বিজন সেতু হত্যাকান্ডের চার দশক পূর্ণ

“কী করা যায়? এমন ঘটনা ঘটে।”
১৯৮২ সালে বিজন সেতু গণহত্যা সম্পর্কে
তুমুল হইচই, আলোড়ণের মধ্যে এ কথা প্রকাশ্যে বলেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। চার দশক পূর্ণ করল সেই গণহত্যা। এক দশকের ওপর হয়ে গেল তৃণমূল সরকারের। আনন্দমার্গীদের ক্ষোভ, “নৃশংস ওই ঘটনায় কারও সাজা হয়নি। ক্ষমতায় আসার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের খুব কাছের মানূষ ছিলেন। এখন আর আমাদের প্রয়োজন নেই ওনার। তবু অপেক্ষায় আছি।”

দিনের পর দিন প্রথম পৃষ্ঠায় আসা রামপুরহাটের সাম্প্রতিক গণহত্যা এখন খবরের বৃত্ত থেকে প্রায় বেড়িয়ে যেতে বসেছে। এভাবেই বিস্মৃত হয়ে গিয়েছে সাঁইবাড়ি থেকে নন্দীগ্রাম, বরানগর থেকে বানতলা— এ রাজ্যে আলোড়ণ জাগানো বিভিন্ন গণহত্যা। প্রতিটাই এক একটা অধ্যায়। রামপুরহাটের এই বাতাবরণে ৩০ এপ্রিল আনন্দমার্গীদের হত্যাকান্ডের ৪০ বছর পূর্ণ হবে। লোকে ভুলে গিয়েছে সেই ঘটনা।

কী হয়েছিল ১৯৮২ সালের ৩০ এপ্রিল? আনন্দমার্গের ১৬জন সন্ন্যাসী ও একজন সন্ন্যাসিনী কলকাতার তিলজলায় তাঁদের মুখ্য কার্যালয়ে শিক্ষা সম্মেলনে যাচ্ছিলেন। বালিগঞ্জে বিজন সেতুতে ট্যাক্সির ভিতর থেকে টেনে তাঁদের বাইরে আনা হয়। একই সময় তিনটি ভিন্ন স্থানে পিটিয়ে মেরে দেহগুলি এক করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।

মার্গীদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের বিরোধের প্রথম আক্রমণটি হয় ১৯৬৭ সালে, পুরুলিয়ায় সদর দফতরে। সেখাখানে তাদের পাঁচজনকে সিপিআই (এম) ক্যাডাররা হত্যা করেছে বলে অভিযোগ। ঠিক দু’বছর পরে, আনন্দমার্গের কোচবিহার মণ্ডলীতে হামলা হয়। সিপিএম সর্বদা বিশ্বাস করত যে মার্গের আধ্যাত্মিক-ধর্মীয় আবরণের নীচে রয়েছে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং এজেন্ডা। এমনকি ১৯৮২ সালের বিজন সেতু হত্যাকাণ্ডের পরেও, ১৯৯০ সালের এপ্রিলে, পুরুলিয়ায় আনন্দমার্গের পাঁচ সদস্য সিপিআই(এম) ক্যাডারদের দ্বারা খুন হয়েছিল বলে অভিযোগ।

বিজন সেতু হত্যাকাণ্ডে বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ওঠে। চাপের মুখে জ্যোতি বসু দেব কমিশন গঠন করেন। কিন্তু আনন্দমার্গীদের সেই কমিশনের উপর কোনও আস্থা ছিল না। কারণ, কান্তি গাঙ্গুলী, রবীন দেব সহ সিপিএম নেতারা এই ঘটনায় অভিযুক্ত ছিলেন।জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ১৯৯৬ সালে এই মামলার তদন্ত শুরু করে। কিন্তু অভিযোগ, রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে খুব বেশি এগোয়নি। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে বারবার আনুষ্ঠানিক বিচার বিভাগীয় তদন্তের আবেদন করে। পরে কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অমিতাভ লালার তত্ত্বাবধানে একটি এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় কমিশন হয়। ২০১২ সালের মার্চ মাসে এই হত্যাকাণ্ড তদন্তের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়।

কমিশন সূত্রের মতে, কিছু নথিতে অভিযোগ করা হয়েছে যে কসবা-যাদবপুর এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সিপিআই (এম) নেতারা ১৯৮২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আনন্দমার্গীদের নিয়ে আলোচনা করতে পিকনিক গার্ডেনের কলোনি বাজারে মিলিত হন। আনন্দমার্গীরা আদর্শগতভাবে সিপিএমের বিরোধিতা করেছিল। আশির দশকের গোড়ার দিকে সিপিএম তাদের কার্যকলাপ নিয়ে গভীরভাবে সন্দিহান ছিল। বিজন সেতুর ঘটনা তারই ফলশ্রুতি।

