সদ্য পেরিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস। শাড়ি-গয়নায় বিপুল ছাড়ের বিজ্ঞাপনের ফাঁকেই নানা গণমাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় ঝলসে উঠেছে অসংখ্য নারীর কৃতিত্ব। কেউ নিজের জীবনে তৈরি করেছেন সাফল্যের নয়া সংজ্ঞা। কেউ আবার অন্যের জীবনে হয়ে উঠেছেন আলোকবর্তিকা। বারবার উঠে এসেছে পরিচিত বাক্যবন্ধ– প্রতিটি পুরুষের সাফল্যের পিছনে কোনও না কোনও নারী থাকেন।
কিন্তু বেঙ্গালুরুর চন্দ্রা শ্বেতার কাহিনি অবশ্য এই সব পরিচিত ছকের নারী সাফল্যের চেয়ে একদম আলাদা। সেভাবে বলতে গেলে, তিনি কিছুই ‘অ্যাচিভ’ করেননি। তিনি কাউকে হয়তো সাফল্যের পথও দেখাননি আলাদা করে। তিনি কোনও পুরুষের জীবনে অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠার মতোও হয়তো কিছু করেননি। কিন্তু যা করেছেন, তা বহু মানুষের জন্য খুব দামি হয়ে উঠেছে।
খাবারের দোকান রয়েছে চন্দ্রা শ্বেতার। বেঙ্গালুরুর সেই দোকানে, দু’বেলা পেট ভরে খেতে পান বহু মানুষ। খুব সস্তায়। দিনে ১৫ ঘণ্টারও বেশি সময় এই দোকানের পেছনেই দেন চন্দ্রা। কিন্তু এ দোকানের জন্ম হওয়ার গল্প এত সহজ নয়। চন্দ্রার কথায়, “এক সময়ে রাজরানি ছিলাম আমি। আমার সব ছিল। সব হারিয়ে ভিখারিনি হয়ে পথে নামলাম ঠেলা নিয়ে। শূন্য থেকে শুরু করলাম বাঁচা।”
তিরুপতিতে চন্দ্রার পারিবারিক ব্যবসা ছিল রেস্তরাঁর। খুবই রমরম করে চলত সে রেস্তরাঁ। কিন্তু কে না জানে, সুসময় দীর্ঘস্থায়ী হয় না অনেক সময়েই। “আমাদেরও ঠিক তেমনটাই হল। পরপর কয়েকটা ধাক্কায় আচমকা মুখ থুবড়ে পড়ল ব্যবসা। আমিই দেখতাম ব্যবসার লেনদেন। ভেবেছিলাম, সামলে নেব। কিন্তু একের পর এক আঘাত। চোখের সামনে নিঃশেষ হয়ে গেল সব কিছু। ওই সময়টায় একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম। কী ভাবে কী করব, কোনও উপায় ছিল না হাতে। আত্মীয়স্বজনরাও পথ দেখলেন একে একে। আত্মহত্যা করার কথা ভাবতাম রোজ। মেয়েটা তখন ছোটো, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিরে ফের বাঁচার কথা ভাবতাম। সে আজ থেকে দু’বছর আগের কথা।”– বললেন চন্দ্রা।
ভাগ্যকে এক রকম চ্যালেঞ্জ জানিয়েই বৃদ্ধা মা, স্বামী ও চার বছরের ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে বেঙ্গালুরু চলে এসেছিলেন চন্দ্রা। থাকার জায়গা নেই। কী খাবেন তার ঠিক নেই। একটিও চেনা মানুষ নেই। পুঁজি নেই। আছে কেবল চ্যালেঞ্জ। বেঁচে থাকা। আছে বিশ্বাস, এত বড় শহর হয়তো কিছু না কিছু হবে। এই অবস্থায়, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সম্পূর্ণ অচেনা শহর বেঙ্গালুরুতে পা রেখেছিলেন চন্দ্রা।
তবে শূন্য থেকে শুরু করতে গিয়ে, সবার আগে যেটা জোগাড় করেছিলেন, সেটা মাথা গোঁজার ঠাঁই নয়, সেটা অন্নসংস্থানের সুযোগও নয়। নয় চাকরি। সেটা হল একটা খাবারের ঠেলাগাড়ি। “আমি রাঁধতে পারি, মানুষকে খাওয়াতে পারি। এইটুকুনিই আমি সঙ্গে করে এনেছিলাম কেবল। তাই কিছু করতে হলে, আমাদের ওটা দিয়েই করতে হতো। তাই সব হারানোর পরেও যখন বেঙ্গালুরুতে একটা ঠেলা নিয়ে দাঁড়াতে পারলাম, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম। তখনও জানতাম না, কী অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতে। কিন্তু জানতাম, সব শেষ হয়ে যাওয়ার আগে শেষ খড়কুটো বলতে আমার এই ঠেলাগাড়িটাই।”– বললেন চন্দ্রা।
