সার্নের দুই বিজ্ঞানী, ক্রিস ফ্যাবিয়ার আর হান্স ট্যুরেগ, এসেছেন ফ্রন্ট অ্যাবজ়র্বার মেশিনিং দেখতে। হাওড়ার বাঁকড়ার বলরাম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসে। নতুন ভার্টিকাল লেদটা আদকবাবুরা পাশের নতুন ঘরেই বসিয়েছেন। ঘরটাতে ঢোকার মুখেই একটা কাঁচা নর্দমা। সেটা পেরিয়ে ঢোকার সময়ই হান্স তিন বার জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি ঠিক বলছ? এখানেই কাজটা হচ্ছে?” আমি শেষে একটু উঁচু গলায় বললাম, “প্রসেস ইনস্পেকশন রিপোর্ট নিয়মিত সার্নে পাঠানো হচ্ছে। ইনস্পেকশন করার পরে দেখা গেছে, এখনও পর্যন্ত একদম ঠিকঠাক।”
ক্রিস ফ্যাবিয়ার তখন এলিস প্রোজেক্টের মুখপাত্র, গম্ভীর স্বভাবের মানুষ। কথা খুব কম বলেন। হাতের ইশারা করে ভিতরে ঢুকতে বললেন।
ভিতরে ঢুকে আমারও চক্ষুস্থির। মেশিন ঠিকই চলছে। তবে চৈত্রের গরমে লুঙ্গিতে মালকোঁচা দিয়ে, বিড়িতে সুখটান দিচ্ছেন অপারেটর বিফলদা। আমার তখন মনে হচ্ছে, ‘ধরণী দ্বিধা হও!’
সাহেবদের বিশ্বাস রাখতে ওই বিশাল বিশাল ফ্রাস্টামগুলোও কম্পিউটার সংযুক্ত কোঅর্ডিনেট মেজ়ারিং মেশিনে মেপে দেখানো হয়েছিল। সব থেকে মজার ব্যপার, সার্নের মাটির নীচে ৫৭৪ ফুট গভীরে লাগানোর সময় দেখা গেল যে, দৈত্যাকার যন্ত্রাংশগুলিতে এক
অন্য অনেক দেশের পাঠানো অংশের কাটাছেঁড়া করতে হয়েছে। ইউরোপের একটি দেশের এক বড় ল্যাবরেটরিতে তৈরি অংশেরও কয়েক কেজি কেটে বাদ দিতে হয়েছিল, কিন্তু হাওড়ার ওই খালি গায়ে কাজ করা মিস্ত্রির মাপ ছিল ১০০ ভাগ নিখুঁত।
তার কয়েক বছর পরে বিশ্বের সংবাদমাধ্যম তোলপাড় হয়েছিল ‘ঈশ্বর কণা’ হিগ্স-বোসনের আবিষ্কারে। জেনেভার সার্নের সেই আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত আর এক গবেষণায় যে হাওড়ার বিশ্বকর্মাদের নাম জুড়ে আছে, তা অনেকেই জানেন না। গত কয়েক দিন আগে কর্কট রোগ কেড়ে নিল এই বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের অন্যতম কর্ণধার অধ্যাপক প্রতাপ ভট্টাচার্যকে। ওই বিশ্বকর্মাদের মধ্যেও এক জন আমাদের মধ্যে আর নেই। বাবান ঘোষকে সপ্তাহে দু’দিন ডায়ালিসিস নিতে হয়। কালীপদ পরামাণিক ৭১ বছরে আর মেশিনে ওঠেন না। একটা বড় দুর্ঘটনাও হয়েছে এই কুশলী হেডমিস্ত্রির। তাই আজ যখন আত্মনির্ভর ভারতের কথা উঠছে, তখন এই সব বিশ্বকর্মার কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। সেই সঙ্গে ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’-এর মতো গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা এই তথাকথিত নিরক্ষর বিশ্বকর্মাদের সহযোগিতা পেলে ভারত কী অসাধ্য সাধন করতে পারে, সে কথা বলতেই এই লেখা।
