মাতৃস্নেহের কী কোনো বিকল্প হয়? জগতের এ এক আশ্চর্য মহাভাব। শিশুর যাবতীয় ব্যাধির মহৌষধ মা, যেন অব্যর্থ মকরধ্বজ। “কুপুত্র যদি বা হয় — কুমাতা কখন নয়।” মাতৃত্বের প্রকাশ যত, অপ্রকাশ তার চেয়ে বহু গুণ। শৈশবে আমরা কেবলই মাকে খুঁজি, তার আঁচলে লুকোই। যখন যৌবনের জটিলতায় পা বাড়াই তখন সেই সহজাত অন্বেষা মনস্তত্ত্বের চোরাগলিতে কোথায় হারিয়ে যায়। একটা গল্প আছে — এক প্রেমিকা প্রেমের মূল্যরূপে প্রেমিকের মায়ের হৃৎপিণ্ড চাইল। তাতেই সম্মত হল প্রেমিক। মায়ের হৃৎপিণ্ডটি ধারালো অস্ত্রে ছিঁড়ে আনতে প্রেমিক বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না। উপহার দ্রুত তুলে দিতে হবে প্রেয়সীকে। দু-হাতের মুঠোয় সদ্য-কর্তিত মায়ের হৃদয়, রক্তে রাঙা। উত্তেজনায়, ব্যস্ততায় চৌকাঠ পেরোতে আঘাত পেল প্রেমিক। ছিন্ন হৃৎপিণ্ড সস্নেহে বলে উঠল, “বাছা, লাগেনি তো?” পাঠক হয়তো বলবেন, এ কী সম্ভব? বাংলা প্রবাদে এই ধারণার Missing link খুঁজে পাওয়া যায়।
১. মায়ের গলায় দিয়ে দড়ি/ বউকে পরাই ঢাকাই শাড়ি।
২. মায়ের ঘাড়ে মুগার মালা/ বৌ-এর ঘাড়ে চন্দ্রহার।
৩. দুঃখের কথা কারে জানাই/ মায়ের পুত নয়, শাউড়ির জামাই।
পুত্রের সক্ষমতা ও স্বনির্ভরতার পরও জননীর অনাহার নিত্যসঙ্গী, সে চিরজন্মা। লৌকিক ছড়াতে তারই অনুরণন — “যার জননী শুশনির শাক, আলনো রেধে খায়,/ তার বেটার পায়ে সাপাট জুতো ‘বাবু’ হয়ে যায়।/ যার জননী অগ্নি জ্বেলে শীতের বেলা কাটে,/ তার বেটার গায়ে শালের জোড়া ঘুময় ছাপোর খাটে।”
মায়ের অন্তরের উপাসনা-মন্দিরে সন্তান সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। তাই সন্তানকে মায়ের কাছে ভালোবাসা চাইতে হয় না। সন্তানের মাধ্যমে মা আসলে কী চান? উত্তরটি বোধহয় আত্মসুখ। আত্মজাতকে ভালোবাসা মানে নিজেকেই ভালোবাসা, প্রিয় সঙ্গীকে ভালোবাসার রেশও থাকে। সুতরাং সন্তান হলো মায়ের ‘Two in one.’ সন্তান হল মায়ের চালিকাশক্তি। বাংলা প্রবাদে আছে — “বটের ছায়াই ছায়া, মায়ের মায়াই মায়া।” “ডাবের পানি/মায়ের বাণী।” বিশ্বজুড়ে যে মাতৃকা-সাধনার ধারা দেশ-কাল-জাতি-গোষ্ঠীতে বহমান তা মা ও শিশুর আদি সম্পর্কের ধন্যবাদাত্মক লোকায়ত চিন্তনের ফসল।
গোষ্ঠীজীবনের একক হল পরিবার। পরিবারে নারীর অবস্থান ত্রিবিধ — কন্যা, জায়া ও জননী। জননী রূপই নারীর Text. পরিবার হল Fundamental Institution. সেই মৌল প্রতিষ্ঠানে কার্যত জননীই সর্বাধিনায়িকা। সভ্যতার বহুধা বিস্তৃতির শিকড় অনুসন্ধানে গেলে গর্ভধারিণী জননীর কাছেই পৌঁছতে হবে। মায়ের রূপকথার গল্প যেন তার স্নেহ-ভালোবাসার আর একটি স্পর্শ।
