আপাত দৃষ্টিতে প্রশ্নটি সহজ। তা হল, যে আইএএস অফিসার সংখ্যায় ‘কম পড়ার’ দাবিতে ডেপুটেশন-নীতি নিয়ে (রাজ্যের অফিসারকে কেন্দ্রে পাঠানো) কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য প্রশাসনের মধ্যে এমন দড়ি টানাটানি, তাঁদের নিয়োগ আরও বাড়ানো হয় না কেন? বছরের পর বছর নিয়োগে যদি ঘাটতি থেকেই থাকে, তা হলেই বা কেন তার বিরুদ্ধে সে ভাবে সরব হয় না প্রায় কোনও রাজনৈতিক দল?
আমলামহলের একাংশের ব্যাখ্যা, গত কয়েক দশকের উদাহরণ থেকে স্পষ্ট, ‘অচেনা’ আইএএসের তুলনায় অনেক সময়েই ‘ঘরের এবং চেনা’ অফিসারদের (এ রাজ্যে যেমন ডব্লিউবিসিএস) সঙ্গে কাজ করতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এবং তাঁদের মতে, এ কথা গত কয়েক দশকে প্রায় সমস্ত রাজ্যের সব দল পরিচালিত সরকারের ক্ষেত্রে সত্যি। সেই কারণেই আইএএস অফিসার কম নিয়োগ কিংবা তাঁদের কম সংখ্যায় পাঠানোর বিষয়ে কোনও রাজ্যের প্রশ্ন তোলা অথবা তীব্র প্রতিবাদের নজির বিরল।
নিয়োগে ঘাটতি প্রসঙ্গে প্রবীণ এক আইএএস অফিসার বলেন, “এই সমস্যা উবলব্ধি করতেই বড় দেরি হয়ে গিয়েছে।” প্রাক্তন আইএএস অফিসার তথা তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ জহর সরকারের অবশ্য বক্তব্য, “রাজ্য দাবি করেনি, এটা পুরোপুরি ঠিক নয়। মোট কত জন আইএএস অফিসার প্রয়োজন (অফিসার-শক্তি), তার একটা অঙ্ক কষে কেন্দ্রকে পাঠায় রাজ্য। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কেন্দ্রেরই। দূরদৃষ্টি রেখে তাদের নিয়োগ-পরিকল্পনা করা উচিত।”
আইএএস অফিসারদের ঘাটতি এবং তার কারণ খতিয়ে দেখতে তৈরি হয়েছিল বাসওয়ান কমিটি। ২০১৬-১৭ সাল নাগাদ তাদের রিপোর্ট গ্রহণ করে কেন্দ্র। তাতে কিন্তু কার্যত রাজ্যগুলির ভূমিকাকে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে। কোনও রাজ্যে কোনও দলের সরকারই টানা, জোরালো ভাবে তার প্রতিবাদ করেনি।
তথ্য জানার অধিকার আইনে দেশে আইএএস-দের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন প্রতীচী ট্রাস্টের গবেষক সাবির আহমেদ। সেই সূত্রে কেন্দ্রের দেওয়া তথ্যই বলছে, ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দেশে আইএএস অফিসারের ঘাটতির হার ১৪% থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫%। ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে দেশে মোট অফিসার প্রয়োজন ৬৭৪৬। রয়েছেন ৫২৩১ জন (এর মধ্যে সরাসরি আইএএস ৩৭৮৭)। ঘাটতি ১৫১৫ জনের। ঠিক এই কারণে এখন পর্যাপ্ত নিয়োগের দাবি জোরদার হচ্ছে। রাজ্যসভায় সম্প্রতি সরকারের উদ্দেশে জহর বলেন, “সাড়ে ছ’হাজার পদের মধ্যে দেড় হাজার খালি। দয়া করে সেগুলি পূরণ করুন। সব জায়গায় জোর খাটে না।”
