আধুনিক মানুষের সর্বাপেক্ষা মৌলিক প্রশ্ন মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কি তা জানা। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর জীবনলব্ধ উপাসনার মধ্য দিয়ে সেই মূলগত জিজ্ঞাসার স্পষ্টতর উত্তর নির্দেশ করেছিলেন । মানব জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ আর তারই উপায় সহজ কথায় তুলে ধরেছিলেন ” যত মত তত পথ” এই মতবাদের প্রভাবে ।
বিভিন্ন পথ দিয়েই পৌঁছানো যায় ঈশ্বরের কাছে। ভক্তি, ব্যাকুলতা, ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসাই আসল।মাতৃপূজারী শ্রীরামকৃষ্ণ ভবতারিণীর পায়ে নিবেদন করেছিলেন জ্ঞান-অজ্ঞান, ভক্তি–অভক্তি, বৈরাগ্য–অবৈরাগ্য, শরীর-মন সর্বস্ব, কিন্তু সত্যকে দিতে পারেননি। অকুণ্ঠ সত্য নিষ্ঠার এই বীজ গদাধরের মধ্যে প্রোথিত হয়েছিল বংশ পরম্পরায়।
হুগলীর ক্ষুদিরাম ও চন্দ্রমণি, উভয়েরই বিশ্বাস হয়েছিল ভগবান পুত্র রূপে তাঁদের কাছে আসছেন। ১৮৩৬ –এর ১৮ই ফেব্রুয়ারী (৬ই ফাল্গুন, শুক্লা দ্বিতীয়া) কামারপুকুরে ক্ষুদিরামের বাড়ীর ঢেঁকিশালে তাঁর তৃতীয় পুত্র গদাধরের জন্ম হয়েছিল।
নয়বছর বয়সে উপনয়নের সময় গদাই জেদ ধরেছিল তার দাইমা ধনী কামারনীকে ভিক্ষে মা করতে হবে, কারণ সে আগেই কথা দিয়ে রেখেছে। প্রচলিত লোকাচারের বিরুদ্ধে গিয়ে সত্যরক্ষায় দৃঢ়মনস্থ বালকের সামনে কারোর কোনো আপত্তি টিকলো না। অন্ত্যজ বর্ণের মানুষের প্রতি ভালোবাসার উৎস্রোতে কখনোই বাধা হতে পারে নি প্রচলিত জাতিভেদ বা লোকাচার।গদাধরের বয়স যখন সতের বছর, অগ্রজ রামকুমার তাকে কোলকাতায় (সম্ভবত প্রথমে ঝামাপুকুরে) নিজের টোলে নিয়ে এসেছিলেন।
১৮৫৫ র ৩১শে মে স্নানযাত্রার দিন রাণী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে (Dakshineswar) ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। কিছুদিন পরে মা কালীকে সাজাবার কাজ শ্রীরামকৃষ্ণের উপর ন্যস্ত হল।মায়ের পুজোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দর্শন লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকতে শুরু করলেন। পুজোর সময় ছাড়াও অন্য সময় সর্বদা।ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যখন যেভাবে সাধনা করে সিদ্ধ হয়েছিলেন, তখন সেই ভাবের সাধককূল তাঁর কাছে যেন স্বতঃপ্রেরিত হয়ে এসেছিলেন। সেই ভাবের পূর্ণ আদর্শ ঠাকুরের মধ্যে অবলোকন করে, তাঁর সহায়তা লাভে ধন্য হয়েছিলেন। ঈশ্বরের অবতার রূপে চিনে তাঁর পাদপদ্মে সমর্পণ করেছিলেন হৃদয়ের ভক্তি ও প্রীতি।তীব্র পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, ধীশক্তি ও সাধনালব্ধ দিব্য ভাবভূমির আঙ্গিকে তীর্থদর্শনের অভিজ্ঞতা শ্রীরামকৃষ্ণের সামনে তুলে ধরেছিল তৎকালীন সমাজের প্রকৃত পটভূমি। ধর্মহীনতা, প্রচলিত ধর্মমতগুলির একদেশিতা, বিভিন্ন ধর্মীয় মতের একই চরমলক্ষ্য সম্পর্কে আচার্যদের অনভিজ্ঞতা, দেশ-কাল-পাত্র বিবেচনা অনুসারে ধর্ম পথ প্রদর্শনের অভাব তিনি বিশেষভাবে অনুভব করেছিলেন। সব ধর্মই সত্য- “যত মত তত পথ –” একদেশিত্বহীন বিদ্বেষশূন্য তাঁর এই ভাব যে এক অদৃষ্টপূর্ব আদর্শ তা তিনি অনুভব করেছিলেন। ভক্তবৎসল ঠাকুর অপার করুণায় মানুষের মুক্তির পথ প্রদর্শন করেছিলেন। যে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, সে অবস্থা থেকে ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা ও অনুরাগ বৃদ্ধির পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। সহজ সরল কথায়, উপমার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন জটিল তত্ত্বকে। আবার সাধারণ মানুষ নিত্যদিনের জাগতিক ব্যস্ততার মধ্যে কি ভাবে তাঁর নামস্মরণ করবে তার উপায় ও বের করেন।গলায় রোগ হওয়ায় ও রোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৮৮৫-র ২৬শে সেপ্টেম্বর দক্ষিণেশ্বর থেকে তাঁকে কোলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়েছিল চিকিৎসার সুবিধার্থে। বাগবাজারে দুর্গাচরণ মুখর্জী ষ্ট্রীটের বাসাটি পছন্দ না হওয়ায় বলরাম বসুর গৃহে চলে এসেছিলেন।
বুড়ো গোপালের (স্বামী অদ্বৈতানন্দ) আনা গেরুয়া ও রুদ্রাক্ষের মালা এগার জন ত্যাগী শিষ্যকে তুলে দিয়ে তাঁদের চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন সন্ন্যাসী সন্তানরূপে। মহাসমাধির পূর্বলগ্নে ভাবী কর্মযজ্ঞের দায়িত্বভার ন্যস্ত করেছিলেন সুনিপুণ দক্ষতায় নরেন্দ্রনাথকে। লোকশিক্ষাদানের চাপরাস লিখে দিয়েছিলেন।
১৮৮৬-র ১৬ই আগষ্ট (৩১শে শ্রাবণ, ১২৯৩) রাত্রি ১টা ২ মিনিটে শ্রীরামকৃষ্ণ মহাসমাধির মধ্য দিয়ে মর্ত্যলীলা সংবরণ করেছিলেন। নিজেই তিনি বলেছিলেন, একদিন তাঁর ছবি ঘরে ঘরে পুজো করা হবে। আজ সত্যিই সারা পৃথিবীর বহু মানুষ শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশকে সামনে রেখে খুঁজে পাচ্ছে পরম আশ্রয়স্থল, শান্তির ঠিকানা।
” সব মতকে নমস্কার করবে, তবে একটি আছে নিষ্ঠাভক্তি। সবাইকে প্রণাম করবে বটে, কিন্তু একটির উপরে প্রাণ-ঢালা ভালবাসার নাম নিষ্ঠা।”
– শ্রীরামকৃষ্ণ
ইন্দ্রাণী সান্যাল ভট্টাচার্য্য।।