The Story of Islamic Imperialism – ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী – ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী – ১০

১। জাতীয় সংহতির নামে
২। ভারতে মুসলিম শাসনের চরিত্র
৩। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর দাবি
৪। মধ্যযুগের ভারতে সংঘাতের বৈশিষ্ট্য
৫। ইসলামই ছিল দোষী
৬। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ১
৭। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ২
৮। মুসলিম সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিংবদন্তী
৯। হিন্দুদের পরাজয়ের নির্ণায়ক কারণ
১০। ইসলামী দেশে/রাজ্যে হিন্দুদের অবস্থান
১১। আত্তীকরণ ও সংশ্লেষ
১২। ইসলাম বনাম মানবতা

ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী 

অধ্যায় ১০: ইসলামী রাষ্ট্রে হিন্দুদের অবস্থান

এখন NCERT পাঠ্যপুস্তক নির্দেশিকার কথায় আসি যেখানে ঐতিহাসিকরা মুসলিমদের শাসক ও হিন্দুদের শাসিত হিসাবে দেখতে পান না। রাজনীতির ওপর ধর্মবিশ্বাসের কী ও কতখানি প্রভাব ছিল তা বিশ্লেষণ না করেই নির্দেশ দেওয়া আছে, মধ্যযুগে মুসলিম শাসনে ভারত যে ধর্ম দ্বারাই পরিচালিত হত, সে কথা উল্লেখ করাই চলবে না।

আমি প্রথমে এই নির্দেশিকার দ্বিতীয়ার্ধ নিয়ে আলোচনা করব। ইসলামের বর্তমান উমেদাররা চেষ্টা চালিয়ে এসেছে এইসব মধ্যযুগের মুসলিম ঐতিহাসিকদের দ্বারা বর্ণিত জঘন্য নৃশংসতা থেকে ধর্মকে উদ্ধার করতে। প্রথমত, তাঁরা মধ্যযুগের ইতিহাসবিদদের সামগ্রিক অতিরঞ্জনকে দুষেছেন। দ্বিতীয়ত তাঁরা তুর্কিদের ওপর বর্বতার সব দায় চাপিয়ে দিয়েছেন। এই কৈফিয়তদাতাদের তৃতীয় স্তম্ভ হল, সেইসব কুকীর্তিকে রাজনৈতিক পদক্ষপ বলে চালানোর চেষ্টা যেগুলো মধ্যযুগের ঐতিহাসিকরা স্পষ্টভাবে ধর্মীয় হিসাবে উল্লেখ করে গেছেন।

ইসলামের উমেদারের এক উদাহরণ

আমি ইতিমধ্যে দুরকম প্রচেষ্টার বিশ্লেষণ করেছি। একটি উদাহরণ তৃতীয় ধরণটা ব্যাখ্যা করবে। মহম্মদ নাজ়িম তাঁর বহুল প্রচলিত মনোগ্রাফ The Life and Times of Sultan Mahmud of Ghazna -তে লিখেছেন: “যেসব সমালোচকরা সুলতানকে নিষ্ফল রক্তপাত ও হিন্দু মন্দির ধ্বংসের জন্য দায়ী করে, ভুলে যায় তথাকথিত বর্বরতা যুদ্ধের ন্যায়সঙ্গত গতিপ্রকৃতির অংশ ছিল, যে আচরণ পৃথিবীর সব মহান বিজেতারাই করেছেন। যুদ্ধে পরাজিত শত্রুদের কাছ থেকে তাদের সম্পত্তির ধ্বংসাবশিষ্ট সম্পদ সংগ্রহ করা জয়ীর পক্ষের কাছে একেবারে আইনসম্মত ব্যাপার। অন্যান্য দেশের চেয়ে ব্যতিক্রমীভাবে ভারতে এই সম্পদ শুধু রাজকোষ  নয়, মন্দিরে বিভিন্ন দেবদেবীর মন্দিরের কোষাগারেও জমানো ছিল। এর ফলে অন্যত্র যেখানে পরাজিত রাজার কোষাগার লুণ্ঠনই বিজয়ীদের তৃপ্ত করত, ভারতে সেখানে সোনা ও বহুমূল্য পাথরের লোভে রত্নখচিত মূর্তি ও মন্দিরও আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হয়েছে। ধর্মীয় বিবেচনা সেই বিজয়ের মধ্যে কাজ করত না, সুলতান তারা দ্বারা আদৌ প্রভাবিত ছিলেন বলে মনে হয় না।” (জোর প্রযুক্ত) নাজ়িম মুসলিমদের বিরুদ্ধেও অনুরূপ হিন্দু শত্রুতা দেখেছেন। এটাকে দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের রচনা হিসাবেই গ্রহণ করেছেন তিনি। তিনি লিখেছেন: “কিছু সমালোচকের মতে ইসলামের প্রতি হিন্দুদের মনে জ্বলন্ত ঘৃণা তৈরি করা হয়েছে কারণ ইসলামকে লুঠেরাদের বাহিনী হিসাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গী মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। হিন্দুরা ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করেছিল কারণ দুটি মতবাদে মৌলিক ও অলঙ্ঘনীয় কিছু প্রভেদ ছিল। ইসলাম যার নির্দিষ্ট বিশ্বাস আছে তা হিন্দুদেরকে আবেদন করতে পারেনি যাদের নির্দিষ্ট কোনও বাণী তথা নির্দেশিকা নেই। একটা মূর্তিকে জীবন-মৃত্যুর নির্ণায়ক ভাবার বদলে অসহায় প্রস্তরখণ্ড মনে করা, এবং দেবদেবীর পরিবর্তে এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরে বিশ্বাস করার মধ্যে সংঘাত বাধতে বাধ্য, কারণ সেটা হিন্দুরা যা ভাবে তার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। এই মৌলিক পার্থক্যই ব্রাহ্মণদের শত্রুতার কারণ হয়েছে, যারা গভীর পর্যবেক্ষণ দ্বারা নিশ্চিত বুঝতে পারছিল ইসলামের মতো গণতান্ত্রিক নীতি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক বিপ্লব আনতে চলেছে, যা ব্রাহ্মণদের সুবিধার্থে রচিত ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণ বা জাতি প্রথাকে ভেঙে ফেলবে। তার ফলে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী হিসাবে ব্রাহ্মণরা নির্ঘাৎ ইসালমের প্রসার রুখতে নিজেদের সমস্ত ভার প্রভাব প্রতিপত্তি কাজে লাগাতে চেয়ে থাকবে। তাছাড়া হিন্দুদের মনে পরিবর্তনের প্রতি সহজাত বিতৃষ্ণা পরোক্ষভাবে হলেও প্রবলভাবে ইসলামের জয়যাত্রায় বাধা দিয়ে থাকবে।.”(জোর প্রযুক্ত)

আমি একজন শিক্ষিত ঐতিহাসিকের অভিজাত ব্রিটিশ প্রকাশক দ্বারা প্রকাশিত একক বিষয়কেন্দ্রিক বইটির এই কথাগুলোর স্ববিরোধ, প্রচারসর্বস্বতা, ভান ও বিশুদ্ধ মিথ্যা সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে চাই না। আমি নিশ্চিত, পাঠকরা নিজেরাই উমেদারিত্বের মধ্যে লুকোনো নিছক বদমাশি দেখতে পাচ্ছে। যেটা আমি এই তিনটি উদ্ধৃতি দ্বারা ভারতের বঁড়শি, রেখা ও নিমজ্জকের তত্ত্ব গেলা সেকুলারিস্টদের মনোবৃত্তি দেখাতে চাই। এটা হল সেই মানসিকতা যা আমাদের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা বছরের পর বছর পরিচর্যা করেছে। আর আমি নিশ্চিত NCERT এটাকেই পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে বা করতে চলেছে।

ইসলামের অন্তর্নিহিত বিষ

বিষয়টা কী?

