১৩ মার্চ শতবর্ষে আনন্দবাজার পত্রিকা

“আনন্দবাজার পত্রিকা যাত্রা শুরু করেছিল ১৩ মার্চ, ১৯২২। আনন্দবাজার পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল দোলযাত্রার দিন। প্রথম সংখ্যাটি ছাপা হয়েছিল পুরোপুরি লাল কালিতে। যাকে ব্রিটিশ সরকারের মুখপত্র ইংলিশম্যান এক ‘বিপদ সংকেত’ বলে ভেবেছিল। ইংলিশম্যানের এই দূরদৃষ্টির প্রশংসা না-করে উপায় নেই। কেননা, আনন্দবাজার পত্রিকা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে নির্ভীক ও আপসহীন মনোভাব নিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিতে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল।”

নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে একথা লিখেছেন আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃপক্ষ। সেই হিসাবে ১০০ বছর হল এই পত্রিকার। এর প্রায় এক তৃতীয়াংশ সময় কাটিয়েছি এই সংস্থার কর্মী হিসাবে। ঐতিহ্য ও মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের অনেক কিছু কাছ থেকে অনুভব করার সুযোগ হয়েছে এই প্রতিবেদকের। এর ভিত্তিতে নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি, অন্তত আমার কাছে এই প্রতিষ্ঠান এককথায় সত্যিই অনন্য। ২০১৬-র পর থেকে একটা সম্পূর্ণ অন্য অধ্যায় শুরু হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানে। যা নিঃসন্দেহে পত্রিকার আগের ৯৫ বছরের চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যবিহীন। এতে অনেক বিতর্ক হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু গুণগত মানের নিরিখে আনন্দবাজার পত্রিকা আজও একমেবাদ্বীতিয়ম।

অনেকেই জানেন অধুনালুপ্ত অমৃতবাজার পত্রিকা এবং আনন্দবাজার পত্রিকার দুই প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে ছিল আত্মীয়তার সম্পর্ক। ১৮৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অমৃতবাজার পত্রিকা। আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম আনন্দবাজার গ্রামে। সেই ছবি ফেসবুকে দেওয়ার পর পরিচিত, অপরিচিত অনেকে নানা তথ্য জানতে চান। ‘Speeches and writing of Motilal Ghosh’, (1935)-তে পেয়েছি Babu Motilal Ghosh, one of the founders of Amrita Bazar Patrika, was born in a small village called Polua Magura, subsequently named as Amrita Bazar, after the name of his mother Amrita Moyee…” (pg ১), “Amritabazar Patrika was started in the year 1868 in the village Amritabazar. (pg ৩)

ইন্দ্র মিত্র আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত ‘ইতিহাসে আনন্দবাজার’ বইতে জানিয়েছেন, অধুনালুপ্ত অমৃতবাজারের ঘোষ পরিবারের সঙ্গে আনন্দবাজারের সরকার পরিবারের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। শিশিরকুমার ঘোষের ভাগ্নী সরলাবালা সরকারের মেয়ে নির্ঝরিনী সরকারের সঙ্গে ১৯০৫ সালে বিয়ে হয় প্রফুল্ল কুমার সরকারের। ১৯২১-এর ডিসেম্বরের পরে ঢেঙ্কানল থেকে কলকাতায় চলে আসেন প্রফুল্ল সরকার। গোড়ায় মাস ৩-৪ তিনি মতিলাল ঘোষের অধীনে সহকারী সম্পাদকের কাজ করেন।

