১। জাতীয় সংহতির নামে
২। ভারতে মুসলিম শাসনের চরিত্র
৩। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর দাবি
৪। মধ্যযুগের ভারতে সংঘাতের বৈশিষ্ট্য
৫। ইসলামই ছিল দোষী
৬। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ১
৭। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ২
৮। মুসলিম সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিংবদন্তী
৯। হিন্দুদের পরাজয়ের নির্ণায়ক কারণ
১০। ইসলামী দেশে/রাজ্যে হিন্দুদের অবস্থান
১১। আত্তীকরণ ও সংশ্লেষ
১২। ইসলাম বনাম মানবতা
ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী
অধ্যায় ৭: মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ২
মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাসের স্পষ্ট মিথ্যাচার ও বিকৃতির ক্ষেত্রে NCERT-ই একমাত্র খলনায়ক নয়। বেশ কিছুদিন ধরে All India Radio হিন্দীতে একটি অনুষ্ঠান করে আসছে “ইতিহাস কে ঝরোকে সে” (ইতিহাসের বাতায়নে)। বার্তা সেই এক – মধ্যযুগের মুসলিম শাসিত ভারত ছিল হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানের সময়, এবং মুসলিম শাসকরা বিশেষত আওরঙ্গজ়েব নিয়মের বাইরে গিয়েও হিন্দুদের প্রতি দয়ালু ও সহানুভূতিশীল ছিল। সিদ্ধান্ত হল হিন্দু-মুসলিম সংঘাত হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সৃষ্টি যাদের নোংরা খেলা, যা এখন হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অল ইন্ডিয়া রেডিও-র এই অনুষ্ঠানের বক্তা দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে সর্বদা সত্যগোপন করে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার পদ্ধতি (suppressio veri suggestio falsi ) অবলম্বন করেছে। যেমন আওরঙ্গজ়েবের ২-৩টি হিন্দু মন্দির নির্মাণে তুচ্ছ সাহায্যকে কয়েকজন পোষা হিন্দু সভাসদ গদগদ হয়ে বিরাট করে দেখিয়েছেন। কিন্তু দীর্থ শাসনকালে তাঁর নিয়মিত হিন্দু মন্দির ধ্বংস ও দেবদেবীর অসংখ্য মূর্তি অবমাননা করার কথা কখনও উল্লেখ করা হয় না।
পাহাড় প্রমাণ হিংস্রতাকে তিল তুল্য সৌজন্য দিয়ে আড়াল করার এই করুণ প্রচেষ্টা পুরো সময়কালটাকে সম্পূর্ণ ভুলভাবে বিচারের জন্য উপস্থাপিত করে। এটা আরও দুঃখের হিন্দু বুদ্ধিবৃত্তির একটা বড় অংশের চোখে দীর্ঘ ইসলামী সাম্রাজ্যবাদী শাসনের কারণে দাসত্বের চশমা এমনভাবে এঁটে বসে আছে: যেন প্রভু চাইলে দাসকে প্রতিদিন একশো লাথি মারতেই পারে। কিন্তু কদাচিত কোনও দুর্লভক্ষণে প্রভু সামান্য মুচকি হাসলেও দাসেদের কৃতজ্ঞতা তার প্রাপ্য হয়। যদি ইসলাম কৈফিয়তদাতারা ইসলামের মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য এমনটা করে, তবু বোঝা যায়, কিন্তু হিন্দুরাও এই পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করলে সেটা হয় আত্ম-অবনমনের চরম। কোনও ধর্মনিরপেক্ষতার চাদর দ্বারাই এই পাপ ঢাকা যায় না।
এই প্রশ্নটা কেউ শুদ্ধতার প্রচারকারীদের করতেই পারে, মধ্যযুগীয় ভারতে ইসলামের কীর্তিকলাপ যদি এত উজ্জ্বল ও নির্দোষ হয়ে থাকে, তাহলে এটাকে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত চুনকাম করার দরকার পড়ছে কেন? অসংখ্য হিন্দু বীরদের মধ্যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, সমুদ্রগুপ্ত, হরিহর, বুক্কা, মহারাণ প্রতাপ এবং শিবাজি হলে কতিপয় নাম, তাদের তো এভাবে মুখ তুলে ধরার দরকার পড়ছে না। অজস্র মুসলিম শাসকদের মধ্যে প্রকৃষ্ট একজন আলাউদ্দিন খলজি, একজন ফিরোজ শাহ তুঘলক, একজন সিকান্দার লোদি, ও একজন আওরঙ্গজ়েব – এদের কেন ভালত্ব প্রমাণের জন্য কেন সবিস্তারে এত তাড়াতাড়ি মুখে ঘন প্রসাধনীর প্রলেপ দেওয়ার দরকার পড়ছে?
