কলকাতা বইমেলাতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্টলে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী তথা জাতীয়তাবাদী নেতাদের পাশে নেতাজী – বিতর্কের মাঝে সত্য কেন সমাধিস্থ হবে?

কলকাতা বইমেলাতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্টলে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী তথা জাতীয়তাবাদী নেতাদের পাশে নেতাজীকে দেখে বিভিন্ন স্বঘোষিত নেতাজী প্রেমিক এবং ইতিহাসবিদ এর বিরোধিতায় নেমেছে। তাদের দাবি অদ্ভুত! নেতাজীর ছবি নাকি এই স্তরে রাখা যাবে না‚ কারণ নেতাজী নাকি শ্যামাপ্রসাদ‚ সাভারকার বা ডাক্তারজী বা গুরুজীর মতন সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। এদের এই ঐতিহাসিক চরিত্রকে হাইজ্যাক করে নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা কাজে লাগানোর ইতিহাস বহু পুরনো। এক সময় যে নেতাজীকে এরা #তোজর_কুকুর বলে অপমান করেছিল‚ সেই নেতাজিকে তারা আজ ব্যবহার করছে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে! হিন্দুত্ববাদীদের বিরোধিতা করতে গিয়ে তারানেতাজিকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে ফেলছে।

ইতিহাস কিন্তু বলছে অন্য কথা। নেতাজী ছিলেন বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর একনিষ্ঠ ভক্ত। যে বিবেকানন্দকে এখনো পর্যন্ত বহু কমিউনিস্ট এবং ইসলামিস্ট আক্ষরিক অর্থেই ভারতবর্ষে হিন্দু রেজিমেন্টেশন এর অন্যতম পথপ্রদর্শক বলে দাবি করে। নেতাজী ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ হিন্দু। তিনি প্রত্যহ পূজা-উপাসনা করতেন। তার সঙ্গে সবসময় গীতা থাকতো। এমনকি, তিনি ভারতের বাইরে বিশেষত আফ্রিকা মহাদেশে হিন্দু ধর্ম প্রচারের কথা ভাবতেন।

মান্দালয় জেলের ডায়েরীতে সুভাষ লেখেন‚

“আফ্রিকা মহাদেশে এখন মাত্র দুইটি ধর্ম প্রচারিত হইতেছে— খ্রীস্টীয় ও ইসলাম। সেখানে হিন্দুধর্ম প্রচারিত হইবে না কেন ? ভগিনী নিবেদিতা বলিতেন যে হিন্দুধর্মকে aggressive হইতে হইবে। স্বামী বিবেকানন্দও এই ভাব প্রচার করিতেন এবং এই উদ্দেশ্যে তিনি আমেরিকা ও ইউরোপে গিয়া ধর্ম প্রচার করিয়াছিলেন। … আফ্রিকাবাসীদের মধ্যে ধর্ম প্রচার করিলে তাহারা হিন্দুধর্ম গ্রহণ করিতে পারে। …

যদি আফ্রিকাবাসীদের মধ্যে ২০০ লক্ষ হিন্দু হয় তবে নিশ্চয়ই হিন্দুজাতির এবং ভারতের প্রভাব আফ্রিকায় খুব বেশি হইবে । ভারতবর্ষকে World-Power হইতে হইলে হিন্দুধর্ম প্রচারের ফলে অনেক সুবিধা হইবে। … হিন্দুধর্ম গ্রহণের ফলে অন্য জাতির কতদূর বা কিরূপ উন্নতি হইতে পারে—ইহা কি experiment করিবার সুন্দর বিষয় নহে ?”

(৫/৫/১৯২৬, সুভাষচন্দ্র বসু সমগ্র রচনাবলী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৪-১৫ ,আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৫ )

আর এই নেতাজীকেই মিথ্যে প্রপাগান্ডার জোরে প্রায় কমিউনিস্ট বানিয়ে দিয়েছে এরা।

নেতাজীকে হিন্দুত্ববাদ বিরোধী প্রমাণের জন্য একটি বিকৃত ইতিহাস ব্যবহার করা হয় যে নেতাজি নাকি শ্যামাপ্রসাদ এর উপর রাজনৈতিক হামলা চালিয়েছে এবং বহু মানুষ ঘটনাটা না জেনে এটা বিশ্বাস করে নেয়। – চলুন দেখা যাক আসলেই কী হয়েছিল সেই সময়!

আসল ঘটনা বলরাজ মাধক শ্যামাপ্রসাদের জীবনী “পোট্রেট অফ আ মার্টিয়র” এ লিখে গিয়েছেন।

১৯৪০ এর এপ্রিলে কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে নেতাজী সুভাষ বোসের ফরোয়ার্ড ব্লক এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভার মধ্যে জোট হতে হতেও ভেঙ্গে যায়। সুভাষ বোস এবং শ্যামাপ্রসাদ নির্বাচনী জোট গঠনের জন্য বারকতক মিটিংয়ে বসলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে মাত্র দুটি আসনের জন্য সমঝোতা হয় নি। এই জোট না হওয়া নিয়ে ফরোয়ার্ড ব্লকের রাজেন্দ্র চন্দ্র দেব বলেছিলেন যে, তাঁদের আরও নমনীয় হওয়া উচিত ছিল। তিনি জানান‚
, ’ if the duo could make a joint front against the Muslim League , the situation could have been a bit different .”

