সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার রামচন্দ্রের ফেরার সময় হয়েছে। তিনি জানতেন যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিষ্ণু মর্ত্যে অবতরণ করেছিলেন, তা সম্পূর্ণ হয়েছে, কাজেই আর আর তার মর্ত্যে থাকার দরকার নেই — স্বর্গে ফিরে যাওয়াই ভাল। সেজন্য তিনি একজন দেবর্ষি নারদকে পাঠালেন, যিনি ইঙ্গিত-পূর্ণ কথার মাধ্যমে বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রামচন্দ্রকে মনে করিয়ে দেবেন — “এবার স্বর্গে ফিরে এসো।”
ঋষি নারদ বীণা বাজাতে বাজাতে এক সময়ে রামচন্দ্রের দরবারে এলেন। কিছুক্ষণ রাজনীতি নিয়ে রাম, নারদ ও লক্ষ্মণের মধ্যে আলোচনা হল। তারপর হঠাৎ নারদ বললেন, “রামচন্দ্র! আমি তোমাকে একটা প্রয়োজনীয় কথা বলতে ভুলে গেছিলাম। যা সবার সামনে বলা সম্ভব নয়। প্রহরীকে বলে দাও, কেউ যেন এই সময়ে আমাদের আলোচনায় না বাধা দেয়। এমনকি যদি সে সাক্ষাৎ-প্রার্থীর জীবন-মরণ সমস্যা দেখা দেয়, তাহলেও নয়।”
রামচন্দ্র হাসলেন, “হে দেবর্ষি নারদ! এটা আবার কোনো কথা হল? লক্ষ্মণ! প্রহরীকে একথা জানিয়ে দাও, যা নারদ বললেন।”
লক্ষ্মণ সঙ্গে সঙ্গে উঠতে যাচ্ছিলেন। এমন সময়ে নারদ মাথা নাড়লেন, “উঁহু, প্রহরী কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির চাপে পড়ে তাকে এখানে ঢুকতে দিতে পারে। তাতে আলোচনার মর্ম নষ্ট হবে। এক কাজ করো, তুমিই ঘরের বাইরে পাহারা দাও। মনে রেখো, কেউ যেন এখানে ঢুকতে না পারে। একজনও না।আর হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে কি আলোচনা হচ্ছে কেউ যেন জানতে না পারে, এমনকি তুমিও না। বোঝই তো, রাজার সাথে কিছু দরকারি কথা থাকে, যা বাইরে জানাজানি হলে বিপদ।”
“যে আজ্ঞে, আপনার আদেশ শিরোধার্য।” বলে লক্ষ্মণ বাইরে বেরিয়ে গেলেন। তিনি দরজা বন্ধ করে দিয়ে পাহারা দিতে লাগলেন। তখন নারদ বললেন, “আদেশের নড়চড় হলে রামচন্দ্র কিন্তু তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন, মনে থাকে যেন।”
কথাটা শুনে একবার শিউরে উঠলেন লক্ষ্মণ। তারপর নারদের সাথে রামচন্দ্রের আলোচনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে বললেন, “আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব।” নারদ হাসলেন, “তাই যেন হয়।”
লক্ষ্মণ চলে যেতেই এবার নারদ প্রায় ফিসফিস করে বললেন, “তুমি ভুলে গেছ? বিষ্ণুর অবতার হিসাবে যে কাজ করতে ব্রহ্মা পাঠিয়েছিল, সেটা মিটে গেছ। তাই তোমার আর মনুষ্য অবতারে থাকার প্রয়োজন নেই। তোমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। কালই লব ও কুশকে সিংহাসনে বসিয়ে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নাও। তোমাকে নিয়ে স্বর্গে যাব।”