এর বীজ রোপিত হয়েছে কলেমা (Kalimah ) দ্বারা – কোথাও কোনও ভালো নেই একমাত্র আল্লা ছাড়া এবং মহম্মদই তার একমাত্র প্রেরিত পুরুষ।  এটা ধর্মীয় ধারণা নয় যার সত্যতা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা দ্বারা মিলিয়ে নেওয়া যায়, কিংবা কোনও যুক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা যায়। এটা বিশুদ্ধ রাজনৈতিক উচ্চারণ যা মানুষকে ‘মুমিন’ (mumins ) ও ‘কাফির’ (kafirs) এই দুই ভাগে বিভক্ত করে। ঠিক যেমন কমিউনিস্ট দ্বারা মানুষের বিভাজন হল ‘প্রগতিশীল’ (progressives) ও ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ (reactionaries); কিংবা নাৎসিরা বিভাজন করেছিল নিজেদের ‘উন্নত’ (superior) ও অন্যদের অনুন্নত (inferior) এই দুই জাতিতে, কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়াই।

এরপরে, কোরান মুমিনদেরকে আহ্বান জানিয়েছে – “যতক্ষণ অবিশ্বাসের চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া যায়, ততক্ষণ তাদের সাথে লড়াই করবে”,  অথবা “সত্য বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বাস প্রদর্শন না করা অব্দি অবিশ্বাসীদের সঙ্গে লড়াই করতে হবে, যতক্ষণ না তারা বিনয়ের সঙ্গে ‘জিজ়িয়া’ আদায় না দেয়”, কিংবা যেখানেই তাদের সন্ধান পাবেন, সেখানেই আপনাকে তাদের গলা কেটে ফেলতে হবে, অথবা আপনি মোটেই কোনও নবী নন যতক্ষণ না আপনি তাদের মধ্যে একটি মহান বধ্যভূমি প্রস্তুত করছেন।” এটেকেই ‘জিহাদ’ (পবিত্র যুদ্ধ হিসাবে মহিমান্বিত) বলা হয় যা কালেমা, নামাজ়, রোজা, হজ ও জাকাতের মতোই ইসলামের মূল তত্ত্ব।

যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করে না, আবার ‘জিজ়িয়া’ দিতেও রাজি হয় না, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদে যে নীতি প্রয়োগ করতে হবে, তা হাদিস ও চারজন ধর্মপ্রাণ খলিফা দ্বারা বর্ণিত। অস্ত্র বহন করতে সক্ষম কাফের পুরুষদের হত্যা করা উচিত; কাফের নারী ও শিশুদের দাসত্বের জন্য বন্দী করতে হবে; কাফেরদের অস্থাবর সম্পত্তি লুণ্ঠন করতে হবে; তাদের জমি বাজেয়াপ্ত করতে হবে; তাদের উপাসনা স্থান ধ্বংস করা হবে; তাদের পুরোহিত ও সন্ন্যাসীকে হত্যা করা হবে এবং তাদের ধর্মগ্রন্থ পুড়িয়ে দিতে হবে।

যারা জিজ়িয়া দিতে সম্মত হয় তাদের ‘জিম্মি’ রূপে বিবেচনা করে ইসলামিক দেশে বসবাস ও কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে নিম্নলিখিত শর্তে:

(১) তারা কোনও নতুন উপাসনালয় নির্মাণ করতে পারবে না; (২) মুসলমানদের ধ্বংস করে দেওয়া কোনও পুরাতন উপাসনালয়কে তারা মেরামত করতে পারবে না; (৩) তারা মুসলিম ভ্রমণকারীদের তাদের উপাসনাস্থলে থাকতে বাধা দিতে পারবে না; (৪) তাদের বাড়িতে থাকতে ইচ্ছুক যে কোনও মুসলমানকে কমপক্ষে তিন দিনের জন্য এবং সেই মুসলিম অসুস্থ হয়ে পড়লে অনির্দিষ্ট দীর্ঘকাল ধরে থাকতে দিতে হবে; (৫) তারা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতি কোন শত্রুতা পোষণ করতে পারবে না বা ইসলামের শত্রুদের কোনরকম সহায়তা ও সান্ত্বনা দিতে পারবে না; (৬) তারা তাদের কাউকেই ইসলাম গ্রহণে বাধা দেবে না; (৭) তাদেরকে প্রত্যেক মুসলমানের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে; (৮) তাদের মুসলমানদের তাদের ব্যক্তিগত সভায় অংশ নিতে দিতে হবে; (৯) তারা মুসলমানদের মতো পোশাক পরতে পারবে না; (১০) তারা নিজেদের মুসলিম নামও রাখতে পারবে না; (১১) তারা জিন ও লাগাম লাগিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে পারবে না; (১২) তারা অস্ত্র রাখবে না; (১৩) তারা তাদের আঙ্গুলে কোনও নামাঙ্কিত বা মোহরযুক্ত আংটি পরতে পারবে না। (১৪) তারা প্রকাশ্যে মদ্য বিক্রয় বা পান করতে পারবে না; (১৫) তাদেরকে একটি স্বতন্ত্র ও নিজেদের নিকৃষ্ট অবস্থান প্রদর্শক পোষাক পরতে হবে, যাতে করে তাদের মুসলিমদের তুলনায় পৃথক দেখায়; (১৬) তারা নিজেদের আচার সংস্কৃতি মুসলমানদের মধ্যে প্রচার করতে পারবে না; (১৭) তারা মুসলমানদের আশেপাশে প্রতিবেশে তাদের ঘর নির্মাণ করবে না; (১৮) তারা তাদের মৃতদেহ মুসলমানদের কবরস্থানের নিকটে নিয়ে আসবে না; (১৯) তারা প্রকাশ্যে তাদের ধর্মীয় অনুশীলন পালন করবে না বা তাদের মৃতদেহকে নিয়ে উচ্চস্বরে শোকও প্রদর্শন করতে পারবে না; এবং (২০) তারা মুসলিম দাসকে কখনই কিনবে না।

ইসলামের আইন তাদের মৃত্যুদণ্ডেরও বিধান দিয়েছে, যদি কেউ (১) একমাত্র সত্য ধর্ম হিসাবে ইসলামের একচেটিয়া দাবি ও শেষ নবী হিসাবে মুহাম্মাদ এই দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে; (২) ইসলাম গ্রহণের জন্য বাধ্য বা প্ররোচিত হওয়ার পরেও তাদের পূর্বপুরুষদের বিশ্বাসে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করে; এবং (৩) প্রথমে ইসলাম গ্রহণ না করেই মুসলিম মহিলাদের বিবাহ করে।

আইন আদালতে সাক্ষ্যদান, কর প্রদান বা আদায় এবং সরকারী দফতরে নিয়োগের ক্ষেত্রেও অমুসলিমদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হত। সংক্ষেপে বলতে গেলে, একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অবস্থান হল কাঠের ডুঙি করে জল তোলার মতো। তাদেরকে ইসলামের আওতায় আনার জন্য সম্ভাব্য সবরকম অপমান, অবমাননা ও চাপের মুখে রাখা হয়।

