‘বিক্রম-সম্বত’—ভারতবর্ষের গৌরবময় ইতিহাস ও ‘বিজ্ঞানচর্চার একটি কালজয়ী প্রমাণ

কাল নির্ণয় বা সময়ের গণনা একটি সভ্যতার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সময়ের গণনা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা একটি বিকাশশীল সভ্যতার প্রাথমিক শর্ত।
‘ইতিহাস’ রচনার ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের নিজস্বতা আছে।বেদ-উপিনষদ থেকে শুরু করে রামায়ণ-মহাভারতে প্রত্যেক ঘটনা শ্লোকের আকারে লিপিবদ্ধ করার সময় ; সেসময়ের চন্দ্র-সূর্য , গ্ৰহ-নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে যা থেকে একদিকে যেমন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের উৎকৃষ্টতা সম্পর্কে জানা যায় , অন্যদিকে ঘটনাগুলোর কালনির্ণয়ে বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্তে আসা যায়। সুতরাং , কালনির্ণয় ; ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।যে সভ্যতা যত আগে কালনির্ণয় এর পদ্ধতি ও লিপির ব্যবহার শিখেছে , সেই সভ্যতা তাদের ইতিহাস তত আগে থেকে লিপিবদ্ধ করেছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতার ‘কালনির্ণয়’ এর ইতিহাস , স্বতন্ত্রভাবে সেই সভ্যতার বিজ্ঞানের ইতিহাস , সেই সভ্যতার প্রাচীনত্বের প্রমাণ।
আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রেও ‘সময়’ একটি প্রধান চর্চার বিষয়। ভারতবর্ষের সমৃদ্ধশালী ইতিহাস, তাঁর সমাজব্যবস্থা , শিল্প , বিজ্ঞানের উৎকৃষ্টতার দলিল। ভারতবর্ষের এই সমৃদ্ধির পেছনে ‘কালনির্ণয়’ এর ভূমিকা এবং ভারতীয় পদ্ধতিতে নির্মিত ‘কালপঞ্জী’ বা ক্যালেন্ডারের উৎকৃষ্টতা বেশিরভাগ ভারতীয়ের কাছে এখনো অজানা।
প্রাচীন ভারতের সম্পদশালী হওয়ার পেছনে দুটো কারণ ছিল , এক কৃষি ও অন্য বৈদেশিক বাণিজ্য।
এই দুই ক্ষেত্রেই সফলতার জন্য একটি ভালো কালপঞ্জীর প্রয়োজন ছিল। কৃষিক্ষেত্রে বর্ষাকাল নির্ণয়ের জন্য এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমুদ্রযাত্রার উদ্দ্যেশ্য নেভিগেশনের জন্য। সঠিক ‘কালপঞ্জী’ ও তার গণনার পদ্ধতি না থাকার জন্যই কলম্বাসের জাহাজ ভারতের উদ্দ্যেশ্য যাত্রা করে আমেরিকায় পৌঁছে গিয়েছিল।ভারতবর্ষের সমৃদ্ধশালী অতীত প্রমাণ করে যে এইদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে ছিল। কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়া একটি ভালো কালপঞ্জী নির্মাণ করা সম্ভব হতো না আর ভালো কালপঞ্জি ছাড়া কৃষি ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে সফলতা অলীক কল্পনা ছিল। যদিও পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকরা এই সাধারণ বুদ্ধির প্রয়োগ কোনোদিন করেননি। তাইতো তাদের লেখায় বিশ্ব ভারতবর্ষের কাছে কতটা ঋণী তা প্রকাশ পায় না।
ভারতবর্ষে কালপঞ্জি ঋকবেদ ও বেদাঙ্গ জ্যোতিষ এর সময় থেকে অবিচ্ছিন্ন ভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে।ঋকবেদ থেকে বেদাঙ্গ জ্যোতিষ এবং তার পরবর্তী কালে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট, বরাহমিহির,ভাস্করাচার্য্য পর্যন্ত ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং কালপঞ্জীর কয়েক হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাস আছে।
