The Story of Islamic Imperialism – ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী – ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী – ৮

১। জাতীয় সংহতির নামে
২। ভারতে মুসলিম শাসনের চরিত্র
৩। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর দাবি
৪। মধ্যযুগের ভারতে সংঘাতের বৈশিষ্ট্য
৫। ইসলামই ছিল দোষী
৬। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ১
৭। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ২
৮। মুসলিম সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিংবদন্তী
৯। হিন্দুদের পরাজয়ের নির্ণায়ক কারণ
১০। ইসলামী দেশে/রাজ্যে হিন্দুদের অবস্থান
১১। আত্তীকরণ ও সংশ্লেষ
১২। ইসলাম বনাম মানবতা

ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী 

অধ্যায় ৮: মুসলিম সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিংবদন্তী

ইসলামের উমেদার ধর্মতত্ত্ববিদরা এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা যুক্তি দেয়, যে মধ্যযুগীয় মুসলিম ইতিহাসবিদদের বর্ণনা অনুযায়ী হিন্দু ও হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে মুসলিম বিজয়ীরা যদি এ জাতীয় নিয়মমাফিক পরিকল্পিত, ব্যাপক ও অব্যাহত সন্ত্রাসের অনুশীলন করতেন, তাহলে সুদীর্ঘ ইসলামী শাসনের শেষে হিন্দুরা এই বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারত না।

এখানে যুক্তি বিশুদ্ধ অবরোহী (প্রথাগত)। মনে করুন যে কোনও ব্যক্তি একটি হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে, কিন্তু সে আত্মরক্ষার জন্য লড়াই করার কারণে সে বেঁচে গেছে। নিম্নাবগামী সূত্র অনুযায়ী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে, যে ব্যক্তিটি কখনও আদৌ প্রাণঘাতী হামলার শিকার হননি, কারণ অন্যথায় সে বেঁচে থাকতে পারতে না! কিন্তু এই উপসংহারের বাস্তব সত্যতার কতটুকু প্রাসঙ্গিকতা আছে?

সুতরাং আমার ষষ্ঠ প্রশ্নটি হ’ল: হিন্দুরা যে তাদের নিজস্ব জন্মভূমিতে সংখ্যাগরিষ্ঠরূপে বেঁচে ছিল তার কারণ কি ইসলামী হানাদাররা তাদের হত্যা বা রূপান্তর করার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি নিয়োগ করেনি, নাকি হানাদার বাহিনীর উচ্চতর সামরিক দক্ষতার কাছে বার বার পরাজিত হলেও, হিন্দু রাজকুমাররা প্রতিরোধ ত্যাগ করেনি এবং বার বার ফিরে আসে পুনরায় যুদ্ধ করে তাদের হারিয়ে যাওয়া রাজ্যগুলি পুনরায় দখল করতে, যতদিন না বর্বররা শুধুলমাত্র বইয়ের পাতায় ঠাঁই নেয়?

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমার উচিত ভারতীয় ইতিহাসের একটি অতিাকায় বিস্তৃত সহজলভ্য সংস্করণ যা অতি বিকৃত, সে সম্পর্কে সচেতন করে দেওয়া। এই জনপ্রিয় বিদেশী আর্য সংস্করণে, ভারতীয় ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন সময় বেশ কিছু বিদেশী হানাদারের ইতিহাস, যেখানে তার সহজগম্যতার কারণে বিভিন্ন সময় ভারতে এসে ঘাঁটি গেড়েছে তথাকথিত আর্য, ইরানী, গ্রীক, পার্থিয়ান, সিথিয়ান, কুশান, হুন, আরব, তুর্কী, পাঠান, মোগল, পার্সিয়ান, পর্তুগীজ়, ডাচ বা ওলোন্দাজ, ফরাসী এবং ব্রিটিশরা। এই ইতিহাস যে ধারণা তৈরি করে তা হল, ভারত সর্বদা একটি মালিকানা বিহীন ফাঁকা জমি ছিল, যা যেকোনও সময় যে কোনও সশস্ত্র দস্যুর দল এলে অধিকার করতে পারত। আর হিন্দুরা ছিল বরাবরই এক “বিক্ষিপ্ত জনতা” যা তাদের চেয়ে উন্নততর জাতির কাছে সর্বদা মাথা নত করেছে।

ভারতবর্ষ এবং অন্যান্য জায়গার মুসলমানরা মোল্লা এবং মুসলিম ঐতিহাসিকদের দ্বারা বিশ্বাস করতে পরিচালিত হয়েছে, যে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিমের দ্বারা সিন্ধু আগ্রাসন দ্বারা ভারতে ইসলামের বিজয় শুরু হয়েছিল, যা ১০০০ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ গজনবী পুনরায় তা শুরু করেছিলেন এবং মুহাম্মদ ঘোরী দ্বারা তা সম্পূর্ণ হয়েছিল যিনি দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দশকে আজমেরের চৌহান ও কনৌজের গহড়বাদের পরাজিত করেছিলেন।  ভারতের মুসলমানদের অতীতে সেই ছয় শতকের দিকে ফিরে তাকিয়ে নিয়ে গর্ব করতে উৎসাহিত করা হয় যখন ভারত মুসলিম সম্রাটদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। এই আরোপিত বিশ্বাসে ব্রিটিশ শাসকদের অস্থায়ী অনুপ্রবেশকারী হিসাবে গণ্য করা হয় যারা একশ বছর ধরে ভারতীয় সাম্রাজ্যের ইসলামের সঙ্গে নিছক প্রতারণা করেছে। ঠিক যেভাবে ‘হিন্দু বানিয়ারা’, যারা ১৯৪৭-এর পর ব্রিটিশদের কাছ থেকে ক্ষমতার সফল হস্তান্তর করেছিল। মুসলমানদের প্রতিদিন প্রতিটি মসজিদ ও মাদ্রাসায় অস্থির করে তোলা হয় এই বলে, যে ভারতবর্ষের পুনর্গঠন না করা পর্যন্ত মুসলিমরা বিশ্রাম নেবে না। মুসলিমদের প্রতিদিন বাগাড়ম্বরপূর্ণ উত্তেজক বক্তৃতা দেওয়া হয় প্রতিটি মসজিদ ও প্রতিটি মাদ্রাসায়, যাতে তারা ভারতের বাকি অংশটাও দখল না করা পর্যন্ত যেন বিশ্রাম না নেয়, যার ওপর তাদের আইনত ন্যায্য দাবি আছে।