আনন্দবাজার পত্রিকা প্রথম ছাপা হয়েছিল বাংলা হিসেবে ২১ ফাল্গুন, ১৩২৮। ইংরেজি হিসেবে ১৩ মার্চ, ১৯২২। দোলপূর্ণিমায় বেলা সাড়ে চারটে নাগাদ প্রথম প্রকাশিত হল আনন্দবাজার পত্রিকা। আদ্যান্ত লাল কালিতে ছাপা। চার পৃষ্ঠা। একেকটি পৃষ্ঠার আয়তন ৫৪ ৪৫ সেন্টিমিটার। নগদ মূল্য ২ পয়সা। প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপনে ভর্তি। মুদ্রক, প্রকাশকের নাম-ঠিকানা থাকলেও সম্পাদক বা কার্যাধ্যক্ষের নাম নেই।

প্রথম সংখ্যায় এই লাল রঙের ব্যবহার প্রসঙ্গে রুদ্রাংশু মুখার্জি লিখেছেন, “The significance of the choice of colour, however, did not escape the leading English newspaper in Calcutta of the time which noted that the new daily at its very moment of birth was defiantly waving the banner of protest. Anandabazar Patrika was born under the star of nationalism, which in the 1920s meant protest against the oppression of foreign rulers. Nationalism also signified hope — the hope of a nation in the making — and Anandabazar Patrika embodied this hope.(‘এ সেন্টেনারি ট্রিবিউট, অশোক কুমার সরকার, ১৯১২- ১৯৮৩‘, ৭-১০-২০১২)।

প্রথম প্রকাশের কিছুদিন বাদে, ১৯২৩-এর ২৫ অক্টোবর প্রকাশিত হয় নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ‘ফরোয়ার্ড‘। আনন্দবাজার পত্রিকা বিক্রির জন্য (অর্থাৎ, সোল সেলিং এজেন্ট হওয়ার জন্য) নেতাজীর সুপারিশ করা চিঠি নিয়ে এসেছিলেন পাতিরাম পারিজা। পাতিরাম জানিয়েছেন, প্রথম দিন আনন্দবাজার ছাপা হয় ১,০০০ কপি। বিক্রি হয়েছিল ৬৫০-র মত। এটা ছিল অবশ্যই দৈনিক।

প্রথম থেকেই আনন্দবাজার ছিল বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত। যৌবনে সুরেশ চন্দ্র মজুমদার ছিলেন বাঘাযতীনের ঘনিষ্ঠ অনুগামী। প্রফুল্ল কুমার সরকারও যুক্ত ছিলেন বিপ্লবের সঙ্গে। তবে
১৯২৩-এ গ্রেফতার হয়ে তাঁকে কারাবাস করতে হয় আনন্দবাজার পত্রিকায় বিপ্লবের সমর্থনে সংবাদ প্র কাশের দায়ে। মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন প্রফুল্লবাবুর স্ত্রী অর্থাৎ অশোক সরকারের মা নির্ঝরিনি দেবী। ত্রিশের দশকে, তিন বার গ্রেফতার হন তিনি। এই রকম নিবেদিত সংগ্রামী দম্পতির পুত্রও যে বিপ্লবের মনত্রে দীক্ষিত হবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী? আনন্দবাজার পত্রিকা প্রকাশের ১১ বছর বাদে, ১৯৩২ সালে গ্রেফতার হলেন অশোক কুমার সরকার। রুদ্রাংশু মুখার্জি লিখেছেন, “It was his baptism by fire.“

সবচেয়ে মজার কথা, দীর্ঘদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করার সুবাদেও যেটা জানতে পারিনি, ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে জেনেছি, এই দৈনিকের অনেক আগে প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক আনন্দবাজার পত্রিকা। খুব বেশিদিন চলেনি। ১৮৮৬ সালে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এটির জন্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন ঘোষ পরিবারের শিশিরকুমার, হেন্তকুমার, মতিলাল। ওঁদের নামোল্লেখ করে গোলাপ লাল ঘোষ লিখেছেন, “ওঁরা ছিলেন আনন্দবাজারের শৈশবধাত্রী।“