শুরুটা ২০০২ সাল। আমার বিয়ের বছর। বিয়ের আগের দিন থেকেই ছুটি নিয়েছিলাম। সে দিন সকাল ১১টা নাগাদ ফোন। ডিরেক্টর সাহেব ডাকছেন। আমার বাড়ি বারুইপুরে, তখন যেতে ঘণ্টা দুয়েক লাগত। বললাম যাচ্ছি, তবে এতটা সময় তো লাগবেই। পাঁচ মিনিট পরে অধ্যাপক প্রশান্ত সেন ফোন করলেন, “বিকেল তিনটের সময় এসো।”
অধ্যাপক বিকাশ সিংহের তিনটে মানে দুটো ৫৯ মিনিট। মিনিট দশেক আগেই পৌঁছে গেলাম। ডিরেক্টরের ঘরে ঢুকে দেখি তাবড় বিজ্ঞানীরা বসে আছেন। অধ্যাপক বিকাশ সিংহ, প্রশান্ত সেন, প্রতাপ ভট্টাচার্য আর সুকল্যাণ চট্টোপাধ্যায়। মিটিং শুরুর আগে ডিরেক্টর অফিসের সেক্রেটারি সীমা ভট্টাচার্য কথায় চিমটি কেটে গেলেন, “স্যর! পাত্রকে বিয়ের পিঁড়ি থেকে তুলে নিয়ে এসেছেন?”
বিকাশ সিংহ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসিকতায় বললেন, “সে কী মশাই! লগ্ন ক’টায়?”
আমি সলজ্জ ভাবে বললাম, “আজ নয় স্যর, কাল বিয়ে।”
“কাল বিয়ে? তা হলে আজকে ছুটি স্যাংশন করল কে?” বলেই হাসতে লাগলেন।
কফিতে লম্বা চুমুক দিয়ে কথা শুরু করলেন প্রশান্ত সেন। অধ্যাপক সেন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ অনেকটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেনানায়কের ভঙ্গিতে দিতেন, “জিষ্ণু, একটা কমিটমেন্ট করেছেন আমাদের ডিরেক্টর। এটা ইন্টারন্যাশনাল কোলাবোরেশনে আমাদের দেশের মর্যাদার প্রশ্ন। এটা করতেই হবে।”
কী করতে হবে? বুঝতে বুঝতেই ছ’টা বেজে গেল। ইউরোপের সবচেয়ে বড় পরমাণু গবেষণাকেন্দ্র হল সার্ন (সিইআরএন)। এই ফরাসি নামের ইংরেজি তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ’। সেখানে মাটির নিচে ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছে। সেই বৃত্তাকার সুড়ঙ্গপথ সুইৎজ়ারল্যান্ড, ফ্রান্স আর জার্মানি ছুঁয়ে গেছে। মহাবিশ্বের সৃষ্টি-রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য হবে দু’দিক থেকে ধেয়ে আসা অতি উচ্চ শক্তিসম্পন্ন কণার সংঘর্ষ বা কলিশন। পরীক্ষা অনেকগুলো, সেই সব ক’টি নিয়ে ওই সুড়ঙ্গকেন্দ্রিক পরীক্ষার নাম দেওয়া হয়েছে, ‘লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার এক্সপেরিমেন্ট’।
তার আটটি ডিটেক্টর এক্সপেরিমেন্টের একটি হল, ‘আ লার্জ আয়ন কোলাইডার এক্সপেরিমেন্ট’ (এলিস, এএলআইসিই)। এটির এক অংশগ্রহণকারী সংস্থা কলকাতার ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্স’। এই পরীক্ষাগারে বসানো হবে মিউয়ন ডিটেক্টর। বিগ ব্যাং মানে সৃষ্টির সময়কালের মতো শক্তিসম্পন্ন বিস্ফোরণ হলে অতি শক্তিধর অব-পারমাণবিক কণা মিউয়নের নির্গমন হবে। কিন্তু পৃথিবীতে, ভূগর্ভে