যাই হোক। জোট না হওয়াতে ফরোয়ার্ড ব্লক আর হিন্দু মহাসভা পরস্পরের বিরোধী হিসাবে নির্বাচনে নামে। হিন্দু মহাসভার একটি সভায় এক গুন্ডা শ্যামাপ্রসাদের দিকে পাথর ছোঁড়ে এবং শ্যামাপ্রসাদ আহত হন। কিন্তু তারপর জনতা ঐ গুন্ডাকে ধরে গণধোলাই দেয়। নেতাজি পরে শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেন এবং জানিয়ে দেন কেউ কারও কার্যক্রমে বাধা প্রদান করার চেষ্টা করবে না। শুধু তাই নয়, তাঁদের মধ্যে এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সূচনা হয়। পথ আলাদা হলেও পথের শেষের লক্ষ্য তো উভয়ের একই ছিল।

প্রসঙ্গত বলে রাখা উচিত যে ঐ নির্বাচনে ৪৮ শতাংশ আসন দখল করেছিল শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভা।

অর্থাৎ আমরা দেখলাম যে নেতাজি শ্যামাপ্রসাদ এর উপর আক্রমণ চালিয়েছে এমন অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে মৃত্যু এবং একটি বিকৃত ইতিহাস মাত্র নেতাজি কিভাবে শ্যামাপ্রসাদ বা সাভারকারের বিরুদ্ধে বলে দেখানো সম্ভব নয়।

বলরাজ মাধকের পোট্রেট অফ আ মার্টিয়র বই এর অংশবিশেষ দেওয়া হল। আপনারাই দেখে নিন।

এবং তার সাথে আরো একটি ঘটনা জানিয়ে রাখা উচিত। এইযে নেতাজি ও শ্যামাপ্রসাদকে মিথ্যে ইতিহাসের দ্বারা যে কাল্পনিকভাবে লড়িয়ে দেওয়া হয়‚ আসলেই সেই সময়ের মানুষরা কিভাবে দেখতেন এদের?

নিম্নলিখিত চিঠির অংশটা কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন‚
মধুপুর থেকে ১৭ জুলাই, ১৯৪২-এ ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর উদ্দেশ্যে।

শ্রী চরণেষু,
…এই coalition ministry-র একমাত্র
আপনাকে আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি ও
ভালবাসি, আর কাউকে নয়। আমি জানি আমরাই এই ভারতবর্ষকে পূর্ণ স্বাধীন করব। সেদিন বাঙালীর আপনাকে ও সুভাষবাবুকেই সকলের আগে মনে পড়বে-আপনারাই হবেন
এদেশের পতাকার নায়ক।
-কাজী নজরুল ইসলাম

(চিঠির প্রতিলিপি উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত
শ্যামাপ্রসাদের ডায়েরি ও মৃত্যু প্রসঙ্গ, মিত্র ও
ঘোষ পাবলিসার্স, ১৯৯১, পৃঃ IX ও পৃঃ X)

আর শ্যামাপ্রসাদ নিয়ে কুৎসার জবাব? যে লোকটা না থাকলে পূর্ব বাংলা থেকে জেহাদী অত্যাচারে পালিয়ে আসা হিন্দুরা মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পেত না‚ সেই পশ্চিমবঙ্গের স্রস্টা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে
নিয়ে কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। লোকটা একবার না‚ দুইবার হেলায় মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই মন্ত্রীত্ব‚ যা পাওয়ার জন্যে মানুষ কি না করতে পারে—- খুন‚ অপহরণ‚ বিশ্বাসঘাতকতা‚ নিজেকে বিক্রি করা‚ আরও কতকিছু!

প্রথমবার মন্ত্রীত্ব ছাড়লেন ব্রিটিশ আমলে; ১৯৪২ সালে তিনি তখন ফজলুল হক মন্ত্রীসভার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এই মন্ত্রীসভা গঠনের একটা ইন্টারেস্টিং ইতিহাস আছে। পরে কখনো আলোচনা করব। কিন্তু সেই সময় মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের উপরে পুলিশের অত্যাচার দেখে মনে আঘাত লাগে শ্যামাপ্রসাদের। মূহুর্তের মধ্যে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে নেমে আসেন মানুষের মাঝে।