কেমন ছিল আনন্দবাজার পত্রিকার গোড়ার দিকের বিন্যাস? ১৯২২-এর ১০ এপ্রিল, বাংলা ১৩২৮-এর ২৭ চৈত্রর পত্রিকায় দেখছি এর মাস্টহেডে লেখা, “অমৃতবাজার পত্রিকার পরিচালকগন কর্তৃক ১৮৭৭ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠিত।“ কাগজের দাম ২ পয়সা। প্রথম পৃষ্ঠার পুরোটাই টুকরো টুকরো বিজ্ঞাপন। বাগবাজারের রসগোল্লা থেকে সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের ‘বৈদ্যনাথ আয়ুর্ব্বেদ ভৈষজ্যালয়’, কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটের ‘সেমি অটোমেটিক রাণী চড়কা’ থেকে ১৪৮ বহুবাজার স্ট্রিটের ‘হিলিং বাম’। ওই প্রথম পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপনেই দেখছি ডোয়ার্কিন-এর বাক্সসমেত একটি ‘গ্রামোলা’ হারমোনিয়ামের দাম ছিল ৪৫ টাকা। এ ছাড়াও বিজয় কবচ, মহৎ আশ্রম, স্বর্ণঘটিত বিশুদ্ধ সর্বরোগনাশক মকরধ্বজ, হিলিং বাম, শান্তিরস সালসার বিজ্ঞাপন দেখলে বোঝা যায়, আমাদের সেকালের জীবনে কোন জিনিসগুলো নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছিল। ঢাকা শক্তি ঔষধালয়, সাধনা ঔষধালয়, ঢাকা আয়ুর্বেদীয় ফার্মাসি লিমিটেড প্রবৃতির বিজ্ঞাপন মনে করিয়ে দেয় ওপার বাংলার স্মৃতি।

এখানে জানিয়ে রাখি, এই Dwarkin & Son.Ltd কিন্তু কোন বিদেশী কোম্পানী নয়। দ্বারকানাথ ঘোষ (১৮৪৭-১৯২৮) এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৭৫ সালে এই বাদ্যযন্ত্রের দোকানটি চালু করেন। এখানে দেশী বাদ্যযন্ত্রের সাথে সব রকম বিদেশী বাদ্যযন্ত্র পাওয়া যেত। সেই এটির ঠিকানা ছিল ১১, এসপ্ল্যানেড। বর্তমানে এটির ঠিকানা ৮/২ এসপ্ল্যানেড ইস্ট। জানা গেছে ইনি এক সময় ঠাকুর পরিবারের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

আনন্দবাজার আঁতুরঘর থেকে বেড়িয়ে যখন পরিচিতি পেয়েছে, সেই ১৯৩৭ সালে ৩, বর্মণ স্ট্রিটের অফিস থেকে সুরেশচন্দ্র মজুমদার বার করলেন হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল ‘দি স্টেটসম্যান’-এর। ১৯৫১ সালে চালু হল দিল্লি সংষ্করন। কিন্তু ১৯৮২-তে বন্ধ হয়ে যায় এর মুদ্রণ। পত্রিকার সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র হিসাবে বার হত ‘দি সান্ডে’। ১৯৭৬ সালে অভীক সরকার এটি পৃথক সাপ্তাহিক হিসাবে বার করতে শুরু করেন। সম্পাদক হন এমজে আকবর। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৪ পাঠকমহলে সমাদৃত ছিল এই প্রতিষ্ঠানের ‘স্পোর্টসওয়ার্ল্ড’। এর সম্পাদক ছিলেন পতৌদির নবাব মনসুর আলি খান। ১৯৭৫-এর ২৬ মার্চ প্রকাশিত হয় ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড‘। এর হিন্দি সংষ্করনও বার হয়। ১৯৯৭ সালে পত্রিকাটি বিক্রি করে দেওয়া সয় কোটাক মাহিন্দ্র ফিনান্সকে। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় এবিপি-র ইংরেজি বানিজ্য-অর্থনীতি বিষয়ক সাপ্তাহিক বিজনেস ওয়ার্ল্ড। এর দফতর ছিল দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাইয়ে। ২০১৩-র ১৯ সেপ্টেম্বর পত্রিকাটি কিনে নেন অনুরাগ বাত্রা এবং বিক্রম ঝুনঝুনওয়ালা। ১৯৮২-র ৭ জুলাই প্রকাশিত হতে শুরু করে এবিপি-র ইংরেজি দৈনিক ‘দি টেলিগ্রাফ’। ২০১৯-এর আইআরএস সমীক্ষায় এটি ছিল ভারতের অষ্টম সর্ববৃহৎ ইংরেজি দৈনিক। কিছুকালের জন্য প্রকাশিত হয় বৈকালিক দৈনিক ‘দি মেট্রোপলিটন’।