বা অতি শক্তিধর মহাজাগতিক মিউয়ন, যারা প্রতিনিয়ত পৃথিবীকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে যাচ্ছে, তাদের আগমনে পরীক্ষার ব্যাঘাত যাতে না ঘটে, তাই ডিটেক্টরের আগে লাগানো হবে এক বড়সড় অ্যাবজ়র্বার, যা মূলত পার্থিব মিউয়নকে আটকে দেবে। এই বিপুল ধারকটি বহু ধাতু ও অধাতুর পরতে মোড়া এক জটিল যন্ত্রাংশ। তামা আর গ্রাফাইটের কম্পোজ়িট অংশটি দেবে বলে কথা দিয়েছিল রাশিয়া। কিন্তু সাবেক সোভিয়েট রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পরে সেই দায়িত্ব তারা নিতে অক্ষম বলে জানিয়েছে। দেশের প্রযুক্তির উপর বিশ্বাসী অধ্যাপক বিকাশ সিংহ সেই দায়িত্ব নিয়েছেন। ওই কম্পোজ়িট কাঠামো তৈরি করতে ছ’টন তামা আর দু’টন গ্রাফাইট লাগবে।
সে দিন বাড়ি ফেরার পরে সব ভোলার চেষ্টা করে বিয়েতে মন দিলাম। কিন্তু পরের দিন আমার জেঠশ্বশুরমশাই যখন কন্যা সম্প্রদান করছেন, তখন তাঁর হাতে তামার কোশাকুশি দেখে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, ছ’টন তামা!
কিন্তু কাজ শুরু হতেই দেখা গেল, তামা দিয়ে এ কাজ হবে না। সেই সময় সার্নের এলিস গ্রুপের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন দিয়েগো পেরিনি। অসাধারণ পণ্ডিত মানুষ। একটা সহজ সহযোগিতার মানসিকতা, বোঝানোর ধৈর্য আর শিক্ষকসুলভ উদারতা ছিল দিয়েগোর। সব কিছুতে ছিল অকৃত্রিম আত্মীয়তা। ওঁর সঙ্গে কাজ করার সময় মনে হত, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কোনও প্রিয় অধ্যাপকের সঙ্গে রয়েছি। আমাদের থেকে সার্নের সময় প্রায় চার ঘণ্টা পিছিয়ে। প্রায় বললাম এই জন্য যে, ওখানে দিনের আলোর ব্যবহার বাড়াতে শীতে আর গ্রীষ্মে গ্রিনউইচ মিন টাইমের সঙ্গে সময় আগে-পিছে করা হয়। যাই হোক, আমরা সন্ধে সাতটায় কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউটে কাজ শেষ করার পরেও দিয়েগো আরও ঘণ্টা চার-পাঁচেক কাজ করতেন। কোনও দিন এমন হয়নি যে, সন্ধেয় কোনও সমস্যা ইমেল করেছি, কিন্তু পরের দিন সকালে উত্তর পাইনি। সে যত জটিল কারিগরি সমস্যাই হোক না কেন। আর উত্তরের সঙ্গে এক পাতা ব্যাখ্যা।
প্রতাপ ভট্টাচার্য তখন প্রোজেক্ট লিডার। আমাদের দলের সবচেয়ে কমবয়সি সদস্য ছিল আমার সহকর্মী দীপঙ্কর দাস। আমরা বেশ কিছু দিনের লড়াইয়ের পরে সমাধানসূত্র বার করে ফেললাম। প্রথম দিকে বড় বাধা ছিল রাশিয়ান ড্রয়িং। সে ড্রয়িংয়ের রীতি ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড-এর থেকে অনেকটা আলাদা। তার উপর ওই নকশা তৈরি হয়েছিল সোভিয়েট রাশিয়ার সারোভ-এর পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে। সাবেক