একাডেমিক ঐতিহাসিকরা এও একমত যে, দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত ভারতবর্ষ মুসলিম রাজাদের দ্বারা শাসিত ছিল। ইতিহাসের প্রমিত পাঠ্যপুস্তকগুলি তাই ভারতের মধ্যযুগকে বর্ণনা করে দিল্লীর মসনদে বসা সাম্রাজ্যবাদী মুসলিম রাজবংশের সংখ্যা অনুসারে। যেমন – মামলুক (দাস), খলজি, তুঘলক, সায়িদ, লোদি, সুর ও মুঘলদের ক্ষমতায় আরোহণ দ্বারা। প্রাদেশিক মুসলিম রাজবংশগুলি যাদেরর রাজধানী ছিল শ্রীনগর, লাহোর, মুলতান, থট্ট, আমেদাবাদ, মান্দু, বুরহানপুর, দৌলতাবাদ, গুলবার্গা, বিদার, গোলকোন্ডা, বিজাপুর, মাদুরাই, গৌড়, জৌনপুর এবং লখনউ, তারা কেবল বড় সাম্রাজ্যের পতন ও নতুন উত্থানের মধ্যেকার মধ্যে যেন শূন্যস্থান পূরণ করে।

মধ্যযুগীয় ভারতীয় ইতিহাসের এই সংস্করণে এটাই স্বাভাবিক, যে মুসলিম আগ্রসন – সে বড় সাম্রাজ্য হোক বা প্রাদেশিক পর্যায়ের হোক, সেগুলোর বিরুদ্ধে বারংবার হিন্দু প্রতিরোধকে মনে হয় সামান্য কোনও মনান্তর নিয়ে বা নিছক ব্যক্তিগত স্বার্থে করা কিছু বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহ। রাজস্থান, বুন্দেলখণ্ড ও গঙ্গা-যমুনা দোয়াবে বারংবার রাজপুতদের উত্থান, দেবগিরি, ওয়ার‍্যাঙ্গাল, দ্বারাসমুদ্র ও মাদুরাইয়ে নবোত্থিত হিন্দু শক্তি, বিজয়নগর সাম্রাজ্যের উত্থান, মারাঠাদের সুদূরপ্রসারী লড়াই, পাঞ্জাবের শিখদের তীব্র বিদ্রোহ – এ সমস্ত তখন মুসলিম সাম্রাজ্যের সুদূরপ্রসারী স্থায়ী কাঠামোয় খাপ খেয়ে যায়। আর হিন্দু বীররা যারা এই প্রতিরোধ করেছিলেন, তাঁরা প্রতিপন্ন হন সাম্রাজ্যের শান্তি বিনষ্টকারী সম্মানের অযোগ্য সামান্য বিদ্রোহী হিসাবে।

তবে মধ্যযুগীয় ভারতীয় ইতিহাসের এই সংস্করণটি বড়োজোর কেবলমাত্র অনুমান আশ্রিত প্রাঙ্গণের উপর ভিত্তি করা একটি ব্যাখ্যা এবং ঘটনার আসল সত্যতা থেকে নিতান্তই বাছাই করা সংক্ষিপ্তসার, এমনকি উদ্ভাবনও বলা যায়। এখানে কিন্তু আরও একটি ব্যাখ্যার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে, যা জানা তথ্যের থেকে আরও ভালো সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে আরোহিত।

ঘটনাটি কি? এই ব্যাখ্যা থেকে এটাই মনে হয় ভারত পুরোপুরি ও চূড়ান্তভাবে মুসলিমদের করায়ত্ত ছিল, মুসলিম সাম্রাজ্য ছিল সম্পূর্য় ভারতবর্ষ, যা ব্রিটিশরা প্রতারণামূলক উপায়ে নিজেরা চুরি করে নেয়।

মুসলিম আগ্রাসন প্রতিদ্বন্দ্বীহীন ছিল না

প্রথমত তথাকথিত সিন্ধু বিজয়।

থানা, ব্রোচ এবং দেবলের মাধ্যমে ৬৩৪ থেকে ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নৌ-পথে ভারত প্রবেশের চেষ্টা চালানোর পর আরবরা ৬৫০-৭১১-য় উত্তর-পশ্চিমে স্থলপথ দিয়ে চেষ্টা চালায়। কিন্তু খাইবার পথটি কাবুল ও জ়াবুলের হিন্দু রাজকুমারা অবরোধ করে আরবদের বেশ কয়েকবার পরাজিত করেন, এবং তাদেরকে আগ্রাসন থেকে বিরত থাকার চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিলেন। বোলান পাসটি কিকানের জাঠেরা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। আল বিলাদুরী তাঁর ফুতুহ্-উল-বুলদান (Futûh-ul-Buldãn) গ্রন্থে লিখেছেন: “৩৮ হিজরির শেষের দিকে বা ৩৯ হিজরির শুরুতে (৬৫৯ খ্রিস্টব্দ।) আলি হারাসের একই সীমান্তে খিলাফত করার জন্য খলিফের অনুমোদন পান। তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা যে কয়েকজন রক্ষা পেয়েছিলেন, তাঁদের কিকানের মাটিতে ৪২ হিজরিতে (৬৬২ খ্রিষ্টাব্দ) মেরে ফেলা হয়। ৪৪ হিজরি বা ৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে (এবং যে সময়) খলিফ মুয়ায়িয়া, মহল্লাব একই সীমান্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। শত্রুরা তাকে প্রতিহত করে তাকে ও তার অনুগামীদের মেরে ফেলে। মুয়াবিয়া আবদুল্লাহকে হিন্দ সীমান্তে প্রেরণ করে। সে কিকানে যুদ্ধ করে ও লুঠ সংগ্রহ করে। কিছু সময় খলিফের কাছে কাটিয়ে কিকানে ফেরত যায়, যখন তুর্কীরা ও হিন্দুরা তাদের বাহিনীকে একত্র করে তাকে হত্যা করে।”