ইসলাম নিয়ে তর্ক অথবা মৃত্যু

যখন উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তখন উলেমারা একটি বিরাট বিতর্ক উত্থাপন করেন। ততদিনে ইসলামী আইনের ব্যাখ্যাকারীরা হানাফি, হানাবলি, মালেকী এবং শফী এই চারটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে হানাফি প্রতিষ্ঠানটিই শুধু হিন্দুদের জিম্মির মর্যাদায় উত্তীর্ণ করার পক্ষে ছিল। অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠান অনেক কট্টর। তারা জোর দেয়, হিন্দুদের কাছে দুটি মাত্র বিকল্প – হয় ইসলাম বরণ নয় মৃত্যু। ‘ফতোয়া-ই-জাহান্দরী’তে জ়িয়াউদ্দিন বারানি হানাফি ধারার বিরুদ্ধে মতামত ব্যক্ত করে লিখেছিলেন: “যদি মাহমুদা আরও একবার ভারতে যেতেন, তবে তিনি হিন্দুদের সমস্ত ব্রাহ্মণকে তলোয়ারের আওতায় নিয়ে আসতেন যারা ছিল এই বিশাল ছিল ভূমিখণ্ডে কাফের আইনের ধারাবাহিকতা ও মুশরিকদের শক্তির কারণ; তিনি দুই বা তিন লক্ষ হিন্দু সর্দারদের মাথা কেটে ফেলতেন। যতক্ষণ না গোটা হিন্দ ইসলাম গ্রহণ না করে ততক্ষণ তিনি তঁর হিন্দু-জবাইকারী তরোয়ালটিকে তার খাপে ফিরিয়ে রাখতেন না। কারণ মাহমুদ একজন শফীয় ছিলেন এবং ইমাম শাফিয়ির মতে হিন্দুদের জন্য হুকুমই হ’ল ইসলাম বা মৃত্যু, অর্থাৎ তাদের হয় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত বা ইসলাম গ্রহণ করানো উচিত। হিন্দু যাদের নবী বা নির্দিষ্ট প্রকাশিত গ্রন্থ নেই, তাদের কাছ থেকে জিজ়িয়া গ্রহণ করাও বৈধ নয়।

শেখ শিহাব-উদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিষ্য শেখ নূরউদ্দিন মুবারক গজনবি ছিলেন ১২৩৫-এ বাগদাদে মৃত চিশ্‌তিয়ার পর দ্বিতীয় সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ সফী ‘সিলসিলা’র (silsilã) প্রবর্তক । গজনবি এসে ভারতে বসতি স্থাপন করেছিলেন যেখানে তিনি ১২৩৩-৩৫ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। তিনি শামসুদ্দিন ইলতুতমিশের রাজত্বকালে (১২১০-১৩66 খ্রিস্টাব্দে) ‘শেখ আল-ইসলাম’ (Shykh-ul-Islãm ) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং ‘দিন পানাহি’ (Dîn Panãhî) মতবাদটির প্রচার করেছিলেন। তারিখ-ই-ফিরোজশাহী (Tãrîkh-i-Fîruzshãhî) গ্রন্থে বারানি এই মতবাদের প্রথম নীতিটি উদ্ধৃত করেছেন: “বাদশাহদের উচিত আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করা। এবং বাদশাহরা কখনই তাঁদের কর্তব্য সমাধা করতে পারবে না যতক্ষণ না, আল্লা ও নবীর জাতের জন্য কুফরা (kufr a)ও কাফির (kãfiri ) ও শির্কদের (খোদার সমতুল্য অংশীদারিত্ব মানা) এবং মূর্তিপুজো উত্খাত করে। তবে কুফরার ও কাফিদের বৃহৎ সংখ্যা ও দৃঢ় শিকড়ের জন্য যদি মূর্তি উপাসনা পুরোপুরি উপড়ে ফেলা না যায়, তাহলে বাদশার উচিত কুফরি ও মুশরিকদের যথাসাধ্য হেয় অপমান অসম্মান ও বদনাম করা, কারণ মূর্তি পূজারী হিন্দুরা হল আল্লাহ্‌র নিকৃষ্টতম শত্রু। রাজাদের ধর্মের রক্ষাকারী হওয়ার লক্ষণ হল: হিন্দু দেখলেই তাদের চোখ লাল হয়ে যাওয়া এবং তাকে জীবিত কবর দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করা; ব্রাহ্মণদের পুরোপুরি উপড়ে ফেলতে চাওয়া, যারা কুফর ও শিরকের নেতা এবং যাদের জন্য কুফর ও শির্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং কুফরের নির্দেশ কার্যকর হয়। ইসলাম রাজশক্তির ভয় ও সন্ত্রাসের কারণে, আল্লা ও নবীর একজন শত্রুও যেন মিষ্টি জল পান না করতে পারে, বা তার বিছানায় পা প্রসারিত করে শান্তিতে ঘুমাতে যেতে না পারে। (জোর প্রযুক্ত, আরও পড়ুন ঈশ্বর ও আল্লা)।

নিজ়ামুদ্দীন আউলিয়ার সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য আমির খুসরু যার ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের দ্বারা ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবর্তক হওয়ার কথা, তিনিও অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন। ভারতের সেকুলারিস্ট ঐতিহাসিক তাঁর ‘খাজ়াইন-উল-ফুতাহে (Khazãin-ul-Futûh ) যা তরিখ-ই-আলাই’ Tãrîkh-i-Alãî নামেও পরিচিত, সেই গ্রন্থে লিখেছেন: “আমাদের পবিত্র যোদ্ধাদের তরোয়াল দিয়ে পুরো দেশটা আগুনে কাঁটাঝোপপূর্ণ বনের মতো হয়ে উঠেছে। কাফিরত্বের (হিন্দুত্বের) বাষ্প একেবারে বিক্ষিপ্ত বির্যস্ত হয়ে উঠেছে। হিন্দুদের শক্তিশালী লোকেদের পায়ের নীচে মাড়িয়ে চলা হয়েছে, এবং সকলেই ইসলামকে সেলামি দিতে প্রস্তুত। ইসলাম বিজয়ী আর মূর্তিপূজা অবনত। যদি ‘হানিফা’র আইন জিজ়িয়া প্রদানের মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড থেকে রেহাই পাওয়ার ছাড় না দিত, তাহলে হিন্দুত্বের মূল এবং শাখার অস্তিত্বও নিভিয়ে দেওয়া যেত।”

মুসলিম বাদশাহরা অবশ্য এর চেয়ে ভাল জানতেন। তারা মোল্লা ও সুফিদের মতো মূর্খের স্বর্গে বাস করত না। ইসলামিক আইনকানুনের পক্ষে যা ঘাতক সেই অবসর বিনোদন ও বিলাসবহুলতার মধ্যে কাটিয়েও ইসলামের সেনাবাহিনী দ্বারা সুরক্ষিত শহরগুলিতে আরামে বেঁচে থাকত। তারা খুব ভালভাবে তাদের ধর্ম সম্পর্কে সৌন্দর্যের গরম বাতাস বইয়ে দিতে পারত। অন্যদিকে মুসলিম সম্রাটদের বেশিরভাগকেই যুদ্ধের ময়দানে বেঁচে থাকতে হত, যাদের শক্তির সমীকরণকে সহজে বুঝে হিন্দুদের দাবিয়ে রাখার জন্য লাগাতার হিন্দু প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার পুনরুত্থানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হত। তারা খুব শীঘ্রই আবিষ্কার করেছিল, যে হিন্দুরা ইসলামকে কালো বর্বর ব্যবস্থা হিসাবে ঘৃণা করে এবং এই অপরাধী ধর্মের বশবর্তী হওয়ার পরিবর্তে লড়াই করে যাবে। তদুপরি তাদের এমন কাজ করার জন্য হিন্দুদের প্রয়োজন ছিল যা মোল্লা বা সুফি বা ইসলামের তরোয়ালবাজদের দ্বারা সম্ভব ছিল না বা তেমন ঝোঁক ছিল না। যেমন কৃষিকাজ, বাণিজ্য, শিল্প, হিসাব রক্ষণ, সাফাইকর্ম ইত্যাদি। তাই এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, মুসলিম রাজতন্ত্রের সামনে হানাফি মতবাদ উত্থাপিত হতেই তারা এর পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে। এই চিন্তাধারা যে তাদের খুব পছন্দ ছিল তা নয়। কিন্তু কারণটা ছিল এ ছাড়া তাদের কাছে বিকল্প কোনও পছন্দ খোলা ছিল না। তারা হিন্দুদেরকে জিম্মি হিসাবে স্বীকৃতি দেয়, তাদের ওপর জিজ়িয়া করসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা চাপিয়ে দেয় এবং যেখানেই পারে সেখানে পেরেছে কাঠুরে থেকে জল বাহক ভারীর পেশায় ঠেলে দিয়েছে।

