১.
যদি কোনো দলে কেউ মনে করেন, তিনি চিরকালই নেতা-নেত্রী থাকবেন, চক্রাকারে সাধারণ কর্মী হয়ে আর ফিরবেন না, কমিটির পদ গেলেই তাঁর গোঁসা হবে, তবে বুঝতে হবে সে দল, সেই সংস্থা ভেতরে ভেতরে কখন মরে গেছে! এ প্রসঙ্গে রবি ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাস থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দেবো। গ্রন্থটি ১৯২৯ সালে লেখা, যখন ঔপন্যাসিকের বয়স ৬৮ বছর। নিজের বিরুদ্ধেই কলম ধরে রবীন্দ্র বিরোধিতার অস্ত্র ভোঁতা করে দিয়েছিলেন তিনি। পরিহাসের ছলে লিখলেও এই অংশটুকু অন্য অ্যাঙ্গেলে আমাদের সকলের শিক্ষণীয়, নেতাদের তো বটেই। কাহিনির নায়ক ‘অমিত’-কে দিয়ে তিনি বলাচ্ছেন —
“রবি ঠাকুরের বিরুদ্ধে সব চেয়ে বড়ো নালিশ এই যে, বুড়ো ওয়ার্ড্স্বার্থের নকল করে ভদ্রলোক অতি অন্যায়রকম বেঁচে আছে। যম বাতি নিবিয়ে দেবার জন্যে থেকে থেকে ফরাশ পাঠায়, তবু লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও চৌকির হাতা আঁকড়িয়ে থাকে। ও যদি মানে মানে নিজেই সরে না পড়ে, আমাদের কর্তব্য ওর সভা ছেড়ে দল বেঁধে উঠে আসা। পরবর্তী যিনি আসবেন তিনিও তাল ঠুকেই গর্জাতে গর্জাতে আসবেন যে, তাঁর রাজত্বের অবসান নেই, অমরাবতী বাঁধা থাকবে মর্তে তাঁরই দরজায়। কিছুকাল ভক্তরা দেবে মালাচন্দন, খাওয়াবে পেট ভরিয়ে, সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করবে, তার পরে আসবে তাঁকে বলি দেবার পুণ্যদিন—— ভক্তিবন্ধন থেকে ভক্তদের পরিত্রাণের শুভলগ্ন।” এখানে মূল বক্তব্য বয়স বা প্রবীণতা বিষয়ক নয়। বিষয় হল নিজের আখের গোছাতে প্রতিষ্ঠানকে আঁকড়ে থাকা। ব্যক্তিপূজা যে একেবারেই অনুচিত, তা রবীন্দ্রনাথ সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন বক্তব্যের পরবর্তী অংশে —
“পূজা জিনিসটাকে একঘেয়ে করে তোলার মতো অপবিত্র অধার্মিকতা আর-কিছু হতে পারে না।…ভালোলাগার এভোল্যুশন আছে। পাঁচ বছর পূর্বেকার ভালোলাগা পাঁচ বছর পরেও যদি একই জায়গায় খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তা হলে বুঝতে হবে, বেচারা জানতে পারে নি যে সে মরে গেছে। একটু ঠেলা মারলেই তার নিজের কাছে প্রমাণ হবে যে, সেন্টিমেন্টাল আত্মীয়েরা তার অন্ত্যেষ্টি-সৎকার করতে বিলম্ব করেছিল, বোধ করি উপযুক্ত উত্তরাধিকারীকে চিরকাল ফাঁকি দেবার মতলবে।”
দলে পরবর্তী যোগ্যতরকে ফাঁকি দিতেই পদ কুক্ষিগত করে রাখে দলপতি। রবি ঠাকুরের প্রস্তুত বক্তব্যের মূল উপজীব্য বিষয় এটাই। ‘ভালোলাগার এভোল্যুশন’ বলতে তিনি যুগধর্মের বাস্তবতাকে বোঝাতে চেয়েছেন। যতবড়ই দেবী হোন না কেন, যুগধর্মে তাঁকেও ছাপিয়ে যান আরেক দেবতা। কারও আসনই চিরকালের নয়। নইলে বাংলার গ্রামে গ্রামে দেবী চণ্ডীকে ছাপিয়ে একসময় মনসা বহুল পূজিতা দেবী হলেন কীভাবে?
২.
একটা দল কখন ‘বেঁচে’ থাকে? একটা প্রতিষ্ঠান কখন ‘অমর’ হয়? নেতা-নেত্রীরা যখন একদম নিচুতলার কর্মী/সমর্থক বনে যাবার হিম্মত দেখান তখন। তবে সে দল সজীব, তবে সে কমিটি তাজা, তবে সে সংগঠন বেঁচে আছে! সেল্ফি তুলে নেতাকে বা নিজেকে অহরহ ‘দামী’ করা যায় না, যাবেও না। নেত্রীর প্রাপ্য গুরুত্বের চাইতে গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলা যায় না, যাবেও না। এটা এক ধরনের ‘রাজনৈতিক-দুর্নীতি’। একটা সময়ের পর আর ভোটার তাঁকে বিশ্বাস করবেন না। প্রেস কনফারেন্স করে যতই স্টেটমেন্ট দেওয়া হোক না কেন!
