আমরা বহু প্রাচীনকাল থেকেই জেনে এসেছি শনিদেবের দৃষ্টির প্রকোপের কথা, আরো স্পষ্ট বললে ভয় পেয়ে এসেছি শনিদেবের দৃষ্টিকে, শনিদেবের দৃষ্টি যেখানে পরে সেই বিষয়ে আমাদের শাস্তি পেতে হয়। কিন্তু সত্যিই কি তাই ?? আসুন জেনে নিই সত্যিটা। শনিদেবকে ঋষিরা দণ্ডদাতা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, অর্থাৎ জীব এই জন্মে বা পূর্বপূর্ব জন্মে যা যা অপকর্ম করেছে সে জ্ঞাতসারেই হোক বা অজ্ঞাতসারে, শনিদেব সর্বদা তাকে শাস্তি দেন। প্রতিটি ব্যক্তির রাশিচক্রে শনিদেবের এই ভূমিকা, শনিদেব কারুর রাশিচক্রে ধনাত্বক হলে সেই ব্যক্তি জ্ঞানী, পরিণামদর্শী, কর্মঠ ও জনপ্রিয় হয়, তেমনি শনিদেব কারুর রাশিচক্রে যদি ঋনাত্বক হন তবে তাকে চরিত্রহীনতা, কষ্ট, হতাশা, অলসতা ও দারিদ্রের কষ্ট ভোগ করতে হয়। শনিদেবের দৃষ্টি জাতকের রাশিচক্রে যেখানে পরে সেই ভাব সম্পর্কিত সমস্যায় জাতককে কমবেশি ভুগতে হয়, এর কারণ শনিদেব নন, আমরাই নিজেদের পূর্বপূর্ব জন্মের কর্মফলে সেই ভাবগৃহ সম্পর্কিত অপকর্মের জন্য শাস্তি পাই, শনিদেব বরং একজন প্রকৃত গুরুর ন্যায় আমাদের নির্দেশ করে দেন যে এই এই ভাবে আপনার কর্মফল ঋনাত্বক, আপনি সাবধান হন নয়তো আমার প্রকোপ আপনাকে সহ্য করতে হবে। শনিদেবের তিনটি দৃষ্টি, শনিদেব যে ভাবগৃহে বসেন সেখান থেকে তৃতীয়, সপ্তম ও দশমভাবে দৃষ্টি দিয়ে থাকেন। আপনার কোষ্ঠিতে শনিদেব যে যে ভাবগৃহে দৃষ্টি দেন সেই ভাবগৃহ সম্পর্কিত বিষয়ে আপনাকে সচেতন থাকতে হবে, সততা অবলম্বন করতে হবে, নিজের কর্তব্য সততার সাথে পালন করতে হবে নতুবা শনিদেব আপনাকে সেই ভাবগৃহ সম্পর্কিত বিষয়ে শাস্তি দেবেন। আসুন একে একে জেনে নেওয়া যাক রাশিচক্রের ১২টি ভাবগৃহে শনিদেবের দৃষ্টি পরলে তার কি ফল হয় এবং আপনাকে সেই বিষয়ে কি সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে।
প্রথম ভাবগৃহ : লগ্নভাবে বা প্রথম ভাবগৃহে যদি শনিদেব দৃষ্টি দেন তবে জাতক শারীরিক ভাবে কিছুটা দুর্বল হয়, অলস হয়, জাতক জীবনে কমবেশি হতাশায় ভোগে, জাতকের মানসিকতা কিছুটা নিরাশাবাদী হয়ে যায়, জাতকের কর্তব্য অলসতা ত্যাগ করা, সর্বদা ধনাত্বক চিন্তার অভ্যাস করা, নিজের শরীর ও মনের প্রতি যত্নশীল হওয়া।