এরপরে আরবরা মাকরান হয়ে তৃতীয় স্থলপথটি দিয়ে চেষ্টা করেছিল। আল বিলাদুরি আরও লিখেছেন: “একই মুয়ায়িয়ার রাজত্বকালে প্রধান জ়িয়াদ সিনানকে নিযুক্ত করে। সে সীমান্তে চলে এগিয়ে যায় এবং জোর করে মাকরান ও তার শহরগুলিকে পদানত করে। জ়িয়াদ তখন রশিদকে নিযুক্ত করেন। সে মাকরানে অগ্রসর হয়, কিন্তু মেডদের (হিন্দুদের) হাতে তাকে নিহত হতে হয়েছিল। জ়িয়াদের পুত্র আববাদ তখন সিস্তানের পথে হিন্দ সীমান্তে যুদ্ধ করেছিল। সে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দের সঙ্গে লড়াই করে; কিন্তু তাতেও অনেক মুসলমান মারা যায়। জিয়াদ পরবর্তীকালে আল মনজ়ারকে নিযুক্ত করেন। সিনানও এটিকে কব্জা করে, কিন্তু সেখানকার বাসিন্দাদের বিচক্ষণতার জন্য সুবিধা করতে পারেনি। সে (আল মনজ়ার) সেখানেই মারা গেল। যে সময়টা হাজ্জাজ ইরাকের শাসক ছিলেন, তখন সাইদাকে মাকরান ও তার সীমান্তে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সেখানে বিরোধিতার মুখে সাইদা নিহত হয়। এরপরে হাজ্জাজ মুজ্জাকে সীমান্তে নিয়োগ করেছিলেন। এক বছর থাকার পরে মাকরানে মুজ্জা মারা যায়। এর পরে হাজ্জাজ উবায়দুল্লাহকে দেবলের বিরুদ্ধে প্রেরণ করলেন। উবায়দুল্লাহকে হত্যা করা হলে হাজ্জাজ বুদাইলকে চিঠি লেখেন, শত্রু তাকে ঘিরে ফেলে হত্যা করেছিল। এই বলে দেবলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এরপরে হাজ্জাজ ওয়ালিদের খিলাফত চলাকালীন সিন্ধিয়ান সীমান্তে সেনাপতির জন্য কাসেমির পুত্র মোহাম্মদকে নিযুক্ত করেছিলেন। সেটা ছিল ৭১২ খ্রিস্টাব্দে।

এখন ভারতের সীমান্তে আরবদের এই তথ্যটি তাদের অন্যান্য রেকর্ডের সঙ্গে তুলনা করুন। নবীর মৃত্যুর আট বছরের মধ্যে তারা পারস্য, সিরিয়া এবং মিশর জয় করে ফেলেছিল। ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে তারা অক্সাস এবং হিন্দু কুশের পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। ৬৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭০৯ খ্রিস্টাব্দ তারা সমগ্র পুরো উত্তর আফ্রিকা গ্রাস করেছিল। তারা ৭১১ সালে স্পেন জয় করেছিল। কিন্তু ভারতের মাটিতে প্রথম পা রাখার জন্য তাদের ৭০ বছর সময় লেগেছিল। অথচ কোনও ঐতোহাসিক ভারতীয় নুনের মান রেখে স্বীকার করেননি যে বহিরাগত আগ্রাসকদের কাছে হিন্দুরা মোটেই যুদ্ধ খেলার সহজ প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না।

মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুর কয়েকটি শহর দখল করতে সফল হন। তাঁর উত্তরসূরীরাও পাঞ্জাব, রাজস্থান এবং সৌরাষ্ট্রের দিকে কিছু অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা শীঘ্রই পরাজিত হয় এবং তাদের পিছু ফিরতে বাধ্য করা হয়। আরব ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেছেন যে, “এমন কোনও আশ্রয়স্থল ছিল না, যেখানে মুসলিমরা পালিয়ে গিয়ে বাঁচতে পারে।” অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তারা কেবলমাত্র মুলতান এবং মনসুরাহ শহরগুলিকে অতি কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। মুলতানে তাদের দুর্দশার কথা আল কাজ়উইন (AI Kazwin) নিম্নরূপে তাঁর আসর-উল-বিলাদ (Asr-ul-Bilãd)  গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন: “কাফেররা সেখানে একটি বিশাল মন্দির এবং একটি প্রকাণ্ড প্রতিমা নির্মাণ করেছিল। মন্দিরের চারপাশে দাস ও ভক্তদের বাড়িঘর রয়েছে। চত্ত্বরে থাকা বাসিন্দাদের মধ্যে ছাড়া আর কোনও মূর্তি উপাসকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। মুলতানের শাসক এই প্রতিমাটি বরবাদ করেননি, কারণ যে বিশাল নৈবেদ্য উত্সর্গ করত ভক্তরা সেটাই ফিরে আসত তাঁর কাছে। যখন ভারতীয়রা মুলতান আক্রমণ করে, তখন মুসলমানরা মূর্তীগুলি বাইরে এনে শাসয়। যখন হিন্দুরা দেখল মুসলমানরা মূর্তিগুলো ভাঙার উপক্রম করতে চলেছে, তখম তারা যুদ্ধে পিছু হটে”। (জোর প্রযুক্ত)

