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিশেষত হিন্দু সমাজের বর্ণ বিভাজন এবং শ্রেণীবিন্যাসের বিপরীতে মানব ভ্রাতৃত্ব এবং সামাজিক সাম্যের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজতান্ত্রিক প্রবণতা রয়েছে বা তার ভাব করা বহু মানুষ তারা যাকে ‘সামাজিক প্রগতিশীলতা’ বলে, ইসলামের মধ্যে তা উপস্থিত দাবি করে ছলনা করে। আমাদের দেশে এই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি পুরো বাহিনী রয়েছে যাদের কাছে আল্লাহ বা মুহাম্মদের কোনও উপযোগিতা নেই, কিন্তু তারা ইসলামের জোরালো সুপারিশ করে কারণ তাদের বিশ্বাস ইসলাম আরও উন্নত সামাজিক মূল্যবোধের পক্ষে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ভালোবাসে এমন হিন্দুরও কোনও অভাব নেই, কিন্তু একই সাথে স্বীকার করে যে ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের প্রশ্নে হিন্দু সমাজের ইসলামের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
আধুনিক যুগে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের উত্থানের পূর্বে ইসলাম এই দাবিগুলি কখনও সামনে রাখেনি। ইসলামের প্রবীণ ধর্মতত্ত্ববিদরা বিভিন্ন লোককে তাদের যথাযথ স্থানে স্থাপনের ক্ষেত্রে নিখুঁত ছিলেন। মুমিনগণ (believers) ছিল সমগ্র মানবতার ওপর বিশ্বাস ও পয়গম্বরের আইন চাপিয়ে দেওয়ার মহান দায়িত্বপ্রাপ্ত সমস্ত মানবজাতির মালিক স্থানীয় (millat)। কাফিররা ছিল পৃথিবীর কলঙ্ক যাদের হত্যা করা বা পুরোপুরি ধর্মান্তরিত করা না গেলে, তাদের অনন্ত নরকের আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। জিম্মিরা ছিল এমন লোকেরা যারা ইসলামিক রাষ্ট্রের আধিপত্যকে মেনে নিত এবং গুরুতর প্রতিবন্ধকতার মধ্যে অনাগরিক হিসাবে থাকতে সম্মত হত। ক্রীতদাসরা ছিল কেবল এমন পণ্যদ্রব্য যাদের বাজারে কেনা বেচা করা যেত এবং স্বাধীনতা লাভের চেষ্টায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে কোনও দায়বদ্ধতা ছাড়াই হত্যা করা যেত। আর মহিলারা (জ়ান) ছিল পুরুষদের ব্যক্তগত সম্পত্তি – সোনা রূপোর তুলনীয়। যদি তারা বৈধ স্ত্রী হয় তাহলে হারেমে ওড়না পরিয়ে গোপন করে রাখতে হবে, কিংবা যদি নতুন ধৃত লুঠের মাল হয় তাহলে উপহার হিসাবে উপস্থাপনা করা চলবে, অথবা রক্ষিতা হলে বন্ধুদের মধ্যে ভাগাভাগি করে ভোগ করা চলবে। ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদের সূচনায় মিল্লাতের মধ্যেও কুরাইশরা সাধারণ আরবদের চেয়ে প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার পেয়েছিল। যুদ্ধে প্রাপ্ত লুঠ থেকে আরব পরিবারগুলিকে দেওয়া আর্থিক অনুদান দেওয়ার জন্য খলিফা উমর কর্তৃক প্রণীত নাগরিক তালিকা আরব সমাজে এই জাতীয় উচ্চনীচ শ্রেণী বিন্যাসের অস্তিত্ব প্রতিফলিত করে। আরব সাম্রাজ্য পূর্ব ও পশ্চিমে প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে সর্বত্র অ-আরবদের আইনত এবং বাস্তবেও নিম্নমানের মানুষ হিসাবে বিবেচনা করা হত, এমনকি পরবর্তীকালে অ-আরবরা যখন মুমিন হয়ে যেত, তার পরেও। পরবর্তী পর্যায়ে তুর্কীরা সেরা জাতি হওয়ার দৌড়ে নেমে আরব উত্তরাধিকার গ্রহণ করেছিল। ইসলাম তাদের মিল্লাতদের মধ্যেও কখনও কোনও ভ্রাতৃত্ব বা সাম্য এনেছিল বলে জানা যায়নি।
তবে ইসলাম ধর্মতত্ত্ববিদরা অন্যভাবে ইসলামকে একটি নতুন পোশাকে বিক্রির সময় এবং সেটাও করে এমন লোকেরা যারা আদৌ ইসলামকে অনুসরণ করে না। তারা সামাজিক দর্শনের সর্বশেষ গতিবিধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে কোরানের ব্যাখ্যায় স্থূল কৌতুহলে অংশ নিতেও প্রস্তুত। একমাত্র সত্য বিশ্বাসের খিদমত করতে হবে, সেটা পবিত্র শাস্ত্রের সঙ্গে জালিয়াতি করে হলেও।
