মন্দিরময় ভারতে “ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার স্মৃতি মন্দির” একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।কেন না,এই স্মৃতি মন্দিরটি সাধারণ মন্দিরের চেয়ে আলাদা।ভারতে এবং ভারতের বাইরে যত হিন্দু মন্দির আছে,সেগুলি সবই দেবমন্দির ও অবতার পুরুষদের নামাঙ্কিত মন্দির।সেই অর্থে শ্রী হেডগেওয়ার কোনো অবতার পুরুষ বা সাধু সন্ত নন।তিনি বিশ্বের বৃহত্তম অরাজনৈতিক সেবা ও দেশপ্রেমী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার।তিনি চিকিৎসকও ছিলেন।তাই তাঁকে ডাক্তারজী নামেও সম্বোধন করা হয়।
মহারাষ্ট্রের নাগপুর নগরের রেশমবাগ এলাকায় এই স্মৃতি মন্দির অবস্থিত।প্রতি বছর দেশ ও বিদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ এই মন্দির দেখতে আসেন।তাঁরা ডাক্তারজীর দেশ ও সমাজের প্রতি অবদানের জন্য তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন।
ডাক্তারজী পরাধীন ভারতের অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন।প্রথম দিকে কংগ্রেসের ডাকে স্বাধীনতা আল্দোলনে ঝাঁপিয়েও পড়েন।কিন্তু অচিরেই তিনি কংগ্রেসের মেকী দেশপ্রেমের স্বরূপটি ধরে ফেলেন।অনুধাবন করেন যে,কংগ্রেসের তৎকালীন নেতারা নিজেদের স্বার্থেই দেশোদ্ধারের ধুয়া তোলেন।তাঁরা সবাই নিজ নিজ স্বার্থ পূরণের জন্যই ইংরেজ বিদ্বেষ দেখায়।যা আসলে “ইং-কং”-এর এক গভীর গট আপ গেম!
দেশের তৎকালীন বর্তমান ও ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারতকে রক্ষা করার নিমিত্তে দেশের জন্য বলিপ্রদত্ত প্রজন্ম তৈরীর জন্য এক বলিষ্ঠ সংগঠন গড়ে তোলার সংকল্প গ্রহণ করেন।এই সংকল্পেরই বাস্তবায়ন ঘটে ১৯২৫ সালে বিজয়া দশমী তিথিতে।এই তিথিতেই তিনি গুটিকয়েক কিশোর-তরুণদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ RSS. সেই থেকেই RSS ব্যক্তি নির্মাণ ও রাষ্ট্র রক্ষার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে।ডাক্তারজী-ই ছিলেন সঙ্ঘের প্রথম সরসঙ্ঘচালক।পরবর্তীতে তিনি এই দায়িত্ব অর্পণ করে যান সদাশিব রাও গোলওয়ালকার বা গুরুজীর উপর।
RSS তার প্রতিষ্ঠাতাকে শ্রদ্ধা জানাতে ও দেশের প্রতি তাঁর অবদানকে সকলের সামনে তুলে ধরতে ১৯৬২ সালে ৫ এপ্রিল ডাক্তারজীর জন্মস্থান রেশমবাগে “ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার স্মৃতি মন্দির” প্রতিষ্ঠা করে।এই কারণেই মন্দিরময় ভারতে এ স্মৃতি মন্দির একটু আলাদা ধরণের।
সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ স্বয়ংসেবক অন্যান্য নাগরিকদের কাছে এই একটি স্মৃতি সৌধই নয়।ব্যক্তি নির্মাণ,রাষ্ট্র নির্মাণ,দেশ-দশ-সমাজসেবার এক মূর্ত প্রতীক-মন্দির।বিশ্ববাসীর কাছে পবিত্র তীর্থক্ষেত্রের মর্যাদা লাভ করেছে এই স্মৃতি মন্দির।তাদের দর্শনীয় স্থানের তালিকায় এটি অবশ্যই থাকে।
