The Story of Islamic Imperialism – ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী – ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী – ২

১। জাতীয় সংহতির নামে
২। ভারতে মুসলিম শাসনের চরিত্র
৩। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর দাবি
৪। মধ্যযুগের ভারতে সংঘাতের বৈশিষ্ট্য
৫। ইসলামই ছিল দোষী
৬। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ১
৭। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ২
৮। মুসলিম সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিংবদন্তী
৯। হিন্দুদের পরাজয়ের নির্ণায়ক কারণ
১০। ইসলামী দেশে/রাজ্যে হিন্দুদের অবস্থান
১১। আত্তীকরণ ও সংশ্লেষ
১২। ইসলাম বনাম মানবতা

ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী 

অধ্যায় ২: ভারতে মুসলমান শাসনের চরিত্র

কিছু কিছু নির্দেশিকা ভালো মনে হয়। ভারতীয় ইতিহাসের প্রাচীন যুগকে হিন্দু পর্ব ও মধ্যযুগকে মুসলিম পর্ব হিসাবে চিহ্নিত না করাটাই কাম্য। Indian Express-এর রিপোর্টে উল্লেখ না থাকলেও এর পরে আসছে আধুনিক যুগ, এবং এটিকেও যথারীতি ব্রিটিশ পর্ব বলে অভিহিত করা হবে না। এই পর্ব বিন্যাস অবশ্য অধিকাংশ ঐতিহাসিক বেশ কিছু কাল আগেই ত্যাগ করেছিলেন। একটাই বিস্ময়, মুসলিম সাম্রাজ্যবাদের সমর্থকরা মুসলিম পর্ব ছাড়া ভারতিয় ইতিহাস নিয়ে কীই বা করবে?

এটাও প্রশংসনীয়, যে ‘আর্য’ শব্দটি কোনও জাতিবাচক পদ হিসাবে ব্যবহৃত হবে না। ভারতীয় সাহিত্যের বিপুল পরিসরে কোথাও শব্দটি জাতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। সমগ্র ঋকবেদে ‘আর্য’ শব্দটি আছে মাত্র ৩৩ বার। বৌদ্ধ ও জৈন অনুশাসনেই এটি বিশাল গুরুত্ব পেয়েছে যা পরবর্তীকালে সংস্কৃত সাহিত্যেও বজায় থেকেছে। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই শব্দটি ‘বিশিষ্ট’ বা ‘মহান’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। পদটি জাতিবাচক অর্থে প্রথম ব্যবহার করে পশ্চিমী ঐতিহাসিকরা যারা ১৫০০ খ্রীস্ট পূর্বাব্দে ‘আর্য আক্রমণ’-এর কাল্পনিক তত্ত্ব রচনা করেছে। তারাই ‘দ্রাবিড়’ শব্দটিকেও জনপ্রিয় করে তোলে যেটি ভারতে ঐতিহ্যগতভাবে ভৌগোলিক ইঙ্গিতে ব্যবহৃত হত।

অবশ্য এটা একেবারেই পরিষ্কার নয়, সব মিলিয়ে আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে খাড়া করার জন্যই পর্ষদের এই নির্দেশিকা কিনা। পরবর্তী পর্যায়েই নির্দেশিকা যা বলে তা থেকে একটাই সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো যায়, যে এই ভিত্তিহীন তত্ত্বকে পরিহঅর করা চলবে না। অন্যথা ঐতিহাসিকদের ‘আর্য’ ‘অনার্য’ সংস্কৃতির আদান-প্রদান সংঘাতকে অতটা গুরুত্ব দিতে বলা হত না। প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিকে আর্য অনার্য সংস্করতিতে বিভাজনের উৎপত্তিই আর্য আক্রমণ তত্ত্ব থেকে। যতক্ষণ আমরা আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির কথা উচ্চারণ করব, ততক্ষণ ‘আর্য; ও ‘দ্রাবিড়’ পদ দুটিকে জাতিবাচক ইঙ্গিত থেকে মুক্ত করা যাবে না। কিন্তু  National Integration Council অনুমোদিত ও শিক্ষা মন্ত্রক প্রযোজিত প্রকল্প সম্পর্কে প্রশংসাবাচক এইটুকুই বলা করা যায়। বাকি সবটাই আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে বলা মিথ্যা এবং সত্য গোপন করে যাওয়া।

হিন্দু ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা

উদাহরণস্বরূপ কিংবদন্তিকে ইতিহাস মনে করার বিরুদ্ধে সতর্কতা। আঘাতটা রামায়ণ ও মহাভারত এবং তাদের দুই নায়ক শ্রীরাম ও শ্রীকৃষ্ণকে লক্ষ্য করে। কোনও সিরিয়াস ঐতিহাসিক এই দুটি মহাকাব্যকে ইতিহাস হিসাবে বিবেচনা করেননি। কিন্তু বর্তমানে কোনও সিরিয়াস ঐতিহাসিক এগুলোর ঐতিহাসিক উপাদান নিয়ে সন্দিগ্ধও নন। একই কথা অন্যান্য কিংবদন্তী ও পৌরাণিক উপকথা সম্পর্কেও খাটে, যেখানে তদগত ইতিহাসবিদরা প্রকৃত ঐতিহাসিক উপাদানের সন্ধান করছেন।

