ফাল্গুনকৃষ্ণচতুর্দশ্যামাদিদেবো মহানিশি।
শিবলিঙ্গতয়োদ্ভূতঃ কোটিসূর্যসমপ্রভ।।
হিন্দু মহাপুরাণ তথা শিবমহাপুরাণ অনুসারে শিব রাত্রিতে শিব সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের মহা তান্ডব নৃত্য করেছিলেন । আবার এইরাত্রেই শিব ও পার্বতীর বিবাহ হয়েছিল । এর নিগুঢ় অর্থ হল শিব ও শক্তি তথা পুরুষ ও আদিশক্তি বা পরাপ্রকৃতির মিলন। এই মহাশিবরাত্রিতে শিব তার প্রতীক লিঙ্গ তথা শিবলিঙ্গ রূপে প্রকাশিত হয়ে জীবের পাপনাশ ও মুক্তির পথ দিয়েছিলেন।এই তিথিতেই শিব ও শক্তি অর্থাৎ পার্বতীর মিলন হয়েছিল। শিব-পার্বতী বিবাহের রাত্রি হিসেবে পালিত হয় এই উৎসব। ফাল্গুন কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিনই বৈরাগ্য ত্যাগ করে গৃহস্থ জীবনে প্রবেশ করেন শিব। একে শিবরাত্রির ১৫ দিন পর দোল পালনের অন্যতম কারণ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়।শিবমহাপুরাণ অনুসারে, অতি প্রাচীনকালে বারাণসী তথা কাশীধামে এক নিষ্ঠুর ব্যাধ বাস করত। সে প্রচুর জীবহত্যা করত। একদিন শিকারে বেরিয়ে তার খুব দেরী হওয়ার ফলে সে জঙ্গলে পথ হারিয়ে রাতে হীংস্র জন্তুর ভয়ে এক গাছের উপর আশ্রয় নেয় । কোনো শিকার না পেয়ে সে হতাশ হয়ে গাছ থেকে একটা করে পাতা ছিঁড়ে নীচে ফেলতে থাকে । সেই গাছটি ছিল বেলগাছ । আর সেই বেলগাছের নীচে একটি শিবলিঙ্গ ছিল। সেদিন ছিল শিবচতুর্দশী অর্থাৎ মহাশিবরাত্রি আর ব্যাধও ছিল উপবাসী। তার ফেলা বেলপাতাগুলো শিবলিঙ্গের মাথায় পড়ে এর ফলে তার শিবচতুর্দশী ব্রতের ফল লাভ হয় তার অজান্তেই। পরদিন ব্যাধ বাড়ী ফিরে এলে তার খাবার সে এক অতিথিকে দিয়ে দেয়। এতে তার ব্রতের পারণ ফল লাভ হয়।এর কিছুদিন পরে সেই ব্যাধ মারা গেলে যমদূতরা তাকে নিতে আসে। কিন্তু শিবচতুর্দশী ব্রতের ফল লাভ হেতু শিবদূতরা এসে যুদ্ধ করে যমদূতদের হারিয়ে ব্যাধকে নিয়ে যায়। যমরাজ তখন শিকার করেন যে শিবচতুর্দশী ব্রত পালন করে তার উপর যমের কোনো অধিকার থাকেনা। সে মুক্তিলাভ করে। এইভাবে মর্ত্যলোকে শিবচতুর্দশী ব্রতের প্রচার ঘটে।মহাশিবরাত্রির দিনে ৬৪টি স্থানে শিবলিঙ্গ প্রকট হয়। তার মধ্যে শুধুমাত্র ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গের নাম জানা রয়েছে। মহাশিবরাত্রির দিনে উজ্জৈনের মহাকালেশ্বর মন্দিরে দীপস্তম্ভ লাগানো হয়। শিবের অগ্নি-রূপী অনন্ত লিঙ্গের অনুভূতির জন্য এই দীপ স্তম্ভ লাগানো হয়। এই মূর্তির নাম লিঙ্গোভব, অর্থাৎ যা লিঙ্গ থেকে প্রকট হয়েছে। এমন লিঙ্গ যাঁর আদি বা অন্ত নেই।