মণিপুরের বিষ্ণুপুর জেলার অধীনে একটি ছোট শহর মইরাং। ইম্ফল থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মইরাং-এর গুরুত্ব অপরিসীম। মইরাং সেই জায়গা, যেখানে সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ বাহিনী ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করার পর ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। ১৯৪৪-এর ১৪ এপ্রিল এই মইরাং-এ নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আইএনএ) ভারতের তিরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল।
এখানেই গড়ে উঠেছে একটি ওয়ার মিউজিয়াম। আগেও এখানে একটি স্মৃতিসৌধ ছিল বটে, তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা ধুঁকতে বসেছিল। এমনকী এখানে নেতাজির যে মূর্তিটি ছিল, কয়েক বছর আগে দুষ্কৃতীরা তা ভাঙচুর করেছিল। সম্প্রতি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আইএনএ)-র যুদ্ধ স্মৃতিসৌধের কাজ শেষ হয়েছে মণিপুরে। ভারতের উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যের বিষ্ণুপুর জেলার মইরাং-এ এই ‘ওয়ার মেমোরিয়াল’ তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়াও এখানে স্থাপন করা হয়েছে উত্তর-পূর্বের সবচেয়ে উঁচু নিশানদণ্ড-ও।
সম্প্রতি একথা জানিয়েছেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। তিনি বলেছেন, “এটি অত্যন্ত গর্বের বিষয় যে, ময়রাং-এ আইএনএ ওয়ার মেমোরিয়াল সম্পূর্ণ হয়েছে। উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে উঁচু নিশানদণ্ড স্থাপন করা হয়েছে এখানে।” তিনি আরও বলেন, “আমি আনন্দের সঙ্গে বলছি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই জাদুঘরটি মণিপুরের জনগণের কাছে উন্মোচিত করবেন।” মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীর কথায়— “যাই হোক না কেন, আমি নেতাজিকে ভুলতে পারি না। আমি মণিপুরিদের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই কিংবদন্তিকে ভুলতে দেব না। তাই আমি গুজরাত থেকে সবচেয়ে লম্বা খুঁটি এবং জাতীয় পতাকা নিয়ে এসেছি। এর উচ্চতা প্রায় ১৫৩ মিটার।”
বীরেন সিং জানান, কয়েক একর জমিও অধিগ্রহণ করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অধ্যুষিত এই অঞ্চলেই মিত্রবাহিনী আক্রমণ করেছিল। এখানকার পরিবারগুলিকে ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি ও বাড়ি মণিপুর সরকারের তরফে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এলাকাটি নেতাজির আইএনএ-কে স্মরণ করবার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। বীরেন সিংয়ের মতে, “এর ফলে নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি উপযুক্ত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে।”
দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর (Netaji Subhas Chandra Bose) স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলির প্রচার ও পর্যটন উদ্যোগী হল কেন্দ্রীয় সরকার। আজাদ হিন্দ সরকারের (Azad Hind government) ৭৮ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ অস্থায়ী সরকার গঠনের ঘোষণা করেছিলেন নেতাজি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের মুক্তি সংগ্রাম শুরু করেছিলেন।
এই প্রথম কেন্দ্রীয় স্তরে নেতাজির স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলির প্রচার ও পর্যটনে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এক আধিকারিক বলেন, “এই ধরনের সাইটগুলি সনাক্ত করা হয়েছে এবং একাধিক রুট অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আমরা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে সম্পর্কিত স্থানগুলি জুড়ে পর্যটন পথের পরিকল্পনা করেছি। নেতাজি সম্পর্কিত সাইটগুলির প্রচারের জন্য ট্যুর অপারেটরদের বলা হবে।” তিনি জানিয়েছেন, কয়েকটি সাইট বৌদ্ধ সার্কিটের আওতায় থাকবে, যা বিভিন্ন কেন্দ্রীয় মন্ত্রক, বিহার ও উত্তরপ্রদেশ সরকারের সহযোগিতায় তৈরি করছে পর্যটন মন্ত্রক। অন্যগুলি ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গে মিলে করা হবে।