কারও মনে হতেই পারে এই দুর্লভ গল্পগুলো কাহিনীগুলো ‘জাতীয় এক্য’-এর কী ক্ষতি করতে পারে? হিন্দু সমাজ তো এই গল্পগুলোর মাধ্যমেই বহু বছর ধরে বিধৃত আছে। এখন কী এমন হল যে হিন্দু সন্তানদের তাদের আধ্যাত্মিক আকর থেকে বঞ্চিত রাখতে হবে? এর একটাই ব্যাখ্যা – ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ এই অনবদ্য গল্পগুলো হজম করতে পারে না। এগুলো আসলে ইসলামের রক্তরঞ্জিত ইতিহাসের যাবতীয় নায়কদের অশুভ দিকটা প্রতিফলিত করে।

কিন্তু নির্দেশিকাগুলি শুধু পৌরাণিক কাহিনীকে রুদ্ধ করেনি। তারা লিখিত ইতিহাসকেও আক্রমণ করেছে। সব মিলি্য়ে সাধারণ সুপারিশ হল এক কথায় ‘দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের অতিরিক্ত গৌরবায়ন নিষিদ্ধ’। নির্দিষ্ট উদাহরণ দিয়ে বলতে হয়, গুপ্ত যুগকে আর ‘হিন্দুত্বের স্বর্ণযুগ’ বলা চলবে না।

একজন সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন করতে পারে, হিন্দুরা নিজেদের অতীতকে গৌরবান্বিত কেন করবে না, কেন গুপ্তযুগকে স্বর্ণযুগ বলে অহংকার করবে না। প্রাচীন ভারত প্রকৃতেই এতটা মহান ছিল যে তাকে অতিরঞ্জিত করার অবকাশই নেই। আর গুপ্তযুগ বস্তুতই হিন্দু ইতিহাসের স্বর্ণযুগ ছিল যখন হিন্দু আধ্যাত্মিকতা, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শন গগনচুম্বী উচ্চাতায় আরোহণ করেছিল যা পরবর্তীকালে আর সঞ্চারিত হয়নি। প্রতিটি জাতিই নিজের অতীতের কোনো না কোনও পর্বকে মহিমান্বিত করেছে। চীনারা তাদের মিং রাজত্বকাল, পার্সীরা তাদের সাইরাস যুগ, গ্রীকরা তাদের পেরিকল্‌ যুগ, রোমানরা তাদের যুক্তি ও বিপ্লবের যুগ, জার্মানরা তাদের বিসমার্ক যুগ ইত্যাদি। মহত্বের এক একটা কাল যা নিয়ে গর্ব করা যায় মানুষকে নিজেদের আত্মপরিচয় জানতে সাহায্য করে। একটি জাতির আত্মা কিন্তু তার সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছোনো সময় নিয়ে সঙ্গত গর্ববোধের দ্বারা লালিত হয়। হিন্দুদের গুপ্তযুগ নিয়ে গর্ব করা থেকে বিরত রাখঅর কারণটা ভীষণই বিকৃত। ‘জাতীয় সংহতি’-র পুরো সুপারিশটাই তাই হিন্দুদের চোখে সন্দেহের ব্যাপারে পরিণত। সন্দেহ গাঢ়তর হয় যখন নির্দেশিকা প্রাচীন যুগ ছেড়ে মধ্যযুগের ইতিহাসে প্রবেশ করে। এর সুপারিশ অনুযায়ী একেবারে গোড়ার দিকে আগত ভারতে বসত না গাড়া কিছু হামলাবাজ ছাড়া বাকি মুসলিম শাসকদের বহিরাগত বিদেশী বলা চলবে না। ‘প্রথম দিকের আগ্রাসক’ (early invaders) বলতে আমাদের ধরে নিতে হবে প্রথম দিকে মুসলিম আগ্রাসকদের, আর গ্রীক, শক, কুশান ও হুন যারা কেউ কেউ শাসকও ছিলেন কিন্তু মুসলিম ছিলেন না। অর্থাৎ তফাৎটা দাঁড়াচ্ছে ‘এখানে’ বলতে যা বোঝায়, যেখানে মুসলিম হামলাবাজরা বসত করেনি। প্রশ্নটা বাস্তব ঘটনার, নিছক উপস্থাপনার নয়। এখন ঘটনাটা কী?

আদি মুসলিম আগ্রাসকরা ছিল আরবী, যারা ৮ম শতকের দ্বিতীয় দশকে সিন্ধু দখল করতে সমর্থ হয়। সেই আরবীরা হিন্দু রাজাদের আভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ সত্ত্বেও সিন্দুতে ঘাঁটি গাড়ে। মহম্মদ ঘোরীর নেতৃত্বে তুর্কীদের দ্বারা বিতাড়িত হওয়ার আগে পর্যন্ত তারা সিন্ধু ও মুলতানে শাসন করেছিল। সিন্ধী ভাষা যে এখনও আরবী হরফে লেখা হয়, সেটাই প্রমাণ আরবরা সিন্ধুপ্রদেশে বসত করেছিল এবং নিজেদের অস্তিত্ব এখনও পর্যন্ত আমাদের অনুভব করেতে বাধ্য করেছে।

