গত কয়েক বছর ধরে খুব শুনছি, ‘এক বিশ্ব, এক শাসন, এক নিয়ম’এর গল্প। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, সেই এক বিশ্বটি কার বিশ্ব? সে কেমন বিশ্ব? সে কি বিল গেটসের বিশ্ব? সে কি বাইডেন বা এডরোগেনের বিশ্ব? সে কি পুতিন কিংবা জি জিপিং’এর বিশ্ব? নাকি সে নরেন্দ্র মোদীর বিশ্ব? শিবের বিশ্ব, আল্লাহ’র বিশ্ব না ক্রাইস্টের বিশ্ব? কার্ল মার্কসের বিশ্ব না এলন মাস্কের বিশ্ব? প্রাকৃতিক বিশ্ব না কৃত্রিম বিশ্ব? শ্বেতাঙ্গদের বিশ্ব না কৃষ্ণাঙ্গদের বিশ্ব? নাকি খয়েরি ও তামাটেদের বিশ্ব? ইউক্রেনের সংঘাত সম্ভবত কিছু নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দেয়। উঠতি কি এবার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে পড়ন্তকে?
১৭৫’টি দেশের সাথে একটি চুক্তি করতে উদ্যত হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। যদি সেই চুক্তিতে সবকটি রাষ্ট্র সাক্ষর করে তাহলে অতিমারী চলাকালীন কারুর কোন স্বাধীনতা থাকবে না। হু যা নির্দেশ দেবে তা মানতে এবং রূপায়ণ করতে প্রতিটি রাষ্ট্র বাধ্য থাকবে। এতকাল পর্যন্ত কিছুটা হলেও শিথিলতা ছিল। আইন অনুযায়ী হু একবার প্যাণ্ডেমিক ঘোষণা করলে প্রতিটি রাষ্ট্রের হাতে একটি বিশেষ ক্ষমতা আসে, ‘স্পেশাল এপিডেমিক আ্যক্ট’, যার দ্বারা দেশের সরকার স্বাস্থ্য সংকটের কারণ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকার খর্ব করতে পারে। যা অধিকাংশ দেশই করেছে। কিন্তু তবু তারই মধ্যে কিছু রদবদল করা, মানুষের ক্ষোভ বুঝে কিছু শিথিলতা দেখানো, প্রয়োজনে তুঘলকী প্রয়োগ ও ছাড় দেওয়ার মধ্যে একটু সামঞ্জস্য ঘটানো, সেটুকু অধিকার অন্তত রাষ্ট্রের হাতে থাকে। ব্রিটেন যেমন মাস্ক-বিধি তুলে নিয়েছে, কিছু দেশ ও প্রদেশ সামাজিক দুরত্বের অনুশাসন আলগা করেছে, অনেক জায়গায় ভ্যাকসিন পাসপোর্টের আবশ্যিকতা বাতিল করা হয়েছে, বেশিরভাগ দেশ স্কুল কলেজের দরজা খুলে দিয়েছে।
কিন্তু একবার এই নতুন চুক্তিতে সই হয়ে গেলে কোন রাষ্ট্রের হাতে আর নিজের ইচ্ছামত বিধিনিষেধের ফাঁস আলগা করার অধিকার থাকবে না। এবং অদূর ভবিষ্যতে অতিমারী শর্তের অবসান হওয়ার কোন সদিচ্ছার ইঙ্গিত নেই। হু যা বলবে অক্ষরে অক্ষরে তাই মানতে হবে সাক্ষরকারী দেশগুলির প্রতিটি নাগরিককে। অর্থাৎ আপনার আমার জীবন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করবে বিল গেটসের টাকায় লালিত ও পোষা একটি মেরুদণ্ডহীন সংস্থা। এক বিশ্ব এক শাসন এক নিয়মের আদিপর্ব এইভাবেই রচিত হচ্ছে। দেশের অপদার্থ সরকার বা অক্ষম রাষ্ট্রনেতা তখন রাম্পে হাঁটা মডেলের মত আপনার টিভি স্ক্রীনে ঢুকবে বেরোবে, সেই মনেহরণ দৃশ্যের নির্মাতারা পর্দার পিছন থেকে আমাদের ফ্যালফ্যালে সম্মোহিত চোখ দেখে আপন পিঠ চাপড়াবেন।