১৯৫৭-র ৬ জুলাই আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষ তৈরি করেন পুস্তক প্রকাশনার পৃথক শাখা আনন্দ পাবলিশার্স। পত্রিকার মত এটিরও গড়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে অনেক কাহিনী। ১৯৩৩-এর ২৪ নভেম্বর থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ‘দেশ’ পত্রিকা। বেশ কয়েক যুগ এটি ছিল জনপ্রিয় ও মর্যাদাসম্পন্ন সাপ্তাহিক। পরে এটি পাক্ষিক হয়। প্রতি মাসের ২ এবং ১৭ তারিখে প্রকাশিত হয়। এক সময়ে ছিল মূলত সাহিত্যভিত্তিক। এখন রাজনীতি, খেলা, আজকাল, বাংলার হালচাল, সিনেমা, থিয়েটার, সাম্প্রতিক বিষয় – সব নিয়ে ছাপা হচ্ছে।
‘আনন্দলোক’-এর যাত্রা শুরু হয় ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে। আনন্দমেলার প্রথম প্রকাশ মার্চ, ১৯৭৫। কিছুকালের জন্য প্রকাশিত হয় ‘ভূমিলক্ষী’। ১৯৮৬-র ৩১ জুলাই প্রথম প্রকাশিত হয় ‘সানন্দা‘। প্রথম সংখ্যাই বিক্রি হয়েছিল ৭৫ হাজার। দীর্ঘকাল এটি সম্পাদনা করেছেন অপর্ণা সেন। ২০০৫ সালে প্রকাশ করা হয় এর ওডিয়া সংস্করণ।

প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে আনন্দবাজার পত্রিকা ছিল জাতীয়তাবাদের উদ্গাতা, স্বাধীনতা পরবর্তী কালে সে দাঁড়িয়েছে এই বাংলা ও তার মানুষদের সার্বিক উন্নয়নের পক্ষে। পক্ষপাতহীন মতামত, গঠনমূলক সমালোচনা, অদম্য সাহস ও আপসহীন মনোভাব এ হল মাত্র কয়েকটা দিক, যা আনন্দবাজার পত্রিকাকে করে তোলে ‘বাঙলার ভাষা’।

১৯৫৪ সালে প্রেস কমিশন আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেশের একক সংস্করণের সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র হিসাবে ঘোষণা করে। নতুন শতকের সূচনালগ্নে আজও আমরা সেই গৌরবকে অক্ষুণ্ণ রেখে চলেছি। ‘আমাদের কথা’-তে আনন্দবাজার পত্রিকা এ কথা জানিয়ে লিখেছে, পত্রিকার দৈনিক প্রচার সংখ্যা (অডিট ব্যুরো অফ সার্কুলেশন) এখন ১০ লক্ষ ৬৬ হাজার ৭১৪ (প্রধান সংস্করণ)। পশ্চিমবঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার পাঠকসংখ্যা ১ কোটি ২৭ লক্ষ (IRS 2019 Q3, Total Readership, Main)। কোনও সংবাদপত্র শক্তি আহরণ করে তার পাঠকবর্গের কাছ থেকে। আর এই পাঠকদের কাছ থেকেই আনন্দবাজার পত্রিকা পেয়েছে তার প্রেরণা। তাঁরাই তো সংবাদপত্রের চালিকাশক্তি। প্রতিদিন সকালে প্রায় ৭০ লক্ষ শিক্ষিত প্রাপ্তবয়স্ক বাঙালি আনন্দবাজার পত্রিকা পড়েন। সত্যি বলতে কি, পশ্চিমবঙ্গে প্রতি দু’জন সংবাদপত্র পাঠকের মধ্যে একজন আনন্দবাজার পত্রিকার পাঠক। কলকাতার উচ্চ সমাজের বেশির ভাগ মানুষ ইংরেজি সংবাদপত্র না-পড়ে একটি আঞ্চলিক ভাষার খবরের কাগজ পড়েন, এ-ঘটনা সত্যিই অভিনব। আর কোনও মহানগরে আমরা এমন ঘটনা দেখতে পাই না।

