নববর্ষ সূচনায় মোনোহর ডাকাতের আরাধ‍্যার সাধনায়

অতিমারি পেরিয়ে আজ নতুন ভোর, নতুন বছর, নববর্ষ। প্রায় দুবছর পর নববর্ষ বরনে আবার দেবমন্দিরে এসে উপস্থিত। প্রাচীন বঙ্গ , তার ইতিহাস স্মরণ করেই আজ গেলেম ডাকাত কালীর কাছে। মা হয়তো আজ ডেকেছিলেন। তৃপ্তি ভোরে পুজো দিলেম তাঁর নিকট। বড় সুন্দর পরিবেশ। এত বড় কংক্রিটের শহরের মধ্যে এত মিষ্টি নিরিবিলি শান্ত , গাছের ছায়ায় স্নিগ্ধ স্থান খুব কমই পাবেন। মন্দিরটিও খুব সুন্দর , সর্বপরি ধাক্কা, ভিড় ইত্যাদি এখানে নেই। এই মন্দিরের ইতিহাস জানতে একটু চলে যাই ১৮০০ শতকের জঙ্গলে….কি ভাবছেন? হ্যাঁ হ্যাঁ , জঙ্গল….

আজ থেকে ২৫০-৩০০ বছর পূর্বে দক্ষিণ কলকাতার বহু অঞ্চল ছিল জঙ্গলে আবৃত। দক্ষিণ কলকাতার অনেক অংশই তখন সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রধানত হোগলা এবং সুন্দরীর ঘন অরণ্যে আবৃত ছিল দক্ষিণ কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত অঞ্চল গড়িয়াহাট সেখানে ২৫০ বছর পূর্বে ডাকাতেরা বংশ পরস্পর নরবলি দিয়ে কালীপূজো করত। ডাকাতদের কালী পূজো নিয়ে মিথ হয়ে আছে প্রচুর কল্প কাহিনী। তাতে দেখা যায় ডাকাতেরা নরবলি বা ছাগবলি দিয়ে সেই রক্ত করালবদনী কালীর খাঁড়ায় ছুঁইয়ে, কপালে রক্ত তিলক কেটে রক্ত বস্ত্র পরে দলবল নিয়ে হা রে রে রে করে ডাকাতি করতে বেরোতো।

দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত পাড়া, সেই পূর্ণদাস রোড, রাসবিহারী এভেনুই সব জায়গায় ছিল ঘন জঙ্গল। কালীঘাটের জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে যেত আদি গঙ্গা। অবশ্য তখন তার রূপ ছিল অন্য রকম। এই সমস্ত জঙ্গলে ছিল বাঘ আর সাপের ভয়। আর ভয় ছিল মনোহর ডাকাতের। তখন লোকে মনোহর ডাকাতের নামে ভয়ে কেঁপে উঠতো।

মনোহর ডাকাত সেই সময় জঙ্গলের মধ্যে একটি ছোট কালী মূর্তি প্রতিষ্টা করেছিলেন। গড়িয়া হাটের মোড়ে ট্রেডার্স অ্যাসেম্বলির ঠিক পাশেই ছোট্ট কালীমন্দিরটি ছিল। কষ্টি পাথরের কালী মূর্তিটি ছোট। তাই অনেকে এই কালী বাড়িকে ছানা কালী অর্থাৎ ছোট কালী বাড়ি বলে উল্লেখ করেন।

তখন কলকাতার মানচিত্রে জাঁকজমক এবং বাবুয়ানা ছিল শুধুমাত্র উত্তরের দিকে আর দক্ষিণ কলকাতা ছিল বিভিন্ন ডাকাত, ঠগী ও বন্য প্রাণীর বিচরণভূমি।

মনোহর ডাকাত প্রতি অমাবস্যায় ডাকাতি এবং লুঠপাটের কাজে যাওয়ার পূর্বে দেবী কালী কে নিজে হাতে পুজো দিয়ে তারপর যেতেন, এবং মায়ের কাছে বলে যেতেন যদি ডাকাতি এবং লুঠপাট সুসম্পন্ন হয় তবে মায়ের কাছে নরবলি দেবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মনোহর ডাকাতিতে সফল হতেন। ডাকাতি সুসম্পন্ন হওয়ার পর মনোহর লুঠের দ্রব্যসামগ্রীর সাথে কোনো অল্পবয়সী ছেলে বা মেয়েকে ধরে নিয়ে আসতেন এবং তাকে স্নান করিয়ে সেই রাতেই এই কালির কাছে নরবলি দিতেন।

মনোহরের বিশ্বাস ছিল যে তার প্রতিষ্ঠিত দেবী মা একমাত্র নরবলিতেই তৃপ্ত। তাই তিনি এই মায়ের নাম রাখেন বলিপ্রিয়া কালী। তবে ডাকাত কালী বাড়ি নামেই এটি সুপ্রসিদ্ধ। তখন কোন অলংকার ছিল না দেবীর গায়ে। দেবী ছিলেন আয়ুধভুষিতা, মুন্ডমালা বিভূষিতা। দেবীর হাতে ঝুলতো কোনও হতভাগ্যের করোটি। বিশেষ কয়েকটি দিন ছাড়া এই মন্দির ফাঁকাই থাকে। তাই অনেক সময় এই মন্দিরে গেলে গা ছমছম করে। দক্ষিণ কলকাতার ঘন জঙ্গলের মধ্যে ছিল কালিঘাটের কালী মন্দির। লোকে আদিগঙ্গা দিয়ে নৌকো করে ,বা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে মাকে দর্শন করতে আসতো। জঙ্গলে মোনহর ডাকাতের ভয় ছিল। মনোহর ছিল অকৃতদার।

