ভারতীয় প্রাথমিক শিক্ষা বনাম পাশ্চাত্য শিক্ষা – শ্রী রতন শারদা, ড. স্বরূপ সম্পাত রাওয়াল এবং সন্দীপ সিং

ভারতীয় প্রাথমিক শিক্ষা বনাম পাশ্চাত্য শিক্ষা – শ্রী রতন শারদা, ড. স্বরূপ সম্পাত রাওয়াল এবং সন্দীপ সিং।

শৈশবকালীন শিক্ষা একজন ব্যক্তির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সেই কোমল এবং অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য মনের মধ্যে বসানো ধারণাগুলি সর্বদা ব্যক্তির সাথে থাকে। তাই এটি সবচেয়ে সমালোচনামূলক। গল্প, গেমস এবং কবিতার মাধ্যমে ছোট শিশুর মনকে শিক্ষিত এবং মার্জিত করার দুর্দান্ত সরঞ্জাম ছিল ভরতের কাছে। আমরা ধীরে ধীরে পশ্চিমা মডেলের কাছে চলে যাচ্ছি যার মধ্যে নেতিবাচকতা রয়েছে। কীভাবে? সন্দীপ সিং, একজন গবেষক এই পর্বে আমাদের বলছেন। Q A অনুসরণ করে এবং ডক্টর স্বরূপ সম্পাত রাওয়ালের সাথে আলোচনা। একটি আনন্দদায়ক পর্ব:

তাঁর প্রকৃত নাম শ্রীকৃষ্ণ। তিনি যমুনা নদীর কূলে এক দ্বীপে জন্মেছেন, তাই তাঁর নামের সাথে এসে যুক্ত হয় দ্বৈপায়ন এবং তিনি বেদকে সম্পাদনা করেছেন তাই তাঁর নামের সাথে একটি উপাধি যুক্ত হয় ‘বেদব্যাস’। শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। ঋষি পরাশর এবং জেলে কন্যা সত্যবতীর পুত্র। যিনি পৃথিবীতে ‘ব্যাসদেব’ নামেই প্রাতঃস্মরণীয়। শ্রীমদ্ভাগবতে তাঁর সম্পর্কে বলা আছে:

ততঃ সপ্তদশো জাতঃ সত্যবত্যাং পরাশরাৎ।

চক্রে বেদতরোঃ শাখা দৃষ্ট্বা পুংসঃ অল্পমেধসঃ।।

                                 (শ্রীমদ্ভাগবত: ০১.০৩.২১)

এরপর তিনি সপ্তদশ অবতারে সত্যবতীর গর্ভে এবং পরাশর মুনির ঔরসে বেদব্যাসরূপে অবতীর্ণ হন। পৃথিবীর মানুষের মেধাশক্তি দিনদিন ক্ষীণ হয়ে আসছে দেখে অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানবের প্রতি কৃপাপূর্ণ হয়ে তিনি বেদরূপ বৃক্ষের শাখা বিভাজন করেন। ( তাই তাঁর নামের সাথে অনন্তকালের জন্যে একটি উপাধি যুক্ত হয় বেদব্যাস)

ব্যাসদেব চিন্তা করলেন অনন্ত এ বেদবিদ্যা একত্রে গ্রহণ করা মানবের পক্ষে দুঃসাধ্য। তাই তিনি বেদবিদ্যাকে চারভাগে বিভক্ত করে তাঁর প্রধান চার শিষ্যকে দান করলেন। পৈলকে দিলেন ঋগ্বেদ, জৈমিনিকে দিলেন সামবেদ, বৈশম্পায়নকে দিলেন যজুর্বেদ এবং পরিশেষে সুমন্তকে দিলেন অথর্ববেদ। ব্যাসদেবের প্রধান এ চার শিষ্য জগতে বেদবিদ্যার প্রচার করেন তাঁদের শিষ্য -প্রশিষ্যের মাধ্যমে। এভাবেই গুরুশিষ্য পরম্পরায় বেদজ্ঞান শত-সহস্র শাখায় বিকশিত হয়ে জগতে বেদবিদ্যার অমৃতধারাকে দিকে দিকে প্রবাহিত করে তোলে। বেদ কোন একটি গ্রন্থ নয়, অসংখ্য গ্রন্থের সমষ্টি। 