দ্বিতীয় ভাবগৃহ: দ্বিতীয় ভাবগৃহে বা ধনস্থানে শনিদেবের দৃষ্টি পরলে জাতককে অর্থ কৃচ্ছতার সম্মুখীন হতে হয়, পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়, জীবনের প্রতি জাতকের মূল্যবোধ খুব নিচু হয়, জাতকের কথাবার্তা কটু ও অন্যদের পীড়াদায়ক হয়, জাতক দন্ত সংক্রান্ত ও ক্ষুধামান্দ্য রোগে ভুগতে পারে, জাতকের কর্তব্য সর্বদা পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, কথাবার্তায় মধুরতা আনা, সর্বদা সত্যি কথা বলা, নিষিদ্ধ খাবার ও পানীয় গ্রহণ না করা, সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল অসৎপথে এক টাকাও উপার্জন না করা।
তৃতীয় ভাবগৃহ : ভ্রাতৃভাবে শনিদেবের দৃষ্টি পরলে জাতকের ছোট ভাইবোন ও প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়, জাতকের কমিউনিকেশন স্কিল দুর্বল হয়, জাতকের কর্মে গাফিলতি আসে, গলা ও ঘাড় সম্পর্কিত রোগ দেখা দেয়। জাতকের কর্তব্য ছোট ভাইবোনদের প্রতি স্নেহশীল ও সৎ হওয়া, তাদের সৎপথে চলতে সাহায্য করা ও তাদের প্রতি কখনো অবিচার না করা, কর্মে গাফিলতি না করে সত্বর তা সম্পাদন করা, প্রতিবেশীদের সাথে সততা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করা।
চতুর্থ ভাবগৃহ : মাতৃভাবে শনিদেবের দৃষ্টি পরলে জাতক স্বগৃহে শান্তি পায়না, মাতার সাথে সম্পর্কের অবনতি হয় জাতকের মানসিকতা সংরক্ষণশীল হয়, নতুন কোনো চিন্তাভাবনাকে জাতক সহজে গ্রহণ করতে পারেনা, জাতকের শিক্ষাজীবন বাধাবিঘ্নপূর্ণ হয়। জাতকের কর্তব্য নিজের মাতার প্রতি সৎ ও সহানুভূতিশীল হওয়া, তাকে সর্বদা সেবা করা, স্বামী বা স্ত্রীকে কখনো অসৎকর্মে অনুপ্রাণিত না করা, বরং বাধা দেওয়া, সারাজীবন শিখতে থাকার সচেতন চেষ্টা করতে থাকা, কৌতূহলী হওয়া।
পঞ্চম ভাবগৃহ :সন্তান ভাবে শনিদেবের দৃষ্টি পরলে সন্তানলাভে বাধা আসে, জাতক নির্বুদ্ধি হয়, জাতকের স্কিল বা দক্ষতায় খামতি থাকে, প্রণয় জীবন ব্যর্থ হয়, জাতক সৃজনশীল হতে পারেনা। জাতকের কর্তব্য হল শিশুদের সেবার জন্য কাজ করা, জ্ঞানলাভের চেষ্টা করা, কাজে কর্মে সৃজনশীলতা ফুটিয়ে তোলা, শিশুদের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা, প্রেম-সম্পর্কে সম্পূর্ণ সৎ থাকা, ব্যাভিচার না করা।
ষষ্ঠ ভাবগৃহ : রিপুভাবে শনিদেবের দৃষ্টি পরলে জাতকের স্বাস্থ্য দুর্বল হয়, রুগ্ন হয়, একাধিক বিষয়ে ভীত থাকে, মামলা মোকদ্দমাতে জড়িয়ে পরার ভয় থাকে। জাতকের কর্তব্য হল নিজের মামাবাড়ির পরিবারের সাথে সৎ থাকা, চাকরি করলে কর্মস্থলে সততার সাথে পরিশ্রম করা, নিজের অধীনে কাজ করা ব্যক্তিদের প্রতি সদাচরণ করা।