কেবল সরকার পরিবার নয়, স্বাধীনতার আগে ওই পত্রিকা গান্ধীজী এবং জাতিয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিল। প্রতিষ্ঠানে যাঁরা কাজ করতেন, সকলেই নিজেদের সংগ্রামীর চোখে দেখতেন। স্বাধীনতার পরেও পত্রিকার এই সত্বা কর্তৃপক্ষ বিসর্জন দেননি। ফলশ্রুতি হিসাবে চরম আঘাত এসে পড়েছে জরুরি অবস্থার সময়। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার আনন্দবাজার পত্রিকার মেরুদন্ড ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। পত্রিকা কর্তৃপক্ষ নতজানু হয়নি। আরও পরে বাম আমলে চেষ্টা হয়েছিল পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার। ১৯৮৪ সালে তৎকালীন বাম সরকার ও সিপিএম সমর্থকদের ভূমিকার কথা আমরা অনেকেই দেখেছি।

‘কালের কন্ঠ’-তে রাজীব নন্দী লিখেছেন, ‘কাজেই পরিচয়’ নীতিতে অটল কলকাতার ৬ নম্বর প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট ঘেঁষে দাঁড়ানো বহুতল ভবন ‘হোয়াইট হাউস’ নামে খ্যাত। পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা। বাংলাদেশের সব জাতীয় দৈনিকের সম্মিলিত প্রচারসংখ্যা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সেই একক সার্কুলেশনেরও কম। ২০০৩ সাল থেকে প্রতিদিন ১৪ পৃষ্ঠা প্রকাশিত হয়। ২০০২ সালে ১০ পৃষ্ঠার প্রকাশিত প্রতি কপির দাম ছিল ভারতীয় দুই রুপি। আনন্দবাজার যখন প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে তখন ছিল মাত্র দুই পৃষ্ঠা, এপিঠ-ওপিঠ, দাম ছিল আধ-আনা। ১৯৩০ সালের ১৩ মার্চ আনন্দবাজার চার পৃষ্ঠা করা হয়। দাম এক আনা। আনন্দবাজারে প্রথম সাদাকালো ছবি ছাপা হয় ১৯৩৮ সালে। ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই ছাপা হয় প্রথম রঙিন ছবি। আনন্দবাজার আট পৃষ্ঠা প্রকাশ শুরু হয় ১৯৭৭ সালে এবং দাম ছিল এক রুপি। ১৯৮৮ সালে ১০ পৃষ্ঠা পত্রিকার দামও ছিল এক রুপি। ২০০০ সালে ১০ পৃষ্ঠা আনন্দবাজারের দাম পুনর্নির্ধারিত হয় দুই রুপি (১৩ মার্চ, ২০২০)।