মুসলিম আগ্রাসকদের দ্বিতীয় ঝাপটা আসে তুর্কীরা ৯৬৩ সালে গজ়নি অধিকার করে সেখান থেকে শুধু সমগ্র আফগানিস্তান নয়, সুবুক্তিগীন ও তার পুত্র মেহমুদ গজ়নবির নেতৃত্বে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো ও পাঞ্জাবের বৃহৎ অংশ দখল করে নেয়। ১০৩০ সাল নাগাদ মহমুদ গজ়নবির মৃত্যুর মধ্যে তুর্কীরা এই পুরো জায়গাটাতে বসতি করে নেয়। কিছু বছর পরে তারা রাজস্থানের নাগৌর অধিকার করেও বসবাস শুরু করে। কালক্রমে কাবুল গজ়নবীদের রাজধানী হয়ে ওঠে, যেখান থেকে তাদের দ্বাদশ শতকে ঘোরীরা উচ্ছেদ করে। তারা সেখানেই ছিল ১১৮৬ পর্যন্ত যতদিন না মহম্মদ ঘোরী তাদের বিতাড়ন করে।

মুসলিম আক্রমণের তৃতীয় তরঙ্গ আসে মহম্মদ ঘোরীর হাত ধরে, যে ১১৯২-৯৩ সাল নাগাদ হরিয়াণার চৌহান রাজ্য, আজমের, আলিগড় ও বায়ানা এবং ১১৯৫ সালে উত্তরপ্রদেশের গহড়বা রাজ্য অধিকার করে নেয়। ঘোরী ১২০৬ সালে নিহত হওয়ার আগে তার সেনাপতিরা দক্ষিণ বিহার, পশ্চিম ও দক্ষিণ বঙ্গ ও বুন্দেখন্ডের কিয়দংশ দখল করে নেয়।

শেষ পর্যন্ত ১২১০ সালে ‘শামসি’ বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার পর পরপর একাধিক রাজবংশ এইসব অঞ্চলে ও পরে সারা ভারতেই ছড়িয়ে পড়ে।

অনুমান করা যায় যে সময়টার কথা নির্দেশিকা মাথায় রেখেছে তা হল ১২১০ সাল, যতদিনে মুসলিম শাসকরা এ দেশে পাকাপাকি বসতি করে স্থানীয় হয়ে উঠেছিল। সুতরাং ‘এখানে’ বলতে সিন্ধু, আফগানিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও শতদ্রুর ওপারের পাঞ্জাবকে বাদ দিয়ে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু এই প্রদেশগুলি যেখানে প্রাথমিক মুসলিম আগ্রাসকরা এসে বসত করে ও দীর্ঘদিন রাজত্ব করে, সেগুলো মুসলিম আক্রমণ শুরু হওয়ার সময় ভারতেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। আরবীরা নিজেদের ভারতের অংশ বলে মনে করে। তুর্কীরাও তেমনটাই ভাবতে ভালোবাসে। এনসিআরটি-র নির্দেশিকাগুলির সততার সঙ্গে পরিষ্কার করা উচিত ছিল, যে ‘এখানে’ বলতে তারা ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হওয়ার পর ভারতে যা পড়ে আছে, ততটুকুকে বুঝিয়েছে, আর পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে অষ্টম শতাব্দী থেকেই বিদেশী ভূমি হিসাবে ধরা হয়েছে। ঐতিহাসিক ভূগোলের শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ জানাতে পারে। কিন্তু নির্দেশিকাগুলোর এই বিস্মৃত অধ্যায় মনে রাখার দরকার নেই।

ভারতীয় ইতিহাসের এই ছকে বাবরের জায়গাটা কোথায় ভেবে ধাঁধা লাগতে পারে। যদি আফগানিস্তান থেকে হামলা শুরু করেছিল বলে মাহমুদ গজনবী ও মহম্মদ ঘোরীদের বিদেশী আক্রমণকারী বলে ধরা হয়, তাহলে ভারতে ঐ একই জায়গা থেকে আক্রমণ করা বাবর কী করে ভারতীয় হয়? এটা ঠিক, যে সে প্রথম দিকের আগ্রাসক ছিল না এবং ১৫২৮ সালে খানুয়ার যুদ্ধের পর ভারতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়; কিন্তু সেও তো নির্দেশিকা অনুযায়ী বিদেশ বলে চিহ্নিত অঞ্চল থেকেই এসেছিল। এইরকম অনকে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আছে নির্দেশিকাতে। আলোচনার এই পর্বে সেই দিকে যাচ্ছি না। মোটের ওপর বিদেশী আগ্রাসক যারা এদেশে বসতি করেনি ও ভারতীয় মুসলিম শাসক যারা এদেশে বসত করেছে – এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে নির্দেশিকাটি পুরোপুরি যুক্তিহীন অনুমাননির্ভর।