মন্দিরটি ডাক্তারজীর সমাধী ক্ষেত্রের উপর গড়ে তোলা হয়েছে।তবে প্রথগত ও ঐতিহ্যগত ভাবে প্রচলিত মন্দিরের ধাঁচে এর গঠনশৈলী নয়।এখানে ডাক্তারজীর একটি পূর্ণাবয়ব ব্রোঞ্জ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে।আগত দর্শনার্থী ও স্বয়ংসেবকগণ এই মূর্তির সামনেই তাঁদের আন্তরীক শ্রদ্ধার্ঘ্য ডাক্তারজীর উদ্দেশ্যে অর্পণ করেন।মন্দির চত্বরে কোনো ফুল-মালা-মিষ্টান্ন-বই ইত্যাদির দোকান নেই।যা অন্যান্য ধর্মীয় মন্দির চৌহদ্দিতে দেখা যায়।এদিক দিয়ে দেখলে এই স্মৃতি মন্দির অন্যান্যদের থেকে আলাদা।কোলাহল বর্জিত,দৃষ্টি নন্দন মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলেই আগন্তুকের মনে পবিত্রতা ও অপার প্রশান্তি নেমে আসে।
ডাক্তারজী ১৯৪০-এর ২১ জুন তাঁর নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন।যে-স্থলে তাঁকে দাহ করা হয়,সেই পবিত্র ভূমির উপরেই স্মৃতি মন্দির নির্মিত হয়েছে।প্রথম একটি তুলসী বেদী বানানো হয়েছিল।যার নাম ছিল “তুলসী বৃন্দাবন”।এই বেদীর দ্বারা সেই পবিত্র ভূমিকে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছিল।
১৯৪৮ এ মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করার পর পরই কিছু দুষ্কৃতীরা এই পবিত্র তুলসী বেদী ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।কংগ্রেস ও তার সহচররা বলতে থাকে যে গান্ধীর হত্যার পিছনে RSS-এর হাত রয়েছে।সেই অজুহাতে RSS-কে নিষিদ্ধ করে জওহর লাল নেহেরু।সঙ্ঘের প্রচারক,বিস্তারক ও প্রচুর সংখ্যক স্বয়ংসেবকদের কারারুদ্ধ করে কংগ্রেস চালিত জাতীয় সরকার।অথচ পরে প্রমাণিত হয় যে RSS গান্ধী হত্যায় জড়িত ছিল না।যাইহোক তখন দুষ্কৃতীরা ডাক্তারজীর সমাধী বেদীকে ভেঙে দেয়!অপবিত্র করে দেয়!১৯৪৯ সালে RSS-এর উপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।তখন আবার সমাধীক্ষেত্রটি চিহ্নিত করে সাধারণ মানের একটা কুঠির বানিয়ে ঘিরে রাখা হয়।বেদীটিও মেরামত করা হয়।
১৯৫৫ সালে কিছু প্রস্তাব আলোচিত হয় সমাধীক্ষেত্রের উপর স্থায়ী একটি মন্দির নির্মাণ বিষয়ে।যাতে প্রাকৃতিক ও মানুষের আক্রমণ থেকে এই পবিত্র ভূখন্ডকে রক্ষা করা যায়।স্মৃতি সৌধ নির্মাণের লক্ষ্যে মুম্বাই কেন্দ্রীক স্থপতিবিদ দীক্ষিতকে স্মৃতি মন্দিরের একটি নক্সা বানাতে অনুরোধ করা হয়।১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে স্মৃতি মন্দির নির্মাণে কর্মসূচী গৃহীত হয়।এবং পাঁচটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় : ১) ডাক্তারজীর দাহস্থলটি মন্দিরের মধ্যস্থলে থাকবে। ২) একটি কক্ষ নির্মিত হবে মূল সমাধীবেদীকে সংরক্ষণের জন্য।এই কক্ষের উপরে ডাক্তারজীর একটি মূর্তি নির্মিত হবে। ৩) পুরো নির্মাণ কর্ম সম্পন্ন হবে পাথর দিয়ে। ৪) স্মৃতি মন্দিরের অন্তর বহিঃ সৌন্দর্যায়নের ব্যয় যতটা সম্ভব কমাতে হবে। ৫) স্থাপত্যে দেশীয় দ্রব্যাদি ব্যবহৃত হবে।