মোল্লা ও সুফিরা এই অসম্পূর্ণতায় হু হু করে কেঁদে উঠল। বারানি শোক প্রকাশ করে বলেছেন: “সুলতান কি মাত্র কয়েক টাকার বিনিময়ে কাফিরদের সমস্ত কাফিরি উপাচার, সম্ভাব্য জীবনযাত্রা, তাদের বিভ্রান্তিমূলক সাহিত্য পাঠের অনুমতি, আর নিজেদের ধর্মশিক্ষা বিস্তার ও কাফেরি ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দিয়ে দেবেন? তাহলে কী করে সত্য ধর্ম অন্যান্য ধর্মগুলোর মাথার ওপর থাকবে এবং তার চিহ্ন সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করবে? যদি শাসকরা কাফেরদের তাদের মন্দিরগুলো রাখতে অনুমতি দেয়, তাদের মূর্তিগুলি সজ্জিত রাখতে দেয় এবং তাদের উত্সবগুলিতে ঢোল পিটিয়ে নাচ গান করে আনন্দ করতে দেয়, তাহলে কীভাবে ‘বিশ্বাস’ প্রতিষ্ঠিত ও বিরাজমান হবে?”

হিন্দু সমাজের অবস্থা

কিন্তু ঐ অবস্থায় যেসব মুসলিম রাজারা ইসলামের যথাসাধ্য সেবা করার চেষ্টা করেছিল, বারানি ও তার মতো লোকেরা  তাদের প্রতি সুবিচার করেননি। যেসব জায়গায় মুসলিম শাসন কায়েম হয়েছিল, সেইসব জায়গায় হিন্দু সমাজের অবস্থা খুব সুন্দর মায়াবী ছবি এঁকেছিলেন। অবশ্যই হিন্দুরা তাদের মাতৃভূমির সেই অংশগুলিতে হেসে খেলেই বেড়াত, যে অংশগুলিতে তাদের হিন্দু রাজারা স্বাধীনতা বজায় রেখেছিল বা ফিরে পেয়েছিল। তবে মুসলিম রাজাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলিতে হিন্দুরা সর্বদা নীচ মুসলমানের অনুগ্রহের বশবর্তী বোবা গবাদি পশুতে পরিণত হয়েছিল। বারানি নিজে লিখেছেন: “সুলতান আলাউদ্দিন (খলজি) বিদ্বান পুরুষদের কাছে বিধি-বিধানের দাবি করেছিলেন যাতে হিন্দুরা মাটিতে মিশিয়ে যায়, আর তাদের হতাশা ও বিদ্রোহের কারণ হতে পারে যে সম্পত্তি ও অধিকার, তা যেন আর তাদের ঘরে তাদের আওতায় না থাকে।” এইরকম একজন বিদ্বান ছিলেন কাজ়ি মুগিসউদ্দিন। তিনি অত্যন্ত কদাকার কঠোর পদক্ষেপের পক্ষে ছিলেন এবং পরামর্শ দিয়েছিলেন: “রাজস্ব আদায়কারী যদি কোনও হিন্দুর মুখে থুথু দেয়, তবে সেই হিন্দু বিনা দ্বিধায় তা গ্রহণ করার জন্য মুখ খুলবে।”

আলাউদ্দিন খলজি মোট জমির আয়ের অর্ধেক পর্যন্ত জমির রাজস্ব বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনি সমস্ত দুগ্ধবতী পশুর উপর একটি চারণ কর এবং একটি গৃহ-কর আরোপ করেছিলেন। বারানি নিজেই বলেছেন: “জনগণকে এমন আজ্ঞাবহ অবস্থায় আনা হয়েছিল যে একজন রাজস্ব আধিকারিক বারো খুট, মুকাদ্দাম ও চৌদ্দারিকে (সবাই হিন্দু) এক সাথে ঘাড়ে বেঁধে রীতিমত আঘাতের মাধ্যমে অর্থ আদায় করা হত।” হিন্দুরা এতটাই দরিদ্র ছিল যে তাদের স্ত্রীদের মুসলিম বাড়িতে দাসী হিসাবে কাজ করতে হত। এরপরে ছিল আলাউদ্দিনের বাজার সংক্রান্ত নিয়মকানুন যা আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের দ্বারা এবং অল ইন্ডিয়া রেডিওতে “ভারতের ইতিহাসে সমাজতন্ত্রের প্রথম পরীক্ষা” হিসাবে প্রশংসিত হয়েছে। কৃষকদের মধ্যে যারা হিন্দু ছিল, তাদের শস্য ব্যবসায়ীদের কাছে নির্বিচারে নির্ধারিত দামে বিক্রয় করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। রাজ্যের হিন্দু বণিকরাও সেই শস্য আবারও নির্বিচারে নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে বাধ্য হত, যার ফলে লাভ বলে কিছুই থাকত না বা নিতান্ত নগণ্য অংশ লাভ থাকত। রাষ্ট্রীয় গুদামগুলিতে এত শস্য জমা ছিল যে আলাউদ্দিনের মৃত্যুর ১৮ বছর পরে ইবনে বতুতাহ দিল্লী সফর করার সময়ও আলাউদ্দিনের রাজত্বকালে যে চাল পাওয়া যেত তা খেয়েছিলেন। হিন্দু বণিকদের যে জায়গাগুলির মূল্য নির্ধারণ হয়নি, সেখানে থেকেও সমস্ত ধরণের পণ্য সংগ্রহ করতে হত। কিন্তু তারা যে নগণ্য দামে রাজ্যে বিক্রি করতে বাধ্য হত, তার সঙ্গে ক্রয়মূল্যের কোনও সঙ্গতিই থাকত না। আর বণিকদের স্ত্রী ও শিশুদের রাজধানীতে জিম্মি বা পণবন্দী করে রাখা হত, যাতে তারা নিয়মিত নিশ্চিত পণ্যসামগ্রী সরবরাহ করতে বাধ্য হয়। এটা ছিল সাদামাটা ভাষায় বাজেয়াপ্তকরণ, এমন এক শর্ত যেখান থেকে মৃত্যু ছাড়া মুক্তির উপায় ছিল না হিন্দুদের।

গিয়াসুদদ্দীন তুঘলক একটা অধ্যাদেশ জারি করেন যার দাবি ছিল, “হিন্দুদের হাতে শুধু সেইটুকু সম্পদ রাখতে হবে যাতে তারা একদিকে যাতে তারা ধনসম্পদের কারণে মাতাল না হয়ে পড়ে, অন্যদিকে জমি হারিয়ে চাষাবাদ করতে না পেরে নিরাশ্রয় হয়ে হতাশায় ডুবে যায়।” তাঁর পুত্র মুহাম্মদ বিন তুঘলক অত্যন্ত খাড়া ভাবে জমির আয় বৃদ্ধি করেছিলেন। বারানি প্রতিবেদন দিয়েছেন: “দোয়াবে কর বৃদ্ধি করা হয়েছে দশ থেকে বিশ গুণ, কঠোরভাবে রাজস্ব আদায় করত গিয়ে এমন ‘আব্বাব’ বা আইন প্রণয়ণ করেছিলেন যার ফলস্বরূপ রাজার আধিকারিকরা এতটা নিষ্ঠুরভাবে কর সংগ্রহ করত, যে উর্বর জমির চাষীরাও হতাশা দারিদ্র্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। এমনকি তারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে  সুলতান বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের বন্য পশুর মতো তাদের শিকার করতেন। ইবন বতুতা যিনি মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে দিল্লী সফর করেছিলেন, তাঁর ‘রেহলা’য় সুলতানের প্রাসাদে একটি ঈদ উদযাপনের প্রতিবেদনে লেখেন: “তারপর প্রবেশ করল সুরকারগণ, প্রথম পর্বে সেই বছর যুদ্ধে বন্দী কাফের রাজাদের কন্যা। তারা গান গায় ও নাচে, তারপর সুলতান তাদেরকে নিজের আমীর এবং আজ্জাতদের দিয়ে দেন। তারপরে কাফেরদের অন্য কন্যারা এসে গান করে, নাচে ও অতঃপর সুলতান তাদেরকে তাঁর আত্মীয়, ভগ্নিপতি এবং মালিকের ছেলেদের হাতে তুলে দেন। কিছুদিন পরে সেখানে কিছু কাফের মহিলা বন্দী দিল্লীতে পৌঁছোয়, যাদের মধ্যে দশজনকে উজির আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়। আবার সুলতান চীনের সম্রাটের কাছে ভারতীয় কাফেরদের মধ্যে থেকে একশো পুরুষ দাস এবং একশত দাস গীতিকার বা গায়িকা ও নর্তকীকে উপহার দেন।” তিনি আরও জানিয়েছেন, “আলাপুরের মুসলিম সেনাপতি কাফেরদের ওপরে আছড়ে পড়ে তাদের মেরে ফেলত বা বন্দী করে নিত। এই নরাধমকে একদিন হিন্দুরা হত্যা করে। কিন্তু তার দাসেরা আলাপুরের ওপরে আছড়ে পড়ে পুরুষ জনগোষ্ঠীকে তরোয়াল দিয়ে কেটে ফেলে ও মহিলাদের বন্দী করে নিয়ে যায় এবং সেখানকার সমস্ত কিছু দখল করে নেয়।”