এরপরেই ব্যাসদেবের অনন্য কীর্তি বৃহত্তর ভারতবর্ষের ইতিহাসের মহাগ্রন্থ মহাভারত রচনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে গ্রন্থকে বলেছেন – ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস।একলক্ষ শ্লোকের এ মহাভারতের ভীষ্মপর্বের আঠারোটি অধ্যায় নিয়েই রচিত হয়েছে ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক গ্রন্থ।

আঠারোটি পুরাণ এবং আঠারোটি উপ-পুরাণের সকলই

ব্যাসদেবের রচনা বলে প্রচলিত। যদিও পুরাণগুলোর মধ্যে অনেক পরস্পর বিরোধী , অবাস্তব, কাল্পনিক, বালখিল্য জাতীয় কথা আছে; এ সত্যেও পুরাণগুলোর মধ্যে অনেক মণি-মুক্তা খচিত অমৃতময় কথাও বিদ্যমান। তাই আমাদের এ পুরাণগুলোকে গ্রহণ -বর্জনের মাধ্যমেই গ্রহণ করতে হবে।

ব্যাসদেবের আরেকটি সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি সম্পূর্ণ বৈদিক সিদ্ধান্তগুলোকে মাত্র ৫৫৫ টা সূত্রে প্রকাশিত করা; যার নাম ব্রহ্মসূত্র। এ ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যের মাধ্যমেই ভারতবর্ষের সকল মত-পথের উৎপত্তি। শ্রীশঙ্করাচার্য থেকে আমাদের যত আচার্যবৃন্দ আছেন তাঁরা সকলেই এ ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য লিখে আপন আপন সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেছেন। এ কারনেই ব্যাসদেব গুরু পরম্পরায় সবার গুরু এবং তাই তাঁর জন্মতিথিকে  গুরুপূর্ণিমা বলা হয়।  এদিনে নিয়ম ব্যাসদেবের অর্চনার সাথে সাথে যার যার গুরুকেও সম্মান জানানো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যে আমরা যার যার গুরু নিয়েই ব্যতিব্যস্ত  ; এ তিথিতে যে ব্যাসদেবের জন্ম হয়েছিলো এবং এই কারণেই যে এ তিথিটি এতো মাহাত্ম্যপূর্ণ  তা আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা। বা আমাদের গুরুরা হয়তো অনেকে শিষ্যদের জানতেও দেন না তিথিটির মাহাত্ম্য ; পাছে তাদের ভাগে কম পরে যায়!

গুরুপূর্ণিমায় আধ্যাত্মিক গুরুদের সাথে সাথে আমাদের সকলেরই স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগুরুদেরও যথাযথ সম্মানিত করা বা শ্রদ্ধার্ঘ্য দেয়া প্রয়োজন।

অতি প্রাচীনকাল থেকেই চলে এসেছে এ গুরুপূর্ণিমা স্মরণের রীতি। তাইতো গৌতমবুদ্ধ এ দিনেই সারনাথের ঋষিপত্তন মৃগদাবে  তাঁর পঞ্চবর্গীয় শিষ্য কৌন্ডন্য, বপ্প,ভদ্দীয়, মহানাম ও অসসজিতের কাছে তাঁর নবমত প্রচার করেন এবং ধর্ম রক্ষার্থে ‘ধর্মচক্র’ প্রবর্ত্তন করে 

ব্যাসদেবের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন।

বেদের আক্ষরিক অর্থ হয়তো জ্ঞান; কিন্তু বিদ্ ধাতু থেকে উৎপন্ন ‘বিদ্যা’ ও ‘বেদ’ শব্দের অর্থ একেবারে এক নয়। ‘বিদ্যা’ বলতে বোঝায় সেইধরণের জ্ঞান, যা মানুষ নিজের চেষ্টায় আহরণ, অর্জন করে। অন্যদিকে ‘বেদ’ হল “প্রাচীন পরম্পরাগত জ্ঞানভাণ্ডার।” বেদের সাথে ‘জ্ঞান’এর সম্পর্ক আমরা মনে রাখি কিন্তু ‘পরম্পরা’র ব্যাপারটা গুরুত্ব দিই না।

