সাহিত্যিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং আইনজ্ঞ নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত (জন্মঃ- ৩ মে, ১৮৮৩ – মৃত্যু- ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৪)

প্রথম জীবনে তিনি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং তিনি কংগ্রেস কর্মী হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। ১৯২৫-২৬ খ্রিস্টাব্দে নবগঠিত ওয়ার্কাস অ্যান্ড পেজ্যান্টস্ পার্টির প্রেসিডেন্ট হন। পরে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে লেবার পার্টি অফ ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২১ জুন ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ম্যাক্সিম গোর্কির মৃত্যুতে কলকাতায় অনুষ্ঠিত শোকসভায় নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সঙ্ঘের যে সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়েছিল তিনি তারও সভাপতি হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রগতিশীল চিন্তা বিস্তারের ক্ষেত্রে এই সঙ্ঘের বিশেষ অবদান ছিল। শুভা, পাপের ছাপ, অভয়ের বিয়ে ইত্যাদি গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা তুলে ধরেন। তাঁছাড়া তাঁর আরও কয়েকটি উপন্যাস পরে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। নরেশচন্দ্র ১৯১০ সালে Abbye of Bliss নামে বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত উপন্যাস আনন্দমঠের ইংরেজি অনুবাদ করেন।
………………….

তিনি বোগরাতে তাঁর মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল টাঙ্গাইলের বাঁশীতে। তাঁর পিতার নাম মহেশচন্দ্র। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।

১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে নরেশচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে এম এ পাস করেন। তারপর তিনি নিও-জার্মান অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ফিলোজফির উপরে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে গবেষণা করেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ওকালতি পাস করে তিনি হাইকোর্টে যোগ দেন। এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে অধ্যাপনা আরম্ভ করেন । তিনি প্রাচীন ভারতের ব্যবহার এবং সমাজনীতি নিয়ে গবেষণা করে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ডিএল উপাধি পান। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা আইন কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল নিযু্ক্ত হন। ১৯২০ থেকে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ছিলেন। আইন উপদেষ্টা হিসাবে তিনি খ্যাতিলাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতায় আইন ব্যবসা শুরু করেন । তিনি এই সময়ে ডিন অফ দ্য ফ্যাকাল্টি অফ ল হন । ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অধ্যাপক হন । ইউনেস্কোর আমন্ত্রনে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় অনুষ্ঠিত অধিবেশনে যোগ দেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় আইন কমিশনের সদস্য হন । কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন সময়ে রিপন কলেজ এবং সিটি কলেজের সাথেও যুক্ত ছিলেন। আইন সংক্রান্ত কিছু গ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন । যার মধ্যে ইভোলিউশন অফ ল বিখ্যাত।
তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম প্রধান ও জগন্নাথ হলের প্রথম প্রোভস্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগদানের পূর্বে তিনি ঢাকা কলেজের সহঅধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্বে তিনি নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের গুরুত্ব তুলে ধরেন ও পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দাবি করেন। তাঁর উৎসাহে জগন্নাথ হলের বার্ষিক পত্রিকা “বাসন্তিকা” প্রকাশিত হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সফরে এলে তিনি বাসন্তিকার জন্য তার বিখ্যাত গান “এই কথাটি মনে রেখ” লিখেছিলেন।

সফল আইনজীবীর পাশাপাশি তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক ছিলেন । তিনি বহু প্রবন্ধ, গল্প, নাটক ও উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যে জীবনধর্মী উপন্যাস রচনার পথিকৃৎ । তাঁকে নিয়ে এক সময় বাংলা সাহিত্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতা এবং নীতি ও দুর্নীতির বিতর্ক হয়েছিল। তিনি ছিলেন সুষ্ঠ যৌন আবেগমূলক রোচক সাহিত্যের গুরু। তাঁর উপন্যাসে যৌন এবং অপরাধ তত্ত্ববিশ্লেষণ প্রাধান্য পেয়েছিল। তিনি নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে তথাকথিত বিশুদ্ধ সতীত্বের থেকে বেশি মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাঁর দীর্ঘ ওকালতি জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁকে মানবমনের নানা কুটিল গতিপ্রকৃতি বুঝতে সাহায্য করেছিল। তাঁর একাধিক উপন্যাস চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছিল। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬০টি । ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন Abbey of Bliss নামে।

তাঁর প্রথম উপন্যাস শুভায় (১৮৯০) নায়িকার স্বামীর গৃহ ত্যাগ এবং স্বাধীন জীবনযাপনের ইচ্ছার সাহসের পরিচয় পাওয়া যায়। পাপের ছাপ-এ (১৯২২) দুঃসাহসিকতার পরিচয় আরো স্পষ্ট। যৌনভাবাশ্রিত ক্রিমিনাল মনোবৃত্তির চিত্রন বাংলা উপন্যাসে এই প্রথম। মেঘনাদ-এ দেখা যায় নায়িকার চরিত্রে জন্মগত অপরাধীর স্বাভাবিক পাপপ্রবণতার চিত্র। লুপ্তশিখায় পতিতা নারীর জীবনের ক্লেদাক্ত গ্লানিময় দিকটিকে আদর্শবাদের আবরণে গোপন করে রাখবার কোন চেষ্টা করা হয় নি। সর্বহারায় পাওয়া যায় বেপরোয়া নাস্তিকের ছবি। বিপর্যয়ে দেখানো হয়েছে বৈপরীত্যের চিত্র । মনোরমার কঠোর বৈধব্য ব্রত পালন, আত্মনিগ্রহের ভিতর দিয়ে যৌবন চঞ্চলতার অনুভব ও এই নবজাত আকাঙ্খার বিবাহে পরিতৃপ্তি সাধন। আর অনীতার ভোগ এবং ঐশ্বর্যপূর্ণ জীবনের কঠোর বৈরাগ্য ও কোমল বৈষ্ণব প্রেমতত্ত্ব উপলব্ধির মধ্যে পরিসমাপ্তি – এই দুটি চিত্র পরিবর্তন সম্ভাবনার দুই বিপরীত সীমা স্পর্শ করেছে।
……………

রচিত গ্রন্থ
শুভা (১৮৯০)
পাপের ছাপ (১৯২২)
অগ্নি সংস্কার (১৯১৯)
অভয়ের বিয়ে
রূপের অভিশাপ (গল্পগ্রন্থ)
ঠানদিনি (গল্পগ্রন্থ)
আনন্দ মন্দির (১৯২৩ নাটক)
যুগপরিক্রমা (https://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.301619/page/n1)
…………….
তথ্য সংগৃহীত – প্রতাপ সাহা (https://www.facebook.com/pratapcsaha)। ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.