মজার কথা আরবীদের ইসালামী একেশ্বরবাদ (monotheism) এবং তাদের নব রণপ্রস্তুতি যখন বিশ্ববিখ্যাত, সে সময় ষুদ্ধে জেতা মহাসেনানীরা শেষ পর্ষন্ত একটি মূর্তির আড়ল নিয়ে বেঁচেছিল। বিশ্বজয়ীদের ভারত জয়ের স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গিয়েছিল।

এর প্রায় দুশো বছর পরে, ৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে, আল্পটিগিন তুর্কী জাবুলের রাজধানী গজনি দখল করতে সফল হয়েছিল। ৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর কিছু আগেই তাঁর উত্তরসূরী সুবুক্তিগিন হিন্দু শাহিয়াদের জন্য কাবুল শহরকে বন্ধ করে দেয়। তাঁর পুত্র মাহমুদ গজনবী ১০০০ ও ১০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে অনেকগুলো অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

তার ধ্বংসাত্মক বিশদ এতটাই সুবিদিত, যে পুনরাবৃত্তি করার দরকার নেই। এখানে আমাদের উদ্বেগের বিষয়টি হল, ঐতিহাসিকদের একটি দুর্বল অনুমান, যে মাহমুদের এদেশে সাম্রাজ্য বিস্তারে ততটা আগ্রহ ছিল না, যতটা আগ্রহ ছিল মন্দিরগুলি ভেঙে ফেলা, ধন-সম্পদ লুণ্ঠন, দাসদের ধরে নিয়ে যাওয়া এবং কাফেরদের হত্যা করার প্রতি। এই ধারণাটি রবির পশ্চিমে পাঞ্জাব এবং পুরো সিন্ধু দখল করার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই উপসংহারটিই অনিবার্য, যে যদিও মাহমুদ অনেক দূরে হিন্দুস্তানের প্রাণকেন্দ্রে গিয়েছিলেন এবং বহু বিজয় অর্জন করেছিলেন, তবুও তাঁকে প্রতিবারই হিন্দু পাল্টা আক্রমণে তড়িঘড়ি পিছু হটতে হয়েছিল। ১০২৬ খ্রিস্টাব্দে সোমনাথ থেকে ফিরে আসার সময় তাকে যে পাঞ্জাবের জাঠেরা বিপদে ফেলেছিল, তা এই বিন্দুটিই প্রমাণ করে ।

মাহমুদ মারা যাওয়ার পরে একই জাট এবং গক্‌খররা সিন্ধু ও পাঞ্জাবের মুসলিম দখলদারদের কিন্তু কোন সমস্যায় ফেলেনি। পুনরায় আর একজন ইসলামী হানাদার ভারত বিজয়ের পরিকল্পনা করার আগে মাঝে ১৫০ বছর কেটে গিয়েছিল। তিনি ছিলেন মুহাম্মদ ঘোরী। ১১৭৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের দিকে তাঁর প্রথম প্রয়াস চৌলুক্যদের হাতে বিপর্যস্ত হয়েছিল এবং তিনি কোনওক্রমে নিজের প্রাণ নিয়ে পালাতে পারেন। ১১৯১ সালে তরাইনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাকে প্রায় অর্ধ-মৃত অবস্থায় বহন করে নিয়ে আসা হয়। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দেই তিনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রথম লড়াইয়ে জয়লাভ করেছিলেন হীন কৌশল অবলম্বন করে যা জাত্যাভিমানী বীর রাজপুতরা দেখতে পায়নি।

তুর্কী সাম্রাজ্য ছিল ক্ষণস্থায়ী

মুহম্মদ ঘোরী পাঞ্জাব, সিন্ধু, দিল্লী এবং কানৌজ পর্যন্ত দোয়াব জয় করেছিলেন। তাঁর সেনাধিপতি কুতুবুদ্দিন আইবক এই বিজয় প্রসারিত করেন রাজস্থান, গোয়ালিয়র, কালিনজর, মহোবা ও বুন্দেলখণ্ডের খাজুরাহো এবং গঙ্গার ওপারে কাটিহার ও বাদাওনে পর্যন্ত। চূড়ান্ত পর্বে কিন্তু তাঁর গুজরাট অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল যদিও তিনি অনাহিলওয়ার পাটানকে অবরোধ করে ও লুণ্ঠনে সফল হন। ইতিমধ্যে বখতিয়ার খলজি হুগলীর উত্তর ও পশ্চিমে বিহার ও বাংলা জয় করেছিলেন। আসামে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করার সময় তিনি একটি বিপর্যয়কর পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে বখতিয়াত খলজি বিহার ও উত্তর বাংলা জয় করেন কিন্তু আসামে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে তাঁর শোচনীয় পরাজয় হয়।

কিন্তু ১২০৬ সালে গকখরদের হাতে মুহম্মদ ঘোরী মারা পড়ান। আইবাক ভারতে পূর্ববর্তী অংশের ওপর ক্ষমতাসীন থাকেন, কালিঞ্জরকে চান্দেল্লারা পুনরায় উদ্ধার করেছিল, রনথম্বর দিল্লী আধিপত্যে ফেরে, প্রতিহাররা গোয়ালিয়র পুনরায় অধিকার করে নেয়, দোয়াব গহড়বা রাজকুমার হরিশ্চন্দ্রের দখলে চলে আসে এবং কাটিহার রাজপুতরা গঙ্গা পর্যন্ত নিজেদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করেছিলেন। আলওয়ারের আশেপাশের যাদবভট্টি রাজপুতরা আজমেরের রাজকীয় রাস্তাটি কেটে ফেলেছিল। আইবাক ১২১০ খ্রিস্টাব্দে মারা যাওয়ার আগে এই অঞ্চলগুলির কোনওটিই পুনরায় দখল করতে সক্ষম হননি।