মহাশিবরাত্রি অনুষ্ঠানে ভারতবর্ষের বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ তথা সোমনাথ, মল্লিকার্জুন, মহাকালেশ্বর, ওঁকারেশ্বর, কেদারনাথ, ভীমশঙ্কর, বিশ্বেশ্বর, ত্র্যয়ম্বকেশ্বর, বৈদ্যনাথ, নাগেশ্বর, রামেশ্বর ও ঘুশ্মেশ্বর এ বহু মানুষের সমাগম হয় ও সবার হাতে এই জ্যোতির্লিঙ্গের পূজা ও পবিত্র স্পর্শলাভ ঘটে।ঈশান সংহিতা অনুযায়ী, এদিনই প্রকট হয়েছিলেন মহাদেব। এদিন শিব ভক্তরা মন্দিরে গিয়ে শিবলিঙ্গে বেলপাতা, দুধ, ফুল, অক্ষত অর্পণ করেন। ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও জ্যোতিষ দৃষ্টিতে মহা শিবরাত্রির বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে।শিবপূজায় শিবলিঙ্গ স্নানার্থে প্রধাণত গঙ্গাজল বা গঙ্গাজল মিশ্রিত জল ব্যবহার করা হয় । আর বেলপাতা দেওয়া হয় তিনটি পাতাযুক্ত একটি যৌগিক পত্রকে । তবে বিশেষ লক্ষ্যণীয়, শিবের পূজার বেলপাতার প্রতিটি যৌগিক পত্রের বৃন্ত বা বোঁটার নীচের একটু মোটা অংশ অবশ্যই ভেঙ্গে বাদ দিয়ে তবে সেই বেলপাতা অর্পণ করা উচিত।
মহা শিবরাত্রিতে শিবের জন্য উপবাস রেখে পূজার্চনা করেন তাঁর ভক্তরা।ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে জ্যোতির্লিঙ্গ হিসেবে শিব আবির্ভূত হওয়ায় মহাশিবরাত্রি হিসেবে এই উৎসব পালিত হয়। সকলে এই ব্রত করতে পারেন। এই ব্রত পালন না করলে ব্যক্তি দোষ ও পাপের অংশীদার হয়। মহা শিবরাত্রি আবার ব্রতরাজ নামে খ্যাত। শিবরাত্রি যমরাজের শাসন ধ্বংস করে ও শিবলোকের পথে নিয়ে যায়। শাস্ত্র সম্মত ভাবে যাঁরা মহাশিবরাত্রিতে রাত্রি জাগরণ করেন, তাঁরা মোক্ষ লাভ করতে পারেন। পাপ ও ভয় মুক্ত করে এই উৎসব।ফাল্গুন কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথিতে চন্দ্র সূর্যের কাছে থাকে। সে সময় জীবন-রূপী চন্দ্রের শিব-রূপী সূর্যের সঙ্গে মিলন ঘটে। অতএব এই চতুর্দশী তিথিতে শিব পুজো করলে ব্যক্তির মনস্কামনা পূরণ হয়। মহিলাদের জন্য এই ব্রত বিশেষ ফলদায়ী। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী অবিবাহিত মহিলারা মহা শিবরাত্রির উপবাস রাখলে তাঁদের শীঘ্র বিবাহ সম্পন্ন হয়। আবার বিবাহিত মহিলারা নিজের সুখী জীবনের জন্য মহা শিবরাত্রির ব্রত পালন করেন।শিবরাত্রি শিবের দিব্য অবতরণের মঙ্গলসূচক তিথি। নিরাকার থেকে সাকার রূপে এদিনই অবতরিত হয়েছিলেন মহাদেব। এই অবতরণের রাত্রিই মহাশিবরাত্রি নামে খ্যাত। কাম, ক্রোধ, মোহ, লোভের মতো বিকার থেকে মুক্ত করে পরম সুখ, শান্তি ও ঐশ্বর্য প্রদানের মধ্যেই এই ব্রত পালনের মাহাত্ম্য লুকিয়ে রয়েছে।
- সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য্য।।