উত্তরটি মধ্যযুগীয় ভারতের মুসলিম ঐতিহাসিকরাই সরবরাহ করেছেন। তারা তাদের নায়কদের ইসলামী আদর্শের নাছোড় পাকা রঙ দিয়ে এঁকেছেন। তারা পূর্বানুমান করতে পারেনি, একদিন ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ কেবল যন্ত্রণাদায়ক অতীতের স্মৃতি হয়ে উঠবে। তারা কল্পনাও করতে পারেনি যে ভারতে ইসলামের কীর্তিকলাপ বা নথি একদিন মানবিক মূল্যবোধের নিক্তিতে ওজন করা হবে। মধ্যযুগীয় ভারতে ইসলামকে তার রক্তলোলুপ ইতিহাস থেকে মুক্ত করার পক্ষে এখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। গোঁড়া মুসলিম ঐতিহাসিকরা কিন্তু একটা ব্যাপারে সৎ – তারা স্পষ্ট বলে যে, মধ্যযুগীয় মুসলিম রাজারা কেবল তখনই ইসলামের হুকুম তামিল করেছিলেন, যখন তাঁরা হিন্দু পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের হত্যা, বন্দী, দাসত্ব শৃঙ্খলে বাঁধা এবং মর্যাদা লঙ্ঘন করেছিল; হিন্দুদের উপাসনা স্থানকে অশুদ্ধ, ধ্বংস ও নিঃশেষ করেছিল; এবং হিন্দুদেরকে তাদের তাদের সমস্ত সম্পদ থেকে উৎখাত করেছিল। কিন্তু আলিগড়ের ঐতিহাসিকরা ও তাদের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী পৃষ্ঠপোষকরা শুধু বাস্তব চরিত্র চিত্রায়নের বদলে কপটতা অবলম্বন করে নানা বৈশিষ্ট্য আরোপ করে গেছেন।
আমি ইতিমধ্যে শাসকের ভূমিকায় আসীন কিছু দিল্লীর সুলতানের হিন্দুদের প্রতি আচরণ সম্পর্কে খুঁজে তথ্য পেয়েছি। এখন প্রাদেশিক মুসলিম অধস্তন শাসক যারা দিল্লীর মসনদে দুর্বল সম্রাট দেখলেই স্বাধীন হয়ে যেত, তাদের আচরণও কোনও অংশে ভালো ছিল না।
প্রাদেশিক মুসলিম সামন্ত শাসক
১৩৯১ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের মুসলমানরা দিল্লীর তুঘলক সুলতান নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদের কাছে অভিযোগ করেছিল যে স্থানীয় গভর্নর ফরহাত-উল-মুলক হিন্দুদের প্রতি সহনশীলতা দেখাচ্ছেন। সুলতান তত্ক্ষণাত মুজাফ্ফর খানকে নতুন গভর্নর নিযুক্ত করলেন। তিনি দিল্লীর সুলতানের মৃত্যুর পরে স্বাধীন হয়ে যান এবং ১৩৯২ খ্রিস্টাব্দে ‘মোজাফফর শাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। পরের বছর তিনি আরেকটি সোমনাথ অভিযানে নেতৃত্ব দেন এবং হিন্দুদের পুনর্নিমিত মন্দিরটি পুনরায় বরবাদ করেন। তিনি হিন্দুদের স্পর্ধার শাস্তি দিতে বহু হিন্দুকে হত্যা করেছিলেন এবং প্রাচীন মন্দিরের স্থানে আবার একটি মসজিদ গড়ে তোলেন। হিন্দুরা অবশ্য এরপরেই মন্দিরটি পুনরায় পুনর্নিমাণ শুরু করে দেয়। ১৪০১ সালে মোজাফ্ফর একটি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরে আসে। তিনি আবার অনেক হিন্দুকে হত্যা করেন এবং আবারও মন্দিরটি ধ্বংস করে আর একটি মসজিদ নির্মাণ করান। মোজাফ্ফরের পর তাঁর নাতি আহমদ শাহ ১৪১১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিন বছর পরে আহমদ গুজরাটে সমস্ত মন্দির ধ্বংস করার জন্য একটি বিশেষ ‘দারোগাহ’ (dãrogah) নিযুক্ত করেছিলেন। ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দে আহমদ সিদ্ধপুরে আক্রমণ করে রুদ্রমহালয়ার সবকটি চিত্র ধ্বংস করে দেন এবং মহা মন্দিরটিকে শেষে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। সিদ্ধপুরের নতুন নামকরণ করা হয় সৈয়দপুর।
১৪৫৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুলতান হয়ে ওঠা মাহমুদ বেগরা ছিলেন এই রাজবংশের নিকৃষ্টতম ধর্মান্ধ। তাঁর অন্যতম সামন্ত ছিলেন জুনাগড়ের মণ্ডলিকা যিনি কখনও নিয়মিত নজরানা দিতেন না। ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ জুনাগড় আক্রমণ করেন। মন্ডলিকার প্রতিবাদের জবাবে মাহমুদ বলেছিলেন, যে তিনি টাকার প্রতি ততটা আগ্রহী নন, যতটা আগ্রহী ইসলামের প্রসারে। মণ্ডলিকাকে জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল এবং জুনাগড়ের নামকরণ করা হয় মুস্তাফাবাদ। ১৪৭২ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ দ্বারকা আক্রমণ করে স্থানীয় মন্দিরগুলি ধ্বংস করেন এবং শহর লুণ্ঠন করেন। চম্পানরের শাসক রাজা জয়সিংহ ও তাঁর মন্ত্রীকে পরাজিত করার পরে তাঁদের দেশে চুরি ডাকাতি লুণ্ঠণের পর দু’জনকে ইসলাম গ্রহণ করতে না চাওয়ায় ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়। আর চম্পানরের নামকরণ করা হয় মাহমুদাবাদ।