ঋকবেদের প্রথম মন্ডলের বিভিন্ন ঋকে সূর্যের উত্তরায়ণ, দক্ষিনায়ণ অবস্থান (১/২০/৬ ও ১/২০/৮) , ছয়টি ঋতুর (১/১৬৪/১৫ ও ১/৯৫/৩) কথা উল্লেখ আছে। ঋকবেদের প্রথম মন্ডলের ঋকগুলি কমপক্ষে ৯০০০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দের আগে রচিত। কিন্তু ঋকগুলিতে বর্ণিত কাল গণনা পদ্ধতি ঋকগুলির রচনার আরো আগে শুরু হয়েছিল বলাই যায়।
ঋকবেদের চতুর্থ ,ষষ্ঠ ও নবম মন্ডলের বিভিন্ন ঋকে চাঁদের বিভিন্ন দশা ও স্থির নক্ষত্রের স্বাপেক্ষে সূর্য-চন্দ্রের অবস্থান নির্ণয় সম্পর্কে জানা যায়।
ঋকবেদ পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্ৰন্থ।
তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় , ভারতবর্ষের কাল গণনা পদ্ধতি বিশ্বের মধ্যে সবথেকে প্রাচীন।
ভারতবর্ষের পঞ্চাঙ্গ(Panchang) একটি সৌর-চান্দ্র (Luni-Solar) কালপঞ্জি যা বছরকে সূর্যের ঋতুচক্র অনুসারে ও মাসকে চাঁদের দশা অনুযায়ী হিসেব করে।
পঞ্চাঙ্গ অনুসারে , একমাসে ৩০ টি তিথি থাকে এবং সূর্য ও চন্দ্রের মধ্যে কৌণিক ব্যবধান ১২° হতে যে সময় লাগে তাকে এক তিথি বলে।
যদিও তিথি ও বর্তমানে দিনের সময়কাল এক নয়।সূর্যের ঋতুচক্র অনুযায়ী ১ বছর , চাঁদের দশা অনুযায়ী ১২ মাসের থেকে কিছুটা বেশি হয়।তাই সৌরবছর কে চান্দ্রমাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে আরো কিছু অন্তর্বর্তী মাস(Intercalary month) বা অতিরিক্ত মাস এর প্রয়োজন হয় যাকে আমরা ‘মলমাস’ বলে জানি। সূর্য , চন্দ্রের গতিকে ‘কালপঞ্জী’ নির্ণয়ে ব্যবহার করতে জটিল গণনার প্রয়োজন হয় এবং এই গাণিতিক সক্ষমতা না থাকাতেই গ্ৰীক , রোমানরা এবং পরবর্তীকালে ইউরোপীয় দেশগুলোতে ক্যালেন্ডারে সংশোধনের প্রয়োজন হয় এবং সেই সংশোধনের জন্যেও তারা ভারতবর্ষের গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের মুখাপেক্ষী ছিল।
আরবীয়রা , ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান এর নীতি অনুসরণ করলেও তাদের কালপঞ্জি শুধুমাত্র চাঁদের দশার (Lunar Calendar) ওপর নির্ভরশীল। বৌদ্ধদের মাধ্যমে ভারতীয় কালপঞ্জী চীনে পৌঁছায়।
সারা বিশ্বে বর্তমানে প্রচলিত ‘গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’ এ প্রতি মাসের দিনসংখ্যা সাধারণত ৩০ ,৩১,২৮ বা ২৯ হয় যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।প্রতি মাসের নামকরণের মধ্যেও কোনো যুক্তি নেই।যেমন বছরের সপ্তম মাস না হলেও ‘সেপ্টেম্বর’ এবং দশম মাস না হলেও ‘ডিসেম্বর’ নামকরণ দেখা যায় ইংরেজি ক্যালেন্ডারে। ভারতীয় পদ্ধতিতে , মহাকাশে চাঁদের গতিকে ২৭ টি নক্ষত্রের মাধ্যমে ২৭ টি ভাগে ভাগ করা হয়।একটি মাসের প্রথম পূর্ণিমার সময় চাঁদের অবস্থান যে নক্ষত্রের কাছে হয় , মাসের নামকরণ সেই নক্ষত্রের নামানুসারে হয়।যেমন বিশাখা থেকে বৈশাখ , জৈষ্ঠা থেকে জৈষ্ঠ্য , চিত্রা থেকে চৈত্র। ভারতীয় ‘কালপঞ্জী’ থেকে জোয়ার-ভাটার সঠিক সময় নির্ধারণ করা সম্ভব–ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ক্ষেত্রে যা কল্পনার বাইরে। বেশিরভাগ ভারতীয় উৎসবের নামে চাঁদের দশার উল্লেখ থাকে , যেমন রাখি পূর্ণিমা , গুরু পূর্ণিমা , কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী , রাম নবমী ইত্যাদি।
আমাদের যদি বেশ কিছুদিন একটি নির্জন দ্বীপে রেখে দেওয়া হয় তাহলে আমরা বর্তমানে গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রচলিত সাল, তারিখ ভুলে যাব আর একবার ভুলে গেলে ক্যালেন্ডার না দেখে সঠিক দিন নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।