আইবাকের উত্তরসূরী ইলতুৎমিশ রণথম্ভর ও গোয়ালিয়র পুনর্দখল করতে এবং আজমেরের আশেপাশে তাঁর ঘাঁটি প্রশস্ত করতে সফল হন। তবে তিনি নাগড়ার গুহিলোট, বুন্দির চৌহান, মালওয়ার পারমার এবং বুন্দেলখণ্ডের চান্দেলাদের হাতে বেশ কয়েকটি পরাজয় বরণ করেছিলেন। গঙ্গার ওপারে, কাটিহার রাজপুতরা তাদের শক্তিকে একত্র করেছিলেন যা সুলতান নড়াতে পারেননি। দোয়াব তখনও প্রবল প্রতিরোধের জায়গা ছিল। ১২৩৬ সালে মৃত্যুর শঙ্গে সঙ্গে আজমিরের ওপরও সুলতানী নিয়ন্ত্রণ কমতে শুরু করে।

ইলতুতমিশ প্রতিষ্ঠিত শামসি রাজবংশের রাজ়িয়া, বাহরাইন, মাসুদ এবং মাহমুদের রাজত্বকালে সুলতানি দাপটের ব্যাপক অবনতি ঘটেছিল যদিও এর অধঃপতন কিছুটা আটকাতে পেরেছিলেন বলবন যিনি ১২৪৬ থেকে সক্রিয় ক্ষমতা অর্জন শুরু করেন।  হিন্দু ওড়িশার দ্বারা বাংলায় মুসলিম শাসন যথেষ্ট ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছিল। আসামে আরেকটি মুসলিম আগ্রাসন সামুহিক বিনাশের মুখোমুখি হল, যেখানে মুসলিম সেনাধপতি তো প্রাণ হারিয়েই্ছিল, পুরো মুসলিম সেনাবাহিনীই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। হিন্দু সামন্ত সর্দাররা এরপর বিহারের মুসলিম সেনা শিবির শহরগুলিতে মারধর শুরু করে। দিল্লীর নিকটে চান্ডেলরা মথুরা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। আলওয়ারের রাজপুতরা হানসি পর্যন্ত অভিযান চালিয়েছিল এবং দিল্লীর মতো পরিবেশেও মুসলমানদের জন্য সন্ত্রাসে পরিণত হয়েছিল। হিন্দু পুনরুদ্ধারের এই ক্রমবর্ধমান জোয়ারের বিপ্রতীপে বলবনের সাফল্য ছিল নিতান্ত প্রান্তিক। তিনি বেশ কয়েকটি ধাক্কা খেয়েছিলেন। ১২৮৯ খ্রিস্টাব্দে বলবান মারা যাওয়ার পরে সলতনত পুনরায় দিল্লীর আশপাশে এলাকায় গুটিয়ে আসে।

ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার নিম্নোক্ত কথায় এই পরিস্থিতিটির সংক্ষিপ্তসার দিয়েছেন: বিদ্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভারত ছিল হিন্দু শাসনাধীন। এমনকি উত্তর ভারতেও একই শতাব্দীতে শক্তিশালী রাজ্যগুলি তখনও মুসলিম শাসনের অধীন ছিল না, বা তখনও তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল। এমনকি ভারতবর্ষের যে অংশে মুসলিম শাসন স্বীকৃত ছিল, সেখানেও ক্রমাগত প্রতিরোধ, ছোট বড় নিয়মিত বিদ্রোহ এবং হিন্দু বীরত্বের প্রদর্শন হত, যাতে একের পর এক মুসলিম শাসকরা বারবার একই অঞ্চলের বিরুদ্ধে সুসজ্জিত সামরিক অভিযান প্রেরণ করতে বাধ্য হত। সত্যি বলতে কী, উত্তর ভারতে ত্রয়োদশ শতাব্দী জুড়ে মুসলিম কর্তৃত্ব শুধু কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কেন্দ্রকে দখল করে রেখেছিল, যেখানে প্রকৃত নিয়মানুগ কোনও প্রাশাসনিক কাঠামো বা ক্ষমতা গড়ে ওঠেনি।

জালালউদ্দিন খলজি পূর্ববর্তী শাসনকালে মুসলমানদের দ্বারা হারানো জমি পুনরায় দখল করতে ব্যর্থ হন। তুলনায় আলাউদ্দিন অনেক বেশি সফল ছিলেন। তাঁর সেনাপতি ওলুগ খান এবং নুসরত খান ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটকে জয় করতে সক্ষম হন। কিন্তু রণথম্বোর থেকে তাদের পিটিয়ে তাড়ানো হয়েছিল যা আলাউদ্দিন ১৩০১ খ্রিস্টাব্দের আগে কব্জা করতে পারেননি। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর চিত্তোর বিজয়ও খুব স্বল্পমেয়াদী ছিল, কারণ সিসোদিয়রা ১৩১৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পরেই পুনরুদ্ধার করে। রাজস্থানে তাঁর জলোর জয়ও অনুরূপ ছিল। তাঁর নিজের ও পাশাপাশি মালিক কাফুরের অভিযানগুলি, যেমন মহারাষ্ট্রের দেবগিরি, অন্ধ্র প্রদেশের ওয়ারঙ্গাল, কর্ণাটকের দ্বারসামুদ্র এবং তামিলনাড়ুর মাদুরাইয়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ নিছক সাময়িক অবরোধ ছাড়া আর কিছুই ছিল না কারণ হানাদার বাহিনী চলে যাওয়ার পরপরই হিন্দু রাজপুত্ররা সেই সমস্ত রাজধানীতে তাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে এনেছিল। শুধু তাই নয়, ১৩১৬ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিনের মৃত্যুর সাথে সাথে খলজি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। গিয়াসউদ্দিন তুঘলককে ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল যাতে গুজরাটের হিন্দুরা যারা নামমাত্র ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিল, তাদের অবশিষ্টাংশগুলি দখল করে বাঁচাতে পারে।