কারোর প্রশ্ন জাগতেই পারে, দিল্লীতে মুসলিম শাসন কায়েম করাই কেন বিদেশীদের স্থানীয়তে রূপান্তরিত করল বলে ধরা হবে। ১২১০ সালে দিল্লী তো কোনও মহানগরও ছিল না। এটা তখন আজমেরের চৌহানদের অধীনে অধস্তন শাসক দ্বারা শাসিত একটা ছোট শহর ছিল। উত্তরপ্রদেশের কনৌজ ও বারাণসী, গুজরাটের অনহিনওয়ার পতন, মহারষ্ট্রের দেবগিরি, কর্ণাটকের দ্বারাসমুদ্র, তামিলনাড়ুর মাদুরাই, অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়ারঙ্গল, উড়িষ্যার জয়পুর, বাংলার নবদ্বীপ, বিহারের উদন্দপুর এবং মধ্যপ্রদেশের ত্রিপুরী, উজ্জয়ন ও কালাঞ্জোর ছিল দিল্লীর চেয়ে অনেক বেশি বড় ও রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ জনপদ। বিদেশীদের স্থানীয় হিসাবে চালানোর প্রক্রিয়া এই নগরগুলোতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা থেকে ধরা হল না কেন? দিল্লী তো গুরুত্ব পেল প্রথম সুলতানি রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পর থেকে। দিল্লীর পরবর্তী গরিমা আগেই কেন আরোপিত হল এবং সেই তারিখটাই কেন ভারতীয় ইতিহাসে নির্ণায়ক হিসাবে উঠে এল? মুলতান, ব্রহ্মবাদ, গজ়নি, কাবুল, পেশোয়ার ও লাহর, যেগুলো সেই প্রথম মুসলিম আক্রমণের সময় দিল্লীর চেয়ে বড় ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেগুলোকে এই গৌরব থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে কেন? সেগুলো বর্তমানে বিদেশ হয়ে গেছে বলে?

শেষ পর্যন্ত একজনের কাছে বিদেশী আগ্রাসকদের স্থানীয় ও সাম্রাজ্যবাদীদের দেশপ্রেমী বানানোই নির্দেশিকা দ্বারা নির্ধারিত একমাত্র শর্ত হিসাবে পড়ে থাকে। ভারতীয় সবকিছুর প্রতি অবিমিশ্র ঘৃণা এবং আরবী ও পারসী যাবতীয়ের প্রতি অনুরাগ নিয়েও কেউ যদি ভারতে পাকাকাকি বসবাস শুরু করে, তাহলেই একজন ভারতীয় বনে যাবে। তারপর যদি সে ঠাণ্ডা মাথায় কোটি কোটি ভারতীয়দের রক্তপাত ঘটায় গণহত্যা করে, ছল বা বল প্রয়োগে দলে দলে মানুষকে ধর্মান্তরিত করে, কোটি কোটি ভারতীয় নারী পুরুষদের ইসলামী দুনিয়া জুড়ে দাসত্ব বা দেহব্যবসা বা লিঙ্গদাসত্বের জন্য বিক্রিও করে দেয়, ভারতীয় শিল্প সাহিত্য ও বিজ্ঞানের সৃষ্টিগুলো সমূহ ধ্বংস করে ফেলে, এমনকি ভারতীয়দেরকেই নিজভূমে নাগরিকত্বহীন উদ্বাস্তু করে তোলে, তাহলেও সে শুধুমাত্র ভারতে জমি দখল করে বসবাস করছে বলেই ভারতীয়।

নির্দেশিকা সঠিকভাবেই পরবর্তীকালে আগত ব্রিটিশ শাসক যারা ভারত থেকে সম্পদ লুঠ করে নিজেদের গৃহভূমিতে পাকাপাকিভাবে নিয়ে গেছে, তাদের বিদেশী শাসক হিসাবে সনাক্ত করেছে। ব্যাপারটা প্রথম নজরে বেশ তাৎপার্যপূর্ণ লাগে। কিন্তু যখনই তুর্কীদের গৃহভূমি খোঁজার চেষ্টা চলে, তখনই এটি অর্থহীন হয়ে পড়ে। আমরা দেখি ভারতে আক্রমণের বহু আগেই তুর্কীরা জাক্সার্তি-র পূর্ব দিকে নিজেদের মূল বাসভূমি হারিয়ে বাস্তুহীন যাবাবর যোদ্ধা হয়ে যায়। তারা ট্রানসোজ়িয়ানা, সিংকিয়াং, খুরাসান ও কাস্পিয়ান সাগর বরাবর ইরানের উত্তরাংশে আক্রমণ চালিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের নির্বিচারে গণহত্যা করে, বাকিদের সঙ্গে বিবাহ করে পুরো অঞ্চলটাকে নিজেদের স্থায়ী গৃহ বা বাসভূমি বানিয়ে ফেলেছিল। পরবর্তীকালে একই কাজ তারা করে বর্তমানে আমরা তুরস্ক বলতে যা বুঝি সেখানেও। ভারতেও সেই একই চেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু হিন্দুদের লাগাতার তীব্র প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়। কিন্তু সেটা ভিন্ন কাহিনী। বর্তমান প্রেক্ষিতে যেটা প্রাসঙ্গিক, তা হল তুর্কী আগ্রাসকরা যে ভারত থেকে লুঠের মাল নিয়ে যাওয়ার মতো নিজস্ব জন্মভূমির কথা ভাবতেই পারেনি, মানে তেমন নিজস্ব জায়গাই ছিল না, তার সামন্যতম ইঙ্গিত মধ্যযুগের মুসলিম ভাষ্যকাররা দেননি। তারা এখানে এসেছিল নিজেদের আরেকটা বাসভূমি বানানোর অভিলাষে।

