প্রায় তিন দশক আগের কথা। মাইক গ্যাটিং অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান। ইংল্যান্ড মোটামুটি শক্ত পোক্ত টিম তখন। লেগ স্টাম্পের বাইরে পড়া বল দেখে ছেড়ে দিলেন। বলটা এদিক ওদিক না তাকিয়ে স্রেফ নিজের খেয়ালে অফ স্টাম্পে এসে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। শেন ওয়ার্ন মধ্য পিচ থেকে সোনালী চুলের বাহার নিয়ে উইকেটকিপার ইয়ান হিলির দিকে দৌড়তে শুরু করলেন। ক্রিকেট পেয়ে গেল তার সবচেয়ে বড় স্টারকে। নিঃসন্দেহে শতাব্দীর সেরা বল!ট্রেন্ডিং স্টোরিজ
সাল ২০২২, ৪ মার্চ
থাইল্যান্ডের একটি চেনা হোটেল। ৫২ বছরের ওয়ার্নের খুব মন খারাপ। সকালেই চলে গিয়েছেন আর এক যুগের অস্ট্রেলিয় তারকা উইকেটকিপার রডনি মার্শ। এদিকে ওজন কমানোর লড়াই চলছেই। এই সময়ে একটা অপরিচিত গুগলি, হার্ট অ্যাটাক, শেন পা সরাতে পারলেন না। পরিষ্কার এলবিডব্লিউ! যবনিকা পড়ে গেল একটা ইতিহাসের।
খবরের দুনিয়ায় অসুস্থ মানুষদের নিয়ে শোকগাথা আগের থেকেই তৈরি থাকে। শুধু স্থান, কাল বসিয়ে নিলেই চলে, আর পাঠক গোগ্রাসে তাই গেলে। চিরকালের সেরার সেরা লেগস্পিনার কিন্তু এখানেও এমন ফ্লাইট দিয়ে গেলেন, যে কেউ ধরতে পারল না। কারও কোনও লেখা তৈরি নেই, পরিসংখ্যানের লিস্ট নেই, শুধু রয়েছে আকস্মিকতা আর মন খারাপ।
৯০-এর দশকের অস্ট্রেলিয়া কিন্তু সেরার সেরা ছিল না, বরং বর্ডারের হাত ধরে টিম তৈরি হচ্ছিল। একে একে মার্ক টেলর, ইয়ান হিলি, গ্লেন ম্যাকগ্রা… দমকা হাওয়ার মতো এসেছিলেন শেন ওয়ার্ন। স্টিভ ওয়া ছিলেন তার অনেক আগের থেকেই এবং চিনেছিলেন যে এই লেগ স্পিন কিন্তু ঘুরবেই। সঙ্গে গুগলি থাকবে, ফ্লিপার আর লেগ স্টাম্প থেকে চরকি পাকের মতো ঘোরা। পরিসংখ্যানে শেন ওয়ার্ন স্রেফ মুরলিধরনের পিছনে। ওয়ান ডে তে ২৯৩ উইকেট আর টেস্ট ম্যাচে ৭০৮— একার হাতে যে কত ম্যাচ জিতিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।
বর্ণময় চরিত্র বলতে যা বোঝায়, সব কিছুই ছিল ওয়ার্নের— টাকার বিনিময়ে পিচ নিয়ে খবর দেওয়া জুয়াড়িকে, বিবাহ বহির্ভূত অবাধ যৌনতা এবং যৌন কেলেঙ্কারি, ডোপিং এবং সাময়িক নির্বাসন। তবে এগুলো নেতিবাচক দিক। ক্রিকেটকে শেন ওয়ার্ন উজাড় করে দিয়েছেন। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তাঁকে অধিনায়কত্ব দেয়নি বটে তবে আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালসের নীল জার্সিতে নিজের ক্ষুরধার মস্তিষ্কের পরিচয় দিয়েছেন। প্রমাণ করেছেন যে অস্ট্রেলিয়া হয়তো তাদের সেরা একজন অধিনায়কের থেকে বঞ্চিত থেকেছে।
কমেন্ট্রি বক্সে ওয়ার্ন প্রমাণ করে দিয়েছেন যে তিনিই রিচি বেনো, বিল লরির যোগ্য উত্তরসূরী। গলফের পিচেও নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছেন আর কোচ হিসেবেও জাত চিনিয়েছেন। আর সেরা শিক্ষকের মত নতুন সব স্পিনারকে হাতে ধরে বলের গ্রিপ চিনিয়েছেন। তাই ভারতের অশ্বিন থেকে আফগানিস্তানের রশিদ খান, সবাই কৃতজ্ঞ শেন ওয়ার্নের কাছে। অ্যাশেজ সিরিজ নিজের জ্যোতি হারিয়েছিল ওয়ার্নের কাছে, দোসর ছিলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা। আর স্লিপ ফিল্ডিং! মার্ক ওয়, মার্ক টেলরকে নিয়ে শেন ওয়ার্ন বানিয়েছিলেন একটি নিশ্চিন্ত স্লিপ কর্ডন, ওভারের পর ওভার খেলা চলত, কিন্তু বল গলে যেত না!
১০০ বছর পরেও ক্রিকেট তথা আপামর ক্রিকেট ফ্যানেরা সচিন তেন্ডুলকর আর শেন ওয়ার্নের দ্বৈরথ মনে রাখবে। এই একটা লড়াই শেন ওয়ার্ন হয়তো জেতেননি, কিন্তু প্রমাণ করে দিয়েছেন যে অনেক হার সম্মানেরও হয়।
বছর শেষে ক্রিসমাসের পরের দিন আবারও একটি বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচ হবে। নবীন আগ্রাসী অস্ট্রেলিয়া মাঠে নামবে আর একটি ব্যাগি গ্রিন টুপি বরাদ্দ থাকবে ওয়ার্নের জন্য, চিরকালের জন্য…