বেদের বিষয়বস্তুকে ভাগ করতে বসলে তাদের সংখ্যা হয় চার। বিজ্ঞান, উপাসনা, জ্ঞান এবং কর্ম। মজার ব্যাপার হল বিজ্ঞান বলতে আমরা আজ যা বুঝি, উপরিলিখিত ‘বিজ্ঞান’মোটেও তা নয়। ইংরাজি ‘সায়েন্স’ শব্দের ভাবার্থ গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আয়ত্ত্ব করা পরীক্ষিত জ্ঞান। সনাতন মতে সংস্কৃত শব্দ ‘বিজ্ঞান’এর অর্থ ছিল ঈশ্বরকে অনুভব করবার তত্ত্ব জ্ঞান। দুটি অর্থ সম্পূর্ণ বিপরীত। তা সত্বেও আশ্চর্যজনক ভাবে সায়েন্সের অর্থ বিজ্ঞান বোঝা হয়েছে। খুবই বিভ্রান্তিকর। যাই হোক, মূল বিষয়ে ফিরে আসা যাক। ঈশ্বরকে অনুভব করবার সাথেসাথেই তাঁর আরাধনা প্রয়োজন। উপাসনায় আসে সেই যাগযজ্ঞের বিষয়। তৃতীয় ভাগ ‘জ্ঞান’ হল বিভিন্ন দার্শনিক উপলব্ধি। যা বুদ্ধিমান মানুষের বোধ’কে বিকশিত করতে সাহায্য করে। এই জ্ঞানের উদ্দেশ্য কেবল আত্মোন্নতি নয়, এর উপর ভিত্তি করে জীবনে শান্তি আনা সম্ভব। এরপর চতুর্থ অর্থাৎ ‘কর্ম’ভাগে আসে সামাজিক দায়িত্বপালন বিধি। এই ভাগটি বাকি তিন ভাগের থেকে একেবারেই আলাদা। এই অংশেই সমাজের হিত এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। বেদের জ্ঞান যেমন উচ্চতর শক্তিদের আরাধনার, তেমনই সমাজব্যবস্থা পরিচালনারও। এই অংশগুলি কেউ কেউ অর্বাচীন বলে দাবী করে থাকেন বটে তবে ভবিষ্যতে আমরা আলোচনা করবো যে বৈদিক যুগে ধর্ম এবং কর্ম উভয়কেই গুরুত্ব দেওয়া হতো।

                                              ♦️

বেদের বিষয়বস্তু না’হয় বোঝা গেল, কিন্তু সে’সব একত্র করলো কে? অথবা কারা? সাধারণভাবে আমরা জানি, বেদ হ’ল ঈশ্বরের মুখ নিঃসৃত বাণী। প্রথমে আর্য ঋষিদের থেকে শিষ্যরা সেই জ্ঞান শুনে শুনে মনে রাখতো। তাই বেদ স্রুতিশাস্ত্র। পরবর্তীকালে মানুষের স্মৃতিশক্তি কমে এলে সেই জ্ঞান লিখে রাখবার প্রচলন হয়। কিন্তু এতো গেল উপরের কথা। ভিতরে তলিয়ে দেখলে বিষয়টা একটু জটিল। বেদের জ্ঞানে আস্থা রাখা মানুষজনেরাও তার উৎপত্তি বিষয়ে একমত হতে পারেন নি। এব্যাপারে কয়েকটি মত রয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় এখানে মত’ও সেই চারখানি!

প্রথম মতাবলম্বীরা বেদকে বলে থাকেন ‘আর্ষ।’ এর মূল বক্তব্য হল, বেদের মন্ত্রের জ্ঞান স্বয়ং ঈশ্বর প্রণীত। তার পরিবর্তন হয় না। বৈদিক যুগের ঋষিরা তাঁদের শ্রদ্ধা, পুণ্য এবং তপস্যার বলে বেদের জ্ঞান অর্জন করেন এবং তা সকলের সামনে নিয়ে আসেন। বেদের ভাষা ঋষিদের নিজস্ব বলে তাকে ‘আর্ষ’ বলা হয়। স্রুতিশাস্ত্র সম্পূর্ণভাবে রচনা করতে ঋষিদের অনেক প্রজন্ম সময় লেগেছে। সব শেষে রচিত হয়েছিল উপনিষদ। সেই সময়েই ঋষিদের যুগ শেষ হয়।