মালওয়ার মাহমুদ খলজিও (১৪৩৬-৬৯ খ্রিস্টাব্দ) হিন্দু মন্দিরগুলি ধ্বংস করে তাদের স্থলে মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন। তিনি হিন্দুদের ওপর আরও অনেক অপমান স্তূপীকৃত করেন। বাংলার ইলিয়াস শাহ (১৩৩৯-১৩৭৯ খ্রিস্টাব্দ) নেপাল আক্রমণ করে কাঠমান্ডুর স্বয়ম্ভুনাথের মন্দিরটি ধ্বংস করে ফেলেন। তাছাড়া উড়িষ্যা আক্রমণ করেও অনেক মন্দির ভেঙে দেন এবং অনেক জায়গা লুঠপাট চালান। গুলবার্গা ও বিদরের বাহমনি সুলতানরা প্রতিবছর এক লক্ষ হিন্দু পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের হত্যা করাকে অত্যন্ত গৌরবের মনে করত। তারা পুরো দক্ষিণ ভারত জুড়ে মন্দিরগুলি ভেঙে ফেলে এবং অপবিত্র করে।
বাবর
লোদি ও রাজপুতদের বিরুদ্ধে বাবর বিজয়ী হয়ে আসার পরে দৃশ্যপট আরেকবার দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয়েছিল। পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কাছ থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা তাঁর প্রতিকূলতার মধ্যে ধৈর্য, প্রবল বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও সাহস, বহু নদীতে তাঁর সাঁতরানো, ফুল ফলের প্রতি ভালবাসা ইত্যাদির ইত্যাদির জন্য বিশেষ মর্যাদা ও অনেক প্রশংসা পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর মুখপত্র, নিজেরই লেখা জীবনী বা তুজ়ুক-ই-বাবুরি (Tuzuk-i-Bãburî) তাঁর সহজাত নিষ্ঠুরতা ও সন্ত্রাসের ছবি তুলে ধরে সেই ভাবমূর্তীর অপরণীয় ক্ষতি করে। তিনি তাঁর কাফেরদের বারবার গণহত্যার যে বিবৃত বিবরণ দিয়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই যে তিনি তার কৃতকর্মের জন্য যারপরনাই গর্বিত ছিলেন। হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় ও পরে হিন্দুদের মাথা কেটে উঁচু স্তূপ তৈরি করার কাজটা বাবর বিশেষ পছন্দ করতেন। নিজের রাজকীয় তাঁবুতে বসে এই চমকপ্রদ দৃশ্যটি দেখতে বিশেষ পছন্দ করতেন। বন্দীদের তাঁর সামনে হাজির করা হত তাঁকে বীর তরোয়ালবাজদের দ্বারা কৃত জবাই দেখানোর জন্য। একসময়, মাটিতে এত রক্ত প্রবাহিত হয়েছিল এবং কাঁপতে থাকা শবদেহে তাঁবু এতটাই পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, যে তাঁর তাঁবুটি তিনবার উচ্চ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়। তিনি যুদ্ধবন্দীদের কারাবন্দী করা ও লুঠতরাজের একটিও সুযোগ নষ্ট করেননি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশে প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর বাদশার কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিজেদের গাজ়ী অর্থাৎ কাফেরদের হত্যাকারী সাব্যস্ত করা। রানা সংগ্রাম সিংয়ের সাথে যুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি যখন মদের পাত্র ভেঙে ফেলেছিলেন, তখনই তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি একইভাবে কাফেরদের প্রতিমাগুলোও ভেঙে ফেলবেন। সুতরাং যেখানেই মন্দির দেখতেন, তা ধ্বংস করে ফেলতেন।
শের শাহ সুর
শের শাহ সুরসের নামটি আমাদের পাঠ্যপুস্তকে উল্লেখ করা হয় পেশোয়ার থেকে ঢাকা অবধি গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের মতো রাজপথ, কাফেলার সারি ও অন্যান্য কল্যাণমূলক প্রকল্পের সাথে জড়িত হিসাবে। এটা সত্য যে, তিনি দিল্লীর সম্রাট হওয়ার আগে হিন্দুদের সহজাত অভ্যাসবশত নির্যাতন করতেন না। কিন্তু তিনি সর্বোচ্চ শাসক হওয়ার সময় ইসলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে রায়সেনে তার প্রমাণ মেলে। শায়খ নুরুল হক তাঁর ‘জুবদাত-উল-তাওয়ারিখ’ (Zubdat-ul-Tawãrîkh) গ্রন্থে নথিভুক্ত করেছেন নিম্নরূপ: ৯৫০ হিজরিতে পুরানমাল রায়সেন দুর্গে দখল করেন। তাঁর হারেমে এক হাজার মহিলা ছিল যার মধ্যে বেশ কিছু মুসুলমানী ছিল যাদের তিনি তাঁর সামনে নাচাতেন। মুসুলমান আত্মাভিমান ও মর্যাদাবোধ নিয়ে শের খান দুর্গটি জয় করার সংকল্প করেছিলেন। এই কাজে বেশ কিছুটা সময় বিনিয়োগের পর একটি আবাসন নির্মাণ প্রস্তাবিত হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত স্থির হয়, যে পুরাণমাল তার পরিবার ও শিশুদের সঙ্গে এবং ৪০০০ বিশিষ্ট রাজপুতকে নিয়ে দুর্গটিতে অসম্মানিত না হয়ে থাকতে পারবেন। ইসলামি আইন জানা বেশিরভাগ লোকই কিন্তু রাজপুতদের মেরে ফেলার পক্ষপাতী বলে মতামত দিয়েছিল চুক্তি কী হয়েছে তাতে গুরুত্ব না দিয়ে। ফলস্বরূপ পুরানমালের শিবিরটিকে মুসলিমদের পুরো সেনাবাহিনী হাতি নিয়ে ঘিরে ফেলে। রাজপুতরা তুমুল সাহসিকতার সাথে মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করেছিল। নিজেদের মহিলা ও শিশুদের হত্যা করে তাদের পুড়িয়ে দেওয়ার পরে তারা যুদ্ধে ছুটে এসে মৃত্যুবরণ করে।
