ধর্ম আফিম, তাই ধর্মের সঙ্গে যুক্ত কাউকে বামপন্থীরা মানতে নারাজ। কিন্তু এখানে ‘ধর্ম’ বলতে কেবলমাত্র ‘হিন্দুধর্ম’-ই পড়তে হবে। অন্য ধর্মের নেতাদের জন্য এই নিয়ম নয়। সেখানে শিখধর্মী হরকিষেণ সিং সুরজিৎ সহ বহু মুসলমান নেতাদের নাম একে একে চলে আসবে। কিন্তু হোপ-৮৬ খ্যাত সুভাষ চক্রবর্তী তারাপীঠে গেলেই মস্ত বড় অপরাধ হয়ে যাবে। কারণ তিনি যে হিন্দু ধর্মের আচার পালন করছেন!
স্বামী বিবেকানন্দ পয়লা মে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেছেন বটে, তিনি ভারতের শ্রমজীবীদের চিন্তায় মগ্ন থেকেছেন বটে, বলেছেন বটে “…. নূতন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে। …… বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে। বেরুক ঝোড় জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে।” — তবুও যেহেতু তিনি ‘Hindu Monk of India’, যেহেতু তিনি হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য কীর্তনীয়া, তাই তিনি বামপন্থীদের আদর্শ নন, হতেও পারেন না।
বরং পদেপদে স্বামীজিকে অপদস্থ করার জন্য বামপন্থীরা মুখিয়ে আছেন। একসময় রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী কলেজে আইনী লড়াইয়ে লড়েছে বামপন্থীরা। এমনই সামাজিক-রাজনৈতিক আবহ পয়লা মে এবং রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা দিবস এলেই নেটিজেনরা বিভ্রান্ত হয়ে যান। ‘শ্যাম রাখি, না কুল রাখি!”
যারা স্বামীজির ভক্ত, তারা বামপন্থীগ্রুপগুলিতে হিন্দু বিরোধিতা দেখলেও চুপচাপ থাকেন। হিন্দু দেবদেবীদের অসম্মান করা হলেও ‘রা’ কাটেন না। ‘সর্বংসহা হিন্দু’ হয়ে থাকাই তারা যথার্থ মনে করেন। কিন্তু অন্য গ্রুপে পয়লা মে নিয়ে পোস্ট দিলেও, রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা নিয়ে কথা বললেও, কখনও বলতে শুনিনি — বিবেকানন্দকে সাম্যবাদী সন্ন্যাসী এবং সমাজতান্ত্রিক নেতা হিসাবে মেনে নেওয়া উচিত। বামপন্থীরা বিশ্বাস করেন না সমাজতান্ত্রিক জীবনদর্শনে স্বামীজির অংশীদারিত্ব আছে, বিশ্বাস করেন না পৃথিবীব্যাপী সাম্যবাদের তিনি অন্যতম দিশারি। তারা কখনও দাবী তোলেন নি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (বিবেকানন্দবাদী) নামে একটা বামদল গড়ে উঠুক।
বামপন্থীরা সব জেনে বুঝেও এইরকম দাবী তোলেন না, তার কারণ তারা জানেন, ‘বামেরা একমাত্র হিন্দুধর্ম নিয়ে প্রবল মৌলবাদী’। বামেদের রাজত্ব এবং সাইনবোর্ড চলে গেলেও বামপন্থার আবহ এখনও মস্তকে-মস্তিষ্কে বইয়ে রাখতে পেরেছে তারা। এ কম গর্বের নয়! কারণ নানান গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বিশেষত শিক্ষা ও বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে এখনও বামেরাই বসে আছেন সর্বত্র। উপরে সবুজ, নীল, গেরুয়া ইত্যাদি রং দেখা যায় বটে, ভেতরে টকটকে লাল। এজন্য দক্ষিণপন্থী নীতিনির্ধারণকারী বোকা নেতাদের সময়ে সময়ে তোয়াজ করতেও ছাড়েন না বামপন্থীরা। কারণ ওইসব পদগুলো তাদের চাই, যেখানে বৌদ্ধিক বিপ্লব এখনও করে যাওয়া সম্ভব হবে৷ রাজত্ব নেই তো কী হয়েছে! বহু দক্ষিণপন্থী নেতা-কার্যকর্তারাই সুপারিশের ঝুলি নিয়ে বুদ্ধিজীবী বামপন্থী মানুষদের জন্য ঘোরাঘুরি করেন বলে,অভিযোগ আছে।
স্বামীজি বলছেন, “দরিদ্র, মূর্খ, অজ্ঞানী, কাতর — ইহারাই তোমার দেবতা হউন।” বলছেন, “তোমরা ভারতের চিরপদদলিত শ্রমজীবী! — তোমাদের প্রণাম করি।” শ্রমিকশ্রেণীর অটল প্রাণশক্তির কথা, অপরিমেয় শারীরিক শক্তির কথা তিনি স্বীকার করেছেন, “এরা সহস্র সহস্র বৎসর অত্যাচার সয়েছে, নীরবে সয়েছে — তাতে পেয়েছে অপূর্ব সহিষ্ণুতা। সনাতন দুঃখ ভোগ করেছে — তাতে পেয়েছে অটল জীবনীশক্তি। এরা এক মুঠো ছাতু খেয়ে দুনিয়া উল্টে দিতে পারবে; আধখানা রুটি পেলে ত্রৈলোক্যে এদের তেজ ধরবে না ….। ” এইরকম কথা বলতে পারেন এমন আন্তর্জাতিক সমকালীন কোনো নেতাকে দেখান দেখি! স্বামীজি বিশ্ব নেতা। তিনি অধ্যাত্মজগতে দাঁড়িয়েই সামাজিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের বামপন্থীরা তা অস্বীকার করলে সমূলে শেষ হয়ে যাবেন। তাই একবার দাবী উঠবে নাকি, শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থে “ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (বিবেকানন্দবাদী)” নামে একটা বামদল গড়ে উঠুক! আচ্ছা স্বামী বিবেকানন্দ নিয়ে যদি আপত্তি থাকে, তো শ্রীচৈতন্যের নামে একটি সাম্যবাদী দল গড়ে উঠুক, @কী কমরেড!
– কল্যাণ গৌতম ।