শুরু হয় অন্য লড়াই। এত দিনের অভ্যেস ছিল, বড়, চালু, পারিবারিক হোটেলের দেখভাল করা। এবার চ্যালেঞ্জ, শূন্য থেকে শুরু করা। যেটুকু টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি সঙ্গে ছিল, বিক্রি করে খানিকটা পয়সা এক জায়গায় করে প্রথম কয়েক দিনের বাজারটুকু হল। ভোর সাড়ে তিনটেয় শুরু হতো দিন। চন্দ্রা আর তাঁর স্বামী লেগে পড়তেন খাবার বানানোর কাজে। সকালের জলখাবার হিসেবে ইডলি, দোসা, বড়া। পুরি সবজি। চাটনি, সম্বর ডাল। ফের দুপুরের জন্য ভাত, রুটি, ফ্রায়েড রাইস, ডাল, তরকারি– এ সব।
চন্দ্রা বলেন, “একটা মুহূর্ত বসার সময় পেতাম না। ভোর সাড়ে ছ’টার মধ্যে তৈরি করে ফেলতাম খাবার। সাতটা থেকে ব্যবসা শুরু। ফের দুপুরে নতুন খাবার। প্রথম কয়েক দিন যেটুকু বিক্রি হতো, সেটুকু দিয়েই পরের দিনের বাজার হতো। প্রতিটা দিন শুরু হতো অনিশ্চয়তা দিয়ে। যদি পর্যাপ্ত বিক্রি না হয়, পরের দিনের খাবারও তৈরি হবে না। বিশ্রাম নেওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না। আমরা জানতাম, এটাই আমাদের শেষ ভরসা।”
প্রথম কয়েক মাস ঠেলাতেই থাকতেন তাঁরা। পরে একটু বিক্রি বাড়লে, ভাড়া নেন ছোট্ট একটা কামরা। চন্দ্রার রান্নার গুণেই হোক, বা তাঁদের লড়াইয়ের জেদেই। কয়েক মাসের মধ্যেই বাড়তে থাকে খদ্দেরের সংখ্যা। চন্দ্রা বললেন, “আমরা এত অসুবিধাতেও ন্যূনতম দামই রেখেছিলাম। ১৫ টাকায় মিলত জলখাবার, ২৫ টাকায় লাঞ্চ। এখনও তা-ই আছে। মাঝখানের প্রচণ্ড অভাবের পর্বটা আমায় বুঝিয়েছিল, দু’বেলা একটু সস্তার অন্ন জুটলে, জীবনটা কত সহজ হয়ে যায়। তাই যতই অনটন থাক, খাবারের দাম আমরা বাড়াইনি। বরং কম দামে কী করে মানুষের পেট ভরানো যায়, সেটাই আমাদের চিন্তা ছিল।”
আর ঠিক এই জায়গা থেকেই আর পাঁচ জন ব্যবসায়ীর চেয়ে আলাদা হয়ে উঠলেন চন্দ্রা। এখনও পর্যন্ত বেঙ্গালুরুর মানুষ শুধু এই কারণেই চন্দ্রার ঠেলাগাড়ির উপর বিপুল ভরসা রেখেছেন। সস্তায়, সুস্বাদু, পরিচ্ছন্ন খাবারের এক নির্ভরযোগ্য জায়গা হয়ে উঠেছে চন্দ্রার খাবার। তাই রোজকার অফিসযাত্রী থেকে শুরু করে পর্যটকেরা, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের থেকে শুরু করে চিকিৎসা করাতে আসা রোগীর আত্মীয়রা– সকলেই তৃপ্ত চন্দ্রার পরিষেবায়।
“এখন রোজ ৩০০ থেকে ৫০০ মানুষ খান আমার কাছে। জলখাবারের পর্ব চুকতেই বেলা ১২টা বেজে যায়। তার পরে বড় জোর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে রেডি করে ফেলতে হয় দুপুরের খাবার। সব সময়ে সেরা খাবারটাই তৈরি করি খদ্দেরদের জন্য। সেটার সঙ্গে কখনও কোনও রকম কমপ্রোমাইজ কোনও দিন করিনি আমরা। এতে হয়তো কোনও দিন দু-‘একটা পদ কম হয়েছে, কোনও দিন কিছু মানুষ কম খেয়েছেন। কিন্তু খাবারের মান বদলায়নি।”– বললেন চন্দ্রা।
বছর খানেকের মধ্যেই খেলা ঘুরে যায়। শুধু সততা আর আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করেও যে এত বড় শহরে পায়ের তলায় মাটি পাওয়া যায়, তা নিজের কাজ দিয়েই প্রমাণ করেছেন চন্দ্রা।
তিনি বললেন, “আমি কখনও ভাবিনি, আমার ছোট্ট পরিবারটাকে নিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারব। আমার মেয়েটা এখন স্কুলে পড়ছে, ও বলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে।” এখন চন্দ্রা ও তাঁর স্বামীর একমাত্র লক্ষ্য, সন্তানের স্বপ্নের পথে তাকে এগোতে সাহায্য করা। আর সেটা এভাবে মাটিতে পা রেখেই।
চন্দ্রা হেসে বলেন, “বড় হোটেল, ভরা ব্যবসা আমার ছিল। সাফল্যের স্বাদ আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়ার পরে বুঝেছিলাম, আচমকা পতনে আঘাত কতটা লাগে। তার চেয়ে এই ভাল। জীবনকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া, হাজার জীবনের মাঝেই। এ এক অন্য সাফল্য। এ সাফল্য বুঝিয়ে দিয়েছে, বিলাসের চেয়ে লড়াইয়ের জোর অনেক বেশি।”