আকবর
ইসলামের সেবায় নিবেদিত থাকতে গিয়ে হুমায়ুন কখনই ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে পারেননি। তবে তাঁর পুত্র আকবর একটি গাজ়ি হিসাবে শুরুটা ভালোই করেন। পানিপতের দ্বিতীয় যুদ্ধের পরে তিনি অর্ধ-মৃত হিমুকে তরোয়াল দিয়ে কুপিয়েছিলেন। এর পরে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈরাম খানের নেতৃত্বে আরও অনেক ইসলামের যোদ্ধা ছিলেন যারা মৃতদেহগুলিকেও ছিন্নভিন্ন করতে ছাড়েনি। ১৫৬৮ সালে আকবর চিত্তোর দুর্গের পতনের পরে একটি সাধারণ গণহত্যার নির্দেশ দেন। আবুল ফজ়ল তাঁর ‘আকবর-নামায়’ নথিকৃত করেছেন এইভাবে: “দুর্গে ৮,০০০ যুদ্ধরত রাজপুত সংগ্রহ করা হয়েছিল, কিন্তু সেখানে ৪০,০০০-এরও বেশি কৃষক ছিল যারা দেখাশুনো ও পরিচর্যায় অংশ নিয়েছিল। কাকভোর থেকে মধ্যাহ্ন অবধি প্রতিকূল নক্ষত্রের দুর্ভাগাদের মৃতদেহ মহান যোদ্ধা মহা উৎসাহে গ্রাস করে ফেলেছিলেন। প্রায় ৩০,০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। ছয় মাস সাত দিন পরে সুলতান আলাউদ্দিন (খলজি) দুর্গটি গ্রহণ করলে কৃষকরা যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়ায় তাদের হত্যা করা হয়নি। তবে এই উপলক্ষে তারা দুর্দান্ত উদ্যোম এবং কর্মোদ্যোগ দেখিয়েছিল। জয়লাভের পরে কিন্তু তাদের নিষ্ক্রিয়তার অজুহাত ফলপ্রসূ হয়নি। সুলতান একটি সাধারণ গণহত্যার জন্য আদেশ দিয়ে দেন। এভাবেই আলাউদ্দিন খলজির কীর্তিকলাপের তুলনায় আকবরের চরিত্রের উন্নতি ঘটে। যুদ্ধ দেখা এবং যোদ্ধাদের সেবা করাকে যুদ্ধের কাজ হিসাবে পুনর্ব্যাখ্যা করা হয়েছিল! (Watching the war and serving the warriors were re-interpreted as acts of war!) সর্বোপরি আকবরের তাড়াহুড়ো করে আজমীরের দিকে যাত্রা করে আল্লাহ ও রসূল এবং তাঁর (আকবরের) পৃষ্ঠপোষক সুফি মইনিদ্দিন চিস্টিতে অসংখ্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। একটি ফতহ্নামা (Fathnãma) জারি করলেন যাতে কুরআনের অনেক উপযুক্ত আয়াত উদ্ধৃত করা ছিল, যার দ্বারা প্রমাণিত হয়, যে তিনি বিশ্বস্তভাবেই রসুলের পদক্ষেপ অনুসরণ করেছিলেন।
জাহাঙ্গীর
জাহাঙ্গীর ছিলেন মূলত মাতাল ও ধর্ষকামী বদমাশ। মসনদে আরোহণের সময় নবাব মুর্তাজা খানকে শরিয়ত পালনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা রক্ষা করতে মোটেই যত্নশীল ছিলেন না। নারী ও সুরার পেয়ালায় এতটাই মত্ত থাকতেন, যে আল্লা ও নবীর কথা খেয়াল থাকত না। কিন্তু তিনি ধর্মান্তরিতদের দৈনিক ভাতা দিয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে উত্সাহ দিতেন। তাঁর রাজত্বের প্রথম বছরেই তিনি গুরু অর্জুন দেবকে অত্যাচার করে হত্যা করেছিলেন। বাদশার হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা তাঁর তুজ়ুক-ই-জাহাঙ্গিরী (Tuzuk-i-Jahãngîrî:)-তে খুব স্পষ্ট: “বিয়াস নদীর তীরে গোবিন্দওয়ালে অর্জুন নামে এক হিন্দু সাধুদের আড়ালে ঐশ্বর্যশালীর ভান করে থাকত। চারদিক থেকে গো-বালক ও বোকারা তার দ্রুত অনুগামী হয়ে উঠল। ব্যবসায়টি তিন বা চার প্রজন্ম ধরে প্রসার লাভ করেছিল। দীর্ঘদিন ধরেই আমার মনে হচ্ছিল যে এই ‘দুকান-ই-বাতিল’ (মিথ্যাচার বা ভণ্ডামি) বন্ধ করে দিয়ে তাকে ইসলামের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসা দরকার। অন্য সূত্রে পাওয়া যায়, তিনি গুরুকে ‘আদি গ্রন্থ’-এ কিছু কোরানের ‘সুরহা’ অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছিলেন যা গুরু অর্জুন সিং করতে অস্বীকার করেন। তাঁর রাজত্বের অষ্টম বছরে, তিনি আজমীরের ভাগবত মন্দিরটি ধ্বংস করে ফেলেছিলেন। তিনি গুজরাটে জৈনদের উপর অত্যাচার শুরু করে আদেশ দেন, যাতে জৈন সন্ন্যাসীদের মৃত্যুর যন্ত্রণা তাঁর রাজ্যে দেখা না যায়। অবশেষে, তিনি মন্দিরময় শহর কাংরায় মন্দিরের সংখ্যা কমানোর জন্য মুর্তাজা খানকে পাঠান। অবরোধ চলেছিল ২০ মাস ধরে, যার পরিসমাপ্তি হল নিজে কাংরায় গিয়ে হিন্দুদের পবিত্রস্থানে গরু জবাই করার মাধ্যমে। শেষে এমন মসজিদ নির্মাণ করান যার আগে কোনও অস্তিত্ব ছিল না।
শাহ্ জাহান