ছাপা, ছবি, বিন্যাসে আনন্দবাজার বিভিন্ন সমরে আন্তর্জাতিক উৎকর্ষতার স্বীকৃতি পেয়েছে। কিছুটা বিতর্কিত হলেও এই পত্রিকার আর একটা গর্ব এর বানানবিধি। অধিকাংশ বাংলা শব্দের ক্ষেত্রেই পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি কর্তৃক সংস্কারকৃত বানানবিধি গৃহীত হয়েছে। কেবল অবঙ্গভাষী ব্যক্তিবর্গের নাম এবং বহির্বঙ্গের কোনো স্থাননামের ক্ষেত্রে এই পত্রিকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্বের মাতৃভাষায় অথবা সংশ্লিষ্ট স্থানে প্রচলিত ভাষায় প্রচলিত বানান এবং উচ্চারণ অনুসারে শব্দটির প্রতিবর্ণীকরণ করে থাকে।

‘আমাদের কথা’-তে পত্রিকার তরফে জানানো হয়েছে, ন্যাশনাল রিডারশিপ সার্ভের রিপোর্টে প্রতিফলিত হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকার পাঠকবর্গের জীবনযাত্রার ধারা। কলকাতা থেকে নিয়মিত বিমানে ভ্রমণকারী প্রতি দু’জনের একজন, পশ্চিমবঙ্গে নামকরা গাড়ির মালিকদের ৪০%, রাজ্যের ওয়াশিং মেশিন আছে, এমন মানুষদের অর্ধেকেরও বেশি, পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেক মাইক্রোওয়েভ মালিক, রাজ্যের সমস্ত এয়ার কন্ডিশন মালিকের ৪০% আনন্দবাজার পত্রিকার সমৃদ্ধ পাঠক-তালিকা খুব দীর্ঘ। আর এই পাঠককুল অসংখ্য বিজ্ঞাপনদাতার কাছে এক সত্যিকারের স্বর্ণখনি। যে-বিজ্ঞাপনদাতা বাজারে একটুখানি ভাগ পাওয়ার জন্য পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। বিজ্ঞাপনদাতারা জানেন, পশ্চিমবঙ্গে সামগ্রী ও পরিষেবা বিপণন করতে গেলে আনন্দবাজার পত্রিকা অপরিহার্য। কারণ, এই পত্রিকা ‘শুধু এক বৃহৎ সংবাদপত্র নয়, এক বৃহৎ বাজার’।

এখন anandabazar.com বাংলা ভাষায় ভারতের এক নম্বর নিউজ ওয়েবসাইট। পাঠকসংখ্যা এবং পেজভিউয়ে সর্বোচ্চ এই ওয়েবসাইটের মাসিক গড় পাঠক এক কোটি। খবরের পাতা পড়েন প্রতি মাসে গড়ে ১২ কোটি বার। সঠিক, নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্লেষণাত্মক খবর দেওয়ায় আনন্দবাজারের অনলাইন পাঠকসংখ্যা প্রতি মাসে ক্রমাগত বাড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মেও আনন্দবাজার রয়েছে। চারটি ফেসবুক পেজে নজর রাখেন ৮০ লক্ষ নেটাগরিক। টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং ইউটিউবে আমাদের এখনই ফলো করেন ৫ লক্ষ মানুষ। এই সংখ্যাও প্রতিদিন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে।

আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে প্রাক্তন কর্মীদের অনেকে নানা সময় স্মৃতিচারণ করেছেন। তাঁদের একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, দুন স্কুল, অক্সফোর্ডের প্রাক্তনী মনিশঙ্কর আয়ার ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অফিসের দাপুটে অফিসার, রাজীব গান্ধীর খাস ইয়ার-দোস্ত। তিনি হন্যে হয়ে একদিন অভীক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন। না পেয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন মোবাইল ফোন চালু হয়নি। ভরসা ল্যান্ড লাইনই। তাই যোগাযোগের ব্যাপারটা ছিল বেশ সময় এবং ভাগ্যসাপেক্ষ।