জোরজবরদস্তি ‘দেবীপূজা’ দলের পক্ষে ক্ষতিকর। যদি ‘থোড়-বড়ি-খাড়া’ করে ‘অমুক-অমুক’ পদ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেদের মধ্যে দখল করে একটা ‘দীর্ঘকালীন সিণ্ডিকেট’ বানানোর চেষ্টা হয়, তবে তার মধ্যে গণতন্ত্রের বিন্দু-বিসর্গও অবশেষ থাকে না। থাকা সম্ভবও নয়।
সকলের চক্রাকারে আবর্তনের মানসিকতা চাই। কর্মীরাও নেতাকে চলার পথ দেখাচ্ছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন এরকম অসংখ্য উদাহরণ চাই। উদাহরণ কই? আসলে নেতানেত্রীরা কর্মীদের কখনও ‘মহীয়ান’ করে তোলেন না বলেই, আমরা কেউ কর্মী হয়ে ফিরে যেতে চাই না, চিরকাল দলের মধ্যমণি বনতে চাই। কারণ নেতা আর কর্মীর বিস্তর ফারাক।
নেতারা উপরের সারির, কর্মীরা নীচের সারির — এই ভ্রান্ত ধারণা যখনই জন্ম নেবে, তখনই দল ‘পিছড়েবর্গ’-র চাইতেও পিছিয়ে পড়বে। বিস্তর নেতার পাহাড়- প্রমাণ ভার অল্প সংখ্যক কর্মী নেবেন কীভাবে! এ তো পিরামিডকে উল্টোপিঠ করে স্থাপন!
কর্মীর যে তুচ্ছ অবস্থান নয়, সেও যে ভাবতে পারে, ভাবাতে পারে, দলকে তালুর মতো চিনতে পারে, বহু বুদ্ধিজীবীকে আটকে রাখতে পারে, এটাতে নেতারা সবসময় ‘না’ ধরেই রেখেছেন। তাই নিচুতলার সদস্যের ‘গরিমা’ নেই। তাই নেত্রী কর্মী হতে চান না। এটা যেকোনো প্রতিষ্ঠানেই গভীরভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে, কর্মীরাই অনন্য সম্পদ। কথায় আছে, ‘কর্মী নেই তো ভোট নেই’। ‘বিজবিজে নেতা তো গিজগিজে কথা।’
প্রত্যেকে নিজের নিজের দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করে, নতুন করে কর্মকর্তা তৈরির সুযোগ করে দিলে সমিতির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, আর সেটা নেতাদের পক্ষেও মঙ্গল। তবে খেয়াল রাখবেন, হতাশায় ‘কাঠি’ দিয়ে ফেলবেন না যেন! থাকুন না এক/দু’টো টার্ম নেতা থেকে স্রেফ কর্মী হয়ে! আবার ঘুরে বসবেন একদিন, আবারও নেত্রী হবেন। দেবীপূজা না হয় কিছুদিন বন্ধ থাকুক। অন্যদেরও কাজের জায়গা দিন। দলীয় মণিমাণিক্যকে খুঁজে নিতে দিন। দলকে সামনে এগোতে দিন। নিজেকে অত্যাবশ্যকীয় ভাবাটাই সমস্ত সমিতির বড় ক্ষতি।
বাংলায় একটা কথা শুনেছি, ‘কাঁকড়ামারি ছেড়ে ঠেলাওয়ালা’। জনগণও দেখতে চান, আপনি সমাজসেবা করতেই এসেছেন। আপনি সমিতির সন্দেশে ভাগ বসাতে আসেন নি। আজকাল এরকম কর্মকর্তা কমই দেখা যায়, যারা নতুন কর্তা তৈরি করছেন। কাজের জন্য গড়ে নিচ্ছেন আর এক সম্ভাবনাময় শক্তি — নতুন রাজা, নতুন রানী, নতুন মন্ত্রী।
‘রাজার রাজা’ একেই বলে। সেই রাজা কিংবা সেই রানী ভৌম-রাজত্ব চান না, দলীয় আগ্রাসন সেই রানীর নাপসন্দ। তারা মনের জগতে রাজত্ব করতে চান। এরকম রাজা, এরকম রানী কোথায়? আছে আপনার দলে? এরকম নেতা তৈরির কথা কি ভেবেছে আপনার দল? দ্বিপদী ত্রিপদী চতুষ্পদী চতুর্দশপদী নেতা বা নেত্রীকে দেব-দেবী জ্ঞানে পুজো করলে দলের অগ্রগতি সম্ভব নয়। ভারতীয় রাজনীতির ক্লাসিকাল বই পড়ে দেখুন। সংগঠনের আকর গ্রন্থ হাতরান। পাশাপাশি মনটাকেও বোঝান, পরিবর্তনই জগতের নিয়ম।
কল্যাণ গৌতম।