১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে শাহ জাহানের রাজত্বের একেবারে শুরুতেই পেন্ডুলামটী ইসলামের প্রকৃত চেতনার দিকে ঝুলতে শুরু করে। এর বাহ্যিক প্রতীকটি ছিল সম্রাটের মুখে দাড়ি। আবদুল হামিদ লাহোরি তাঁর বাদশাহনামায় (Bãdshãhnãma) লিখেছেন: “এটি মহামহিমের নজরে এনে দেওয়া হয়েছিল, যে তাঁর রাজত্বকালের শেষ দিকে অনেক মূর্তি ও মন্দির নির্মাণ শুরু হয়েছিল, কিন্তু কাফেরদের সবচেয়ে বড়ো গড় বেনারসে কাজটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। কাফেররা এখন সেগুলি সম্পন্ন করতে আগ্রহী ছিল। বিশ্বাসের রক্ষাকারী মহামহিম আদেশ দিয়েছিলেন, যে বেনারস ও তাঁর সাম্রাজ্য বা আধিপত্যভুক্ত সমস্ত জায়গায়, যেসব মন্দির নির্মাণ শুরু হয়েছে তা অবিলম্বে ফেলে দেওয়া উচিত। এলাহাবাদ প্রদেশ থেকে খবর এল, বেনারস জেলায় ৭৬ টি মন্দির ধ্বংস করা হয়ে গেছে। সময়টা ছিল ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দ।
১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে শাহ জাহান বিন্দেলা রাজবংশের কিছু পুরনারীকে আটক করেন, কারণ যাজহর সিং ও তাঁর পুত্ররা সময়মতো তাদের সম্মানরক্ষার জন্য হত্যা করতে পারেনি। যদুনাথ সরকারের কথায়, “রাজাদের মা ও কন্যাদের ধর্ম ছিনিয়ে নিয়ে তাদের মুঘল হারেমের কুখ্যাত জীবনযাপন করতে বাধ্য করা হয়েছিল।” শাহজাহান নিজেই বুন্দেলাদের রাজধানী অর্চায় একটি বিজয়সূচক প্রবেশ করেছিলেন, বীরসিং দেবের সুউচ্চ বিশাল মন্দির ধ্বংস করেছিলেন এবং তার জায়গায় একটি মসজিদ উত্থাপন করেছিলেন। যুজা সিংহের বয়সী দুই পুত্র ও এক নাতিকে ধরে তাদের মুসালমান করা হয়। যুজার সিংহের অপর ছেলে উদয়ভান এবং একজন মন্ত্রী শ্যাম দাওয়া পালিয়ে পালিয়ে গোলকোণ্ডায় চলে গেলে সেখঅনে থেকে কুতুল-মুলক তাঁদের ধরে নিয়ে গিয়ে শাহ জাহানের কাছে প্রেরণ করে। ‘বাদশাহনামা’ অনুযায়ী পূর্ণবয়স্ক উদয়বান ও শ্যাম দাওয়াকে ইসলাম অথবা মৃত্যুর মধ্যে একটি বিকল্পকে বেছে নিতে বলা হয়। তাঁরা পরেরটিই বেছে নেওয়ায় তাঁদের জাহান্নামেই পাঠানো হয়।
আওরঙ্গজ়েব
আওরঙ্গজ়েবের আগমনের পর তাঁর আমলের শেষের দিকে আকবর দ্বারা ‘সুলাহ্-ই-কুল’ (sulah-i-kul) বা সকলের সঙ্গে শান্তি নীতি পুরোপুরি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে উল্টো পথ ধরল। আওরঙ্গজ়েব দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণের ১৩ বছর পূর্বে ‘বাট-শিকান’ (আইকনোক্লাস্ট) হিসাবে তাঁর কেরিয়ার শুরু করেছিলেন। মিরত-ই-আহমাদী (Mirãt-i-Ahmadî) অনুযায়ী, গুজরাটের সারশপুরের নিকটে অবস্থিত ‘চিন্তামন’ মন্দিরটি ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজ আওরঙ্গজ়েবের নির্দেশে কুওয়াত-উল-ইসলাম (Quwwat-ul-Islãm ) যার অর্থ ইসলামের শক্তিশালী ঘাঁটি নামে একটি মসজিদে রূপান্তরিত হয়েছিল। উদযাপনটি গৌরবান্বিত করার জন্য একটি গরুকে জবাই করা হয়। তিনি রাজা হওয়ার তিন বছর পরে তিনি মীর জুমলাকে একটি অভিযানে কোচবিহারে প্রেরণ করেছিলেন। মীর জুমলা সেই শহরের সমস্ত মন্দির ভেঙে দিয়েছিলেন এবং তাদের জায়গায় মসজিদ স্থাপন করেছিলেন। সেনাপতি নিজেই নারায়ণের ভাবমূর্তি ভাঙার জন্য স্বহস্তে যুদ্ধের কুঠার চালিয়েছিলেন।
১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেবকে খবর দেওয়া হয়, যে তিনি তাঁর তত্বাবধানে গুজরাটের যে মন্দিরগুলি ভেঙে ফেলেছিলেন তা হিন্দুরা পুনর্নির্মাণ করেছে। তিনি তত্ক্ষণাৎ গুজরাটের রাজ্যপালকে একটি ফরমান জারি করেন যার বক্তব্য ছিল: “আমার মসনদে আরোহণের আগে আমার আদেশে আহমেদাবাদ ও অন্যান্য পরগণায় মন্দিরগুলো ধ্বংস করা হয়েছিল। সেগুলো সারিয়ে আবার প্রতিমা পুজো শুরু হয়েছে। পূর্বের আদেশটি পালন করুন।” ১৬৬৬ সালে তিনি মথুরার ফৌজদারকে একটি প্রস্তর প্রাকার অপসারণের নির্দেশ দেন যেটা দারাশুকো কেশব রাইয়ের মন্দিরের জন্য উপহার দিয়েছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন: “মুসলিম বিশ্বাসে কোনও মন্দিরের দিকে তাকানোও পাপ, আরা এই দারা কিনা মন্দিরের প্রাচীর পুনরুদ্ধার করেছেন!”
১৬৬৯ সালের এপ্রিল মাসে হিন্দু মন্দিরগুলির সম্পর্কে একটি সাধারণ নীতি ঘোষিত হয়েছিল। মাশির-ই-আলমগীরি (Maasir-i-Ãlamgîrî )-র নথি অনুযায়ী: “১০৭৯ সাল জিল কড়ার ১৭ তারিখে (১৭ই এপ্রিল ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দ) এটি বিশ্বাসের রক্ষক মহামান্যের কানে পৌঁছয় যে, প্রদেশে থট্টা, মুলতান এবং বেনারস, বিশেষ করে শেষেরটিতে নির্বোধ ব্রাহ্মণরা তাদের বিদ্যালয়ে অপ্রয়োজনীয় বইয়ের ব্যাখ্যার অভ্যাস করছে এবং হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা দূর দূরান্ত থেকেও সেখানে যাচ্ছে শয়তানি বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আকাঙ্খায়। ফলস্বরূপ বিশ্বাসের রক্ষাকর্তা প্রদেশ শাসকদের হুকুম জারি করেন, সেইসব কাফেরদের বিদ্যালয় ও মন্দিরগুলো