কোরান মানব ভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক সাম্যের ব্যাপারে বেশ স্পষ্ট এবং সোজাসুজি এগিয়ে রয়েছে। এতে বলা আছে: যে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনও বিশ্বাস কখনই গ্রহণযোগ্য হবে না (৩.৮৫)। অবিশ্বাসের চিহ্ন না পাওয়া পর্যন্ত তুমি তাদের সঙ্গে লড়াই করে যাও (৮.৩৯)। যখন কাফিরদের সাথে সাক্ষাৎ হবে, তাদের গলা কাটতে থাকো যতক্ষণ না তুমি একটি বিপুল জবাই করে উঠছ এবং যখন তাদের পরাজিত করতে পারবে, তাদের বন্দী করে রাখো যাতে তুমি মুক্তিপণ লাভ করতে পারো। তারা আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত তাদের সাথে লড়াই করো (৪৭.৪)। যুদ্ধ তোমার জন্য নির্ধারিত এবং তুমি তা অপছন্দ করো। তবে এটা সম্ভব, যে তোমার জন্য যা ভালো তা তুমি অপছন্দ করো (২.২১৬)। এবং এইরকমই চলেছে। পড়লে মানব ভ্রাতৃত্বের সনদের পরিবর্তে মনুষ্য প্রজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ পুস্তক মনে হবে। এটা মানবতাকে মুমিন ও কাফিরদের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে বিভক্ত করে এবং উভয়ের মধ্যে কোনও পারস্পরিক বোঝাপড়া বা স্বাভাবিক নৈতিকতার সামান্যতম অবকাশ রাখেনি।ইসলামের দ্বিতীয় ভণ্ডামির জন্য তাই এত কিছু।
ইসলাম আরব সমাজে নৃশংসতা চালায়
ইসলামের তৃতীয় মিথ্যাচার হল, এটি আরবকে অন্ধকার যুগ (জাহিলিয়া) থেকে উদ্ধার করেছিল এবং তাকে সাংস্কৃতিক অগ্রগতির পথে অগ্রসর করেছিল। এই প্রস্তাবনাটির খুব খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা দরকার। প্রাক-ইসলামী সংস্কৃতির কোনও নথিই আর অবশিষ্ট নেই অল্প কিছু কবিতা ছাড়া যেটা নিজে একটি জলন্ত সাক্ষ্য, যে একমাত্র মহম্মদের নবীত্বকে গুরুত্ব দিয়ে না নেওয়ার অপরাধে ইসলাম সে সমাজে কী সর্বনাশ কাণ্ড করেছিল। তা সত্ত্বেও মুহাম্মদের জীবনীবিদদের বলা মিথ্যের মধ্যে দিয়েও প্রাক-ইসলামিক আরব সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছু কিছু জ্বলজ্বলে ছবি বেরিয়ে আসে। সমাজটা উপজাতিদের ছিল সন্দেহ নেই। তবে উপজাতিদের বৃহত্তর ধর্মীয় উদারপন্থার দীর্ঘ ঐতিহ্য ছিল, যা বহু দেবদেবীর উপাসকদের পাশাপাশি শান্তিতে সহাবস্থান সম্ভব করেছিল। সহিষ্ণুতা ও বোঝাপড়ার এই পরিবেশে ইহুদি ও খ্রিস্টানরাও পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করেছিল। এই উদারতা ও সহিষ্ণুতাই ইসলামের নবীকে তার ইচ্ছা প্রচার ও অনুশীলন করার অনুমতি দিয়েছিল। মুহাম্মদের মুষ্টি বিজয়ের পরে আরবের যা বৈশিষ্ট্য হয়েছিল, তা যদি প্রাক-ইসলামিক আরব সমাজের থাকত, তাহলে কোন নবীও থাকত না আর ইসলামও থাকত না।
প্রাক-ইসলামী আরবরা অন্যান্য মানুষদের সঙ্গে সৎ আচরণ করত এবং তাদের শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধে বীরত্বের ভাব পোষণ করত। তারা সমস্ত দেওয়া নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি সম্মানের নীতি অনুশীলন করত। প্রাক-ইসলামী আরবে মহিলাদের অবস্থান খুব উচ্চ মর্যাদার ছিল। তারা ব্যবসা বাণিজ্যে সভাপতিত্ব করত। তারা গণ বিতর্ক ও কাব্য প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করত। তারা বন্ধু এবং প্রেমিকদের সঙ্গে দেখা করার জন্য স্বাধীনভাবে নিজেরাই ঘোরাফেরা করত। তারা যুদ্ধের ময়দানে তাদের পুরুষদের পাশে দাঁড়াত। তারা কখনও ঘোমটা পরত না, যেটা ইসলাম তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়।