দ্বিতীয় মত অনুসারে বেদ ‘ঈশ্বরীয়।’ এই মতাবলম্বীরা প্রলয় ও কল্পান্তরে বিশ্বাসী। তাঁদের বিশ্বাস অনুসারে প্রতি কল্পে সৃষ্টির আদিতে স্বয়ং ভগবান বেদের জ্ঞান দান করে থাকেন। শুদ্ধচিত্ত ঋষিদের পুণ্য এবং তপের উপর এই জ্ঞান পাওয়ার যোগ্যতা নির্ভর করে। বর্তমানে কল্পে ঋষি অগ্নি, বায়ু, আদিত্য এবং অঙ্গীরা’র হৃদয়ে এই ঈশ্বরীয় জ্ঞান প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। ‘আর্ষ’এর মূল বক্তব্য ঈশ্বরীয় মতেও স্বীকার করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও বেদের জ্ঞান সব সময়ই (প্রতি কল্পে) অপরিবর্তিত।

তৃতীয় মত বেদকে ‘অপৌরুষেয়’ বলে দাবি করে। সহজ কথায় বেদ কারো দ্বারা সৃষ্ট নয়, তা নিত্য এবং সর্বোচ্চ। ঋষিরা নিজেদের তপস্যা ও যোগশক্তিতে এই নিত্যকে অনুভব করেন এবং তাকে বাকিদের সামনে প্রকাশ করেন। কিন্তু বেদমন্ত্রের তাৎপর্যও তারা হুবহু দর্শন এবং পরিবেশনা করে থাকেন। বেদ হল শব্দের আদি লিখিত রূপ। ‘অপৌরুষেয়’ মতে শব্দের উৎপত্তি নেই, তাদের কেবল প্রকাশিত ভাব আছে। মীমাংসা দর্শন রচয়িতা জৈমিনী এই মতের প্রবল সমর্থক। উনি শব্দকে নিত্য বলেছেন; যা আগে থেকেই বর্তমান ছিল। আমরা উচ্চারণের মাধ্যমে স্বর-ব্যাঞ্জন বর্ণে তাকে প্রকাশ করছি। শব্দ ধার করলেও আজ আমরা নিজের মতো করে বাক্য, ব্যাক্যার্থ, অনুচ্ছেদ লিখছি। কিন্তু বেদে সবকিছুই মৌলিক এবং পূর্বনির্দিষ্ট। ঠিক যেমন চাঁদের গায়ে সূর্যের আলো পড়লে তবে তাকে দেখা যায়, অথচ চাঁদ আগে থেকেই বর্তমান রয়েছে। শব্দ ব্রহ্মের ধারণা এই মতবাদ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছে। শব্দের নিত্যতাবাদ মতের বিরোধিতাও হয়েছে, কিন্তু আমাদের প্রয়োজন আপাততঃ এটুকুই।