ফিরোজ় শাহ তুঘলাক দাসদের শিকার নিয়ে একটি শিল্পোদ্যগের আয়োজন করেছিলেন। শামস-ই-সিরাজ আফিফ তাঁর ‘তারিক-ই-ফারোজ় শাহ’-তে লিখেছেন: “সুলতান তার মহান চোর-ধারক, জায়গিরদার ও আধিকারিকদের যুদ্ধের সময় দাসদের ধরার (অর্থাৎ হিন্দু বিদ্রোহ দমন করার) আদেশ দিয়েছিলেন, এবং তাদের মধ্যে সেরাগুলোকে বাছাই করে দরবারের খিদমতে পাঠাতে বলেছিলেন। প্রধান ও আধিকারিকরা স্বভাবতই যথাসাধ্য অধিক সংখ্যক দাস সংগ্রহের জন্য প্ররোচিত হয়েছিল, আর এভাবেই অধিকাংশ দাস সংগৃহীত। যখন তাদের সংখ্যাধিক্য দেখা দেয়, সুলতান তাদের গুরুত্বপূর্ণ শহর ও জায়গিরগুলিতে প্রেরণ করেন। অনুমান করা হয় যে, এই শহরে ও বিভিন্ন জায়গিরগুলিতে ১,৮০,০০০ দাস ছিল। দাস সংক্রান্ত বিষয় পরিচালনা করার জন্য সুলতান পৃথক বিভাগই তৈরি করেছিলেন।”

হিন্দুদের সাথে তার আচরণের ব্যাপারে ফিরোজ় শাহ পূর্বেরকার সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নিজেই তাঁর ‘ফুতুহত-ই-ফিরোজ় শাহী’ গ্রন্থে লিখেছেন: “হিন্দু ও মূর্তি পূজারীরা সহনশীলতার জন্য অর্থ (জ়ার-ই-জ়িম্মিয়া) দিতে সম্মত হয়েছিল এবং এর বদলে তারা মাথাপিছু কর (জিজ়িয়া) দিতে কাছে সম্মতি জানিয়েছিল যাতে তাদের পরিবারগুলি সুরক্ষিত থাকে। এই মানুষগুলো নগরে নবীর বিধানের বিপরীতে নতুন প্রতিমার মন্দির নির্মাণ করেছিল যা থেকে বোঝা যায় এই ধরনের মন্দিরগুলি সহ্য করা অনুচিত। ঐশ্বরিক নির্দেশনায় আমি এই সৌধগুলি ধ্বংস করে দিয়েছি এবং সেই কুফরীবাদী নেতাদের হত্যা করেছি যারা অন্যদের ভুল পথে চালিত করছিল; এবং নীচের আদেশগুলিতে আমি শাস্তিস্বরূপ জরিমানার ব্যবস্থা করি যতদিন না এই অপচর্চা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়। নীচে একটি উদাহরণ দেওয়া হল। মালুহ গ্রামে একটি পুকুর রয়েছে যাকে তারা ‘কুন্ড’ নামে ডাকে। এখানে তারা প্রতিমাবিশিষ্ট মন্দির তৈরি করেছিল এবং নির্দিষ্ট দিনগুলিতে হিন্দুরা ঘোড়ার পিঠে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সেখানে যেতে অভ্যস্ত ছিল। তাদের মহিলা ও শিশুরাও পাল্কি ও শকটে করে বের হত। সেখানে কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়ে প্রতিমা-পূজা করত। অপচর্চা এতটাই নজরআন্দাজ ও অগ্রাহ্য করা হয়েছিল, যে বাজারের লোকেরা সেখানে বিভিন্ন ধরণের বিধান রেখে পাসার বসিয়ে নিজেদের জিনিসপত্র বিক্রি করছিল। যখনই এই বিষয়টি চর মারফত আমার কানে এলো, তখন আমার ধর্মীয় চেতনা আমাকে তত্ক্ষণাত এই কেলেঙ্কারি ও ইসলামের বিরুদ্ধে অপরাধ বন্ধ করার জন্য প্রাণিত করল। সমবেত হওয়ার দিন আমি সেখানে ব্যক্তিগতভাবে গিয়েছিলাম এবং আমি আদেশ দিয়েছিলাম, যে এই লোকদের নেতাদের ও সেই ঘৃণিত প্রচারকদের হত্যা করা উচিত। আমি তাদের প্রতিমা মন্দিরগুলি ধ্বংস করে দিয়েছি এবং তার পরিবর্তে মসজিদগুলি উত্থাপিত করেছি।”

হিন্দুরা মন্দির তৈরি করলেই প্রাসাদের ফটকের সামনে তাদের নৃশংস হত্যার এবং তাদের ছবি মূর্তি ও উপাসনার পাত্রগুলো জনসমক্ষে পুড়িয়ে ফেলার একটা নজিরও গড়েছিলেন ফিরোজ শাহ। তাঁর মতে এটি সমস্ত পুরুষদের জন্য একটি সতর্কতা ছিল, যে কোনও জিম্মি কোনও মুসুলমান দেশে এ জাতীয় দুষ্ট অনাচার করতে পারে না। আফিফ আরও একটি ঘটনার কথা জানিয়েছেন, “যেখানে দিল্লীর এক ব্রাহ্মণ প্রকাশ্যে মূর্তিপুজো করছিল এবং মহম্মদীয় মহিলাদের কাফের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছিল।” সেই ব্রাহ্মণের হাত-পা বেঁধে জ্বলন্ত কাঠের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এই ঘটনার সাক্ষী যে ঐতিহাসিক তিনি নিজেই এই দৃশ্যে সন্তুষ্টি ব্যক্ত করে বলেছেন: “সুলতানের আইন ও নিয়মকানুন কঠোরভাবে মেনে চলুন, কারণ তিনি তার হুকুমনামা থেকে সামান্যতম বিচ্যুত হবেন না।”