সোভিয়েট ভেঙে যাওয়ার পরেও সারোভ নিয়ে একটু ঢাকঢাক গুড়গুড় ছিলই। কলকাতায় রাশিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং-এর খুব স্পষ্ট ধারণা ছিল নিউ অ্যালেনবেরি ওয়ার্কস-এর ডিজ়াইন সেকশনের প্রধান রায়চৌধুরী সাহেবের। কারণ ওই গিয়ারবক্স তৈরির কারখানার সঙ্গে রাশিয়ান কোম্পানির প্রযুক্তিগত চুক্তি ছিল। প্রথম দিকে রায়চৌধুরীদার সহযোগিতা খুব কাজে লেগেছিল।
তামা-কে পছন্দ করার মূল কারণ ছিল তার চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে নিরাসক্তি, মানে কম ম্যাগনেটিক পার্মিয়াবিলিটি। তাই বিকল্প হতে পারে ইস্পাত। অস্টেনাইটিক স্টেনলেস স্টিলের পার্মিয়াবিলিটি এক-এর মধ্যে বেঁধে রাখা যায়। ব্যস, শুরু হল ডিজ়াইন। ১০টি তামার প্লেটের বদলে থাকবে মাত্র একটি স্টিলের বিশাল মাথাকাটা শঙ্কু। মাঝে একটা গর্ত। ছ’ফুট ব্যাসেরও বেশি ব্যাস আর প্রায় দু’ফুট চওড়া এআইএসআই ৩০৪ এল এন গ্রেডের অস্টেনাইটিক নন-ম্যাগনেটিক স্টেনলেস স্টিল। ওজনে বেড়ে হল প্রায় সাড়ে নয় টন।
ভারতের একটি মাত্র কোম্পানি তৈরি করতে পারে এই বিশাল মাপের ইস্পাত। সেটি হল দুর্গাপুরের অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট (এএসপি)। সেই সময় এএসপি সংস্থায় ছিলেন এক ঝাঁক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। এঁরা দেশের সম্মানরক্ষার জন্য রাজি হয়েছিলেন এই চ্যালেঞ্জ নিতে। এমনিতে ওই বিশেষ গ্রেডের ইস্পাত এএসপি তৈরি করত না। ঠিক হল এই কাজ করার জন্যই শুধু এএসপি একটি ৬০ টনের হিট (এক বার ঢালাইয়ে যত ওজনের ইস্পাত তৈরি হয়) নেবে।
একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ঠিক সময়ে নিপুণ ভাবে এই ইস্পাত তৈরি করেছিল। সম্ভবত ওটাই ভারতে তৈরি বৃহত্তম অস্টেনাইটিক স্টেনলেস স্টিল বিলেট। ঢালাইয়ের পরে ওই লোহা রোলিং করার জন্য রৌরকেলা স্টিল প্ল্যান্টে পাঠাতে হয়েছিল। কারণ এত বড় রোলিং মিল দুর্গাপুরের এ এস পি বা ডি এস পি-তে ছিল না।
ওই ইস্পাত ‘এজ কাস্ট’ অবস্থায় এবং ‘রোলড’ অবস্থায় তার চুম্বক আসক্তি মাপা হত। সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্সের এনএমআর গবেষণাগারের বিজ্ঞানী বিল্বদল বন্দ্যোপাধ্যায় এ বিষয়ে দীর্ঘ দিন সহযোগিতা করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। প্রথমে এএসপি থেকে পাঠানো কাস্টিং করা স্যাম্পেলে পার্মিয়াবিলিটি এক-এর বেশি আসছিল। একটু জোরালো স্থির চুম্বক দিয়ে অনুভব করাও যাচ্ছিল। ইন্ডাস্ট্রিতে স্টিলের অন্য মেকানিক্যাল গুণাগুণ নিয়ে ইঞ্জিনিয়াররা মাথা ঘামান। এই প্রথম এএসপি-র ইঞ্জিনিয়াররা চৌম্বকীয় গুণ নিয়ে ভাবলেন। এমনই এক দিন হাওড়ায় একটি কাস্টিং করা নমুনা থেকে ড্রিল করে বাবড়ি নেওয়া হচ্ছিল। সকলে চুম্বকত্ব নিয়ে আলোচনা করছে। স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়ার ইঞ্জিনিয়াররাও আছেন। বছর পনেরোর একটি ছেলে কাছেই পুড়ে যাওয়া কালো বাবড়িতে চুম্বক ঠেকিয়ে খেলছিল। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “ধরছে না!” সকলে চিৎকারে চমকে ওঠে। বোঝা গেল ড্রিলিং করে পুড়ে যাওয়া স্টিল চৌম্বকীয় ধর্ম হারিয়েছে। যা চাওয়া হচ্ছে ঠিক তা-ই। খবর পৌঁছে গেল দুর্গাপুরের এএসপি-র গবেষণাগারেও। পরের দিনেই উত্তর এল, সমাধান হয়ে গেছে। কাস্টিং করা স্টিল হট রোলিং করলেই রিক্রিস্টালাইজ়েশন হবে, আর কেলাসের গঠনের পরিবর্তন হলেই তার পার্মিয়াবিলিটি এক-এর নীচে নেমে আসবে। সঙ্গে সঙ্গে হাওড়াতেই রোলিং করা হল, নমুনা পাঠানো হল সাহা ইনস্টিটিউটে। এক্কেবারে ঠিক, ধাতু তার চৌম্বকধর্ম হারিয়েছে।
এই কাজেই গ্রাফাইটের যন্ত্রাংশটি তৈরি করেছিল গ্রাফাইট ইন্ডিয়া। সেটিও ভারতে নির্মিত বৃহত্তম গ্রাফাইট খণ্ড। কিন্তু আজকের লেখা অন্য নায়কের উপাখ্যান। রক্তমাংসের বিশ্বকর্মাদের নিয়েই এই লেখা।
অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট কাজটা যখন হাতে নিয়েছিল, তখন ছ’ফুট ব্যাসের দু’ফুটের মতো চওড়া একটি মাত্র বিশাল ট্রাঙ্কেটেড হলো ফ্রাস্টাম করার কথা ছিল। স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের ম্যানেজার ভি কে চোপড়া এই কাজটির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি আমাদের পরিচয় করালেন রজনী মুখোপাধ্যায় নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। তাঁর কারখানা ছিল হাওড়ার ধুলাগড়ে। রজনী মুখোপাধ্যায় এক অদ্ভুত মানুষ। যে কোনও লোককে মোহিত করার মতো দারুণ ব্যক্তিত্ব। রজনীবাবুর ঠাকুরদাদা ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়েছিলেন। সেখানে বিয়ে করেছিলেন এক আইরিশ মহিলাকে। ঠাকুরদাদা খুব কম বয়সে মারা যান। অদ্ভুত ভাবে ঠাকুমা আর তাঁর শিশুপুত্র দু’জনেই ব্রিটিশ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও কলকাতায় শ্বশুরবাড়ি চলে আসেন। রজনীবাবুর সঙ্গে কাজের ফাঁকে অনেক গল্প হত। অনেক বিষয়ে অগাধ জ্ঞান ছিল ভদ্রলোকের। উনি মেডিটেশনের সহজ অথচ কার্যকর পদ্ধতি শেখাতেন। রজনীবাবুই এক নতুন ভাবনা দিলেন। ওই দু’ফুট মোটা পাত রোলিং করে মেশিনিং করা সম্ভব হত না। তাই তাঁর প্রস্তাব ছিল, ওই স্টিলের অংশটাকে চার টুকরো করা। পরে অবশ্য কাস্টিং না করে রোলিং করার জন্য চারটির পরিবর্তে আটটি চাকতি করা হয়েছিল। আটটি প্লেট পর পর সাজিয়ে বোল্ট করা হবে। আর