মোদী সরকারের উদ্যোগে এক মধ্যযুগীয় প্রথার অবসান

মুসলমান মহিলাদের অধিকারকে বিধিবদ্ধ আইনে রূপ দেওয়ার উদ্যোগ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। শরিয়ত আইনের তকমা দিয়ে তিন তালাক প্রথা (তালাক-ই-বিদ্দাত), নিকা হালালা এবং বহু বিবাহ প্রথাকে অবৈধ, অসাংবিধানিক এবং চরম লিঙ্গ বৈষম্যমূলক বলে অবিলম্বে এই আইন রদ করার জন্য ভারতীয় মুসলমান নারী সমাজ এবং মুসলমান সংগঠনগুলি। সুপ্রিমকোর্টে আর্জি রেখেছিল। বহুদিনের অপেক্ষারত মুসলমান নারীদের এই অধিকার রক্ষার দাবিটি উত্থাপিত হয়েছিল মুসলমান নারীসমাজ থেকেই। ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন’ মুসলমান মহিলাদের অধিকার রক্ষাকে বিধিবদ্ধ করার দাবি করেছিল। ২০১৫ সালের ২৭ নভেম্বর এই সংগঠনের সংগঠক নুরজাহান সোফিয়া নিয়াজ এবং জাকিয়া সোমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে মহিলাদের অধিকার রক্ষাকে বিধিবদ্ধ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দানের দাবি করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর হাতে ওইদিন তুলে দেওয়া পত্রে তারা বলেছিলেন—“কিছু গোঁড়া পিতৃতান্ত্রিক প্রভুত্ববাদী পুরুষ মুসলমান মহিলাদের অধিকার রক্ষার বিতর্কে প্রভুত্ব কায়েম করে রেখেছে। এর ফলে মুসলমান মহিলারা কোরানে স্বীকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ভারতীয় সংবিধানে নারী ও পুরুষকে যে সমানাধিকার দেওয়া হয়েছে সেই অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।”তারা ওদের দাবির প্রশ্নে সারা দেশের মুসলমান মহিলাদের ওপর যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সমীক্ষা চালিয়েছে তারও ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়েছিল, ভারতীয় মুসলমানদের ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৩৭ সালের শরিয়ত আইন এবং মুসলমান বিবাহবিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯-কে হয় সংশোধন করতে হবে নতুবা নতুন করে মুসলিম পার্সোনাল ল’চালু করতে হবে।
অন্যদিকে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি টি. এস ঠাকুরের নেতৃত্বে এক ডিভিশন বেঞ্চ এই সংক্রান্ত সবগুলো জনস্বার্থ মামলা একসঙ্গে যুক্ত করে শুনানি শুরু করেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে তাদের আর্জি ছিল, মুসলমান বিবাহ, তালাক, বহুবিবাহ ইত্যাদির ক্ষেত্রে এমন একটা আইন প্রণয়ন করা হোক, যেখানে একতরফা তালাক, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, ভরণপোষণ দিতে অস্বীকার করার মতো বিষয়গুলো অপরাধ বলে গণ্য হবে। এখন মুসলমান পুরুষ ইচ্ছামতো তিনবার ‘তালাক’ বলে ডিভোর্স দেয়। এমনকী ইদানীং টেলিফোন, টেক্সট ম্যাসেজিং, ফেসবুক, ওয়াটসঅ্যাপ বা স্কাইপের মাধ্যমেও ডিভোর্স দেওয়া শুরু হয়েছে। কেউ কেউ তো পোস্টকার্ড লিখে তালাক দিচ্ছেন। কোরানে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও তিন তালাক হচ্ছে কেন? এই অন্যায় অবিচারের অবসান চায় মুসলমান নারীরা। নারীবাদী মুসলমান মহিলাদের আইনজীবী শীর্ষ আদালতে বলেন—‘মুসলিম পার্সোনেল ল’ ভারতীয় আইন ব্যবস্থা বা বিচার ব্যবস্থার বাইরে হতে পারে না।