যদি লুঠ বয়ে নিয়ে যাওয়ার কথাই ধরা হয়, তাহলে বিজিতদের লুঠ করাই যেখানে বিজেতাদের প্রাথমিক পেশা, সেখানে লুণ্ঠিত সামগ্রী কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাতে কী এসে যায়? যদি মাহমুদ গজ়নবি ও মহম্মদ ঘোরিকে উত্তর ভারত থেকে গজ়নিতে লুণ্ঠনসামগ্রী নিয়ে যাওয়ার কারণে বিদেশী হামলাবাজ বলা হয়, তাহলে একই যুক্তি মামলুক, খলজি, তুঘলক, লোদি, সুর ও মুঘলদের বেলাতেও কেন প্রযোজ্য হবে না, যারা সারা ভারত থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ নিয়ে গিয়ে দিল্লীতে জড়ো করেছিল? একই যুক্তি প্রাদেশিক মুসলিম শাসক বংশগুলো সম্পর্কেও প্রযোজ্য যারা লুঠের মাল জৌনপুর, গৌড়, পাণ্ডুয়া, ধরে; বা মাণ্ডু, পাটান, আহমেদাবাদ ও দৌলতাবাদে; অথবা বিদর ও গুলবার্গে; কিংবা আহমেদানগর, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডায় নিয়ে চলে যেত। আর সিন্ধুর আবরদের সম্পর্কে তাহলে কী বলা যায়, যারা ৮ম শতাব্দীর পর আরবের সঙ্গে সংস্পর্শই হারিয়ে ফেলেছিল এবং লুঠের মাল নিজেদের জন্মভূমির পরিবর্তে সিন্ধুতে সঞ্চিত করা শুরু করে? তাদেরকেও তাহলে আদি ও বিদেশী আগ্রাসক হিসাবে দেখা যায় না, লুণ্ঠনসামগ্রী ভারতে রাখাই যদি নির্ণায়ক হয়ে থাকে।

আর কে বলতে পারে, ব্রিটিশ আগ্রাসকরা তুর্কী ও অন্যান্য হামলাবাজদের মতোই ভারতে বাসা বাঁধেনি? চোখ মেলে দেখুন: চোখধাঁধানো অট্টালিকা, চ্যাপেল, গীর্জা, পাহাড়ী বসতি ও দিল্লীসহ বড় বড় মহানগরগুলোর দিকে – যেগুলো তারা নিজেদের জন্যই তৈরি করেছিল। তাকিয়ে দেখুন প্রকাণ্ড শিল্প ও বাণিজ্যিক সংস্খাগুলোর দিকে যেগুলো তারা নিজেদের জন্যই নির্মাণ করেছিল। আজকের দিনেও ব্রিটেনে এমন কোনও পরিবার নেই যারা নিজেদের ভারতীয় সংশ্লিষ্টতা নিয়ে যথেষ্ট গর্বিত নয়। ব্রিটিশরা ভারতকে নিজেদের মুকুটের সেরা রত্ন হিসাবেই ভালোবসেছিল। তাদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করার পর তাদের ফিরে যাওয়ার জন্য নিজস্ব একটা গৃহভূমি ছিল, শুধু এই কারণেই তাদের সঙ্গে অন্যান্য বিদেশী আগ্রসাকদের তফাত করা যায় না; একমাত্র NCERT বিশেষজ্ঞরাই পারেন যাঁরা তিলকে তাল করতে ওস্তাদ।

মুসলিম শাসন যে ব্রিটিশ শাসনেরই পূর্ববর্তী সংস্করণ ছিল, তা নিয়ে তর্ক করার মানেই হয় না। কোনও মুসলিম শাসকই ভারতীয় ভাষা শেখা বা তাতে কথা বলাকে বিন্দুমাত্র সম্মান করত না, একমাত্র শেষের দিকটা ছাড়া যখন মুসলিম ক্ষমতার পতন ঘটে গেছে। গৌরবজনক পদগুলো সবসময় বরাদ্দ থাকত আরবী ও পার্সী এমনকি তুর্কীদের জন্য, ঠিক যেমন ব্রিটিশ আমলে ইংরেজর অবস্থান ছিল। সবকটি উচ্চাসন বা উচ্চপদ আরবী, পার্সী বা তুর্কী এমনকি আবেসেনিয়ানদের জন্য সংরক্ষিত ছিল, ঠিক যেমন পরবর্তীকালে ব্রিটিশ আমলে সেসব শ্বেতাঙ্গ বা ইওরোপীয় বংশদ্ভূদদের জন্য থেকেছে। আরব, পারস্য, খুরাসান বা মধ্য এশিয়া বা আফ্রিকা ও আবেসিনিয়ার অনেক উত্তর থেকেও যেসব অভিযাত্রীরা আসত, তারা যে যতই কুৎসিত বা অযোগ্য হোক, তৎক্ষণাৎ মুসলিম সমাজে অভিজাতের মর্যাদা পেয়ে যেত, অবিকল ব্রিটিশ আমলে ভারতে আসা ইওরোপীয় অভিযাত্রীরা যেমন বংশমর্যাদা বা শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকুক না থাকুক অভিজাত ইওরোপীয় ক্লাবগুলির সদস্যতা পেয়ে যেত। মুসলিম শাসকদের পোশাক পরিধান হোক, খাদ্যাভ্যাস হোক, পানীয় প্রীতিই হোক, অবসর বিনোদনই হোক, নর-নারীর সৌন্দর্যের মাপকাঠিই হোক বা আদব কায়দা শিষ্টাচার – এক কথায় সবকিছুতেই ভারতীয়ত্বের ছিটেফোঁটা থাকত না, ঠিক যেমন ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ জীবনচর্চাকেই আদর্শ মনে করা হত।