ফিরোজ শাহ তুঘলকের তুলনায় সিকান্দার লোদির সাম্রাজ্য ছিল অনেক ছোট। কিন্তু তিনিও কম উদ্দীপনা নিয়ে ইসলামের আইন কার্যকর করেননি। আবদুল্লা তাঁর রাজত্বকালের একটি সাধারণ ঘটনা তাঁর ‘তারিখ-ই-দাউদী’তে লিপিবদ্ধ করেছেন: “এটি আকবর শাহীতে বর্ণিত আছে, যে বোধন নামে একজন ব্রাহ্মণ মুসুলমানদের উপস্থিতিতে একদিন এসে বলেছিলেন, ইসলাম যেমন সত্য, তাঁর নিজের ধর্মও তেমনই সত্য। তাঁর এই বক্তব্য বিদেশে প্রচারিত হয়েছিল। সেই জেলার শাসক উলেমা আজম হুমায়ূনের কানে যেতে ব্রাহ্মণকে সবলে রাজার সামনে প্রেরণ করে। সুলতান সিকান্দার প্রতি ত্রৈমাসিকে সমস্ত জ্ঞানী লোককে সমবেত করতেন। বিষয়টি তদন্ত করার পরে উলেমারা স্থির করেছিল, যে তাকে কারাগারে বন্দী করে ইসলামে গ্রহণ করানো উচিত, অথবা মৃত্যুদণ্ড ভোগ করানো উচিত। যেহেতু সেই ব্রাহ্মণ ধর্মত্যাগ করতে অস্বীকার করেন, তাকে উলেমাদের রায় অনুসারে হত্যা করা হয়েছিল। সুলতান জ্ঞানী কুতার্কিকদের পুরস্কৃত করার পরে তাদের যাওয়ার অনুমতি দেন।

ইসলামিক আইন বলতে হিন্দদের জন্য যা ছিল, তার হিন্দুদের দ্বারা লিখিত নথি খুব কম এবং সেগুলোও অনেক সময়ের ব্যবধানে। তবে যখনই পাওয়া গেছে, সেগুলো মধ্যযুগীয় মুসলিম ঐতিহাসিকদেরই বর্ণানর সত্যতা নিশ্চিত করে। বিজয়নগরের কুমার কাম্পানার স্ত্রী গঙ্গাদেবী (মৃত্যু: ১৩৭৪ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর ‘মধুরবিজয়ম’ গ্রন্থে মুসলমানদের শাসনামলে মাদুরাই অঞ্চলের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিম্নরূপ বর্ণা দিয়েছেন: “দুষ্ট ম্লেচ্ছরা প্রতিদিন হিন্দুদের ধর্মকে কলুষিত করে। তারা দেবতার মূর্তিগুলিকে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেয় এবং পূজার উপকরণ ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তারা ‘শ্রীমদ ভগবত’ ও অন্যান্য পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলিকে আগুনে ফেলে দেয়, জোর করে ব্রাহ্মণদের শঙ্খচূড়া এবং ঘণ্টা নিয়ে যায় এবং তাদের দেহে রসকলি বা চন্দন চাটে। তারা তুলসী গাছে কুকুরের মতো প্রস্রাব করে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দু মন্দিরে মলত্যাগ করে। পুজোয় নিযুক্ত হিন্দুদের ওপরে তারা তাদের মুখ থেকে বার করে উচ্ছিষ্ট জল ফেলে দেয় এবং হিন্দু সাধুদের এমন হয়রান করে, দেখে মনে হয় যেন তারা এত উন্মাদ হয়ে গেছে।”

মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের মহান বৈষ্ণব সাধকের জীবনী ‘চৈতন্য-মঙ্গল’ ১৪৮৪ খ্রিস্টাব্দে সাধুর জন্মের প্রাক্কালে নবদ্বীপে হিন্দুদের দুর্দশা উপস্থাপন করেছে। লেখক জয়ানন্দ লিখেছেন: “রাজা ব্রাহ্মণদের ধরে ফেলেন, তাদের জাতকে কলুষিত করেন এবং এমনকি তাদের প্রাণও নেন। যদি কোনও বাড়িতে শঙ্খ বাজানোর শব্দ শোনা যায়, তবে তার মালিক নিজের সম্পদ, বর্ণ এমনকি জীবন হারাতে বাধ্য হয়। যারা তাদের কাঁধে উপবীত ধারণ করেন ও কপালে তিলক আঁকেন, রাজা তাদের বাড়িঘর লুঠ করে তাদেরকে বেঁধে ফেলেন। তিনি মন্দিরগুলি ভেঙে তুলসী গাছগুলো উপড়ে ফেলেন। গঙ্গায় স্নান নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং শত শত পবিত্র অশ্বত্থ ও কাঁঠাল গাছ কেটে ফেলা হয়।”

বিজয়া গুপ্ত বাংলার হোসেন শাহের প্রশস্তি করে একটি কবিতা লিখেছিলেন (১৪৯৩-১৯১৯ খ্রি।)। হাসান ও হুসেন নামে দুই কাজ়ী ভাই এই কবিতায় প্রতিনিধিস্থানীয় দুটি ইসলামিক চরিত্র। তারা আদেশ জারি করেছিল, যে যার মাথায় তুলসী পাতা রয়েছে লোকমদেখলেই তাকে হাত পা বেঁধে তাদের সামনে হাজির করতে হবে; তারপর তাকে মারধর করা হবে। কাজীদের দ্বারা নিযুক্ত প্রেরিতরা ব্রাহ্মণদের পবিত্র সুতো ছিঁড়ে ফেলে এবং তাদের মুখে লালা থুথু দেয়। একদিন এক মোল্লা মনসাদেবীর উপাসনা ও স্তবগানরত কিছু হিন্দু ছেলের প্রতি এই কাজ়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কাজ়ীরা বন্য হয়ে চিৎকার করে উঠল: “কী! আমাদের গ্রামে হিন্দু আচার অনুষ্ঠান করছে, হারামজাদা হিন্দুদের এত সাহস! দোষী ছেলেদের ধরে নিয়ে এসে মুসলমানদের খাবার খেতে বাধ্য করে জাতিচ্যুত করতে হবে।” এই কাজ়ীদের মা ছিলেন এক হিন্দু মহিলা, যাকে তাদের বাবার সাথে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি তাদের থামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা হিন্দু ছেলেদের বাড়িঘর ভেঙে ফেলে, পবিত্র কলসগুলি ভেঙে ফেলে দেয় এবং পূজার উপাচার সামগ্রীও ফেলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ছেলেদের প্রাণ বাঁচাতে পালাতে হয়েছিল।”

১২০৬ খ্রিস্টাব্দে কুতুবুদ্দিন আইবক দিল্লীতে তাঁর প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতের সেই অঞ্চলে মুসলিম রাজাদের দ্বারা শাসিত ছিল। রবি অবধি পাঞ্জাব এবং সমগ্র সিন্ধু মাহমুদ গজনবির আমলে মুসলিম শাসনে চলে গিয়েছিল। কাশ্মীরের একই পরিণতি দেখা দিয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। যে রাষ্ট্র ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় হিন্দুদের সাথে এইরকম ঘৃণ্য আচরণ করেছিল, তা যদি ধর্মতত্ত্ব অথবা ধর্মীয় স্বৈরতন্ত্র বা ধর্ম নিয়ন্ত্রিত শাসন না হয়ে থাকে, তাহলে এনসিইআরটি বিশেষজ্ঞদের ‘theocracy’ ধারণাটিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। এখনও অবধি সাধারণ আলোচনাতে ‘theocracy’ বা ধর্মতত্ত্ব বলতে রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর একক ধর্মের আধিপত্য এবং যারা এই ধর্মের সদস্য নয় তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য বোঝায়। আমাদের জাতীয় সংহতি ও শিক্ষার সভাপতিত্ব করা বা ঠিকা নেওয়া এম নাজ়িম এবং হিন্দু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের মতো জঘন্য ব্যক্তিরা মুসলিম রাজতন্ত্র দ্বারা গৃহীত বিশুদ্ধ ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পদলক্ষেপগুলোকে নিছক রাজনৈতিক বলে চালাতে চায়। তবে সেক্ষেত্রে রাজনীতি ও ধর্মের সাধারণ পার্থক্য গুলিয়ে যায়, তারা সমার্থক হয়ে যায়, যেমন অর্থ করা একমাত্র হীন বজ্জাত সেকুলারিস্টদের পক্ষেই সম্ভব।