কিন্তু ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের রীতি অনুযায়ী যে পঞ্চাঙ্গের (পাঁচটি অঙ্গ-তিথি , নক্ষত্র ,বার ,যোগ , কারণ) সাহায্যে কালনির্ণয় করা হয় সেই পদ্ধতিতে সূর্য , চন্দ্র ও নক্ষত্রের অবস্হান জেনে কাল নির্ণয় সহজেই করা যাবে।এই থেকেই প্রমাণিত সূর্য-চন্দ্রের পর্যায়ক্রমিক গতি ও নক্ষত্রের অবস্হান কে কাজে লাগিয়ে নির্মিত কাল গণনা পদ্ধতি বর্তমানে প্রচলিত ক্যালেন্ডারের থেকে অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক।
শুধু তাই নয় , অতীতকালের কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার সময় সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র ও বিভিন্ন গ্ৰহের অবস্থান থেকে ঐ ঐতিহাসিক ঘটনা টি বর্তমান সময়ের থেকে কতদিন আগে ঘটেছিল তাও নির্ণয় করা সম্ভব।তাই ভারতীয় কাল গণনা পদ্ধতি ভারতীয় সংস্কৃতির মতোই সনাতন। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডঃ মেঘনাদ সাহা ১৯৩৯ সালে নিজের একটি প্রবন্ধে গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে অবৈজ্ঞানিক বলেন।
ভারতীয় কালপঞ্জী ‘বিক্রম সম্বত’ এর সাল গণনা শুরু হয় উজ্জয়িনীর রাজা চন্দ্রগুপ্তের(যিনি বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করেছিলেন) সময় থেকে (৫৭ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দ)।
বিক্রম সম্বত এর প্রতি মাসের দিনসংখ্যা চাঁদের দশার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যা ভারতবর্ষের প্রাচীন পদ্ধতি।আর বিক্রম সম্বত অনুযায়ী বছরের প্রথম দিন চৌত্র শুক্ল প্রতিপদের সঙ্গে বিক্রমাদিত্যের রাজ্যভিষেক, শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যভিষেক এর মত ভারতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা জড়িয়ে আছে। ভারতীয় শাস্ত্র অনুযায়ী কোনো ‘চক্রবর্তী’ সম্রাট নিজের বিজয়-কীর্তির স্মারকস্বরূপ নতুনভাবে ‘কালগণনা’র(সম্বত) প্রচলন করতে চাইলে তাঁকে সমস্ত প্রজাদের কর মকুব করে সমমূল্যের স্বর্ণমুদ্রা রাজকোষে জমা করতে হতো।ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র ও দ্বাপর যুগে মহারাজ যুধিষ্ঠির এই শাস্ত্রীয় বিধান মেনেই নতুন সম্বত- এর প্রচলন করেছিলেন এবং কলিযুগে সম্রাট ‘বিক্রমাদিত্য’ , ‘কৃত সম্বত’ চালু করেন যা পরবর্তীতে ‘বিক্রম-সম্বত’ নামে প্রসিদ্ধ হয়।
ভারতীয় কালপঞ্জী অনুযায়ী কলি যুগের সূচনা খ্রীষ্ট-পূর্ব ৩১০২ থেকে।
ভারতীয় ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত ও বিজ্ঞানসম্মত ‘বিক্রম সম্বত’ কালপঞ্জী ভারতীয়দের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ না হয়ে পরাণুকরনের প্রতীক গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রচলন কবিগুরুর ‘জাপান যাত্রী’ প্রবন্ধের অংশটি মনে করিয়ে দেয়—
“আমরা অনেক আচার, অনেক আসবাব য়ুরোপের কাছ থেকে নিয়েছি–সব সময়ে প্রয়োজনের খাতিরে নয়, কেবলমাত্র সেগুলো য়ুরোপীয় বলেই। য়ুরোপের কাছে আমাদের মনের এই যে পরাভব ঘটেছে অভ্যাসবশত সেজন্যে আমরা লজ্জা করতেও ভুলে গেছি।”
তাই আমাদের কাছে আজ এই প্রশ্ন স্বাভাবিক যে ‘বিক্রম সম্বত’ অনুসারে ‘নববর্ষ’ পালনের মধ্য দিয়ে পরাণুকরনের লজ্জা থেকে আমাদের মুক্তি আর কতদূরে ?

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.