একবার ডাকাতি করে ফেরার সময় মনোহর দেখে যে এক মহিলা বাঘের হাতে মৃত হয়ে পড়ে আছেন। পাশেই একটু শিশু। শিশুটি তখনও জীবিত। কিন্তু তার পরিবারের খোঁজ পাওয়া সম্ভব ছিল না। মনোহর তখন সন্তান স্নেহে এই শিশুটিকে মানুষ করতে থাকে। এই শিশুটির সংস্পর্শে এসে, মনোহর ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে। শিশুটির নাম রাখে হারাধন। আস্তে আস্তে তার ডাকাতির উৎসাহ কমতে শুরু করে। তার দল ভেঙ্গে যায়। ছেলে বড়ো হচ্ছে, সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান। মনোহর ছেলের কাছে তার আসল পরিচয় গোপন করে।

শেষ জীবনে সে চাষকরে একজন চাষীর মত জীবন যাপন করতো। মৃত্যুর আগে গুপ্তধনের নাম করে, ছেলেকে বেশ কিছু মোহর আর সোনা রুপো দিয়ে যায় মনোহর। বলে তার মৃত্যুর পর হারাধন যেন ওই এলাকায় কয়েকটি পুকুর কাটিয়ে দেয়। কারণ সেই সময় ওদিকে খুব জলের কষ্ট ছিল। হারাধন সে কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। সে ওই মনোহর পুকুর সংলগ্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি পুকুর কাটিয়ে দেয়। আজ সেগুলির প্রায় সব কটাই বুজে গেছে। সেখানে উঠেছে বহুতল বাড়ি। বেঁচে আছে কেবল একটি পুকুর। তার অবস্থা খুবই শোচনীয়।

বাংলার ১২০০ শতাব্দীতে দক্ষিণ কলকাতার এই মন্দিরটি ছিল একটি ছোট্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ। পরবর্তীকালে এই মনোহর ডাকাত বা মনোহর বাগদির নামানুসারে এলাকার নামকরণ হয়েছিল মনোহর-পুকুর রোড।

বাংলার ডাকাত প্রবন্ধ থেকে পাওয়া যায় সেই সময়ে বাংলায় মনোহর ছিল এক দুর্দান্ত প্রতাপশালী ডাকাত। সে ছোট বড় অনেক জমিদার বাড়িতেও ডাকাতি করত। এমনকি পূর্বে চিঠি দিয়ে ডাকাতির দিনক্ষণ জানিয়ে রাখত। ডাকাত হলেও মোনহর কোনোদিন কোনো নারীর অসম্মান করেননি এবং নারীদের দেবীর মত সম্মান করতেন। মনোহরের বয়স যখন ৫০-এর কাছে তখন তার মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। মনোহর তখন হয়ে উঠেছিল একজন সমাজ সেবক। তার লুঠের সামগ্রী অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিল গরিব-দুঃখীর মধ্যে। মনোহর গ্রাম বাংলার বহু মেয়েকে নিজের খরচে বিবাহ দিয়েছিলেন। তাই বাংলার গরিব সাধারণ মানুষ এই মনোহর কে তাদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছিল। বাংলার ১২৯৮ সালে মনোহার ডাকাতের মৃত্যু হয়।

মনোহর এর মৃত্যুর পর দক্ষিণ কলকাতায় কালীঘাট সংলগ্ন এলাকার সাধক কামাখ্যাচরণ মুখোপাধ্যায় এই মন্দিরে দায়িত্বভার নেন এবং শতাব্দী ধরে চলে আসা নরবলি বন্ধ করে, অমাবস্যার পশুবলির প্রচলন করেন। এরপর থেকেই দক্ষিণ কলকাতা আস্তে আস্তে শহরের রূপ নিতে থাকে। এই ছোট্ট মন্দির টিও একটু বড় হয়ে ওঠে। আজো মনোহরের প্রতিষ্ঠিত এই বলিপ্রিয়া মায়ের পূজো হয় সম্পূর্ণ আগের রীতি অনুসারে। শুধুমাত্র বলি প্রথাই এখানে বন্ধ। বর্তমানে এই মায়ের কাছে নিয়মিত লুচি, পোলাও, বিভিন্ন উপাচার এবং মাছ ভোগও দেওয়া হয়। আজ এই বলি প্রিয়া কালী শান্ত, স্নিগ্ধ ও মাতৃস্বরূপা।

আজ মনোহর ,হারাধন কেউই নেই। কিন্তু তাদের কীর্তি অমর করে আছে দক্ষিণ কলকাতার মনোহরপুকুর রোড।আর পূর্ণদাস রোডে অবস্থিত এই মনোহর ডাকাতের কালী মন্দির।

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.