জননীকে দশ মাস দশ দিন সন্তানের ভ্রণ গর্ভে ধারণ করতে হয়; সন্তান প্রসবের পর দুর্বল শরীর নিয়েই চলে মায়ের বাৎসল্য, স্তন্যদান, অশেষ সেবাযত্ন। কবি জসীমউদ্দিন ‘পল্লীজননী’ কবিতায় লিখছেন, “রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা,/ করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।” এরপর মায়ের দায়িত্ব ক্রমাগত বাড়ে — আহারের ব্যবস্থা, সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য সচেষ্ট হওয়া, সামাজিক মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা, ইত্যাদি। কথায় বলে, “সাক্ষর নারীর কখনও নিরক্ষর সন্তান হয় না।”
তাই বলে গৃহে পিতার দায়িত্ব ও কর্তব্যও কম নয়। সংসার প্রতিপালনে অর্থের যোগানদার তিনি, তারজন্যই তার নিত্য সংগ্রাম৷ ভারতীয় সংস্কৃতিতে পিতাকে পরিবারিক নিরাপত্তার জন্য সতত সংবেদী হতে দেখা যায়। পরিবারের সকল সদস্যকে আর্থিক ও মানসিক নিরাপত্তাও দেন পিতা। সামাজিক পরিচয়ের অন্যতম ধারক-বাহক হলেন পিতা; সামাজিক স্বীকৃতি আসে পিতার পরিচয়েই। অনেকসময় পিতা পরিবারে অতিরিক্ত মাত্রা দেন; পিতা নিজের ব্যক্তিত্ব, ক্যারিশ্মা দ্বারা সন্তানকে প্রভাবিত করেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব লাভ করেছিলেন পিতা আশুতোষ মুখার্জীর সৌকর্যে। রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মসংগীত রচনায় অসামান্য প্রেরণা লাভ করেছিলেন পিতা দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে। আধ্যাত্মিক কাজে পুত্রকে পথ দেখান পিতা। তর্পণ-কার্যের পর পিতৃ-প্রণাম মন্ত্রে পিতাকেই স্বর্গ, পিতাকেই ধর্ম বলে অভিহিত করা হয়েছে। “ওঁ পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্মঃ পিতা হি পরমং তপঃ। / পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতাঃ।।”
কালিদাসের পূর্ব লেখক নাট্যকার ভাস লিখেছেন, মা হলেন দেবতাদেরও দেবতা, “মাতা কিল মনুষ্যাণাং দৈবতানাং চ দৈবতম্।” ‘বিষ্ণুস্মৃতি’-তে রয়েছে, মা-বাবা-শিক্ষক হলেন অতিগুরু, “ত্রয় পুরুষস্য অতিগুরবঃ ভবন্তি — মাতা পিতা আচার্যশ্চ।” মনুসংহিতায় পাওয়া যায়, পিতার গৌরব শত আচার্যের অধিক, মায়ের গৌরব পিতার হাজার গুণ, “উপাধ্যায়ান্ দশাচার্য, আচার্যাণাং শতং পিতা।/ সহস্রং তু পিতৃন্ মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে।”
রামায়ণে আমরা শ্রবণ কুমারের কথা জানতে পারি, তপস্বী শান্তণ্ব ও জ্ঞানবন্তির একমাত্র সন্তান। পিতামাতার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে অন্ধত্ব প্রাপ্তির পর তাদের সেবাযত্নে ব্রতী হল শ্রবণ কুমার। পিতামাতার প্রতি তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা, আনুগত্য অতুলনীয়। তিনি ঝাঁকাতে পিতামাতাকে বসিয়ে তা বাঁশ দিয়ে যুক্ত করে, কাঁধে নিয়ে পদব্রজে তীর্থদর্শনে বেরিয়েছিলেন। মহাভারতে দেখি যযাতি-শর্মিষ্ঠার কনিষ্ঠ পুত্র পুরু তার পিতার অভিশপ্ত জরা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছিলেন। এই কুরু-র বংশধরই হলেন কৌরব-পান্ডব।