তবে শুধু গত কয়েক বছরে আইএএস নিয়োগ প্রয়োজনের তুলনায় কম হচ্ছে, এমন কথা অবশ্য একেবারেই বলছে না পরিসংখ্যান। ইতিহাস টেনে প্রবীণ আইএএস অফিসারদের অনেকে জানাচ্ছেন, আশির দশকে গড়ে কম-বেশি ন’জন করে অফিসার নিত রাজ্যগুলি। কিন্তু আদালতের রায় এবং খরচে রাশ টানার লক্ষ্যে প্রশাসনিক সংস্কারের যুক্তিতে সারা দেশে বছরে গড়ে ১৬০ জন আইএএসের পরিবর্তে ১৯৯৮ সাল থেকে ৫৫-৬০ জন করে অফিসার নিয়োগ শুরু হয়। তখনও অধিকাংশ এ নিয়ে রাজ্য সে ভাবে আপত্তি করেনি। আমলাদের একাংশের দাবি, এর পিছনে মূল কারণ, নিজেদের রাজ্যের সিভিল সার্ভিস অফিসারদের বেশি করে দায়িত্ব দেওয়ার সুযোগ। বাসওয়ান কমিটির রিপোর্টও তা-ই বলে। কিন্তু এতে ঘাটতি বেড়েছে আরও।
১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এ রাজ্যেও আইএএস অফিসার নেওয়া হয়েছে বেশ কম। এই ২১ বছরে এক বারই সাত জন অফিসার পেয়েছিল রাজ্য। তিন বছর তা ছিল ছ’জন করে। ১৬ বছর ধরে এক-একটি ব্যাচে অফিসার ছিল ২-৫ এর মধ্যে। এক বছর সেই সংখ্যা ছিল ১! প্রশাসনিক মহলের অনেকে জানাচ্ছেন, কেন্দ্র কত জন অফিসার পাঠাবে, তা নির্ভর করে রাজ্যের চাহিদা, জেলার সংখ্যা ইত্যাদির উপরে। সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, তখন পশ্চিমবঙ্গে চাহিদা কম থাকার কারণ, বেশি করে নিজস্ব সিভিল সার্ভিস অফিসারদের ব্যবহারের প্রবণতা। বরং সেই তুলনায় ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এক-একটি ব্যাচে ১০ থেকে ১৬ জন করে অফিসার পেয়েছে এ রাজ্য। কারণ, জেলার সংখ্যা এবং রাজ্যের চাহিদা বৃদ্ধি। সারা দেশেও পদ, অফিসারদের অবসর এবং জেলার সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক বছর ধরে ১৭০-১৮০ জন করে আইএএস নিয়োগ করা হচ্ছে।
কিন্তু তাতেও ঘাটতি এখনও যথেষ্ট। বাসওয়ান কমিটিরও সুপারিশ, ‘ক্যাডার রিভিউ’ আরও দ্রুত (এখন সাধারণত পাঁচ বছর অন্তর হয়) করা প্রয়োজন। তাতে রাজ্যগুলিকেও বাস্তবসম্মত চাহিদা তুলে ধরতে হবে।
তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে আইএএস অফিসারের ঘাটতি ছিল ৮২ জন। ২০১৮ থেকে ২০২১-এর মধ্যে তা যথাক্রমে ৯৮, ৮১, ৭১ এবং ৮০ জন! তবে প্রবীণ আইএএস-দের
অনেকের পাল্টা দাবি, খাতায়কলমে ঘাটতি থাকলেও, তা সামলে দেওয়া গিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ব্যাখ্যা, কেন্দ্র-রাজ্যের সম্মতিক্রমে ২০১৭ সালে সর্বশেষ যে ‘ক্যাডার রিভিউ’ হয়েছিল, তাতে রাজ্যে মোট অফিসার-শক্তি হওয়ার কথা ৩৭৮। সরাসরি আইএএস ২৬৩ এবং ডাব্লিউবিসিএস থেকে আইএএস (প্রোমোটি) থাকার কথা ১১৫ জন। অথচ এখন
রাজ্যে সরাসরি এবং প্রোমোটি মিলিয়ে মোট অফিসার ২৮৫ (সারসরি ২০২)। এর মধ্যে সাত জন ডেপুটেশনে (আসলে থাকার কথা ৮২ জন)। অর্থাৎ, রাজ্যে কাজ করছেন ২৭৭ জন। সংখ্যায় এই ঘাটতি না থাকলে, ডেপুটেশন নিয়ে এমন কেন্দ্র-রাজ্য দড়ি টানাটানি আদৌ হত কি, এই প্রশ্ন আমলামহলের অন্দরেও।