সমাজটা ছিল সহজ সরল সোজাসাপটা এবং অবশ্যই মানবিক, যা ইসলাম একচেটিয়া স্বর্গীয় তত্ত্বের নামে পারস্পরিক বিদ্বেষ দ্বারা বিভক্ত করে দেয়। ভাইকে ভাইয়ের বিরুদ্ধে, পুত্র-কন্যাদের পিতামাতার বিরুদ্ধে, স্ত্রীকে স্বামীর বিরুদ্ধে এবং প্রতিবেশীকে প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে করে দেওয়া হয়। পুরোপুরি নির্মম দস্যুদের এই সমাজে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল জনৈক ‘নিখুঁত নীতি’র (perfect virtue) শিক্ষাদাতা দ্বারা। এই দস্যুদলটি বিনা প্ররোচনায় অপ্রস্তুত উপজাতি বসতির ওপর অসংখ্য আকস্মিক অভিযান চালায়, হামলার আশঙ্কা করেনি এমন কাফেলাগুলো লুঠ করে, অনেক নিরীহ পুরুষ মহিলা ও শিশুদেরকে নৃশংসতম উপায়ে হত্যা করে, বরাবর মুক্ত এমন অনেক নাগরিককে দাস বানায়, অনেক অসহায় মহিলাকে দাসত্ব ও উপপত্নীত্ব স্বীকারে বাধ্য করে এবং উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত তথা কষ্টার্জিত স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি থেকে পুরো প্রজাতিকেই বঞ্চিত করে। যাদের নিজেদের আপনজন আত্মীয় বলে জানত, তাদের কাছ থেকে এমন অপ্রত্যাশিত অসভ্য বর্বর আচরণ পেয়ে ভুক্তভোগী জনতা হতবাক হয়ে গিয়েছিল। ধৈর্যের সীমা অতিক্রান্ত হতে তারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে দ্বিধা নিয়ে বাধ্য হয়ে লড়াই করে। শেষে আত্মসমর্পণ করে উচ্চতর সামরিক কৌশল ও সশস্ত্র বাহিনীর কাছে, যাদের সঙ্গে লড়ার সময় ও অর্থ-প্রকৌশলগত সামর্থ্য কোনওটাই তাদের ছিল না।
আরবের প্রাচীন মানব সংস্কৃতি ধ্বংস করার পরে ইসলাম আরব জনগণের সঙ্গে চরম নৃশংসতা করে এবং তাদের পণ্ডিতদের নির্দেশ পুরোপুরি মানতে বাধ্য করতে বাধ্য করেছিল। আরব জনগণ অতঃপর একটি দস্যুদের ভ্রাতৃত্বে পরিণত হয়ে যায়, যারা পার্শ্ববর্তী জমিগুলিতে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, যারা একেশ্বরবাদের নামে অন্যান্য মানুষের গণহত্যা করে, যারা আল্লাহর নামে অন্যান্য মানুষের উপাসনা স্থান অবমাননা ও ধ্বংস করে, যারা সমগ্র দেশটাই লুট করে ধ্বংস করে দেয়, গোটা দেশে অসংখ্য অসহায় স্থানীয় মহিলাদের জবরদখল করে এলোপাতাড়ি বংশবিস্তার করে এবং পুরুষ নারী শিশু সবাইকে নিয়ে গিয়ে দাসত্বের জন্য বিক্রি করে দেয়। ইসলামের এই সভ্যতা বিস্তারের ব্রতটি পরবর্তীকালে বিশেষত ভারতে তুর্কীদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল।
এখন সময় এসেছে যে আমরা ধর্মের ছদ্মবেশে প্রচারিত এক ক্ষতিকারক রাজনৈতিক মতাদর্শের ভণ্ডামিগুলো সোজা দেখার, এবং নেহেরুভিয়ান ধর্মনিরপেক্ষতা যেগুলো ঢাকাচাপা দিয়ে রেখেছে তার সত্যতা উন্মোচন করার। এখনই সময় এসেছে যে সর্বত্র মুসলমানদের জানানো, ইসলামের সঙ্গে ইনসানিয়াত বা মানবতার দূরত্ব দক্ষিণ মেরুর সঙ্গে উত্তর মেরুর মতোই ছিল এবং এখনও রয়েছে। যে অন্ধকার রাত্রি ইসলাম দ্বারা আক্রান্ত বহু দেশ জুড়ে বিরাজমান এবং যাকে পেট্রো-ডলারের সাহায্যে আরও দূরে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা ফিরিয়ে দিতে হবে যতক্ষণ না প্রতিটি মুসলমান সাধারণ দিবালোক লাভ করে। এই প্রচেষ্টার একটি সূত্রপাৎ সনাতন ধর্মের দেশ ভারতে হতে পারে।
এই লক্ষ্যটি সম্পাদন করার আগে ধর্ম কী, তা নির্ধারণে আমাদের বিচক্ষণতা দেখাতে হবে। সনাতন ধর্মের সত্যতাকে স্লোগান করে তোলা কখনই উচিত নয়, যেটা ‘সর্বধর্ম সম্ভব’ চর্চা করতে গিয়ে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের পক্ষ নিয়ে করা হয়।
লেখক: সীতারাম গোয়েল
অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়