সপ্তম ভাবগৃহ: দার ভাবে শনিদেবের দৃষ্টি পরলে জাতকের বিবাহে বিলম্ব, বিবাহ হতে বাধা বা দাম্পত্য সম্পর্কে অবনতি হয়, ব্যবসায় উন্নতিতে বাধা আসে। জাতকের কর্তব্য সর্বদা স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি সৎ থাকা, তার প্রতি প্রেমপূর্ণ ভাব রাখা, তাকে প্রতারণা না করা, ব্যবসাতেও সততা বজায় রাখা, ক্রেতাদের প্রতি সৎ থাকা।
অষ্টম ভাবগৃহ : মৃত্যুভাবে শনিদেবের দৃষ্টি থাকলে জাতকের আয়ু লম্বা হয় তবে জাতক দীর্ঘ রোগভোগের পরে মৃত্যুকে প্রাপ্ত হয়, মৃত্যু হয় যন্ত্রণাদায়ক। জাতকের কর্তব্য মৃত্যুর সমীপে থাকা ব্যক্তির নিঃস্বার্থ সেবা করা বা মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করা।
নবম ভাবগৃহ : ভাগ্যভাবে শনিদেবের দৃষ্টি জাতকের মনকে সংকীর্ণ ও আদর্শহীন করে তোলে, পিতা ও গুরুর সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়, তাদের আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়না, জাতকের ভাগ্য জাতকের সঙ্গ দেয়না, ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে, উচ্চ্ শিক্ষায় বাধা আসে। জাতকের কর্তব্য পিতা, গুরু ও অন্যান্য গুরুজনের প্রতি সৎ থাকা ও তাদের সেবা করা, সর্বদা ধর্মলাভে সচেষ্ট থাকা, আপন আদর্শকে সচেতনভাবে মেনে চলা।
দশম ভাবগৃহ : কর্মভাবে শনিদেবের দৃষ্টি জাতককে কর্মহীন বেকার করে রাখতে পারে, কর্মস্থলে উন্নতিতে বাধা, সমাজে জাতকের অপযশ হয়, জাতকের দীর্ঘকালীন ইচ্ছাগুলি পূর্ণ হয়না, পিতার সম্পত্তি লাভ বাধা আসে। জাতকের কর্তব্য আপন কর্মে সর্বদা সততা বজায় রাখা, পরিশ্রম করা, পিতার সম্পত্তির প্রতি নির্লোভ হওয়া, সমাজসেবা করা।
একাদশ ভাবগৃহ : লাভ ভাবে শনিদেবের দৃষ্টি পরলে জাতকের বেশিরভাগ ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যায়, জাতক বড় দাদাদিদি ও বন্ধুদের সাহায্য পায়না ও তাদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়, জীবনে সাফল্য থাকে না। জাতকের কর্তব্য সাফল্য লাভের জন্য সততার সাথে পরিশ্রম করতে হয়, বন্ধু ও বড় দাদাদিদিদের নিঃস্বার্থ সাহায্য করতে হয়।
দ্বাদশ ভাব : ব্যয়ভাবে জাতকের দৃষ্টি পরলে জাতক আধ্যাত্মিক জীবনে দুর্বল হয় ফলে জীবনের সব ক্ষেত্রেই সংঘর্ষের সম্মুখীন হয়, না অর্থলাভ করতে পারে না অর্থ ধরে রাখতে পারে, একাকিত্বে ভোগে, হাজত বাসের কষ্ট ভোগ করে, স্বাস্থ্য রুগ্ন হয়, পারিবারিক সুখ লাভ হয়না, জাতকের জীবন ধীরে ধীরে অন্ধকারে ডুবে যায়। জাতকের এই ক্ষেত্রে একমাত্র কর্তব্য ঈশ্বরের প্রতি নিঃশর্ত শরণাগতি।
শ্রী রাজদীপ সাহা (জ্যোতিষ রত্ন)
বি. ই.ইলেক্ট্রনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়)