দিল্লি-মেরঠ-ডালহৌসি-দিল্লি-সুরাত রুটে মেরঠের শহিদ স্মারক, ডালহৌসির কাইন্যান্স বিল্ডিং ও সুরাতের হরিপুরাকে যোগ করা হবে। ডালহৌসির কাইন্যান্স বিল্ডিংয়ে নেতাজি সাতমাস কাটিয়েছিলেন। সুরাতের হরিপুরাতে প্রথমবার জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন নেতাজি। অন্যটি হল কলকাতা-নাগাল্যান্ড-মণিপুর রুট। এর মধ্যে রয়েছে রাউজঝো গ্রামে, ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে এই গ্রামকে মুক্ত করেছিলেন নেতাজি। এখানেই আইএনএ-র অপারেশনাল বেস বানিয়েছিলেন তিনি। এই গ্রামে আইএনএ-র সঙ্গে জড়িত প্রচুর প্রত্নবস্তু পাওয়া যায়। মণিপুর রুটে মইরাং অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যেখানে ১৯৪৪ সালে আইএনএ-র পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল।
অন্য যে রুটটি মন্ত্রকের পরিকল্পনায় স্থান পেয়েছে সেটি হল কটক-কলকাতা-আন্দামান রুট। এর মধ্যে রয়েছে কটকে নেতাজির শৈশবের বাড়ি, তাঁর স্টিওয়ার্ট স্কুল, র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুল। এই রুটে যুক্ত করা হবে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং নেতাজি ভবন। এছাড়াও আন্দামান রুটে রাখা হবে পোর্ট ব্লেয়ারের নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু দ্বীপে। ১৯৪৩ সালে এই দ্বীপেই আইএনএ তাদের পতাকা উত্তোলন করেছিল।
তাঁকে নিয়ে কোনও কিছু লিখতে বসলে তা আর যেন সহজে শেষ হবে না। কত ইতিহাস, কত গল্প। তিনি হলেন দেশপ্রমিক সুভাষচন্দ্র বসু। অবশ্য় এই নামের থেকেও তিনি বেশি পরিচিত আমাদের সকলের কাছে নেতাজি নামে। পরাধীন ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে যাঁর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। বিহারের গোমো রেলওয়ে স্টেশন ও মণিপুরের মইরাংয় অন্যতম। যেখানে আজও এই মহান দেশপ্রেমিকের বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
গোমো রেলওয়ে স্টেশন। যে স্টেশনের ওপর দিয়ে গেলেই মণের মণিকোঠায় অগচরে যে নামটি উচ্চারিত হয়, সেটি হল নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নাম। ১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি ব্রিটিশ গোয়েন্দা ও পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে রাতের অন্ধকারে যখন সুভাষ চন্দ্র ভাইপো শিশির বসুকে নিয়ে কলকাতা ছেড়েছিলেন দেশ স্বাধীনের ব্রত নিয়ে। তারপর গ্র্য়ান্ড ট্রাঙ্ক রোড হয়ে রাতের কুয়াশা ঘেরা পথকে অতিক্রম করে গাড়ি হাইরোড দিয়ে গাড়ি ছুটেছিল এই গোমো স্টেশনের উদ্দেশে। তারপর, সুভাষচন্দ্র হয়ে গেলেন গিয়াসউদ্দিন। পাড়ি দিলেন কাবুলের উদ্দেশে। সুভাষের সেই স্মৃতি আজও বহন করে আছে বর্তমান ঝাড়খন্ডে অবস্থিত এই রেল স্টেশনটি। মহান দেশপ্রেমিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভারতীয় রেল মন্ত্রক এই স্টেশনের নাম বদল করে রেখেছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নামে।
মাত্র কয়েক ঘণ্টা, নেতাজির চরণ ধূলি পড়েছিল গোমো স্টেশনে। তাতেই গোমোর অধিবাসীর যেন ধন্য়। স্টেশন থেকে বাইরে বের হলেই চোখে পড়বে একটি মফঃস্বল মার্কা চায়ের দোকান। সেখানে গিয়েই নেতাজির সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতেই বয়স্ক সেই দোকানের মালিক বলে উঠলেন, দাদা আমরা ধন্য় তাঁর মত একজন মহাপুরুষ এই গোমো স্টেশন দিয়েই দেশ স্বাধীনের ব্রত নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন বিদেশে। তাই গোমোবাসীর অন্তরে সবসময় নেতাজি আছেন-থাকবেন। প্রতি বছর ২৩ জানুয়ারি এসে দেখবেন গোমোবাসীরা তাঁর জন্মজয়ন্তী পালন করেন ধূমধাম সহকারে। গর্ব হওয়ারই কথা।
তবে গোমোর মত আজও নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নাম সমানভাবে উচ্চারিত হয় উত্তর-পূর্বের পাহাড় ঘেরা ছোট্ট রাজ্য় মণিপুরের মইরাংয়ে। মণিপুরের এই শহরেই প্রথম স্বাধীন ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকা নেতাজির নেতৃত্বাধীন আজাদহিন্দ বাহিনী উত্তোলন করেছিল। এতেই গর্বে ভরে যান মইরাংবাসী। তাঁরা এখনও গর্ববোধ করেন মহান এই দেশপ্রেমিকের জন্য়। আর কয়েকদিন বাদেই তাঁর জন্মদিন। প্রতিবছরের মত চলতি বছরেও করোনা আবহের মধ্য়েও শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করতে প্রস্তুত মণিপুর রাজ্য়ের এই শহরের বাসিন্দারা। কেননা নেতাজি যে তাঁদের কাছে দেবতাতূল্য়। ব্রিটিশ ভারতে তিনিই তো প্রথম তাঁদের মধ্য়ে স্বাধীনতার স্পৃহা আরও কঠিনভাবে জাগিয়ে তুলেছিলেন।
তাই আজ থেকে এত বছর পরেও ঝাড়খণ্ডের গোমো কিংবা মণিপুরের মইরাং, নেতাজির স্মৃতি বহন করেই বেঁচে আছে। আর মহান এই দেশপ্রেমিকের স্মৃতি বহন করেই আজবীন বেঁচে থাকতে চান এই দুই এলাকার বাসিন্দারা।