আকবর সম্পর্কে রচিত কিংবদন্তী

এটি কৌতূহলপূর্ণ হলেও সত্য, যে ঐতিহাসিকরা প্রাক-আকবরকালের মুসলিম শাসনকে হিন্দুদের জন্য দুঃস্বপ্ন বলে স্বীকার করতে চাননি, তাঁরাই আকবরকে সেই হিন্দুদের জন্যই ভোরের ঝলমলে আলো বলে অভিহিত করেছেন। তারা দেখান আকবর কীভাবে তীর্থযাত্রী কর এবং জিজ়িয়া কর বাতিল করে দিয়েছিলেন, তিনি হিন্দুদের কত উচ্চ পদে নিযুক্ত করেছিলেন, কীভাবে হিন্দুদের জন্য হেন করেছিলেন তেন করেছিলেন ইত্যাদি, যা তারা আগে উপভোগ করেনি। এই মহামান্যদের খুব সহজেই প্রশ্ন করা যায়, যদি সেইসব বৈষম্যমূলক কর ও প্রতিবন্ধকতা আগে না থাকত, তাহলে আপনাদের আকবর সেসব থেকে হিন্দুদের মুক্ত করলেন কী করে? এই একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গিয়ে এক গোছা চতুর ভূয়ো যুক্তির অবতারণা করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।

এমন হিন্দু ঐতিহাসিকের অভাব নেই যারা আকবরকে বাছা বাছা প্রশস্তি দিয়ে ভূষিত করেন। আশীর্বাদী লাল শ্রীবাস্তব এর একটি আদর্শ উদাহরণ। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু আরও অনেক বেশি এগিয়ে গিয়ে আকবরকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। এই সমস্ত বড় বড় মিষ্টি গল্পগুলোর মধ্যে কিঞ্চিত লবণের সন্ধান পাবে, এমন হিন্দুই বরং এখন বিরল।

অন্যদিকে, বেশিরভাগ মুসলিম ঐতিহাসিক এবং ধর্মতত্ত্ববিদরা ভারতে ইসলামের ইতিহাসে আকবরকে অভিহিত করেছিলেন খলনায়ক হিসাবে। ইশতিয়াক হুসেন কুরেশি যিনি বিশ্বাস করেন, যে হিন্দুরা তাদের নিজস্ব রাজকুমারদের চেয়ে মুসলিম শাসনের অধীনে অনেক বেশি সুখী ছিল, তিনি কিন্তু আকবরকে দোষারোপ করেন, আকবর মুসলিম রাজনীতির মূলগত নীতি কলুষিত করে ইসলামের শান্তিভঙ্গ করেছিলেন। মওলানা আবুল কালাম আজ়াদ লিখেছেন, যে আহমদ সিরহিন্দী যদি উদ্ধার না হত, তাহলে আকবর ভারতে ইসলাম প্রায় শেষ করে এনেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতেই কিছু মুসলিম ঐতিহাসিক আকবরকে এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবর্তক হিসাবে উপস্থাপনা করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। তবে আমরা জানি মুসলমানদের মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ কী, বিশেষত যদি সেই মুসলমান মার্ক্সবাদীও হয়ে থাকে। তাদের কাছে আকবর হিন্দুদের ভোগ করার জন্য মুসলিম নায়ক ছাড়া আর কিছুই নন।

আকবরের সত্যতা জানতে একজনকে তাই মূল উত্সগুলিতে যেতে হবে। এই উত্সগুলি যে গল্পটি বলেছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া যেতে পারে:

১. আকবরের ভারতীয়ত্ব বলতে কিছুই ছিল না শুধু এই কতিপয় বিষয় ছাড়া – তিনি ভারতে তাঁর জীবনযাপন করেছিলেন, ভারতে যুদ্ধ করেছিলেন, ভারতে তাঁর সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন এবং বহু ভারতীয় মহিলাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের হারেমে। তিনি ভারতের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য, ভারতের ইতিহাস বা ভারতবর্ষের সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না, নিতান্ত জাগতিক ধান্দায় তাঁর দরবারে আসা কিছু স্থানীয় আঞ্চলিক চাটুকারদের কাছ থেকে যেটুকু শুনেছিলেন সেটুকু ছাড়া। তাঁর নুন খাওয়া কোনও বিদগ্ধ হিন্দু সাধু বা পণ্ডিত তাকে প্রকৃত ভারতীয় বিষয়গুলো শেখাতে বা সেগুলোর সঙ্গে পরিচিত করাতে পারেননি। তাঁর কাছে এসেছিলেন কেবল কিছু জৈন মুনি। তবে জৈন মুনিরা সর্বদা খ্রিস্টান মিশনারীদের মতো রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার সন্ধানে থাকতেন। অধিকন্তু আকবর এই মুনিদের কিছু রাজপুত রাজকুমারকে প্রভাবিত করার জন্য ব্যবহার করেছিলেন, যারা অন্যথায় বিদ্রোহী বা পুনরুত্থানকারী হয়ে থাকতেন।

২. আকবর নিজের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে একজন বহিরাগত ইসলামিক দস্যু ছিলেন, যিনি মূলত মধ্য এশিয়া এবং পার্সিয়া থেকে আমদানিকৃত মুসলিম তরবারির শক্তি দ্বারা ভারতের একটি বিশাল অংশ জয় করেছিলেন। নিজেকে তৈমুর ও বাবরের বংশধর বলে ঘোষণা করে তিনি রীতিমতো গর্ব করতেন এবং ট্রান্সজ়োকিয়ায়ানায় তাঁর পূর্বপুরুষদের জন্মভূমি পুনরুদ্ধার করতে উদগ্রীব ছিলেন। তিনি তাঁর রাজত্বের শুরুতেই অর্ধ-মৃত হিমুর শিরশ্ছেদ করে নিজের নামটি ইসলামী সম্মানসূচক ‘গাজ়ী’ উপাধিতে ভূষিত করে তোলেন। তিনি একমাত্র প্রতিরোধী হিন্দু রাজ্য মেওয়ার এবং গন্ডওয়ানার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধগুলি চালিয়েছিলেন, তার মধ্যে ধ্রূপদী জেহাদের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি যখনই কোনও আনন্দময় অনুষ্ঠান উদযাপন করতে চাইতেন বা কোনও মহান উদ্যোগের জন্য দোয়া চাইতেন, যেটা তাঁকে প্রায়ই করতে হত, তখনই হিন্দু সমাজ ও হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে ইসলামের নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধের সর্বোচ্চ প্রতীক মইনুদ্দিন চিশতীর দরগায় তীর্থ করতে যেতেন। তিনি মক্কা ও মদীনা সহ মুসলিম তীর্থযাত্রার অনেক কেন্দ্রে সমৃদ্ধ উপহার প্রেরণ করেছিলেন এবং পর্তুগীজ়দের সাথে আলোচনা চালিয়েছিলেন যাতে মুসলিম তীর্থযাত্রীদের ভ্রমণ সহজতর হয়। মক্কার শরীফদের এবং বুখারার উজবেক রাজার প্রতি তাঁর চিঠিতে তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন, যে তিনি শুধু একজন ভাল মুসলিমই নন, তিনি ইসলামের একজন কুশলীও যাঁর সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা গোঁড়া উলেমারা তাঁর ভারতে টেঁকসই ইসলামিক সাম্রাজ্যের একাছত্রাধিপত্য স্থাপনের খেলাটি বুঝতেই পারেননি।