বাম আমলে বিজন সেতুর ওই ঘটনা নিয়ে তদন্ত হয়েছিল। জ্যোতি বসুর সরকার কমিশন গঠন করেছিল। সেই কমিশনে অন্যতম সাক্ষী ছিলেন সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। বাম আমলে কমিশনের কাজে খুশি ছিলেন না আনন্দমার্গীরা। তৃণমূল রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পুনরায় ওই ঘটনায় তদন্তের আবেদন করেন তাঁরা। গঠিত হয় লালা কমিশন। ২০১৬-র ১০ জানুয়ারি সল্ট লেকের ইন্দিরা ভবনে সেই কমিশনের সাক্ষ্য দেন কান্তিবাবু।

গত ২৪ এপ্রিল কান্তিবাবু অবশ্য এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, “আমি ওই ঘটনায় জড়িত ছিলাম না।“ তাহলে কেন বারবার আপনাদের নামে অভিযোগ উঠেছে? কারা, কেন ওই ঘটনা ঘটিয়েছিল? কান্তিবাবু বলেন, “আনন্দমার্গীদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, জনরোষ—সব মিলিয়ে ওরকম হয়েছে। বাম আমলে দেব কমিশন তৈরি হয়েছিল। ওরা তো তাতে সাক্ষ্য দিতে আসেনি। কমিশনও আমাদের কাউকে অভিযুক্ত করেনি।“ কিন্তু হত্যাকান্ডের আগে আনন্দমার্গীদের রুখতে এক সভায় আপনি ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক শচীন সেন, স্থানীয় নেতা নির্মল হালদার, ১০৮ নং ওয়ার্ডের (তিলজলা-কসবা) প্রাক্তন কাউন্সিলর অমল মজুমদার এবং যাদবপুরের তৎকালীন সংসদ সদস্য (ও পরবর্তীকালে লোকসভার স্পিকার) সোমনাথ চ্যাটার্জি প্রমুখ। কান্তিবাবুর দাবি, “হ্যাঁ, সোমনাথদা ছাড়াও অশোক মিত্র, সত্যসাধন চক্রবর্তীর মত নেতারা একটা কনভেনশন ডেকেছিলেন। আমি ওই ঘটনায় ছিলাম না।“ প্রসঙ্গত, ওই তিন নেতার কেউ আর বেঁচে নেই।

বছর ২০ বয়সে আনন্দমার্গী হন দিব্যচেতনানন্দ। এখন বয়স ৫২। সংগঠনের অন্যতম কর্মকর্তা। এই প্রতিবেদককে বলেন, “বাম আমলে কারও সাজা হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা কমিশন করিয়েছিলেন। তার তদন্ত অনেক আগেই শেষ হয়েছে। বিধানসভার স্পিকারকে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে বলেও শোনা গেছে।“

আপনারা কি সেই রিপোর্ট প্রকাশের দাবি করবেন? দিব্যচেতনানন্দ বলেন, “আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। এখন অনেক দূরে সরে গেছেন।“ কেন রাজ্য সরকার তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট পেশ করছেন না? দিব্যচেতনানন্দর উত্তর, “সিপিএমের ওই লোকেদের অনেকে এখন তৃণমূলে। কেন রাজ্য ওদের খোঁচাবে?” ঘটনার নেপথ্যে সিপিএম-ই ছিল বলে দাবি আনন্দমার্গের।

কিন্তু কেন? দিব্যচেতনানন্দ বলেন, “আমরা সে সময় তিলজলায় নিকটবর্তী দুটি জায়গায় মোট চার একর জায়গা কিনি। জমির কাঠাপিছু দাম ছিল দুহাজার টাকা। আরও জমি কেনার কথাচলছিল। সিপিএম ওই এলাকায় আমাদের উপস্থিতি চায়নি। নানাভাবে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচার চলে। আটকানো হয়।”

ওই দিন স্মরণসভা করতে অতীতে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে আনন্দমার্গীদের। এবার ৩০শে প্রকাশ্যে তাঁরা ওই বিশেষ দিনে ’দধিচী দিবস’ পালন করবেন। দিব্যচেতনানন্দ বলেন, “সংবিধানের ২৬ ধারা অনুযায়ী আমরা ধর্মীয় সংগঠনের স্বীকৃতি পেয়েছি। আমাদের এই সমাবেশের অধিকার আছে। গত দু’বছর করোনার জন্য সব রকম সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এবার দুপুরে দেশপ্রিয় পার্ক থেকে পদযাত্রায় আসব বিজন সেতু। সেখানে চলবে মাল্যদান-শ্রদ্ধাঞ্জলী, কীর্তন-ভজন।“

অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.