আমাকে ফোনে পেতেই মনিশঙ্কর অভীকবাবুর সঙ্গে অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনের কথা জানিয়ে বললেন, “কলড হিজ ক্যালকাটা নাম্বারস এ মিলিয়ন টাইমস, কুড নট গেট থ্রু টু হিম। ক্যান ইউ টেল হিম টু কনট্যাক্ট মি ইমিডিয়েটলি? ইট ইজ ভেরি ভেরি ইম্পরটেন্ট। প্রাইম মিনিস্টার ওয়ান্টস টু স্পিক উইথ হিম।’’

আমি তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করলাম অভীকবাবুর সঙ্গে। অভীকবাবু যা শোনালেন তার মর্মার্থ এই রকম। পরিবার, ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব, অনুগত অমাত্যদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বৎসরান্তের ছুটি কাটাবেন লাক্ষাদ্বীপে, প্রমোদ-তরীতে প্রমোদ ভ্রমণ। অমিতাভ-জয়া বচ্চনের সঙ্গে অভীকবাবুকেও রাখা হয়েছে আমন্ত্রিতর তালিকায়। বেশ কিছুদিন আগেই তাঁর কাছে সরকারি আমন্ত্রণপত্র পৌঁছেছে, তিনি কোনো জবাব দেননি। সেদিনই জবাব দেওয়ার শেষ দিন বলে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছে কিন্তু তিনি ধরা দিচ্ছেন না।

কিন্তু কেন? সুমন লিখছেন, “সম্পাদকের জবাব শুনে তাঁর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধায় আমার মাথাটা নুইয়ে পড়ল। এমন একজন সম্পাদকের অধীনে কাজ করি ভেবে খুব গর্ববোধও হল। অভীকবাবু বললেন, ‘ব্যক্তিগত সম্পর্ক এখানে বিচার্য নয়। বিচার্য হল, রাজীব গান্ধী দেশের প্রধানমন্ত্রী আর আমি একটি সংবাদপত্র-গোষ্ঠীর প্রধান সম্পাদক। সম্পাদক হিসেবে এ কাজ আমি করতে পারি না, করলে বাকিদের কাছে আমার বিশ্বাসযোগ্যতা বলে কিছু আর বাকি থাকবে না। সম্পাদকের কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে, নিজেরই টানা একটা লক্ষ্মণ-রেখার মধ্যে থেকে তাঁকে কাজ করতে হয়। অবশ্য তিনি যদি চামচা হতে চান সেটা ভিন্ন প্রশ্ন।’’

প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের কর্তারা বরাবর কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন কিন্তু ব্যবসার বৃহত্তর স্বার্থে দলীয় রাজনীতির প্রলোভনে কদাচ পা দেননি। অশোক কুমার সরকার, অভীক সরকার অনেকবার রাজ্যসভায় যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছেন, স্বধর্ম থেকে সরেননি। তাঁরা ব্যবসায়িক সাফল্যের মধ্যে দিয়ে বঙ্গ-সমাজ ও সংস্কৃতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন, তার জন্য রাজনীতির চোরা-পথে প্রবেশের কোনো প্রয়োজন হয়নি।

আনন্দবাজারের ৭৫তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অভীকবাবু যে বক্তৃতাটি পাঠ করেছিলেন তাতে যেমন তাঁর স্বভাবসুলভ দম্ভের ছোঁয়া ছিল তেমনি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই কাগজটি কীভাবে নিজেকে বদলেছে, কীভাবে নতুন নতুন প্রযুক্তিকে ব্যবহার করেছে, কীভাবে সব কয়টি যুক্তাক্ষর অবিকৃত রেখে কম্পিউটারে বাংলা হরফ তৈরি করেছে এবং এইভাবে একটি জাতির মুখপাত্র হয়ে উঠতে পেরেছে, তার বিশদ, মনোজ্ঞ আলোচনাও ছিল আনন্দবাজারের সাফল্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহী যাঁরা অভীকবাবুর এই বক্তৃতাটি তাঁদের অবশ্যপাঠ্য।“

অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.