RSS প্রথমে নাগপুরের কাছাকাছি অঞ্চলে উপযুক্ত গুণমানের পাথর খোঁজ করে।কিন্তু তা পাওয়া যায় নি।তারপর দক্ষিণ ভারতে অনুসন্ধানে চালানো হয় পাথরের থেকে চূড়া পর্যন্ত নির্মিত হবে রাজস্থানের যোধপুরের স্যান্ডস্টোন দিয়ে।মুম্বাই বিখ্যাত স্থাপত্যবিদ নানাভাই গোরেগাওনকর পুরো নির্মাণ করাবেন।
পাথর-সন্ধানী দলটি নাসিক,মানমাদ,সাঙলি ইত্যাদি অঞ্চলে পাথরের খোঁক করতে থাকে।অবশেষে তালওয়াড়ে গ্রামের পাথর উপযুক্ত মনে হলে বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন।গুরুজী মন্দিরের নক্সার চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
তখনকার কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রমুখ পাণ্ডুরঙ্গপন্থ ক্ষীরসাগর মরোপন্থ পিংলে,বাবাসাহেব তালতুলে,প্রযুক্তিবিদ কারভিন্দে,রাজমিস্ত্রী আহির রাও,মনোহর ইন্দা পাওয়ার,বসন্ত যোশী প্রমুখদের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ কাজ চলতে থাকে।
কাকতলীয় ভাবে ওই একই সময়কালে শ্রী হেডগেওয়ারের জন্মতিথিও এসে যায়।তিথি উদযাপন উপলক্ষ্যে “ডাঃ হেডগেওয়ার স্মারক সমিতি” প্রতিষ্ঠিত হয়।অতপর মন্দির ও স্মারক সমিতি যৌথ ভাবেই স্মৃতি মন্দিরের কাজে আত্মনিয়োগ করে।১৯৫৯ সালের বর্ষ প্রতিপদ তিথিতে ভূমিপূজন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।সমগ্র কার্যসূচী দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক শ্রী গুরুজী নিজের হাতেই করেন।১৯৬০-এর জানুযায়ীর মধ্যেই মন্দিরের “গ্রাউন্ড ফ্লোর”-এর কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যায়।
স্মৃতি মন্দিরটি এক হাজার দু’শ বর্গ ফুট এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।মূল সমাধী ভবনের উচ্চতা ৪৫ ফুট।পুরানো সমাধীটা মার্বেলে মোজাইক করা।তার সাথে নানা রঙের পাথরও ব্যবহৃত হয়েছে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য।
সবুজ রঙের পাথর ভাদোদরা,লাল গ্রানাইট মহিশোরের চামুন্দা পাহাড় ও সাদা মার্বেল আনা হয় মাকরানা থেকে। মন্দির গঠনশৈলীর কারণে দর্শক চতুর্দিক দিয়েই দর্শন করতে পারেন।মন্দিরের চূড়ায় ফুটন্ত পদ্মের ওপর “মঙ্গল ঘট” স্থাপিত হয়েছে।
ডাক্তারজীর পূর্ণাবয়ব মূর্তিটি প্রথম তলে স্থাপন করা হয়েছে।স্থাপিত হয় ২৩ ডিসেম্বর,১৯৬১-তে।মূর্তিটির পিছন দিক বাদে তিন দিক দিয়েই দর্শন করা যায়।প্রথম তলে ওঠার জন্য দুই দিকে দিয়েই সিঁড়ির ব্যবস্থা আছে।