“বেশ।” রামচন্দ্র বরাবরের মত নির্বিকার অভিব্যক্তি দিয়ে বললেন। তিনি জানতেন, নারদ ভুল বলবেন না।
দুর্ভাগ্যক্রমে ঠিক এই সময়েই ঋষি দুর্বাসা এলেন দরবারের ঠিক বাইরে। তার সাথে লক্ষ্মণের বিশাল তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেল। লক্ষ্মণ তাকে বলেন, “আপনি এভাবে জোর করে ঢুকতে পারেন না। দাদা আমাকে নিষেধ করে গেছে — আমি যেন কাউকে না ঢোকাই। দাদার সাথে নারদের আলোচনা হচ্ছে।”
“সেকি কথা।” দুর্বাসা বিস্ময়ের সুরে বললেন, “আমাকে ঢুকতে দেবে না? আমি ইক্ষবাকু গোত্রের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিতে যাচ্ছিলাম।”
লক্ষ্মণ বললেন, “দুঃখিত। আমি আপনাকে প্রবেশ করতে দেব না। বললাম তো, দাদা বারণ করে গেছে।”
এবার দুর্বাসা ক্ষিপ্ত হলেন। “এসবের মানেই বা কি? আমার কি কোনো গুরুত্ব নেই? আমার কি কোনো সম্মান নেই? বেশ, আমি চললাম। রামচন্দ্রকে বলে দিও, আমি তার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম; কিন্তু তোমার জন্য দেখা না করেই ফিরতে বাধ্য হচ্ছি।” তারপর দুহাত আকাশে তুলে দুর্বাসা বললেন, “আমি অযোধ্যাকে অভিশাপ দিচ্ছি।”
লক্ষ্মণ তখন ভাবতে লাগলেন, ‘আমি দুর্বাসাকে ভেতরে ঢুকতে দিয়ে যদি রামচন্দ্রকে বিরক্ত করি, সেক্ষেত্রে আমার মৃত্যু একেবারে পাকা সন্দেহ নেই। রামচন্দ্রের রাগ কি জিনিস আমার জানা। কিন্তু যদি আমি দুর্বাসাকে ঢুকতে না দিই, সেক্ষেত্রে এই রাগী সাধু নিশ্চয়ই অযোধ্যাকে অভিশাপ দেবে। সেক্ষেত্রে অযোধ্যার চরম সর্বনাশ হবে। তা হতে দেওয়া যায় না।’
এসব ভেবে টেবে লক্ষ্মণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও দরজাইয় দুই আঙ্গুল দিয়ে খটখট আওয়াজ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে রামচন্দ্র দরজা খুলে বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলেন, “কি ব্যাপার?”
নারদ বললেন, “কিছুই না, রামচন্দ্রের যাওয়ার সময় হয়েছে, সেটাই ওনাকে বললাম, আরকি।” বলেই নারদ অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
তখন বিধ্বস্ত ও হতাশ লক্ষ্মণ রামচন্দ্রকে দুর্বাসার সাথে তার যা বার্তালাপ হয়েছে, সবই খুলে বললেন। তখন রামচন্দ্র দুর্বাসার দিকে তাকালেন, “প্রভু! আপনার জন্য কি করতে পারি? আপনাকে দেখে খুবই প্রীত হয়েছি, মহর্ষি দুর্বাসা।”
“আগে বলো তো, নারদ তোমার সাথে কি বলতে এসেছিল। তিনি হঠাৎ ওরকম ভাবে বাতাসে মিলিয়ে গেলেন কেন? তোমাকে কি কোনো জরুরি বার্তা দিতে এসেছিল?”