উৎসাহী হাতে ভেঙে ধ্বংস করে দেওয়া হোক এবং মূর্তি উপাসনা করা ও শিক্ষা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হোক। কাফেরদের স্কুল এবং মন্দিরগুলি ইচ্ছামতো হাতে প্রদেশের সমস্ত গভর্নরকে আদেশ জারি করেছিলেন এবং তাদেরকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে তারা মূর্তিপূজা উপাসনার শিক্ষা এবং অনুশীলনকে পুরোপুরি থামিয়ে দেবে। ১৫ রবিউল-আখিরে (সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে) মহান ধর্মরক্ষক সম্রাটের কাছে সংবাদ পৌঁছোয়, একীকরণের নেতারা তাঁর আদেশ পালন করে সরকারি আধিকারিকদের দ্বারা বেনারসের বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করে ফেলেছে।”
মাশির-ই-আলমগীরি আরও বলেছে: “৯৮০ হিজরি অব্দের রমজান মাসে (জানুয়ারী ১৬৭০) এই ন্যায় বিচারের পরাকাষ্ঠা, অত্যাচারীদের শত্রু সম্রাট মথুরার দেহরা কেশব রাই নামে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করার আদেশ দেন এবং তারপর অতি সত্ত্বর মিথ্যার শক্ত ঘাঁটিকে মাটিতে মিশিয়ে ফলা হয়। একই আয়গায় প্রচুর ব্যয় করে একটি মসজিদের ভিত তৈরি করা হয়।” বলা বাহুল্য কৃতিত্ব ইসলামে বিশ্বাস সৃষ্টিকারী আল্লাহকেই দিতে হয় যঁর জন্য মিথ্যা দেবতাদের ধ্বংস করে বিশ্বাস স্থাপনের কঠিন কাজটা সফল হয়েছিল। কাফের মন্দিরগুলি থেকে নেওয়া প্রচুর রত্নখচিত মূর্তিগুলিকে আগ্রাতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল এবং সেখানে নবাব বেগম সাহেবের (জাহানারা) মসজিদে যাওয়ার পায়ে হাঁটা পথের নীচে স্থাপন করা হয়েছিল যাতে প্রকৃত বিশ্বাসীরা তাদের পায়ে চেপে রাখতে পারে। মথুরার নাম পরিবর্তন করে ইসলামাবাদ রাখা হয় এবং এভাবে যাবতীয় আধিকারিক নথিতেই এই নামটি প্রচলিত হয়ে পড়ে।
একই বছরে, সোরনের সিতারামজি মন্দির ও গোন্ডার দেবী পাটনের সমাধি মন্দিরটিও ধ্বংস করা হয়েছিল। মালওয়া থেকেও খবর এলো যে স্থানীয় প্রদেশ শাসক উজ্জয়িনীর আশেপাশের সমস্ত মন্দির ধ্বংস করার জন্য ৪০০ জন সৈন্য পাঠিয়েছে। মুরাকত-ই-আবুল হাসানের (Muraqãt-i-Abul Hasan) মতে নগরের আধিকারিক, জায়গিরদার, কররি ও আমলাদের দালালদের ওড়িশার কটক থেকে বাংলার মেদিনীপুর পর্যন্ত এজন্য এরূপ নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল: “১০ বা ১২ বছরের মধ্যে নির্মিত সমস্ত প্রতিটি প্রতিমার বাড়ি বিলম্ব না করে ভেঙে ফেলা উচিত। তাছাড়াও, হিন্দু এবং ঘৃণ্য কাফেরদের তাদের বিচূর্ণ পুরানো মন্দিরগুলি মেরামত করতে দিও না। কাজ়িদের সীলমোহরে মন্দির ধ্বংসের রিপোর্ট আদালতে প্রেরণ করা উচিত এবং পবিত্র শেখদের দ্বারা প্রত্যায়িত হওয়া উচিত।
১৬৭২ সালে মেওয়াটের নারনৌলের কাছে বেশ কয়েক হাজার সাতনামিকে হত্যা করা হয়েছিল, যে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য রদনদাজ় খান ও শুজাতাত খান ৩০০০ ও ২০০০ ঘোড়ার মনসব নিয়ে জুটি বাঁধে। ১৬৭৫ সালে কাশ্মীরের হিন্দুদের বলপূর্বক ধর্মান্তরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার জন্য গুরু তেগ বাহাদুরকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপরে গুরুদ্বারদের ধ্বংস একটি সুপরিচিত কাহিনী যা আমাদের ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা অবদমন করতে সফল হয়েছে, কারণ আকালি মার্কা শিখরা তাদের পিতামাতার বিশ্বাস হিন্দু ধর্মের বিপরীতে গিয়ে ইসলামের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করে চলেছে।
১৬৭৯ ছিল ‘প্রকৃত বিশ্বাস’-এর জন্য জয়ের বর্ষ। ইসলাম প্রসার ও কাফেরত্ব চর্চার মাসুল হিসাবে ২ এপ্রিল জিজ়িয়া (jizyah) কর পুনরায় আরোপিত হয়। দিল্লী ও আশপাশের হিন্দুরা এক শুক্রবার একটি বিক্ষোভের আয়োজন করে এবং আওরঙ্গজ়েবকে জামি মসজিদে যাওয়ার পথে আটকে দেয়। শক্তিশালী মুঘল সম্রাট তাঁর হাতিগুলিকে জনতার ওপর চালিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলে অনেকে পদদলিত হয়ে মারা যায়। শিবাজিও দূর মহারাষ্ট্র থেকে একটি প্রতিবাদ করে চিঠি লিখেছিলেন। তবে তা পড়ে বধির কানে। ‘মীর-ই-আহমাদী’র নথি জানাচ্ছে: দারব খানকে একটি শক্তিশালী বাহিনী দিয়ে খাণ্ডেলার রাজপুতদের শাস্তি দিতে এবং সেই জায়গার মহান মন্দিরগুলি ভেঙে দেওয়ার জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। তিনি ৮ মার্চ ১৬৭৯-তে সেই স্থান আক্রমণ করে খাণ্ডেলা ও সানুলার মন্দিরগুলো এবং প্রতিবেশীর এলাকার সমস্ত মন্দির ভেঙে ফেলেন। ‘মাশির-ই-আলমগীরি’ আরও বলেছে: ১৬৭৯-র ২৫শে মে ১ খাঁ জাহান বাহাদুর যোধপুর থেকে অনেকগুলো মূর্তি বোঝাই টানা গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন, যেগুলো ভেঙে ফেলা হিন্দু মন্দির থেকে সংগৃহিত ছিল। মহিমময় সম্রাট তাকে মহান প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। এই প্রতিমাগুলির বেশিরভাগই মূল্যবান রত্নখচিত ছিল। আদেশ দেওয়া হয়েছিল সেগুলোর কিছু দপ্তরের বাইরের অফিসে ফেলে দেওয়া হোক এবং বাকিগুলো প্রকাণ্ড মসজিদের সিঁড়ির নীচে রেখে দেওয়া হোক, যাতে সেখানে পায়ের নীচে দেবমূর্তিগুলো পদদলিত হতে পারে। সেখানে তারা দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিল যতক্ষণ না আর কিছু করার থাকে।
১৬৮০ খ্রিস্টাব্দ ইসলামের জন্য সমান সমৃদ্ধির ফসল বয়ে আনে। ‘মাশির-ই-আলমগীরি’ থেকেই আরও পাওয়া যায়: ১৬৮০-র ৬ই বাদশাজাদা মোহাম্মদ আজ়ম এবং খান জাহান বাহাদুর উদয়পুরে যাওয়ার অনুমতি পান। রুহুল্লাহ খান এবং ইয়াক্কাত্জ খানও মুশরিকদের মন্দিরগুলির ধ্বংসের উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়েছিলেন। রানার প্রাসাদের আশেপাশে অবস্থিত এই স্থাপত্যগুলো ছিল একএকটা বিস্ময়কর সৃষ্টি যেগুলো নিজেদের সম্পদ ও জীবন লুটিয়ে নির্মাণ করেছিল হিন্দুরা। যোদ্ধারা সমস্ত ছবি নষ্ট করে ফেলে। ২৪শে জানুয়ারী রাজা উদয়সাগরের পুষ্কর্ণীটি পরিদর্শন করেন। জ়িল্লে ইলাহী আদেশ দেন তিনটি হিন্দু মন্দিরকেই মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। ২৯ শে জানুয়ারী হাসান আলী খান উপস্থিত হয়ে ঘোষণা করলেন প্রতিবেশী জেলাগুলির ১৭২ টি মন্দির ধ্বংস করা হয়ে গেছে। মহামান্য ২২শে ফেব্রুয়ারী চিত্তোরে এগিয়ে গেলেন। ৬৩টি মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল। আবু তরব যার ওপর এইসব মন্দির মূর্তি ধ্বংস করার দায়িত্ব ছিল, তিনি ১০ আগস্ট ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছিলেন যে ৬৬টি মন্দির ভূলিণ্ঠিত করা হয়েছিল। পশ্চিম মেওয়ারের সোমেশ্বরের মন্দিরও একই বছর পরের দিকে ধ্বংস করা হয়েছিল। প্রসঙ্গত যোধপুর এবং উদয়পুরের বিপরীতে অম্বর ছিল মুঘল সম্রাটের প্রতি অনুগত এক রাজ্যের রাজধানী ছিল।
কলিমত-ই-তাইয়েবত (Kalimãt-i-Tayyibãt) মতে, আওরঙ্গজেব জুলফিকার খান এবং মোগল খানকে লিখেছিলেন যে, “যে কোনও সময় যে কোনও মন্দির ধ্বংস করা সম্ভব, কারণ এটি নিজের স্থান থেকে দূরে সরে যেতে পারে না।” তা সত্ত্বেও মহারাষ্ট্রের মন্দিরগুলির কাঠিন্যতে তিনি বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন। ‘কালিমাত-ই-আওরঙ্গজ়েব’ রুহুল্লাহ খানকে তাঁর নিম্নলিখিত বার্তার পুনঃপ্রকাশ করেছে: “এই দেশের বাড়িগুলি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং একমাত্র প্রস্তর ও লোহা দ্বারা নির্মিত। আমার পদযাত্রা চলাকালীন সরকারের কুঠারবাহী পুরুষরা পথে চোখে পড়া মুশরিকদের মন্দিরগুলি ধ্বংস করে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত জনবল ও সময় পায় না। আপনার এমন একটি দারোগা নিয়োগ করা উচিত যে পরে অবসর সময়ে তাদের ধ্বংস করতে পারে এবং তাদের ভিত্তিগুলি খনন করতে পারে।” আওরঙ্গজ়েব অবশ্য নিজেই একবার এমন দারোগা হিসাবে কাজ করেছিলেন। ‘কলিমত-ই-আওরঙ্গজ়েব’-এ তিনি নিজেই প্রতিবেদন লিখেছেন: “আওরঙ্গাবাদের নিকটবর্তী সাতারা গ্রাম ছিল আমার শিকারের জায়গা। এখানে পাহাড়ের চূড়ায় ‘খান্দে রাই’য়ের একটি সচিত্র মন্দির দাঁড়িয়েছিল। আল্লাহর রহমতে আমি এটিকে ভেঙে দিয়েছি এবং মন্দিরের নৃত্যশিল্পীদের তাদের লজ্জাজনক বাণিজ্য করতে নিষেধ করেছি।”
দীর্ঘ দক্ষিণাত্য অভিযানের চলাকালীন হিন্দু মন্দিরগুলি ভেঙে দেওয়া ছিল আওরঙ্গজেবের অন্যতম অবসর বিনোদন। খাফি খাঁ তাঁর মুনতাখব-উল-লুবাব-এর (Muntakhãb-ul-Lubãb) গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন: “গোলকোন্ডা দখল করার পরে, সম্রাট আব্দুর রহিম খানকে হায়দারবাবাদ শহরের সেন্সর হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন কাফের রীতি ও উদ্ভাবন দমন করার জন্য, এবং মন্দিরগুলি ধ্বংস করে মসজিদ নির্মাণের আদেশ দিয়ে।” সেটা ছিল ১৬৮৭ খ্রিস্টব্দ। ১৬৯০ সালে তিনি ইলোরা, ত্র্যম্বকেশ্বর, নরসিংহপুর এবং পান্ধারপুরে মন্দির ধ্বংসের নির্দেশ দেন। ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে অনুরূপ গল্প বিজাপুরে পুনরাবৃত্ত হয়েছিল। মীরাত-ই-আহমাদীর (Mirãt-i-Ahmadî) সূত্রে জানা যায়: “হামিদ-উদ্দিন খান বাহাদুর যিনি বিজাপুরের মন্দিরগুলি ধ্বংস করতে ও সেখানে মসজিদ নির্মাণের জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন, আদেশ কার্যকর করার পরে আদালতে ফিরে এসে সম্রাটের দ্বারা প্রশংসিত হন।” ১৭০৫ সালে মৃত্যুর দুই বছর পূর্বে, সম্রাট কুঠার-পুরুষদের দারোগা মুহম্মদ খলিল এবং খিদমত রায়কে ডেকে পাঠিয়েছিলেন পান্ধারপুর মন্দির ভেঙে দেওয়ার এবং তারপর সেখানে শিবিরের কসাইদের নিয়ে গরু জবাই করার জন্য। মন্দিরের স্থানে গরু জবাই ছিল হিন্দুদের ঐ একই জায়গায় মন্দির পুনর্নির্মাণের বিরুদ্ধে একটা রক্ষাকবচ।