বস্তুত বহু ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসকরা ভারতীয়দের প্রতি মধ্যযুগের মুসলিম শাসকদের তুলনায় অনেক সহৃদয় ছিল। সমস্ত মুসলিম শাসকরাই হিন্দুদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করেছিল, হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিল, যে কোনও প্রকার হিন্দু ভাবাবেগকেই অপমান ও আঘাত করে চলত। যাবতীয় মোল্লা ও সুফিরা হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির কিছু না জেনেই উপহাস ও ঘৃণা বর্ষণ করে যেত। কিন্তু কোনও হিন্দু ইসলামের দাবি ও বিধি সম্পর্কে ফিসফিসিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে বা প্রশ্ন তুললেও তার জীবন সংশয় ঘটে যেত। অন্যদিকে ইংরেজরা যদিও খ্রিস্টান মিশনারিদের উৎসাহ দিত, কিন্তু কখনই তাদেরকে হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তরিত করার অনুমতি দেয়নি। তারা কখনই হিন্দু উপাসনাস্থল অপবিত্র করেনি, হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতিকে অপমানও করেনি। তাদের হিন্দু প্রজারা খ্রিস্টীয় মতবাদের একান্ত দাবিগুলি নিয়ে প্রকাশ্যেই প্রশ্ন তুলতে পারত অধিকাংশ ব্রিটিশ প্রশাসকদের দ্বারা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা ছাড়াই।

আরেকটা লিটমাস পরীক্ষা ছিল শাসক ও শাসিতের মধ্যে বিবাহের ক্ষেত্রে। প্রতিটি মুসলিম শাসক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা নিজেদের হারেমে যত খুশি হিন্দু নারীকে জোর করে পুরে ফেলাটা নিজেদের অধিকার মনে করত। তাদের হিন্দু রক্ষিতার সংখ্যার সীমা পরিসীমা ছিল না। কিন্তু হিন্দুরা কখনও মুসলিম নারীদের বিয়ে করার কথা ভাবতেও পারত না, এমনকি প্রতিবেশী পরিবারে ইসলামে ধর্মান্তরিত মেয়দেরকেও না। মুসলিম নারীর প্রেমে পড়লে, তা সেই মেয়েটি হিন্দু পরিবার থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে থাকলেও, সেই অপরাধে হিন্দু পুরুষদের প্রাণদণ্ড হত। এটা কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের বেলা হয়নি। তারা ভারতীয় নারীদের সম্ভ্রমহানি করেনি। তারা অপছন্দ করলেও ভারতীয় পুরুষদের ব্রিটিশ মেয়েদের বিয়ে করতে বাধা দিত না।

না। মুসলিম শাসকরা শুধুমাত্র এদেশে পাকাপাকি বসত গেড়েছে বলেই তাদের দেশীয় শাসক বলা যায় না। কিংবা ভারতীয় ইতিহাসের ব্যাপক বিকৃতি ঘটিয়ে একদা বলপূর্বক ধর্মান্তরিত হিন্দুদের বংশধররা আজ নিজেদের মুসলিম শাসকদের উত্তরসূরী বলে দাবি করলেও দেশজ শাসক হতে পারে না। ভারতের খ্রিস্টানরা যাদের পূর্বপুরুষরা ব্রিটিশ শাসকদের ধর্ম গ্রহণ করেছিল, তারাও একই যুক্তিতে তাহলে ব্রিটিশদের বিদেশী শাসক মানতে অস্বীকার করতে পারে। খ্রিস্টানদের সাধুবাদ দিতে হয়, যে তারা এখনও তেমন কিছু দাবি করে বসেনি। কিন্তু যদি করে, আমরা কি অস্বীকার করতে পারব? জঙ্গী ‘মিল্লাত’কে তোষণ করা লাভজনক রাজনীতি হতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ভালো ইতিহাসের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে পারে না।

নায়ক ও খলনায়ক

এই বিতর্কিত নির্দেশিকার যাবতীয় অনুসিদ্ধান্তকেই যে সমানভাবে প্রশ্ন করা যায়, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। আমাদের বলা হয়েছে, “আওরঙ্গজেবকে আর ইসলামের আদর্শ হিসাবে দেখানো যাবে না”, “শিবাজীকেও মহারাষ্ট্রের পাঠ্যপুস্তকে অতিগৌরাবান্বিত করা চলবে না”।