৩. আকবর হিন্দুদের যে ছাড় দিয়েছিলেন তা হিন্দু বা হিন্দুধর্মের প্রতি তাঁর কোন মহানুভবতার দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল না। তিনি মুসলিম সাম্রাজ্য নির্মাতাদের দুই সাধারণ বিদ্বেষী শত্রু – মুসলিম সর্দার এবং কট্টর উলেমার সঙ্গে তাঁর সংঘাতে হিন্দুদের সমর্থন অর্জন করতে সফল হয়েছিলেন। আলাউদ্দিন খলজি ও মুহাম্মদ বিন তুঘলকও এর আগে এই একই শত্রুদের মুখোমুখি হয়েছিল, কিন্তু তাদের তারা পরাস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিল, কারণ তারা ভারতে বিদেশী মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বদ্ধ বৃত্তটি ভেঙে ফেলতে পারেনি। আকবর উভয় শত্রুদের মেরামত করতে সক্ষম হন, কারণ তিনি একটি নতুন পদ্ধতি প্রয়োগের চেষ্টা করেন এবং খুব শীঘ্রই আবিষ্কার করেন এটি বেশ কার্যকর। তিনি রাজপুত রাজকুমার ও তাদের অনুচরবর্গদের সহায়তায় মুসলিম সর্দারদের আটকে রাখলেন। তিনি উলেমাদের আংশিকভাবে ইবাদাত খানায় একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে, এবং কিছুটা যোগী ও জৈন মুনি ও খ্রিস্টান মিশনারীদের নিয়ে আদিখ্যেতা করে তাদের ভয় দেখিয়ে কায়দা করে দমিয়ে রেখেছিলেন। তাদের রাজানুগ্রহ ছাড়া অর্জনের কিছুই ছিল না। প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মের কিছু মুখপাত্রের সাথে আকবরের সংযোগ যে তাঁর পক্ষ থেকে আন্তরিক অনুসন্ধান দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল, বা সেই সম্মেলন দ্বারা তাঁর মনের কোনও উন্নতি হয়েছিল, এমন কোনও প্রমাণ নেই। তিনি তাঁর জীবনের শেষ অবধি ইসলামী চিন্তাধারাতেই বন্দী ছিলেন।

৪. হিন্দু সমর্থনের জন্য তাঁকে বিশেষ মূল্য দিতে হয়নি। ভাগ্যক্রমে তিনি এমন সময়ে কাজ শুরু করেছিলেন, যখন ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের প্রতি হিন্দুদের প্রতিরোধ মেওয়ার ও গন্ডওয়ানার মতো ছোট ছোট অঞ্চল বাদে অন্য কোথাও তেমন ছিল না। রাজপুত রাজপুত্ররা এতদিন হিন্দু প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলিম সামন্তদের সাথে ক্রমাগত বহু যুদ্ধ লড়ে তাদের জনবলের পাশাপাশি বৈষয়িক সংস্থানও শেষ হয়ে এসেছিল। আকবর খুব তাড়াতাড়ি আবিষ্কার করেন, যে তিনি কয়েকটি সৌজন্যের বিনিময়ে রাজপুতদের সহায়তা কিনতে পারবেন, যা তৎকালীন গোঁড়া ইসলামের পক্ষে সম্ভবত দুর্ভাগ্যজনক মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে নিছক ওপরকার ভড়ং প্রমাণিত হয়েছিল। আসলে এগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করলে বোঝা যায়, সেই সময় আকবরের ঐসব সৌজন্যের বিনিময়ে হিন্দুদের কতটা কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিল। তিনি তাঁর হারেমের জন্য হিন্দু রাজকন্যাদের দাবি করেছিলেন, যার অর্থ হিন্দু সম্মানের আত্মসমর্পণ। তিনি হিন্দু যোদ্ধাদের শুধু মুসলিম বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নয় হিন্দু মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও নিয়োগ করেছিলেন, যার অর্থ ছিল হিন্দু বীরত্বের পতিতাবৃত্তি। সমস্ত ব্যবহারিক ক্ষেত্র দেখলে আকবর হিন্দুদের দিয়ে শুধু নিজের জীবদ্দশাতেই নয়, আমাদের সময় পর্যন্ত ইসলামের তরোয়ালেই ধার দিইয়েছেন। তীর্থযাত্রা কর বিলুপ্তি এবং ইসলামিক রাষ্ট্রে কাফেরদের জিজ়িয়া রদের ফলে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল, তা হিন্দু জনসাধারণের বিশেষত কৃষক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে মোটা রাজস্ব আহরণ, অসংখ্য যুদ্ধের মাধ্যমে সেই সাম্রাজ্যকে প্রসারিত করা, মুঘল আড়ম্বর বজায় রাখা এবং তাজের মতো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের খরচ উসুল করার মাধ্যমে বহু গুণ বেশিই পূরণ হয়ে গিয়েছিল। মোগল সাম্রাজ্যের অবসান যখন হল, তখন হিন্দু জনসংখ্যা জীবন-জীবিকার মাত্রা তাৎপর্যপূর্ণ রকম হ্রাস পেয়ে গেছে।

৫. আকবরের রাজত্বকালে বাইরের অনেক ইসলামী দেশ থেকে আগত মুসলিম অভিযানকারীর দল অভূতপূর্ব মাত্রায় ভারতের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করে এবং দেশে ইসলামিক প্রতিষ্ঠাকে আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী করে তোলে। তারা মোগল সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানগুলির পাশাপাশি প্রশাসনিক উচ্চ পদগুলোও দখল করে। পরিসংখ্যান দিয়ে আওরঙ্গজ়েবের সময় অবধি সরকারী পদে হিন্দুদের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি পাওয়া দেখানো যেতেই পারে। কিন্তু মোগল সাম্রাজ্যের নীতি নির্ধারণে হিন্দুদের যেটুকু বক্তব্য ছিল তা আকবরের ঠিক পরবর্তী উত্তরসূরী থেকেই হ্রাস পেতে থাকে। এমনকি আকবরের রাজত্বকালেও নিম্ন স্তরের মুসলিম কর্মীরা বিভিন্নভাবে ইসলামের প্রচলিত পদ্ধতিতে হিন্দুদের শ্লীলতাহানি চালিয়ে গিয়েছিল। এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আকবরের দরবারে শেখ আহমদ সিরহিন্দীর নেতৃত্বে গোঁড়া উলেমা ও সুফিদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখা অনেক লোকই প্রকাশ্যে বলেছিল, হিন্দুদেরকে হয় ইসলাম গ্রহণ করতে হবে অথবা তাদের সঙ্গে কুকুরের মতো আচরণ করা উচিত। আকবর মারা যাওয়ার সাথে সাথে এরা উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং তাদের বংশধরেরা জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল থেকে নতুন করে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির দিকে অগ্রসর হতে থাকে যতক্ষণ না তারা আবার আওরঙ্গজেবের অধীনে শীর্ষে আরোহণ করে।

এটা সত্য যে, আকবরের সাহায্য করার ছদ্মবেশ ধরতে না পারার এবং বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্য যা আকবরের আগে ইসলাম কল্পনাও করতে পারেনি, তা প্রতিষ্ঠা ও সমন্বিত করে এক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সশক্তিকরণে সহায়তা করার জন্য মূল দোষ হিন্দুদেরই ছিল। তারপরেও এটাই সত্য যে, আকবরের সাম্রাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন না করলে জাহাঙ্গীরের মতো ধর্ষকামী অত্যাচারী, শাহ জাহানের মতো জঘন্য ঘৃণ্য অপরাধী এবং আওরঙ্গজেবের মতো কোনও ইসলামিক দানব হিন্দুদের উপর নিরন্তর নির্যাতন ও অপমান করার সুযোগ পেত না। এতে কোনও সন্দেহ নেই, যে এক ঝলমলে ভোর হওয়া থেকে শত সহস্র যোজন দূরে আকবরের রাজত্ব কেবল অন্ধকার রাতের শুরু ছিল, যা নেহেরুভিয়ান ধর্মনিরপেক্ষতার আকারে আজ অবধি অব্যাহত রয়েছে।

লেখক: সীতারাম গোয়েল

অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.