ম্যালেরিয়ার টিকা আসছে। আসছে ইবোলা, ডেঙ্গু, এইচআইভির টিকা। একই টিকায় সবকটা মুশকিল আসানের অমৃত আনা হচ্ছে। প্রত্যেকটিই এমআরএনএ প্রযুক্তি যা আপনার ফোনের মত নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে রিচার্জ করতে হয়। বলাই বাহুল্য, তখন আর ‘নিতে চাই’ বা ‘না, নেব না’, এই ধরনের সিদ্ধান্ত জানানোর কোন সুযোগ আর আমাদের দেওয়া হবে না। গরুকে ইঞ্জেকশন দেওয়ার আগে আমরা যেমন তার অনুমতি নিই না।
ইউক্রেনে বোমা পড়ছে আর তার ধোঁয়ার আড়ালে ধনকুবের গোষ্ঠী বেশ দ্রুত সাজিয়ে নিচ্ছেন ঘুঁটি। কিছুটা যেন অশোভন গতিতে তাড়াহুড়ো করছেন তাঁরা। একটু কি ভয় পেয়েছেন? বোমাবর্ষণটুকু খেয়াল করছি, ধ্বংসস্তুপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে লড়াকু ইউক্রেনবাসীর মরিয়া প্রতিরোধ দেখে উদ্বেলিত হচ্ছি কিন্তু কিছু আপাত নিরীহ চোরাস্রোত আছে যেগুলো সংবাদের গলাবাজিতে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনে ছ’টা ভ্যাকসিন চলছে। সেই ফর্দতে স্পুটনিক নেই।
রাশিয়াতে টিকাকরণের হার সবচেয়ে শ্লথ। তার জন্য ক্রমাগত আন্তর্জাতিক মহল থেকে চোখ রাঙানি হজম করতে হচ্ছে অথচ টিকাহীন জনসাধারণ যে সংক্রমণে দলে দলে মৃত্যুবরণ করছেন এমন কোন চটকদারি খবর নেই। রকেফেলার ও রথসচাইল্ড, উভয়কেই রুশ ভূমিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন পুতিন। পশ্চিম তখন পাঁচটি প্রধান রুশ ব্যাঙ্কের সুইফট কোড বাতিল করেছেন। যার অর্থ, রাশিয়া আর টাকাকড়ির আন্তর্জাতিক লেনদেন করতে পারবে না। পুতিন যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। নিজের দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি বৈধ করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিলেন।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ তেল উৎপাদক দেশ রাশিয়া। নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেও জার্মানিকে বলতে হোল যে তারা নর্ড স্ট্রীম ২ প্রজেক্ট অনুযায়ী রাশিয়া থেকে তেল কিনবে না। রাশিয়া তখন বড় অঙ্কের ছাড় দিয়ে এশিয়ার বাজারে টোপ ফেলল। যারা এই নতুন এক বিশ্বের সম্ভাব্য ক্রীতদাসত্ব নিয়ে গজরাচ্ছিল তারা দেখল এই সংঘাত হয়ত এক বিকল্পের বীজ বুনছে। ভাবটা যেন, তোমার এই ভূঁইফোড় এক বিশ্ব এক সরকার মস্তানি মানবো না, আমাদের আছে আরও সাবেকী এক বিশ্ব এক মতবাদ এক স্বপ্ন, সেইটি চাপাবো।
এ কোন রাম-রাবণের যুদ্ধ নয়। দুই সেয়ানা রাবণের যুদ্ধ। রাবণ মনে করেন যে তিনিই ‘কারণ’, ‘হোতা’। কিন্তু তাঁরও জানার কথা নয় যে কারণেরও পিছনে দণ্ডায়মান, মহাকারণ। হোতারও হেতু।
- জয়দীপ মহারাজ
*লেখকের মতামত ব্যক্তিগত