সুতরাং সকল সন্তানের উচিত পিতামাতার প্রতি যথাযথ কর্তব্য সম্পাদন করা। তাদের নিত্য আশীর্বাদ লাভ করাই সন্তানের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত; স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-পিতা-মাতাসহ পরিবারের সকলকে সঙ্গে নিয়ে সুখে-আনন্দে দিনাতিপাত করার মত সুখ বোধহয় আর নেই; অধুনাতন মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেতে অখন্ড পরিবারের বিকল্প নেই। সন্তান পিতামাতার মুখ উজ্জ্বল করলেই, তারা সবচেয়ে খুশি হন। সন্তান চরিত্রবান হয়ে তাদের সর্বাধিক আনন্দ দান করবে — এটিই আকাঙ্খিত হিন্দু আদর্শ। কাজেই পিতৃ-মাতৃ ঋণ যদি পরিশোধ করতে হয় তবে সন্তানকে চরিত্রবান হতে হবে। গৌরববর্ধনের এর চাইতে বড় ব্যাপার আর নেই। সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত সমেত পিতামাতাকে সেবাশুশ্রূষা দান কর্তব্যবোধের এক অন্যতম নাম। সাধ্য মতো সন্তষ্টিবিধান করে, যথোপযুক্ত সমান-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেই পিতামাতার ঋণ শোধ করতে হয়। আর একটি উপায় হল, পিতামাতার পারলৌকিক কাজ যথাযথ নিয়মে সম্পাদন করা। তর্পণ ও পিন্ডদানের কথা রয়েছে হিন্দুশাস্ত্রে।
বাল্মিকীর রামায়নে দেখা যায়, রাম কৌসল্যাকে বনবাসে যাবার আগে বোঝাচ্ছেন, “নাস্তি শক্তিঃ পিতুর্বাক্যং সমতিক্রমিতুং মম।” পিতৃবাক্য লঙ্ঘন করা চলে না। শুরু হয় মাতৃ-আজ্ঞা এবং পিতৃ-সত্যের মধ্যস্থ টানাপোড়েন। মায়ের শত অনুনয়েও রাম নীতিনিষ্ঠ থাকেন, বলেন পিতৃআজ্ঞায় পরশুরাম কুঠার দিয়ে মায়ের শিরচ্ছেদ করেছিলেন। কাজেই তাকে বনবাসে যেতেই হবে। পিতৃআজ্ঞা তো পালিত হল, কিন্তু রামের মনে মায়ের জন্য নিত্য অভাববোধ — তাই লঙ্কায় বসেই স্মরণ করেছেন মা-কে, “ইয়ং স্বর্ণময়ী লঙ্কা ন মে লক্ষ্মণ রোচতে/ জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।” আর এরমধ্যেই একাসনে বসে গেলেন মা এবং দেশমাতৃকা; মনুও বললেন, “মাতা পৃথিব্যা মূর্তিস্তু”, ” বিশ্বম্ভরা বসুধানী প্রতিষ্ঠা।” ভীষ্মের মুখেও শুনলাম তার অনুরণন, “ভূমৌ হি জায়তে সর্বং ভূমৌ সর্বং প্রণশ্যতি।” বঙ্কিমচন্দ্র তাতে যুক্ত করে দিলেন মাতৃ-জাতীয়তাবোধ, “শ্যামলাং সরলাং সুস্মিতাং ভূষিতাং ধরণীং ভরণীং মাতরম্।” ৩০ শে আগষ্ট, ১৯০৫ -এ অরবিন্দ তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে একটি পত্রে লিখছেন, “অন্য লোকে স্বদেশকে একটা জড় পদার্থ, কতগুলা মাঠ ক্ষেত্র বন পর্বত নদী বলিয়া জানে। আমি স্বদেশকে মা বলিয়া জানি, ভক্তি করি, পূজা করি। মা’র বুকের উপর বসিয়া যদি একটা রাক্ষস রক্তপানে উদ্যত হয়, তাহা হইলে ছেলে কি করে? নিশ্চিন্তভাবে আহার করিতে বসে, স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে আমোদ করিতে বসে, না মাকে উদ্ধার করিতে দৌড়াইয়া যায়?” সুতরাং পিতা-মাতার সঙ্গে জন্মভূমির প্রতি কর্তব্য অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ দেশের নিরাপদ বেড়াজালের মধ্যেই মায়ের স্নেহময় আঁচল, পিতার চিরায়ত পিতৃত্ব সম্ভব।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।