প্রতিটি প্লেটের উভয় তল হবে একদম সমান্তরাল, যাতে জোড়ার পরে কোনও ফাঁক না থাকে। আলো দেখা যাবে না তার মধ্য দিয়ে। এই হাই প্রিসিশন প্যারালালিটি আর মিরার সারফেস ফিনিশ ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রজনীবাবুর ছেলে অর্জুন তখন শিবপুর বি ই কলেজের আর্কিটেকচারের ছাত্র। অর্জুন মুখোপাধ্যায় আজ খড়্গপুর আইআইটি-র অধ্যাপক। যাই হোক, সে দিন অর্জুন আর তাঁর বাবা সেই আটটি প্লেটের ডিজ়াইন আর অটোক্যাড ড্রয়িং তৈরি করলেন। সেই নতুন নকশা দিয়েগো পেরিনি আর সার্নের বিজ্ঞানীরা গ্রহণ করলেন এবং কাজ শুরু হল জোর কদমে।
সেই সময় বড় কোম্পানির সিএনসি বা ‘কম্পিউটার এডেড নিউমেরিক্যাল কন্ট্রোলড মেশিন’ না নিয়ে হাওড়ার বাংলাবাড়িতে কাজটা করার দু’টি কারণ ছিল। প্রথমত দু’মিটার মানে ছ’ফুটেরও বড় ব্যাসের সিএনসি মেশিন পাওয়া। অবশ্য বড় সিএনসি ভার্টিকাল মেশিনিং সেন্টার ছিল রাঁচির এইচইসি-র মতো কয়েকটি সংস্থায়। কিন্তু কাজটার জন্য আসলে হাতের নৈপুণ্যের প্রয়োজন ছিল। দক্ষ হাতের ল্যাপিং না হলে ওই মিরর ফিনিশ আসত না।
সেই কাজ দেখতে এলেন ক্রিস ফ্যাবিয়ার আর হান্স ট্যুরেগ। ক্রিস অস্ট্রিয়ান আর হান্স জার্মান। হাওড়ার বিশ্বকর্মার মন্দির আর দেবতাদের চেহারা দেখে দু’জনেই বেজায় ক্ষুব্ধ। তত ক্ষণে জেনেভা জেনে গেছে, কলকাতা এই কাজ করতে পারবে না।
সন্ধ্যায় ক্যালকাটা ক্লাবে নিয়ে গেলেন রজনীবাবু। ক্রিস তো কিছুতেই যাবেন না। গজগজ করছেন, “হান্স, তুমি যাবে তো যাও, আমি হোটেলে চললাম।”
হান্স ওর হাত ধরে বললেন, “চলো, শেষ বারের মতো একটু ইন্ডিয়ান বিয়ার খাওয়াই যাক।”
সে দিন সন্ধেয় রজনীবাবু অসাধ্য সাধন করেছিলেন। রজনী মুখোপাধ্যায় সার্নের বিজ্ঞানীদের বললেন, “আপনারা যে গবেষণা করছেন, তা যদি ব্যর্থও হয় তবে আপনাদের জীবন পুরোপুরি বরবাদ হয়ে যাবে না। আপনাদের জীবনের এই সময়টুকু কেবল নষ্ট হবে। কিন্তু আমার কাজ যদি আপনাদের প্রয়োজনে না লাগে, যদি ফাইনাল ইনস্পেকশনে পাশ না করে, তবে স্বাভাবিক ভাবেই আমি টাকা পাব না। আমি সারা জীবনের পুঁজি, ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি সব এত বড় কাজেই লাগিয়েছি। যে ক্ষেত্রে আমার মতো ছোট কোম্পানি উঠেই যাবে। আমার ১০০ শতাংশ বিশ্বাস আছে এই দক্ষ শ্রমিকদের কুশলতার উপর। তাই আমি এত বড় ঝুঁকি নিয়েছি। আমি জানি এঁরা ব্যর্থ হলে আমার কোম্পানি আমার পরিবার সব শেষ হয়ে যাবে।”
কাজ হল। কলকাতায় রাত তখন সাড়ে আটটা। ফোন গেল সুইৎজ়ারল্যান্ডের সার্নের অফিসে, “তিন মাস সময় দিলাম।”
তার পরের ইতিহাস ওই খালি গায়ে তেলচিটে লুঙ্গি পরা বিফল রায়ের আশ্চর্য সাফল্যের উপাখ্যান।
জিষ্ণু বসু