স্মৃতি মন্দির নির্মাণ চলাকালে জবলপুরে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়।মন্দিরে হাকিম ভাইয়ের অধীনে অনেক মুসলমান মিস্ত্রী-মজুর কাজ করছিলেন।তাঁদের মধ্যে অনেকেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় কাজ ছেড়ে চলে যান।যাঁরা থেকে গেলেন তাঁরাও অনেক অনিশ্চয়তায় ভুগতে লাগলেন।এটা লক্ষ্য করে পাণ্ডুরঙ্গপন্থজী তাঁদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিলেন।বোঝালেন।শেষ পর্যন্ত গুরুজী তাঁদের আশ্বস্ত করলে তাঁরা নিশ্চিন্ত মনে কাজ করতে লাগলেন।হাকিম ভাইয়ের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে গুরুজী তাঁকে একটি স্বর্ণাঙ্গুরীয়,একটি শাল ও একটি “শ্রীফল” দিয়ে অভিনন্দিত করেন এবং তাঁকে রাজস্থানের নিজ বাড়িতে নিরাপত্তা-যোগে পৌঁছে দেওয়া হয়।
“ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার স্মৃতি মন্দির”-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৯৬২ সালের ৫ এপ্রিল।ওই বর্ষ প্রতিপদ তিথি ও একই ডাক্তারজীর জন্মতিথিও।সারা বিশ্বের সকল স্বয়ংসেবক-সহ সকল রাষ্ট্রবাদী ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।২০০০ স্বয়ংসেবকদের নিরলস পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ে বিপুল সংখ্যক মানুষদের থাকা-খাওয়া-যাতায়াতের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা করা হয়েছিল।কোনো কার্যক্রমেই কোনোরূপ বিশৃখঙ্খলতা হয় নি।আমন্ত্রণ গ্রহণ সত্ত্বেও যাঁরা উদ্বোধনে অংশ নিতে পারেন নি,তাঁরা অনেকেই তাঁদের বানী দূত মারফৎ পাঠিয়ে ছিলেন।
উদ্বোধনের যাবতীয় কার্যক্রম বৈদিক মতে সম্পন্ন করেন গুরুজী গোলওয়ালকার।তিনি তাঁর বানীতে বলেন যে,”এই স্মৃতি মন্দির শুধুমাত্র পবিত্র স্থানই নয়।এটি দেশপ্রেম,রাষ্ট্র গঠনের এক তীর্থক্ষেত্র।এখান থেকেই আমরা দেশপ্রেমের জন্য উদ্বুদ্ধ হব”।
গুরুজী দেহ ত্যাগ করেন ১৯৭৩ সালের জুনে।স্মৃতি মন্দিরের সামনে তাঁর নশ্বর দেহের সৎকার করা হয়।ডাক্তারজীর মৃত্যুর পর ৩৩ বছর গুরুজী সঙ্ঘ ও দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।গুরুজীর সমাধীতে নিরন্তর “যজ্ঞ জ্বালা” মঙ্গলদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়।আগত দর্শনার্থীরা এই দীপের জ্যোতিতে দেশপ্রেমে উদ্বোধিত হয়ে ওঠেন।
RSS আজ ভারতীয় জনজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে।ব্যক্তি নির্মাণ,সমাজসেবা তথা রাষ্ট্রবাদী নাগরিক তৈরী করে চলেছে।দেশের অখন্ডতা বজায় রাখা,ভারতবাসীর মধ্যেকার বিভিন্নতা দূরীকরণে নিরন্তর ও নীরবে কাজ করে চলেছে RSS.
স্বয়ংসেবকদের পাশাপাশি প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গও বিভিন্ন সময়ে এই স্মৃতি মন্দিরে এসে ডাক্তারজীর প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন।যেমন–দলাই লামা,দুই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ.পি.জে.আব্দুল কালাম,প্রণব মুখোপাধ্যায়,প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রমুখ।
: সুজিত চক্রবর্তী :