বৃক্ষ ইব স্তব্ধো দিবি তিষ্ঠত্যেকঃ – প্রথম পর্ব

উপনিষদ্ বলছেন – অথ খল্বমুমাদিত্যং সপ্তবিধং সামোপাসীত সর্বদা সমস্তেন সাম মাং প্রতি মা প্রতীতি সর্বেণ সমস্তেন সাম।


অর্থাৎ, প্রশ্ন হল , সূর্যকে কি করে সামের সঙ্গে তুলনা করা যায়? যেহেতু সূর্য অসীম, আদিম, অপরিবর্তিত, সেহেতু সূর্যই সাম। আবার , সূর্যের দিকে তাকালে প্রতিটি প্রাণীর উপলব্ধি হয় যে , সূর্য তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সূর্য সকলের পক্ষে সমান। সূর্যের মতো সামও সকলের পক্ষে সমান।


তস্মিন্নিমানি সর্বাণি ভূতান্যন্বায়ত্তানীতি বিদ্যাৎ তস্য যৎ পুরোদয়াৎ স হিঙ্কারস্তদস্য পশবোহন্বায়ত্তা হিং কুর্বন্তি হিঙ্কারভাজিনো হ‍্যেতস্য সাম্নঃ।

এবিশ্ব চরাচর , সর্বভূত সেই সূর্যের উপর নির্ভরশীল। সূর্য ব্যতীত প্রাণ ধারণ অসম্ভব। উদয়কালে রবির রূপ বড়ই প্রসন্ন ও মনোরম হয়। সেই রূপই হিঙ্কার। সমগ্র প্রাণীকুল এই হিঙ্কার রূপের অনুগত।  তাই সূর্যোদয়ের পূর্বে তারা হিং শব্দ করে থাকে। এই ভাবেই প্রাণীকুল সামের হিঙ্কার অংশের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে।


অথ যৎ প্রথমোদিতে স প্রস্তাবস্তদস্য মনুষ্যা  অন্বায়ত্তাস্তস্মাত্তে প্রস্তুতিকামাঃ প্রশংসাকামাঃ প্রস্তাব-ভাজিনো হ‍্যেতস্য সাম্নঃ।
সূর্য প্রথম উদিত হলে আদিত্যের যে রূপ হয় তা সূর্যদেবতার উদ্দেশ্যে সামের #প্রস্তাব। আরণ্যক প্রাণীকুল সূর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেই অতুলনীয় রূপের প্রশংসা ও ভজনা করে। এই কারনেই তারা নিজেরাও স্তুতি ও প্রশংসাবাক্য শ্রবণের নিমিত্ত লালায়িত হয়। স্তুতি শব্দের অর্থ  কারোর প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে তার প্রশস্তি করা । আর প্রশংসা করার অর্থ হল কারোর উপর মনে উচ্চ ধারণা পোষণ করা।


অথ যৎ সঙ্গববেলায়াং স আদিন্তস্য বয়াংস্যন্বায়ত্তানি তস্মাত্তান্যযন্তরীক্ষেহনারম্বণান্যাদায়াত্মানং পরিপতন্ত‍্যাদিভাজীনি হ‍্যেতস্য সাম্নঃ।
সূর্যোদয়ের পর সূর্যের যে রূপ তা পাখীদের তা আরণ্যকে তা আরণ্যককে মোহিত করে।সেই সময়কার সূর্যই সামের আদি নামক অংশ অর্থাৎ ওঁকার। আরণ্যকগণ নিজেদের এই আদি পর্বের অংশীদার মনে করে। সূর্যের সকল রূপের নিকট তারা নিরাপদ। যদিও তাদের কোথাও কোনো অবলম্বন নেই ,তবুও তারা স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে। যেন তারা সাম গানের আদি পর্বে অংশগ্রহণ করেছে।


অরণ্যের পক্ষীকুল , পশুকুল যখন বিচরণ করে , তখন তারা #আত্মার উপর অর্থাৎ নিজের উপরই নির্ভর করে ওড়ে। যেহেতু আত্মা ও আদি এই দুটি শব্দই #আ অক্ষরটি রয়েছে। আ – আদি , আদিম , আত্মা, আরণ্যক ….তাই অরণ্যের সকল কিছুই এই #আদি অংশের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