“হ্যাঁ।” রামচন্দ্র হাসলেন, “অবশ্যই বার্তা দিতে এসেছিলেন। কিন্তু সেটা কি আপনাকে বলতে পারব না।” একটু থেমে রামচন্দ্র লক্ষ্মণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ঋষি দুর্বাসার জন্য রাজকীয় আতিথেয়তার ব্যবস্থা করো।”
“দরকার নেই।” অত্যন্ত গুরুগম্ভীর স্বরে দুর্বাসা বললেন, “নারদকে দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছি। আমি ঠিক নারদের কথাটাই তোমাকে জানাতে যাচ্ছিলাম, আর দরকার পড়বে না। দূত হিসাবে আমার কাজ শেষ। চলি।”
বলে দুর্বাসা চলে গেলেন। রামচন্দ্র আর লক্ষ্মণ বোঝার চেষ্টা করছিল, ঘটনা প্রবাহ কোনদিকে এগোচ্ছে।
কিছুক্ষণ ধরে রামচন্দ্র লক্ষ্মণের দিকে তাকালেন। লক্ষ্মণ দাদার মনোভাব বুঝতে পেরে স্মিত হাসলেন। তিনি নারদকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। রামচন্দ্র সেজন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। লক্ষ্মণ জানেন, যে কোনো আদর্শ ক্ষত্রিয়ের মতই রামচন্দ্র কোনো অবস্থাতেই নিজের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবেন না। করলে নারদকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবেন। এই প্রসঙ্গে রঘুবংশে মহাকবি কালিদাস লিখেছেন —
রঘুকুল রীত সদা চলি আয়ে
প্রাণ যায়ে পর বচন না যায়ে
অর্থাৎ প্রাণ চলে গেলেও কাউকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কোনো অবস্থাতেই রঘুবংশের কেউ ভঙ্গ করবে না। যে কোনো ভাবেই হোক, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার চেষ্টা করবেই।
লক্ষ্মণ একবার দাদার দিকে তাকালেন। তারপর হেসে বললেন, “দাদা, চিন্তা কোরো না।আমি তোমাকে ভাল মতই চিনি। তুমি কোনো অবস্থাতেই যে সত্য থেকে বিচ্যুত হবে না তাও জানি। তুমি যা করবে তা থেকে বিচ্যুত হও, তাও আমি চাইব না। আমরা আমাদের হাঁটার পথে যা আসবে, তা নির্দ্বিধায় মেনে নেব। তুমি আমাকে এতদিন ধরে শিখিয়েছ একজন সত্যকারের ক্ষত্রিয় কি করতে পারে, কি করা উচিত। আমি তা শিখতে পেরেছি কিনা, তা পরীক্ষার সময় এসে গেছে। তোমাকে কষ্ট করে আলাদা ভাবে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করতে হবে না। আমি স্বেচ্ছায় আমার মৃত্যুর পথ বেছে নিচ্ছি।”
রামচন্দ্র সবই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু এই সময়ে কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কিন্তু লক্ষ্মণ দাদার আদেশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন না। তিনি দৌড়তে শুরু করলেন। রামচন্দ্র তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি জানেন তার ভাই কোথায় যাচ্ছেন। ঠিক তাই, তার ভাই সরযূ নদীর দিকে যাচ্ছে। তারপর সাঁতার কাটতে কাটতে এক সময়ে নদীর একেবারে মাঝখানে পৌঁছলেন। তারপর লক্ষ্মণ চিতসাঁতার কাটতে কাটতে যোগ শুরু করলেন। একসময়ে দেখা গেলে লক্ষ্মণ আর নেই, তার জায়গায় বিষ্ণুর নাগ নামে পরিচিত আদিশেষ রয়েছে। তারপর আদিশেষ ডুব মারল।
লক্ষ্মণের বিদায়ের পর রামচন্দ্রের আর রাজত্বে মন বসল না। দিনরাত সীতা আর লক্ষ্মণের কথা ভাবতে থাকেন। এরকম ভাবে সাতদিন চলার পর রামচন্দ্র সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি রাজত্ব ত্যাগ করবেন। তিনি ভাই ভরতকে ডেকে বললে, “ভরত, আমার জায়গায় তুমি বসে রাজত্ব করো, যেমনটা আমার বনবাসের সময়ে চৌদ্দ বছর ধরে করেছিলে।”
ভরত পরিষ্কার বললেন, “আমার পক্ষে আর দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। প্রজারা সেক্ষেত্রে আমাকে লোভী বলে নিন্দা করবে। যা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।”
তখন নিরুপায় রামচন্দ্র শত্রুঘ্নকে ডেকে পাঠালেন। সব শুনে শত্রুঘ্নও একই কথা বললেন। রামচন্দ্র দেখলেন, এযে বিরাট বিপদ। এভাবে সবাই দায়িত্ব এড়িয়ে চললে অযোধ্যা চলবে কি করে?