প্রথমে শিবাজী। শিবাজী শুধু মহারাষ্ট্রে গৌরবান্বিত, এটা বলাটাই দুরভিসন্ধিমূলক। সৌভাগ্যক্রমে তিনি ভারতের যে কোনও প্রান্তের হিন্দুর কাছে কাছে সম্মানিত। রবীন্দ্রনাথ মরাঠী না হয়েও নিজের দীর্ঘ কবিতায় শিবাজীর বীরত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা অর্পণ করেছেন। শিবাজীর বীরত্ব ও সাহস নিয়ে আরও অনেক কবিতা ও নাটক আছে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায়। সুতরাং শিবাজীকে অতিগৌরবান্বিত করা যাবে না, এটা কিছু মুষ্টিমেয় ব্যক্তির পূর্বানুমান বশত সক্রিয়তা মাত্র। ঘটনা হল, তাঁর চরিত্র ও ভূমিকার যা মহিমা. যা রাজকীয়তা, তাতে তাঁকে অতিগৌরবান্বিত করাই সম্ভব নয়। শিবাজীর চরিত্রের সামগ্রিক মূল্যায়ন করতে পারার মতো ইতিহাসবিদ এখনও জন্মই নেয়নি। কিছু ধান্নাবাজ রাজনীতিক ঐতিহাসিকের ভান করে শিবাজীকে নিজেদের মাপে ছেঁটে নামাতে চাইছে। তারা হল রাস্তার ভবঘুরে যারা সূর্যের দিকে থুথু ছুঁড়ছে।

আর অওরঙ্গজ়েবের কথা বলতে গেলে, আমাদের সেকুলারপন্থীরা তাঁর ভারমূর্তিকে ইসলামের আদর্শ হিসাবে দেখাতে বেশ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কারণ সেটা করতে গেলে ইসালমের ভাবমূর্তিও উন্মোচিত হয়। ইসলামের সেই প্রতিচ্ছবি নিয়ে আদিখ্যেতা চলে না। ইসলামের সেই ভাবমূর্তিকে জনতার চোখ থেকে আড়াল না করলে সেকুলারপন্থীদের পক্ষে ইসলামের দাবিগুলোকে ধর্ম ও সংস্কৃতি হিসাবে দেখানোই মুশকিল হয়ে যাবে। এখন মানুষের ইতিহাস সবসময় আদরণীয় বিষয়ের মধ্যে সীমিত থাকে না। সেই সত্যগুলো শুধু এই কারণে নিশ্চিহ্ন করা মুছে দেওয়া যায় না, যে সেগুলো কিছু মানুষ পছন্দ করে না, বা সেই সত্যের মুখোমুখি হতে চায় না। আওরঙ্গজ়েব ছিলেন তেমন এক সত্য। স্টালিন তেমন আরেকজন, হিটলারও তাই। আওরঙ্গজ়েব ইসলামের আদর্শ ছিল না বলাটা স্টালিন কমিউনিস্ট ছিলেন না এবং হিটলার নাৎসি ছিলেন না বলার সমতুল্য। আর আওরঙ্গজ়েব আদর্শায়িত করেনি এমন ইসলাম না কোরানে খুঁজে পাওয়া যাবে, না নবির সুন্নাতে। এটা সেকুলারিস্টদের কষ্টকল্পনা। বিপরীতক্রমে মধ্যযুগে ও আধুনিক যুগেও ইসলামের অভিভাবকত্বে লেখা ঐতিহাসিকরা কিন্তু তাঁকে আদর্শ মুসলমান বলেই তুলে ধরেছেন। হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে তাদের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গড়ে তোলা অজস্র মসজিদ আওরঙ্গজ়েবের ইসলামী রাজকীয় গৌরবের সৌধ হিসাবেই দাঁড়িয়ে আছে।

‘জাতীয় সংহতি’-র এই অভিসন্ধিপূর্ণ পরিকল্পনার পুরোটাই শিক্ষামন্ত্রকের এই সুপারিশের মধ্যে প্রতিফলিত: “মধ্যযুগকে অন্ধকার যুগ বা হিন্দু-মুসলিমের সংঘাতের সময়কাল হিসাবে দেখানো নিষিদ্ধ। ঐতিহাসিকরা মুসলিমদের শাসক ও হিন্দুদের প্রজা হিসাবেও দেখাতে পারবেন না। ধর্মের প্রকৃত প্রভাব পরীক্ষা না করে রাষ্ট্রকে ধর্মনৈতিক বলা যাবে না। রাজনৈতিক সংঘর্ষে ধর্মের ভূমিকাকে বেশি করে দেখানো নিষিদ্ধ। সেই সঙ্গে সমন্বয়ীকরণ ও সংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় এতটুকু বাদ বা ঢিল দেওয়াও চলবে না।”

ভারতে ইসলাম শাসিত মধ্যযুগকে অন্ধকার যুগ বলা হবে কিনা তাই নিয়ে অবশ্যই দ্বিমতের জায়গা আছে। এটা নির্ভর করছে কেউ কীভাবে দেখবে, তার ওপর। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা ছিল নিঃসন্দেহে ঝলমলে একটা সময়। ইসলাম তখন এক বিরাট দেশে বিশাল সাম্রাজ্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অধিকারী ছিল। একাধিক কারণে ইসলামের পরিতৃপ্তি ছিল চরম: ১) ক্রমাগত জেহাদের মাধ্যমে কোটি কোটি কাফেরের জীবন নরক করে তোলা, ২) মূর্তিপূজারীদের উপাসনালয় ও তীর্থস্থানগুলিকে ধ্বংস ও অপবিত্র করে দেওয়া, ৩) হাজার হাজার ব্রাহ্মণ ও ভিক্ষুদের হত্যা করে বাকিদের জোর করে গোমাংস খেতে বাধ্য করা, ৪) নবীর তৈরি বিধান মেনে বিপুল লুণ্ঠিত সম্পদ জড়ো করে মুমিনদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া, ৫) কোটি কোটি নারী পুরুষ শিশুকে ধরে দাসত্ব ও রক্ষিতাবৃত্তির জন্য সুদূর ইসলামী দুনিয়ায় বিক্রি করে দেওয়া, ৬) বিশাল জনসংখ্যার ওপর ক্ষমতা ও সুবিধা ভোগ করে সামন্ততন্ত্র কায়েম করা, এবং ৭) তরবারির জোরে ইসলামী মতবাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