এই গল্প পরবর্তীকালে মুসলিম রাজা ও সর্দারদের দ্বারা সংঘটিত একই রকম অপরাধের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে আমি এটি প্রলম্বিত করছি না, কারণ বর্তমানে আমার বিষয়বস্তুটি মুসলিম শাসনের অধীনে মধ্যযুগীয় ভারত, যা আওরঙ্গজ়েবের মৃত্যুর সাথে সাথে অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল।
মধ্যযুগীয় মুসলিম ঐতিহাসিকরা মুসলিম রাজাদের যে পরিমাণ অপরাধ সংঘটনের জন্য কৃতিত্ব দিয়েছিলেন, তা পরিমাপের বাইরে ছিল। কিছু ব্যতিক্রম বাদে, মুসলিম রাজা ও সেনাপতিরা ছিল দানব যারা তাদের হিন্দু প্রজাদের বেলা কোনও অপরাধ করা থেকেই বিরত থাকেনি। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেগুলো মনে হয়, সেগুলো হ’ল এই অপরাধগুলির বিস্তৃত বিন্যাস বা নকশা। নকশাটি হল এক জিহাদের, যেখানে ইসলামের গাজ়ীদের কাজ ছিল ১) কাফের দেশে আক্রমণ করা; ২) বিজয় অর্জনের পরে যতটা সম্ভব কাফের পুরুষ, নারী ও শিশু, বিশেষত ব্রাহ্মণদের গণহত্যা করা; ৩) বেঁচে থাকা লোকদের দাস হিসাবে বিক্রয় করা; ৪) সম্ভাব্য প্রতিটি জায়গা ও ব্যক্তিকে লুণ্ঠন করা; ৫) মূর্তিপূজারীদের উপাসনাগৃহের জায়গায় মসজিদ নির্মাণ করা; এবং ৬) মূর্তিগুলি অশুচি করার জন্য সেগুলো জনসাধারণের পদচারণার জায়গায় বা সিঁড়িতে বিছিয়ে দেওয়া।
তারপরেও আরও তাত্পর্যপূর্ণ বিষয়টি হল এই প্যাটার্নটা হুবহু ১) কুরআনে আল্লাহর দ্বারা অবতীর্ণ; ২) নবীর নিজের জীবনকালে তাঁর নিজের দ্বারা অনুশীলিত, সিদ্ধ ও নির্ধারিত; ৩) ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের প্রথম ৩৫ বছরে ইসলামের ধার্মিক খলিফাদের দ্বারা অনুসৃত; ৪) হাদিসে বিশদভাবে বিবৃত এবং কয়েকশত ভাষ্য দ্বারা বিশদভাবে মনোযোগ সহকারে বর্ণিত; ৫) আমাদের নিজস্ব সময় সহ সকল যুগে উলেমা ও ইসলামের সূফীদের দ্বারা প্রত্যয়িত; এবং ৬) সমস্ত মুসলিম রাজা ও সামন্ত সর্দার যারা এই জীবনে নাম খ্যাতি ও হুরদের জন্য লালায়িত ছিল, এবং দাড়িহীন ছেলেদের দ্বারাও অনুসৃত।
সুতরাং, ইসলামী তুর্কীদের একাই বর্বর বলে দোষী করা ইসলামকে ক্ষমা করার ফিকির ছাড়া কিছু নয়। আরব, তুর্কী, পার্সী, পাঠান, ধর্মান্তরিত হিন্দু – যে সমস্ত জাতি ও সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করেছিল বা করতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের দ্বারাই এই বর্বরতা সমানভাবে পালিত হয়েছিল। উপসংহারে অনিবার্যভাবে এটাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়, যে ইসলামের তার গ্রহণকারী বা অনুসারীদের সকলকেই বর্বর করে তোলে। এবং দোষটিকে সেখানেই সকল যুক্তি ও ন্যায়বিচারের মধ্যে রাখা উচিত।
আমরা এখন এনসিইআরটি গাইডলাইনে ফিরে যেতে পারি যা দাবি করে যে মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমানদের দ্বন্দ্বকে ধর্মীয় নয় বরং রাজনৈতিক হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। দ্বন্দ্বের এমন চরিত্রায়নের মধ্যে কোনও যৌক্তিকতা নেই। মুসলমানরা অন্তত নিশ্চিত ছিল, যে তারা হিন্দু কাফেরদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় যুদ্ধই চালাচ্ছে। বিরোধটি কেবল তখনই রাজনৈতিক হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে, যদি এনসিইআরটি এই অত্যন্ত বৈধ প্রস্তাবটি স্বীকার করে, যে ইসলাম কখনই ধর্ম ছিল না, এবং এটি শুরু হয়েছিল এবং অব্যাহত ছিল এক সর্বগ্রাসী প্রবণতা ও সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাভিলাষযুক্ত সন্ত্রাসবাদী মতাদর্শ হিসাবে। প্রাথমিক ক্ষেত্রে ও পদ্ধতিগতভাবে ইসলামের সঙ্গে কমিউনিজ়ম এবং নাজ়িবাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে। কম্যুনিস্টদের দ্বারা আহুত সেনাবাহিনীর একমাত্র পূর্বসূরী যেমন ছিল আল্লাহ, তেমনি নাৎসিদের দ্বারা আহুত মতাদর্শের পূর্বসূরী ছিল আর্য জাতিসত্তা।
লেখক: সীতারাম গোয়েল
অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়