দ্বিতীয়বার আবার একবার মন্ত্রী হলেন তিনি। এবার নেহেরুর মন্ত্রীসভায়। তিনি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী। এখন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দারা স্বাভাবিকভাবেই শিল্পমন্ত্রীর গুরুত্ব বুঝবেন না‚ কিন্তু অন্য যেকোনো মন্ত্রীসভায়‚ বিশেষত নেহেরুর মতো সমাজতান্ত্রিক মন্ত্রীসভায় শিল্পমন্ত্রীর গুরুত্ব সাংঘাতিক। ক্ষমতাও তেমনই। উভয়ার্থেই। কিন্তু বিদ্রোহ আর দেশপ্রেম যার রক্তে মিশে রয়েছে তাকে মন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আটকে রাখবে কে?
এখানেও প্রতিনিয়ত চলতে লাগল নেহেরুর সাথে তীব্র বাদানুবাদ। উপমহাদেশের বিশেষত পাকিস্তানের হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিয়ে নেহেরুকে প্রতিদিন তুলোধুনো করেন তিনি। নেহেরুকে আক্রমণ করে করা তার একটি মন্তব্য ইতিহাসের পাতায় উঠে গেছে – “আপনি ভারত ভেঙ্গেছেন। আর আমি ভেঙ্গেছি পাকিস্তান।
পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫০ এর দাঙ্গার প্রতিবাদে সবার সামনেই নেহেরুকে তুলোধুনো করেন তিনি। দিন টা ছিলো ১৪ এপ্রিল, ১৯৫০! কারণ নেহেরু লিয়াকত চুক্তির দ্বারা পাকিস্তানের হিন্দুদের দায়িত্ব কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলেছিলো নেহেরু। এছাড়া তো কাশ্মীর নিয়ে নেহেরুর নীতি ছিলোই।

সারা দেশের জন্যে এক নীতি নিয়ে চললেও বন্ধু আব্দুল্লার রাজ্য কাশ্মীরে আলাদা নিয়ম জারি করলেন নেহেরু। কাশ্মীরের জন্যে বরাদ্দ হল আলাদা পতাকা‚ আলাদা সংবিধান। একটা দেশের মধ্যেই আরেকটা দেশ। বস্তুত ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর আরেকবার দেশভাগ করেছিলেন নেহেরু। কাশ্মীরকে আলাদা সংবিধান দিয়ে। বিরোধিতায় গর্জে উঠলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ভারতের অঙ্গহানি আর তিনি মেনে নেবেন না। ‘এক দেশ মে দো বিধান নেহি চ্যালঙ্গে (এক দেশে দুই আইন চলবে না)’- তার এই স্লোগান তখন দক্ষিণপন্থী ভারতীয়দের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

কিন্তু শুধু স্লোগান দিয়ে তো হবে না। দেশের কাজের জন্যে চাই মাঠে নেমে লড়াই। নেহেরুর ভেস্টেড ইন্টারেস্টের বিরুদ্ধে মুখোমুখি লড়াই। যে লড়াই তার মন্ত্রীসভায় থেকে কখনোই সম্ভব নয়। অগত্যা আবারও পদের মোহ‚ নিরাপদ জীবনের লোভ‚ লাল বাতি‚ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা – সবকিছু হেলায় পায়ে দলে পদত্যাগ করলেন তিনি। নেমে আসলেন মানুষের মধ্যে। গ্রাসরুট লেভেলে আন্দোলন করে ভারতবর্ষের অখন্ডতা ফিরিয়ে আনার জন্য। আর এই আন্দোলন করতে গিয়ে রহস্যজনকভাবে নিহতও হয়েছেন কাশ্মীরের জেলের ভেতর। একদল অনুগত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে সাথে নিয়ে কাশ্মীরে গিয়ে উপস্থিত হন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীও এই আন্দোলনে শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গী হয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই ভীতসন্ত্রস্ত কাশ্মীর সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে। আর সেই শ্রীনগরেই পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় সম্পূর্ণ সুস্থ শ্যামাপ্রসাদের আকষ্মিক মৃত্যু হয় এই আজকের তারিখে‚ ২৩ শে জুন‚ ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ। বহু মানুষের সন্দেহ‚ রাজনৈতিক আক্রোশ মেটাতে হত্যা করা হয়েছে তাকে।

সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো যে মানুষটা নেহেরুভিয়ান কায়দায় আরাম করে পায়ের উপর পা তুলে কাটিয়ে দিতে পারত সারাটা জীবন‚ নিজের বিবেকের তাড়নায়‚ অসহায় ভারতবাসীকে সাহায্যের উদ্দেশ্যে তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করে নেমে আসলেন মানুষের মাঝে। করুণভাবে নিহতও হলেন শাসক শ্রেণীর ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা করতে গিয়ে।

আর তাকেই কিনা এই রাজনৈতিক কীটগুলো নোংরা অপমান করছে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে। ঘেন্না হওয়া দরকার এদের উপরে।

নেতাজী আর শ্যামাপ্রসাদ দুইজেই ভারত মাতার বীর হিন্দুসন্তান আর দুইজনই হিন্দুধর্মের মঙ্গলের কথাই ভাবতেন। এটাই এদের প্রধান পরিচয়। নোংরা রাজনৈতিক স্বার্থে একজন হিন্দুবীরকে আরেকজন বীরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতেই হবে।

সৌভিক দত্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.