ওই মোকদ্দমায় ভারতের মুসলিম পার্সোনেল ল বোর্ডের পক্ষ থেকে এক হলফনামা দিয়ে বলা হয়, তিন তালাক, বহুবিবাহ ইত্যাদিবিষয়গুলি পবিত্র কোরানের অনুশাসন বিধি অনুসারে পালিত হয়। এতে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এটা নাকি আদালতের এক্তিয়ারের বাহিরে। এইসব বিধি রদ করার সঙ্গে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন জড়িত। ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্ন জড়িত। সংবিধান অনুসারে বিচার বিভাগকেও ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। ভারতে যে-কোনো ধর্মাবলম্বীদের নিজেদের ধর্মীয় প্রথা পালন করার অধিকার দিতে হবে। মুসলিম পার্সোনেল ল’ বোর্ডের মতে, সমাজ সংস্কারের নামে মুসলমানদের ব্যক্তিগত নিয়মবিধি পুনর্লিখিত হতে পারে না। তাই কোনো মুসলমান পুরুষ মৌখিকভাবে তিনবার তালাক উচ্চারণ করে স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে পারে। এটা মুসলমান আইনে বৈধ।
অন্যদিকে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে কেন্দ্রের মোদী সরকার জানিয়েছে তিন তালাক প্রথা অন্যায় ও অসাংবিধানিক। এই প্রথা নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। এটা মুসলমান। নারীদের আত্মসম্মানের প্রশ্ন, এটা ধর্মীয় স্বাধীনতার গ্যারান্টির প্রশ্ন নয়। এটা ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সংঘাতের প্রশ্নও নয়। সৌদি আরবের মতো দেশে মুসলমান বিবাহ এবং ডিভোর্সের জন্য আলাদা বিধি আছে। পরে সুপ্রিম কোর্টের ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে তিন তালাক অসাংবিধানিক বলে রায় প্রদান করে। ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট তারিখে সুপ্রিমকোর্ট রায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর ভিত্তি করে আইন তৈরির অনুরোধ জানায়।
কিন্তু তিন তালাক অবৈধ বলে দেশের সুপ্রিমকোর্টের ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের নির্দেশের পরেও কিন্তু তাৎক্ষণিক তালাক প্রথা জারি ছিল ভারতের বিভিন্ন অংশে। যেমন ভোজপুরী অভিনেত্রীর ঘটনা। ওই অভিনেত্রীর মতে তার স্বামী নাকি তাকে স্ট্যাম্প পেপারে তালাকনামা পাঠিয়েছেন। তাই ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে মোদী সরকার তিন তালাক বিল লোকসভায় পেশ করে এবং ধ্বনি ভোটে লোকসভায় পাশ হয়। কিন্তু সেইসময় রাজ্যসভায় প্রয়োজনীয় সমর্থন আদায় করতে পারেনি মোদী সরকার। বিলটি সংসদীয় কমিটিতে পাঠানোর দাবি জানান বিরোধী সাংসদরা। ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির জন্যই কংগ্রেস এইবিলকে সমর্থন করেনি রাজ্যসভায়। তারপর বাধ্য হয়ে। ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তারিখে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপরিষদ তিন তালাক নিয়ে অর্ডিনেন্স আনে। সেই অর্ডিনেন্সকে আইনে পরিবর্তন করতে ২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর আবার লোকসভায় মোদী সরকার তিন তালাক বিল-২০১৮ পেশ করে এবং লোকসভায় পাশ হয়। কিন্তু রাজ্যসভায় বিরোধীদের প্রতিবাদে পাশ হয়নি এবং ষোড়শ লোকসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিন তালাক বিলের মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। যেমনটি হয়েছিল ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলের ক্ষেত্রে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুনরায় তিন তালাক নিয়ে অর্ডিনেন্স ইস্যু করা হয়েছিল। তাই মোদী সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ২১ জুন তারিখে তিন তালাক বিল পুনরায় লোকসভায় পেশ করে এবং ৩০ জুলাই তারিখে লোকসভায় তিন তালাক বিল পুনরায় লোকসভায় পেশ করে এবং ৩০ জুলাই তারিখে লোকসভায় তিন তালাক বিল পাস হয়। তারপর বহুপ্রতীক্ষিত তিন তালাক বিল গত ৩০ জুলাই রাজ্যসভায় পাস হয়। রাজ্যসভায় ওই বিল পাসের পিছনে বড়ো। ভূমিকা রয়েছে ফ্লোর ম্যানেজমেন্টের। তাই সরকার পক্ষে ভোট পড়েছে ৯৯টি এবং বিরোধীদের পক্ষে পড়েছে ৮৪টি। ওই বিলে রয়েছে ৩টি অধ্যায় ও ৮টি ধারা। এই বিলের ধারা ৩ অনুযায়ী লিখিত বা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে তাৎক্ষণিক তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ (তালাক-ই-বিদ্দাত) অবৈধ। তাৎক্ষণিক তিন তালাক একটি ফৌজদারি অপরাধ যার জেরে ৩ বছরের জেল ও জরিমানা হতে পারে। অভিযোগ তখনই নেওয়া হবে যখন কিনা স্বয়ং বিবাহিত মহিলা বা তার বক্তব্যের সমর্থনে কেউ অভিযোগ করবেন। মুসলমান স্বামী কর্তৃক তাঁর স্ত্রীর উপর মৌখিক, লিখিত ও বৈদ্যুতিন তাৎক্ষণিক তালাক অবৈধ। যে। মুসলমান মহিলাকে তার স্বামী এই নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় তালাক দিয়েছেন তিনি তাঁর বিচ্ছিন্না স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের নির্ধারিত খোরপোষ দিতে বাধ্য থাকবেন। এছাড়াও এই বিলের ৬নম্বর ধারা অনুসারে নাবালক সন্তানদের হেফাজতে রাখার অধিকারও পাবেন। ১৯৭৩ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের পাশাপাশি ধার্য হবে এই আইনও। একমাত্র প্রথম শ্রেণীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মতিতেই ধার্য হবে বিবাহবিচ্ছেদ। এই বিল মতে প্রথম শ্রেণীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্তের জামিন দিতে পারেন। ওই তাৎক্ষণিক তিন তালাকের অভিযোগ নিতে বাধ্য থাকবেন কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার। ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রপতি এই বিলে সম্মতি দান করেছেন।
উপসংহারে বলা যায়, তিন তালাকের ছোঁদো যুক্তি ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানও বাতিল করেছে। শুধু পাকিস্তান বললে ভুল হবে বিশ্বের আরও ২১টি দেশ এই তিন তালাক প্রথা বাতিল করেছে। আধুনিক, দায়বদ্ধ, কল্যাণব্রতী রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত ভারতে কেন এই সাহসী পদক্ষেপের সমালোচনা হবে। হোক তিন তালাক প্রথা ও বহুবিবাহ প্রথা নিষিদ্ধ। যত শীঘ্রই নিষিদ্ধ হবে ততই দেশের মঙ্গল। সত্যি এইসব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়। মুসলমান মহিলাদের দেশের সংবিধান। অনুযায়ী ন্যায় পাইয়ে দেওয়া সরকারের যেমন কর্তব্য, তেমনি দেশের জনসংখ্যার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যও তালাকপ্রথা বন্ধ হওয়া জরুরি। রাজ্যসভায় বিলটি পাশ হওয়ার পর দেশের আইনমন্ত্রী বলেছেন, “আজকের দিনটি ঐতিহাসিক। মুসলমান মহিলাদের ন্যায় পাইয়ে দিতে সক্ষম দুই কক্ষ। এটা ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়ার সূচনা।”
ধৰ্মানন্দ দেব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.