গিয়াসউদ্দিন তুঘলক দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলা জয় করতে সফল হয়েছিলেন। কিন্তু বিহারের তিরহুতকে পুরোপুরি পরাধীন করতে পারেননি তিনি। ১৩২১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র জৌনা খান যখন ওয়ারাঙ্গালকে পুনরায় দখল করার চেষ্টা করেন, তখন তাঁকে পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হয় এবং নির্বল হয়ে যাওয়ার আগে ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে তাকে আরও একটি আক্রমণ চালাতে হয়েছিল। কিন্তু তবে ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতাপারুদ্র ক্ষমতায় ফিরে আসেন। ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে ওড়িশা সীমান্ত থেকে জৌন খানকে পিটিয়ে উড়িষ্যার সীমানা থেকে তাড়ানো হয়েছিল। তিনি মুহাম্মদ তুঘলক হিসাবে ক্ষমতায় আসার সময় আরও সফল হন। তিনি দেবগিরির উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করেন, তুঙ্গভদ্রের উপর কমপিলির নামে ছোট রাজ্য জয় করেন এবং দ্বারসমুদ্রকে দিল্লীর সাম্রাজ্যের কর্তৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বা নজরানা দিতে বাধ্য করেন। মাদুরাইও তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। তিনি দক্ষিণে হিন্দুদের পুনরুত্থানের উপর নিবিড় নজর রাখতে এবং ভারতে ইসলামী শক্তির আরও একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর রাজধানী দেবগিরিতে স্থানান্তর করেছিলেন। কিন্তু তাঁর রাজত্বের প্রথমদিকেই তিনি মেওয়ারের মহারাণা হামিরের কাছে পরাজিত হয়ে বন্দী হয়েছিলেন, এবং আজমির, রণথম্ভোর ও নাগৌরের সমস্ত দাবী মেটানোর পরে অনাদায়ী হিসাবে ৫০ লক্ষ টাকা প্রদানের পরে মুক্তি পান। বিন্ধ্যের দক্ষিণে তাঁর সাম্রাজ্য তাঁর নিজের সময়কালেই দিল্লীর কাছে হেরে যায় এবং ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পরে উত্তরাঞ্চলেও দিল্লীর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যায়।

ফিরোজ শাহ তুঘলক সাময়িকভাবে সমতলটি একসাথে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ওড়িশায় তাঁর অভিযান সফল দস্যুতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাঁকে গঙ্গার উত্তরে কাটিহার রাজপুতদের বিরুদ্ধেও বার্ষিক অভিযানের নেতৃত্ব দিতে হয়েছিল। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরীরা উত্তরেও জমি ধরে রাখতে পারেনি। ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে তৈমুরের আক্রমণ শেষে এটি সম্পূর্ণ ধসে যায়। ইতিমধ্যে, মহান বিজয়নগর সাম্রাজ্য কৃষ্ণের দক্ষিণে হিন্দু শক্তি কেন্দ্রীভূত করেছিল। রাজস্থানও মেওয়াড়ের নেতৃত্বাধীনে বিভিন্ন রাজপুত রাজপুত্ররদের রাজত্বাধীন ছিল। ফিরোজ শাহ তুঘলকের অভিযানের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে উড়িষ্যা ততদিনে পুরোপুরি সেরে উঠেছিল।

তুঘলকগণের উত্তরাধিকারী সায়িদরা ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে যখন শুরু করেছিলেন তখনই তাঁরা কোনও রাজবংশের লোকই ছিল না। তাদের আয়ত্তে পূর্ব দিকে ইটাওয়াহ (উত্তর প্রদেশ) এবং দক্ষিণে মেওয়াত (হরিয়ানা) ছাড়া প্রসারিতই হয়নি। খিজর খান উত্তরে সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সাফল্য পাননি। ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে লোদিদের দ্বারা সৈয়দদের পরাস্ত করার আগে মোবারক শাহ পাঞ্জাব এবং মুলতান পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন।

বাহলোল লোদি ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে জৌনপুরের মুসলিম প্রাধান্য বৃদ্ধি করে ফেলেন। কিন্তু সিকান্দার লোদি রাজস্থান ও বাঘেলখণ্ডের গোয়ালিয়রকে পরাস্ত করতে ব্যর্থ হন। তিনি মালওয়া ও রাজস্থান বিজয়ের পরিকল্পনা করার জন্য তাঁর রাজধানী আগ্রায় সরিয়ে যান। তবে এর কোনও সুফল হয়নি। মোটামুটি ইব্রাহিম লোদির আমালেই লোদি সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। এই সময়ের মধ্যে, রানা সঙ্গর অধীনে মেওয়ার উত্তর ভারতের শক্তিশালী রাজ্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। উড়িষ্যা তার উত্তরে মুসলিম বাংলার এবং দক্ষিণে বাহমানীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। কৃষ্ণদেবরায় (১৫০৫-১ under৩০ খ্রিস্টাব্দ) এর অধীনে বিজয়নগরের শক্তি যথেষ্ট সমৃদ্ধি অর্জন করে।

১৪ ও ১৫ শতকের পরিস্থিতির সংক্ষিপ্তসার ডঃ আর.সি. মজুমদার নিম্নলিখিত ভাষায় প্রকাশ করেছেন: “১৩০০-১৩২০-র মধ্যে খলজি সাম্রাজ্য বিশ বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য উত্থিত ও পতিত হয়েছিল। মুহম্মদ বিন তুঘলকের সাম্রাজ্য তাঁর অধিগ্রহণের এক দশকের মধ্যেই (১৩২৫ খ্রি।) ভেঙে যায়, এবং আরও এক দশক শেষ হওয়ার আগে তুর্কী সাম্রাজ্য চিরতরে চলে যায়।  এভাবে খলজীদের এবং মুহাম্মদ বিন তুঘলকের অধীনে দুটি তুর্কী বংশ বাদ দিলে ভারতে আর তুর্কী সাম্রাজ্য ছিলই না। এই পরিস্থিতি চলে প্রায় আড়াই শতাব্দী। ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মুগলরা একটি স্থিতিশীল এবং টেকসই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা পর্যন্ত এই ভঙ্গুর পরিস্থিতিই অব্যাহত ছিল।”

“The Khalji empire rose and fell during the brief period of twenty years (A.D 1300-1320). The empire of Muhammed bin Tughlaq broke up within a decade of his accession (A.D. 1325), and before another decade was over, the Turkish empire passed away for ever Thus barring two every short-lived empires under the Khaljis and Muhammad bin Tughlaq there was no Turkish empire in India. This state of things continued for nearly two centuries and a half till the Mughals established a stable and durable empire in the second half of the sixteenth century A.D.”