মুসলিম শাসকরা নিজেদের জন্য প্রচুর জামকালো বিলাসবহুল প্রাসাদ তৈরি করেছিল। তারা প্রচুর মসজিদ ও মাদ্রাসাও নির্মাণ করায় এবং অসংখ্য মোল্লাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে আধাত্মিক স্বাস্থ্যে মিল্লাত বজায় রাখার জন্য। তারা নিজেদের ও তাদের সংশ্লিষ্ট স্ত্রীদের সুরম্য বাগান ঘেরা ও দুর্মূল্য রত্নখচিত প্রকাণ্ড ‘মকবারা’-তে সমাধিস্থও করে গেছে। অজস্র ‘খানকাহ্‌’ ও ‘দরগা’ নির্মাণ করিয়ে গেছে যেখানে সুফিরা থেকে নেচে গেয়ে ধর্মপ্রচার করত। এই সৌধগুলো এখন বিশদে বর্ণিত হয় ‘ইন্দো-মুসলিম’ স্থাপত্য হিসাবে। আর পর্যটকরাও সেসব জায়গার অফুরন্ত ছবি আলোকচিত্রে ধরে রাখে। সেগুলো এমন ধারণা গড়ে তোলে যেন মধ্যযুগে মুসলিম শাসনে ভারত দারুণ সমৃদ্ধশালী ছিল। এই স্থাপত্য সম্পদের পাশাপাশি রয়েছে অন্যান্য শিল্পকলা, পোশাক, কেশবিন্যাস, লিখনশৈলী বা ক্যালিগ্রাফি ও পাণ্ডুলিপির ছবি, পার্সী কবিতা ও গদ্য, কোরান ও হাদিসের আরবী টীকা, দরবারি কেতার সঙ্গীত ও নৃত্য এবং সন্ত ও সুফিদের ‘মলফুজ়া’। ইসলামী ঐতিহ্যের এই সম্মিলিত প্রদর্শনীর ফলে এমনটাই মনে হয়, যেন ইসলামী শাসনে মধ্যযুগে ভারত শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বর্গ ছিল।

কিন্তু যদি হিন্দুদের দিক থেকে দেখা হয়, সময়টা ছিল এক প্রলম্বিত অন্ধকার সময়, যেটা অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি যখন মারাঠা, জাঠ ও শিখরা ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের পিঠ ভেঙে দেওয়ার পর শেষ হয়। মুসলিম শাসনে হিন্দুদের অবস্থা ‘তনখ্‌-ই-ওয়াসব’ গ্রন্থে লেখক বর্ণনা করেছেন এইভাবে: “The vein of the zeal of religion beat high for the subjection of infidelity and destruction of idols.” প্রজাদের অবদমন ও মূর্তি ভাঙার মধ্যে দিয়েই ছিল শিরায় শিরায় ধর্মীয় বিজয়ের উন্মাদনা। মহম্মদীয় শক্তি ইসলামের নিমিত্ত এই অপবিত্র ভূমিতে ডাইনে বাঁয়ে নির্বিচারে কাফেরদের জবাই শুরু করে এবং রক্তের স্রোত বইয়ে দেয়। তারা যে পরিমাণ সোনা ও রূপো লুণ্ঠন করে তারা কল্পনার অতীত, আর সেই সঙ্গে মূল্যবান রত্ন ও বিবিধ বস্ত্রাদিও। তারা লিখে প্রকাশ করা যাবে না এমন অগণিত সুদর্শনা নারী ও উভয় লিঙ্গের বাচ্চাদের বন্দী করে। সংক্ষেপে মুসলিম সেনা সেখানকার অধিবাসীদের জীবন তছনছ করে, শহরগুলো লুণ্ঠন করে, বাচ্চাদের বন্দী করে দেশটাকে পুরোপুরি ধ্বংসাবশেষে পরিণত করে। ভাঙা ও পদদলিত মূর্তি সহ অজস্র মন্দির পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকে, যার মধ্যে বৃহত্তম ছিল সোমনাথ মন্দির। সেইসব ভাঙা মন্দিরের টুকরো দিল্লীতে নিয়ে গিয়ে ‘জামি’ মসজিদের রাস্তায় বিছোনা হয়, যাতে লোকে ইসলামের সেই উজ্জ্বল বিজয়কে মনে রাখে। জগতের অধীশ্বর আল্লার বিজয় প্রশংসনীয় ছিল বই কি!

হিন্দুদের ইসলামী ঐতিহ্য নিয়ে গদগদ হওয়ার কিছু নেই, যে ঐতিহ্য তাদের সরাসরি অপমান, অবনমন, মনোকষ্ট, যন্ত্রণা ও মৃত্যুর সমানুপাতিক ছিল। এটা তো ক্ষতের ওপর বাড়তি অপমানের নুন ছেটানো।

লেখক: সীতারাম গোয়েল

অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.