চতুর্থ মত বাকি তিন মতের চেয়ে আলাদা। এই মতাবলম্বী পন্ডিতদের ব্যাখ্যায় বেদ ‘পৌরুষেয়।’অর্থাৎ তা মানুষের দ্বারাই দৃষ্ট এবং সৃষ্ট। বুদ্ধিমান মানবজাতির উর্বর মস্তিষ্কের ফসল। বেদের জ্ঞানে আস্থা রাখলেও তার সঙ্গে জড়িত ভক্তি, তপ, দেব বা ব্রহ্মের তত্ত্বগুলি এখানে সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এই মত অনুসারে বেদ প্রাচীন ঋষিদের এক মহান সাহিত্য কীর্তি। যা বর্তমান অনুসন্ধানকারীদের জন্য হারিয়ে যাওয়া সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার ভূগোল, ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতিকে জানবার একমাত্র সূত্র। পরবর্তীকালে লিখিত রূপ পেলেও, প্রাথমিক দেড় দু’হাজার বছর ধরে গুরুশিষ্য পরম্পরায় কেবল শুনে এবং শিখিয়ে সেই জ্ঞান নির্ভুলভাবে আয়ত্ত্বে রাখা হতো। পন্ডিতদের মতে খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৯০০ র মধ্যে বেদের প্রথম সংহিতা রচিত হয়। পাশ্চাত্যের পন্ডিত ‘টি-বারো’র মতে “পূর্ব বৈদিক সাহিত্য” খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে ১০০০’এর মধ্যে এবং “উত্তর বৈদিক সাহিত্য” খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ থেকে ৭০০এর মধ্যে রচিত গ্রন্থিত। পূর্ব বৈদিক সাহিত্য বলতে ঋগ্বেদের সেই অংশকে (প্রথম ন’টি মন্ডল) বোঝায় যা লেখা শুরু হওয়ার আগে মুখে মুখে চর্চিত হয়েছে। উত্তর-বৈদিক সাহিত্য (ঋগ্বেদের অন্তিম মন্ডল থেকে উপনিষদ পর্যন্ত) বেদ লিখিত হওয়ার সময় এবং পরবর্তীতে রচিত। ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেনের মতে ঋগ্বেদ খ্রিষ্টপূর্ব ১১০০ থেকে ১০০০ এর মধ্যে রচিত হয়ে গিয়েছিল। বেদের ভাষা সম্পর্কেও তাঁরা গবেষণা করেছেন। সংক্ষেপে আমরা তার কিছু অংশ আলোচনা করবো। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার সাহিত্যিক ও কথ্য এই দুটি রূপ ছিল। প্রথম অর্থাৎ প্রাচীন আর্য সাহিত্যের ভাষা (স্রুতি) ব্যবহৃত হয়েছে বেদে। এই ভাষার সংস্কার করা না হলেও বর্তমানে এটি বৈদিক সংস্কৃত অথবা মূল সংস্কৃত বলই বেশি পরিচিত। “হ্যাঁ, বৈদিক সাহিত্যের ভাষা থেকে সংস্কৃত ভাষা আসে নি।” আর্য ভাষা ছাড়া সে’সময় ভারতে উদিচ্যা (উত্তর-পশ্চিমা), মধ্য দেশীয়, প্রাচ্যা এবং দাক্ষিনাত্য এই চার রকম উপভাষা ছিল। ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে আর্যদের প্রথম বসতি এবং সেখানেই বেদের রচনা আরম্ভ হয়। এইকারণে ঋগ্বেদে উদিচ্যা উপভাষার প্রভাব পড়েছে। এই উপভাষার উল্লেখ কৌষীতকি ব্রাহ্মণে পাওয়া যায়। সেখানে উদিচ্যা, বৈদিক আর্য ভাষা ছাড়া আরেকটি নিম্নমানের আর্য ভাষার উল্লেখ আছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা সেটিই দ্বিতীয়, অর্থাৎ প্রাচীন আর্য কথ্য ভাষা। প্রাচীন আর্য ভাষার কথ্য রূপটির লিখিত কোনো নমুনা পাওয়া যায় নি। কেবল বেদ পরবর্তীকালের শাস্ত্র ও পুরাণের মধ্যে তার ‘স্মৃতি’ রয়ে গিয়েছে। এই ভাষাই পরবর্তীকালে সংস্কৃত হয়ে ‘সংস্কৃত’ নাম পায়। বেদ পরবর্তী যুগে আর্যরা সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকা ছেড়ে দেশের মাঝামাঝি গঙ্গা-যমুনা বিধৌত অঞ্চলে তাদের বসতি গড়ে তোলে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম-চতুর্থ শতাব্দী কিংবদন্তি বৈয়াকরণীক পাণিনির সময়। তাঁর প্রধাণ কৃতিত্ব আর্য ভাষার সংস্কার সাধন। অবশ্য এই কাজ অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। পাণিনির কাজে চৌষট্টিজন পূর্বসূরির উল্লেখ পাওয়া যায়, যাঁদের কিছু সূত্র, পরিভাষা তিনি গ্রহণ করেছেন। বৈদিক ভাষার ছন্দের কারণে একে তিনি ‘ছন্দাস’ নামে অভিহিত করেছিলেন। পাণিনি জন্মসূত্রে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের হলেও তাঁর বাসস্থান ছিল পাটুলিপুত্র। তাই তাঁর দ্বারা সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণে উদিচ্য এবং মধ্যদেশীয় উপভাষার প্রভাব বর্তমান। আট অধ্যায়ে বিভক্ত সেই অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে ভাষা সংস্কারের পাশাপাশি লৌকিক এবং (লিখিত) বৈদিক ভাষার তুলনামূলক পাঠও বর্তমান। তিনি তাঁর লেখায় প্রাচ্যাম ভাষার উল্লেখ করেছেন। যা কোশল, কাশী, বিদেহ, মগধ, অঙ্গ, বঙ্গের কথ্য ভাষা ছিল। কিন্তু সেইসব (পূর্বাঞ্চল) জায়গায় ছিল অনার্যদের বাস। সেখানকার লোকেদের ভাষাকে বলা হতো ‘অসুরী’। সেই ভাষা আর্য সমাজের কাছে অশুদ্ধ বলে বিবেচিত হতো। তার কোনো সাহিত্যিক রূপ বর্তমানে পাওয়া যায় না। পাণিনির লেখায় সেই ভাষার বিশেষ উল্লেখ নেই। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ব্যাকরণের সেই যুগান্তকারী পরিবর্তন সম্পূর্ণরূপে সফল হতে পারলো না। সংস্কৃত ভাষা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল। সাহিত্য ও ধর্মগ্রন্থগুলি সেই ভাষায় লেখা হতে লাগলো ঠিকই, কিন্তু কথ্যভাষা না হওয়ায় তৎকালীন সমাজ পাণিনির ব্যাকরণ ভালোভাবে গ্রহণ করে নি। জনসাধারণ পুরোনো ভাষাতেই কাব্য, পুরাণ, ধর্মের চর্চা করতো। পুরাণেও সেই অ-সংস্কৃত ভাষার ছাপ থেকে গিয়েছে। রামায়ণ, মহাভারতের মতো ইতিহাস সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। সেগুলিকেই পন্ডিতেরা নাম দিলেন ‘আর্ষ’, অর্থাৎ ঋষিরা ঠিক যেমনটি লিখে গিয়েছিলেন তেমনটি।