মুঘল সাম্রাজ্য: একটি যৌথ উদ্যোগ

বাবর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করেছিলেন। কিন্তু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা তেমন করেননি। হুমায়ুন শের শাহ সুরের কাছে যুদ্ধে হেরেছিলেন এবং বাবরের জেতা বেশিরভাগ অংশেই নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেনি। শের শাহ রণথম্ভর এবং আজমেরকেও উত্তর ভারতে তাঁর সাম্রাজ্যে যুক্ত করেছিলেন। তবে মারোয়াড়ে যে ভয়ানক যুদ্ধ তাঁকে করতে হয়েছিল, তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন ‘এক মুঠো বাজরার জন্য গোটা সাম্রাজ্য হারাতে বসেছিলেন।” তাঁর শাসনকাল মাত্র পাঁচ বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য স্থায়ী হয়েছিল (১৫৪০-৪৫ খ্রিস্টাব্দ)। সুর সাম্রাজ্য খুব শীঘ্রই এতটা ঝরঝরে নড়বড়ে হয়ে ওঠে, যে হিন্দু সেনাপতি হিমু ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীতে “হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য” উপাধি নিয়ে নিজেকে মুকুটে অভিষিক্ত করতে সক্ষম হন।

বরং ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে আকবরের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মোঘল সাম্রাজ্য তুলনায় আরও স্থিতিশীল প্রমাণিত হয়েছিল এবং ১৫০ বছর ধরে স্থায়ীও হয়েছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত একেবারে চূড়ান্ত দক্ষিণ ব্যতীত প্রায় সমগ্র ভারতের সবদিক জুড়ে মুঘল সাম্রাজ্য প্রসারিত হয়েছিল। তবে মুঘল সাফল্যের জন্য অবশ্যই আকবররের বাস্তব বুদ্ধিকে কৃতিত্ব দিতে হয়। ক্ষমতার বাস্তবতা এবং নিতান্ত ইসলামী বিধি অতিক্রম করে রাজপুতদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পুনর্মিলন একটা বড় ভূলিকা পালন করেছিল। রাজপুত সেনাপতি এবং সৈন্যরা অনেক যুদ্ধ জয় করলেও কৃতিত্ব মুঘল সেনারারই পায়। রাজস্থান এবং বুন্দেলখণ্ডের রাজপুত রাজ্যগুলি কেবল নামেই মুঘল সম্রাটের করদ ছিল। কিন্তু সমস্ত ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে, তারা মুঘলদের মিত্র ছিল যারা তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলত। কিন্তুব মেওয়ার কার্যত পুরো মুঘল শাসনের সময় জুড়ে হিন্দু বিদ্রোহের পতাকা উত্তলিত রেখেছিল।

মুঘল সাম্রাজ্য খুব দ্রুত ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল, যখন আওরঙ্গজেব আকবরের হিন্দুদের থাকার ব্যবস্থা নীতি পাল্টে দেওয়া শুরু করেন এবং প্রকৃত ইসলামী সাম্রাজ্য গড়তে ‘অবিশ্বাসী’দের প্রতি সন্ত্রাস ও অবদমন অবলম্বন করেন। রাজস্থান এবং বুন্দেলখন্ড তাঁর জীবনকালেই নিজেদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করে নেয়। ভরতপুর ও মথুরার আশেপাশের জাঠ ও মারাঠারাও তাই করেছিল। বড় মুঘল ঘাঁটি হওয়া সত্ত্বেও আহমদনগর এবং আওরঙ্গবাদের মতো আসনগুলিকে বিপদের মুখে ফেলে সেগুলোর নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে, খন্দেশ এবং গুজরাট পর্যন্ত সাম্রাজ্য আক্রমণ করে মারাঠারা আরঙ্গজেবের কবর খনন করে ফেলেছিল। হিন্দুদের এই পুনরুত্থান ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর দুই দশকের মধ্যে মুঘল সাম্রাজ্যকে ভেঙে ছত্রাখান করে দেয়।

প্রাদেশিক মুসলিম প্রশাসন

তুঘলক সাম্রাজ্য ভেঙে যাওয়ার পরে বিদ্রোহী ও অভিযাত্রীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রাদেশিক মুসলিম রাজত্বগুলির মধ্যে বাংলা, মালওয়া, গুজরাট এবং বাহমানিরা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল। উভয়ই মুঘলদের দখলে না আসায় হিন্দু উড়িষ্যা বাংলার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। মেওয়ারের সিসোদিয়ারা গুজরাট এবং মালওয়ার সাথে যুক্ত হয়ে রানা সঙ্ঘর রাজত্বকালে প্রায় তাদের পরাভূত করেছিল। গুজরাত স্বল্প সময়ের জন্য পুনরুদ্ধার করা গেলেও পুনরায় মুঘলদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বিজয়নগর সাম্রাজ্য দক্ষিণে বাহমানী সাম্রাজ্য অধিকার করে প্রায় দুই শতক ভয়ানক যুদ্ধ করে ধরে রেখেছিল। প্রায় দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ছড়িয়ে পড়া এক ভয়াবহ লড়াইয়ে, যেখানে উভয় পক্ষের ভাগ্য ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বিজয়নগর মহানগর ধ্বংসের ফলে বিজয়নগর সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়নি। এটি আরও সত্তর বছর ধরে বিজাপুরের পথে বাধা দেয়। ইতিমধ্যে, মারাঠারা শিবজীর আগে থাকতেই আহমদনগর এবং বিজাপুরের নামমাত্র সামন্ত বা করদ রাজা হিসাবে দক্ষিণ ভারতের অনেকগুলি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। এবং স্বভাবতই তারা দ্রুত বাহমনি সাম্রাজ্যের অবশিষ্টাংশগুলিতে মরণ আঘাত হানে যা মুঘলরা তাদের নিজস্ব সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য রাড়াহুড়ো করেছিল।

উপযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গী

সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করা হলে, দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দশক এবং অষ্ঠাদশ শতাব্দী প্রথম প্রান্তিকের মধ্যে যে সময়কালটি ভারতের মুসলিম সাম্রাজ্যের সময়কাল বলে মনে করা হয় – এটি নিছক হিন্দু মুক্তিযোদ্ধা এবং মুসলিম হানাদারদের মধ্যে দীর্ঘ একটানা যুদ্ধের সময়কাল ছাড়া আর কিছুই নয়। হিন্দুরা অনেকগুলো যুদ্ধ হেরেছিল এবং বারবার পিছুও হটেছিল। কিন্তু তারা প্রতিবারই শক্তি জুটিয়ে পুনরায় লড়াই শুরু করেছিল, যাতে অবশেষে শত্রু ক্লান্ত হয়ে ও পরাজিত হয়ে পড়ে। আর শিবাজীর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে তো মুসলিমরা চূড়ান্ত পর্বে ছত্রাকার হয়ে পড়েছিল।

মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাস পড়ে আমরা দেখতে পেলাম, যে মুসলিম বাহিনীর প্রমাণিত শ্রেষ্ঠত্বের আগে মাত্র কয়েকজন হিন্দু রাজকুমারই শোচনীয় আত্মসমর্পণ করেছিলেন। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ হিন্দু পুরুষরা কীভাবে তাদের মহিলাদের জীবন্ত পুড়িয়ে বা অন্য উপায়ে হত্যা করে তারপরে শেষ পুরুষ পর্যন্ত লড়াই করে মারা গিয়েছিল তার অসংখ্য উদাহরণ তুলে ধরেছে। আবার বহু ক্ষেত্রে হিন্দু বীরত্বের দ্বারা মুসলমানদের নির্ণায়ক পরাজয়ের উদাহরণ রয়েছে। তথাকথিত মুসলিম বিজয়ের বেশ কিছু ঘটনাই ছিল নিছক আক্রমণ ছিল যা প্রাথমিকভাবে সফল হলেও তার প্রভাব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। অসম, রাজস্থান, বুন্দেলখণ্ড, উড়িষ্যা, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র এবং পাঞ্জাব যে প্রতিরোধ ও পুনরুদ্ধারের ধারাবাহিক তরঙ্গে নিজেকে তুলে ধরেছে, তার সমান্তরাল নজির মানব ইতিহাসে খুব বেশি কিন্তু নেই।

সুতরাং, এটি সত্যের অপলাপ, যে ছয় শতাব্দী ধরে ইসলাম ভারতে কোনও সাম্রাজ্য উপভোগ করেছিল। যা ঘটেছিল তা হল ইসলাম ছয় শতক ধরে ভারতকে পুরোপুরি দখলের লাগাতার সংগ্রাম করেছিল, কিন্তু কঠোর এবং অব্যাহত হিন্দু প্রতিরোধের মুখে চূড়ান্ত পর্বে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। হালি একেবারেই ভুল বলেননি বা অতিকথন করেননি, যখন তিনি শোক প্রকাশ করেন, যে “হিজাজের অদম্য আর্মডা যা এতগুলি সমুদ্র এবং নদী জুড়ে প্রবাহিত হয়েছিল, শেষে গঙ্গার জলস্রোতে এসে সমাধিস্থ হয়ে গেল।” একই দুঃজনক ব্যর্থতার স্মরণে ইকবাল তাঁর ‘শিকওয়াহ’-তেও লিখেছেন। সত্য বলতে গেলে, ভারতে মুসলিম কবি ও রাজনীতিবিদদের কোনও অভাব নেই যাঁরা অতীতে ভারতে ইসলামের পরাজয়ের জন্য কেঁদেছেন এবং যারা ভবিষ্যতে ভারত পুনর্গঠনের প্রত্যাশায় রয়েছেন। হিন্দুরা যে তাদের মাতৃভূমিতে এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠরূপে টিকে আছে, তার কারণ ইসলাম তাদের বিজয় ও ধর্মান্তরিত করার জন্য কোনও প্রচেষ্টায় ঢিল দিয়েছিল বলে নয়, বরং ইসলামী বর্বরতার বিরুদ্ধে হিন্দুদের সহশীলতা ও  স্বাধীনচেতা মনোভাব আরও জোরালো হয়ে দাড়িয়েছিল বা দাঁড়িয়ে আছে বলে।

এটা সত্যের কাছাকাছিও বলা যায় না, যে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পূর্ববর্তী মুসলিম সাম্রাজ্যেকে প্রতিস্থাপন করেছিল। ব্রিটিশরা যখন তাদের সাম্রাজ্যবাদী খেলা খেলতে শুরু করে, তখন ভারতের কার্যকর রাজনৈতিক শক্তি মারাঠা, জাট এবং শিখদের হাতে ইতিমধ্যে চলে গিয়েছিল। বঙ্গ, অবধ, দক্ষিণ ভারত, সিন্ধু এবং পাঞ্জাবের মুসলিম রাজত্বগুলি পুনরুত্থিত হিন্দু শক্তিগুলোর সমপর্যায় ক্ষমতার ছিল না। বরং ততদিনে দিল্লীর মুঘল সম্রাটের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল একেবারে অসহায়তার করুণ। ভারতে ইসলামের ঠিকাদাররা সীমান্ত পেরিয়ে আহমদ শাহ আবদালিকে বারবার আমন্ত্রণ জানিয়ে আসছিল ইসলাম যে গভীর খাতে পড়েছিলে, সেখান থেকে ইসলামকে উদ্ধার করার জন্য।

লেখক: সীতারাম গোয়েল

অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.