বসন্ত লেগেছে সুনামগঞ্জের শিমুল বাগানে


হয়তো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও #আ – আদি, আদিম, আত্মা, আরণ্যকের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাই তিনি নিজেও আরণ্যক হয়ে উঠেছিলেন। নিজেকে সেই আত্মা সম উপলব্ধি সামের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিলেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে আর আমাদের দিয়ে গেছিলেন সেই মহাগ্রন্থ #আরণ্যক।
সুপন্ডিত অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় উপন্যাসটিকে সংক্ষেপে #অনন্যসাধারণ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছিলেন “ইউরোপীয় উপন্যাসেও এরূপ দৃষ্টান্ত সুলভ নহে। ” 


 আরণ্যক-এর অসাধারণত্বের মূল কারণ কি ছিল? আরণ্যক অনন্যসাধারণ উপন্যাস হয়ে উঠেছিল তার বিষয়বস্তু এবং বিষয়বস্তুর বর্ণনার জন্য। আসলে আরণ্যক তো কোন সম্পূর্ণ উপন্যাস নয় , নানাখন্ড কাহিনী মিলেমিশে সৃষ্টি হয়েছিল এই উপন্যাসের । এই উপন্যাসের দুটো বিষয়বস্তুকে করে গড়ে উঠেছিল তা হলো অরণ্য প্রকৃতি এবং অরণ্যের জীবন অর্থাৎ আরণ্যক। 


বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি রচনায় প্রকৃতিরই এক বিশিষ্ট স্থান আছে। সেখানে প্রকৃতিই দেবী , প্রকৃতিই নায়িকা আবার নায়িকাই প্রকৃতি। তিনি মানবজীবনের সঙ্গে , মানব চিন্তা ও অনুভূতির সঙ্গে প্রকৃতিকে একত্র সম্পৃক্ত করে দেখিয়েছেন , কখনও কখনও বা তাকে অধ্যাত্মানুভূতির আধার রূপে চিত্রিত করেছেন। 


হে স্তব্ধবাণী, কারে দিবে আনিনন্দনমন্দারমাল্যখানি,বরমাল্যখানি,প্রিয়- বন্ধনগান-জাগানো রাতেশুভ দর্শন দিবে তুমি কাহার চোখে॥

প্রকৃতি কখনও ধৈয্য হারায় না। প্রকৃতি অপেক্ষা করতে জানে। লবটুলিয়া, ফুলকিয়া, সরস্বতী কুণ্ডীর প্রকৃতি স্বয়ংসিদ্ধ ও আত্মনির্ভর প্রকৃতি; তার সৌন্দর্য , তার ঐশ্বর্য , তার মহিমা সকলই নিজস্ব। ঈশ্বর এখানে সর্বত্রব্যাপীরূপে – কিন্তু তাঁকে প্রাপ্ত হয় অতি সূক্ষ্ম অনুভূতির। এই রহস্যময় আধ্যাত্মিক অনুভূতি পরিচয় আরণ্যকের পাতায় পাতায়। #আরণ্যক_শাস্ত্র বলতে আমরা বুঝি #উপনিষদ্-কে। উপনিষদ্ যা রহস্যাবৃত না হয়েও রহস্যময়। বিভূতিভূষণ তাঁর আরণ্যকে নতুন করে রহস্য রচনা করে গেছেন। আমাদের তিনি অরণ্য প্রকৃতির আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের অংশীদার করতে চেয়েছেন এই ভাষায় : ” আমার মনে যে দেবতার স্বপ্ন জাগিত তিনি যে শুধু প্রধান বিচারক , ন্যায় ও দন্ডমুন্ডের কর্তা, বিজ্ঞ ও বহুদর্শী, কিংবা অব্যয়, অক্ষর প্রভৃতি দূরূহ দার্শনিকতার আবরণে আবৃত ব্যাপার তাহা নয় – নাঢ়া বইহারের কি আজমাবাদের মুক্ত – প্রান্তরে কত গোধূলিবেলায় রক্তিমেঘ- স্তূপের, কত দিগন্তহারা জনহীন জোৎস্নালোকিত প্রান্তরের দিকে চাহিয়া মনে হইত, তিনিই প্রেম ও রোম্যান্স , তিনি কবিতা ও সৌন্দর্য, শিল্প ও ভাবুকতা ― তিনি প্রাণ দিয়া ভালোবাসেন, সুকুমার কলাবৃত্তি দিয়া সৃষ্টি করেন, নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলাইয়া দিয়া থাকেন, নিঃশেষে প্রিয়জনের  প্রিয়জনের প্রীতির জন্য – আবার বিরাট বৈজ্ঞানিক শক্তি ও দৃষ্টি দিয়ে গ্রহ- নক্ষত্র – নীহারিকারও সৃষ্টি করেন।”


আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥
অসীম কালের যে হিল্লোলে   জোয়ার-ভাঁটার ভুবন দোলে
নাড়ীতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥
এর তুলনা পাওয়া যাবে এক মাত্র উপনিষদ্ রহস্যের মধ্যে। 
উপনিষদ্ বলেছেন – অথ যৎ সম্প্রতি মধ্যন্দিনে সে উদগীথস্তদস্য দেবা অন্বায়ত্তাস্তস্মাত্তে সত্তমাঃ প্ৰাজাপত্যানামুদ্গীথভাজিনো হ‍্যেতস্য সাম্নঃ।
প্রভাত গিয়ে মধ্যাহ্ন আসে , সূর্যের সেই রূপ বড়ই উজ্জ্বল। সেই অরূপ জ্যোতির্ময় সূর্যকে দেখে মনে হয় ভগবান সূর্য নারায়ণ যেন উদ্গীথ আবৃত্তি করছেন। যত দেব , যত দেবী ভগবান সূর্য নারায়ণের এই রূপের নিকট অনুগত। তাঁরা সামগানের এই উদ্গীথ পর্বে অংশগ্রহণ করেন। সেই নিমিত্ত তাঁরাই প্রজাপতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে গণ্য হন।


এই প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সত্যচরণের মুখে উচ্চারিত করেছেন উপাসনার ভাষা। কন্ঠে জেগেছে ধ্রুপদের উদাত্ত সুর। এই প্রকৃতি তো পল্লীবালা, মাধুর্যময়ী,পোষমানা প্রকৃতি নয়। এ প্রকৃতি ঘরছাড়া উদাসিনী প্রকৃতি, কখনো হু হু বৈরাগী, কখনো ছায়াছন্ন বা জোৎস্নালোকিত রহস্যের রূপ, আবার কখনো ভীমা ভয়ঙ্করী। 

বিভূতিভূষণ বলেছেন -” যে কথাটা বার বার নানাভাবে বলিবার চেষ্টা করিতেছি, কিন্তু কোনোবারই ঠিকমতো বুঝাইতে পরিতেছি না , সেটি হইতেছে একটা রহস্যময় অসীমতার দূরঅধিগম্যতার,  বিরাটত্বের ও ভয়াল গা ছম্ – ছম্ করানোর সৌন্দর্যের দিকটা।

……..এখানকার প্রকৃতির এই রূপ আমার মনকে অসীম রহস্যের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছে; কখনও তাহা আসিয়াছে ভয়ের রূপে , কখনো আসিয়াছে একটা নিস্পৃহ,  উদাস , গম্ভীর মনোভাবে রূপে, কখনও আসিয়াছে কত মধুময় স্বপ্ন, দেশ-বিদেশের নর-নারীর বেদনার রূপে। সে যেন খুব উচ্চদরের নিরব সংগীত –  নক্ষত্রের ক্ষীণ আলোর তালে, জ্যোৎস্নারাত্রে অবাস্তবতায়, ঝিল্লির ধাবমান উল্কার অগ্নিপুচ্ছের জ্যাতিতে তার লয় সঙ্গীত। সে রূপ তাহার না দেখাই ভাল যাহাকে ঘরদুয়ার বাঁধিয়া সংসার করিতে হইবে। ……তার সৌন্দর্যের পাগল হইতে হয় ― একটু বাড়াইয়া বলিতেছি না― আমার মনে হয় দুর্বল চিত্ত মানুষের পক্ষে সেরূপ না দেখাই ভালো, সর্বনাশী সে রূপ, সর্বশেষে সকলের পক্ষে তা সামলানো বড় কঠিন।”


ক্রমশঃ
তথ্যঃ ১. ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ( দ্বিতীয় অধ্যায় , অষ্টম খণ্ড)
২. আরণ্যক উপন্যাস

©দুর্গেশনন্দিনী
( প্রবন্ধটি ধারাবাহিকভাবে ঋতম্ বাংলায় প্রকাশিত হল)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.