                                               ♦️

বেদ বিভাজনের পদ্ধতি বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করবো, তার আগে জেনে নিই কেন এই বিভাজন এবং আদিতে সেগুলির রূপ কেমন ছিল।

“আন্বীক্ষিকী-ত্রয়ী-বার্তা দন্ডনীতিশ্চেতিবিদ্যা” (ইশোপনিষদ)

জ্ঞানের ভাগ অনুসারে প্রাচীন ঋষিরা বিদ্যাকেও চারভাগে ভাগ করেছিলেন। কিন্তু সেই ভাগ একটু অন্যরকম। (ক.) আন্বীক্ষিকী অর্থাৎ যুক্তি বিচারাত্মক তর্কবিদ্যা। (খ.) ত্রয়ী অর্থাৎ (অথর্ব বাদে) যজ্ঞানুষ্ঠান সংক্রান্ত তিন ধরণের বৈদিক জ্ঞান। (গ.) বার্তা অর্থাৎ কৃষি, শিল্প, ব্যবসা প্রভৃতি অর্থোপার্জনের বিদ্যা। (ঘ.) দন্ডনীতি অর্থাৎ শাসন এবং বিচার নীতি। এগুলির মধ্যে ত্রয়ি অর্থাৎ (তিন)বেদের আধ্যাত্মিক বিদ্যাকে ‘পরাবিদ্যা’ বা পরম বিদ্যা বলা হয়। কারণয এতদবিদুরমৃতান্তে ভবতিযারা এই জ্ঞান পায় তারাই অমৃত হয়, ব্রহ্মের স্বরূপ জানতে পারে। বাকি সব বিদ্যা হল অবিদ্যা বা ‘অপরাবিদ্যা’। বাস্তবিকই বৈদিক যুগে প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল যজ্ঞ। এই যজ্ঞকে সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করবার জন্যই ‘ব্রাহ্মণ-সাহিত্য’ সৃষ্টি (পরে লিখিত) হয়েছিল। বৈদিক যজ্ঞ দুপ্রকার, কর্ম এবং জ্ঞানযজ্ঞ। কর্মযজ্ঞের ভাগ শ্রৌত ও গৃহ্য। বৈদিক মতে যজ্ঞের আগুন হল দেবতাদের মুখ। সেখানে নির্দিষ্ট দেবতাকে উদ্দেশ্য করে হব্য আহুতি দিলে তা সরাসরি পৌঁছে যায়। গৃহযজ্ঞ কেবলমাত্র একটি অগ্নিদ্বারাই সম্পন্ন হতে পারতো। তবে শ্রৌত যজ্ঞে তিন ধরণের আগুনের প্রয়োজন পড়তো; গার্হপত্য, 
[24/02, 21:19] দইভাত: আহ্বনীয় এবং দক্ষিণাগ্নি। যজ্ঞ আহুতিদানের ভিত্তিতে ইষ্টি যাগ, পশু যাগ ও সোমযাগ, এই তিনভাগে বিভক্ত। যে ঋষিরা যজ্ঞকর্ম সু-সম্পন্ন করে থাকেন তাঁদের ঋত্বিক বলা হয়। বৈদিক যজ্ঞে চার ধরণের ঋত্বিকের প্রয়োজন পড়ে। প্রথমজন হোতা, ইনি মন্ত্র আবৃত্তি করে যজ্ঞদেবকে অগ্নিতে আহ্বান করেন। দ্বিতীয় অধ্বর্যু, ইনি দেবতাদের উদ্দেশ্যে আহুতিদানের প্রক্রিয়া সম্পাদন করেন। তৃতীয় ঋত্বিক হলেন উদ্গাতা। এঁর কাজ স্তুতি বন্দনার মাধ্যমে অগ্নির কাছে প্রার্থনা করা, যেন তিনি প্রত্যেক দেবতাকে তাঁদের প্রাপ্য হবি পৌঁছে দেন। এছাড়া যজ্ঞের আনুষঙ্গিক কাজকর্ম দেখভালের জন্য চতুর্থ ঋত্বিক পদ হল ব্রহ্মা। যাইহোক, এই আলোচনায় বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানের বিশদ বর্ণনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হল যজ্ঞে ঋত্বিকদের কাজের ধরণ। ঋক শব্দের অর্থ ছন্দবদ্ধ মন্ত্র বিশেষ। এক ধরণের প্রাচীন পদ্য, যার সাহায্যে বৈদিক যজ্ঞে দেবতাদের আহ্বান করা হয়। তাই ঋগ্বেদীয় ব্রাহ্মণ হোতা হ’ন। সাম (সামন্) হল প্রাচীন গান যার মাধ্যমে দেবতাদের স্তুতি মন্ত্র উচ্চারিত হতো। সেই কারণেই উদ্গাতা ঋষিরা সামবেদীয় ব্রাহ্মণ। বৈদিক দেবতাদের নামে, একটি বিশেষ উচ্চারণ পদ্ধতিতে এবং নির্দিষ্টভাবে শ্রদ্ধানিবেদনপূর্বক, যজ্ঞে আহুতি দেওয়ার গদ্য মন্ত্রকে যজুঃ (যজুস) বলা হয়। অয়ুর্ধ্ব শ্রেণী যযুর্বেদীয় শাখার ব্রাহ্মণ। যজ্ঞের প্রয়োজন অনুসারেই বেদের প্রথম তিনটি ভাগ বিভাজিত হয়েছে। চতুর্থ বেদের ‘অথর্ব’ শব্দটি কিন্তু কোনো ঋষির নাম অথবা কার্য অনুসারে হয়নি। অথর্বন হল প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা প্রণালী। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে প্রথম তিনটি বেদ পূজার্চনা যাগযজ্ঞ সম্পর্কিত হলেও শেষেরটি একেবারেই আলাদা। ফের চারের দলে তিনটি একরকম, একটি আলাদা। এর মূল কারণ বৈদিক যুগের সমাজরক্ষকদের উন্নত চিন্তাধারা। ঋষিরা সংসার ছেড়ে কেবল ত্যাগ আর তপস্যা করতে বলেননি। তাঁরা ত্যাগের মধ্যে দিয়েই ভোগের কথা বলে গিয়েছেন। অপরাবিদ্যার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমেঅবিদ্যায়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতেমৃত্যুর কারণরূপী কর্মকে অতিক্রম করে অমর্ত হওয়া যায়। সহজ কথায় সদিচ্ছা থাকলে সামাজিক সৎকর্মের মাধ্যমেও নিজ কীর্তিতে অমর হওয়া সম্ভব। তাই যাগযজ্ঞ-আরাধনার পাশাপাশি সামাজিক কর্মের গুরুত্ব বুঝে ত্রয়ির মধ্যে মিশে থাকা অথর্বনকে আলাদা করে বেদের পুনর্বিন্যাস (ব্যাস) করলেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন, হয়ে উঠলেন ‘আরেকজন’ বেদব্যাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.