শেষে সংকটমোচক হনুমান এসে তাকে পরামর্শ দিলেন, “প্রভু! এত চিন্তা করছেন কেন? অযোধ্যা রাজ্য দুই ভাগে ভাগ করে ওদের হাতে দায়িত্ব তুলে দাও। অযোধ্যার উত্তরাংশ কৌশল লব কুশকে দাও, দক্ষিণাংশ লক্ষ্মণের পুত্র অঙ্গদ ও চিত্রকেতু, ভরতের পুত্র তক্ষক ও পুষ্কল এবং শত্রুঘ্নের পুত্র সুবাহু ও শ্রুতসেনকে ভাগ ভাগ করে দাও। তাতে মনে হয় প্রজাদের আপত্তি থাকবে না। তোমরা তিন ভাইও সুখে থাকতে পারবে।”
এতদিন বাদে রামচন্দ্রের মুখে হাসি ফুটে উঠল, “এই জন্যই তোমাকে এত ভালবাসি, হে আঞ্জনেয়! তুমি এত সহজে যে বুদ্ধি বাতলে দিলে, তা এত বড় বড় পণ্ডিতদের কেউই দিতে পারেনি। তোমার পরামর্শ মেনেই কাজ করব।”
তারপর পনেরদিন ধরে রাজ্যভাগ ও রাজ্যভার অর্পণের কাজ চলল। তারপর রামচন্দ্র হনুমানকে বললেন, “একজন নৃপতি হিসাবে আমার যা কর্তব্য করার ছিল, তা সম্পন্ন হয়েছে। এবার মনে হয় পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারি। এবার লক্ষ্মণের পথ অনুসরণ করে সরযূ নদীতে ঝাঁপ দেব।”
রামচন্দ্রের শেষ ইচ্ছার সংবাদ ঝড়ের গতিতে অযোধ্যাবাসীদের কাছে পৌঁছে গেল। শুধু রামচন্দ্র নয়, দাদার পদাঙ্ক অনুসরণ করে শত্রুঘ্ন ও ভরতও সরযূর দিকে হাঁটতে লাগল দাদার সাথে। তিন ভাই গল্প করতে করতে এক সময়ে সরযূ নদীর তীরে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন নদীর দুই পাড়ে হাজার হাজার প্রজারা তাদের শেষ বিদায় জানাতে এসেছে। প্রজাদের অশ্রু দেখে তিন ভাইয়ের চোখে জল এলো বটে, কিন্তু নিজের কর্তব্য পালন করতে ভুললেন না। এরপর এক এক করে তিন ভাই সাঁতার কেটে যেখানে লক্ষ্মণ শেষ বারের মত পৃথিবীতে দেখা দিয়েছিলেন, সেখান পৌঁছে গেলেন। তারপর একটি বড় ঘূর্ণি এসে তিনজনকে অদৃশ্য করে দিল। রামচন্দ্র বিষ্ণুতে রূপান্তরিত হলেন, আর ভরত ও শত্রুঘ্ন তার পাঞ্জজন্য শঙ্খ ও সুদর্শন চক্রে রূপান্তরিত হল। এইভাবে তিন ভাই স্বর্গে গেলেন।
আজ সরযূ নদীতে ফইজাবাদের অংশে গেলে দেখা যায় চার ভাইয়ের নামাঙ্কিত ক্ষুদ্রাকার মন্দির আছে যেখানে চারজনকে শেষ বারের মত দেখা গিয়েছিল।
Ayan Sesselj Chakraborty