২০ শে ফেব্রুয়ারী ছিল সংস্কৃতভারতী দক্ষিণবঙ্গ আয়োজিত সংস্কৃত-সম্ভাষণ বর্গের অনলাইন সমারোপ কার্যক্রম। এদিন মুখ্যাতিথি রূপে উপস্থিত হয়ে বিশিষ্ট কৃষিবিজ্ঞানী ও প্রাবন্ধিক ড. কল্যাণ চক্রবর্তী বলেন, ‘সংস্কৃত’ এক গঙ্গানদী। এক বোধ-গঙ্গা। সংস্কৃত-গঙ্গাকে জোর করে, বাঁধ দিয়ে রাখা হয়েছিল। এই গঙ্গাকে সংস্কৃত-ভারতীর অজস্র ভগীরথ মুক্ত করে মানুষের কাছে আবারও সুখপাঠ্য করছেন, সহজপাঠ্য করছেন, অবগাহনের ব্যবস্থা করছেন। এটি একটি বড় কাজ। আগামীর কাজ আরও বাকি। সংস্কৃতচর্চাকারীদের সংহত হয়ে সেই কাজ করতে হবে৷
ড. চক্রবর্তী বলেন, সংস্কৃত ভাষার মৃত্যু নেই। ভারতবর্ষে এক হাজার বছর ধরে কম চেষ্টা হয় নি, ভাষাটিকে মেরে ফেলার, পুঁথি জ্বালিয়ে দেবার, টোল চতুষ্পাঠী বন্ধ করে দেবার। কিন্তু সংস্কৃত ভাষা বট-অশ্বত্থের ফেকরির মতোন; যতই কাটা হোক, আবার নতুন ফেকরি বা নতুন বিটপ গজিয়ে উঠবে। যে ভাষার মন্ত্রে প্রতিমার প্রাণদান হয়, চক্ষুদান হয়, তা মৃতভাষা হতেই পারে না। বরং সংস্কৃতের বহু পাণ্ডুলিপি পাঠের ব্যবস্থা করে আমাদের সংবিৎ বাড়িয়ে তোলা উচিত।
তিনি আরও বলেন, তামিল আন্দোলনের নামে একসময় সংস্কৃত শব্দগুলিকে অপসারণের প্রয়াস চলেছিল। ইদানীং বাংলাভাষায় সংস্কৃত তৎসম ও তদ্ভব শব্দের ব্যবহার দূরে রেখে অনাবশ্যক বিদেশী শব্দের আকছার ব্যবহার হচ্ছে, সেটাও এক গভীর ষড়যন্ত্রের চিত্রনাট্য। মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য হওয়া উচিত ভাষার মা, ভাষার পিতামহী/ মাতামহীকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়া, নিজের ভাষার ঐতিহ্যে আস্থাশীল হওয়া এবং ভাষার প্রকৃত ইতিহাস জানা। বাংলা যদি আমাদের মাতৃভাষা হয়, সংস্কৃত মাতামহীর ভাষা৷
এই কার্যক্রমে মুখ্যবক্তা রূপে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃত ভারতীর অখিল ভারতীয় সহ-সংগঠন মন্ত্রী শ্রীমন্ত জয়প্রকাশ গৌতমজী। তিনিও শিক্ষার্থীদের আশীর্বচন দেন এবং উদ্যোগে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
প্রস্তুত আলোচনায় ড. কল্যাণ চক্রবর্তীর ভাষণের টেক্সট পরিবেশিত হল।
“সংস্কৃতভারতী দক্ষিণবঙ্গ আয়োজিত সংস্কৃত সম্ভাষণ বর্গের সমারোপ কার্যক্রমে উপস্থিত সকল অতিথিবৃন্দ, আয়োজক, শিক্ষার্থী এবং প্রিয় দর্শক মণ্ডলীকে আমার অন্তরের প্রীতি, শ্রদ্ধা, শুভেচ্ছা ও নমস্কার জানাই।
নমস্কার জানাই আজকের মুখ্যবক্তা তথা সংস্কৃত ভারতীর অখিল ভারতীয় সহ-সংগঠন মন্ত্রী শ্রীমন্ত জয়প্রকাশ গৌতমজীকে৷ নমস্কার সংগঠন সম্পাদক মান্যবর শ্রী প্রণব নন্দ মহোদয়কে।
ধন্যবাদ জানাই ভারত টুডে, ঋতম বাংলাকে, এই মহতী অনুষ্ঠান সম্প্রচার করার জন্য।
আপনারা সংস্কৃত ভাষা শিখলেন, আত্মস্থ করলেন, সংলাপ-কথন চর্চা করলেন। সংস্কৃত ভাষা শিখে শিক্ষার্থী যখন অনুভব করবেন।
“অন্তরে অতৃপ্তি রবে/সাঙ্গ করি’ মনে হবে/শেষ হয়ে হইল না শেষ।”
যেটা রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থে লিখছেন।
সংস্কৃত শেখার আগ্রহ আরও বেড়ে যাবে, উৎসাহ আরও অদম্য হবে, তখনই আমরা প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার একটি আলোকময় সিঁড়িতে পা রাখবো। আজ সংস্কৃতির অবিসংবাদিত অসাম্প্রদায়িক দেবী সরস্বতীর কাছে আমার প্রার্থনা, যেন থেমে না,থাকে, আপনাদের সংস্কৃত ভাষা চর্চা। যেন থেমে না থাকে সংস্কৃত শিক্ষকের গবেষণা, সম্প্রসারণের ইচ্ছা।
আমার মনে হয়, ‘সংস্কৃত’ হচ্ছে এক গঙ্গানদী, গঙ্গাবারি। এক বোধ-গঙ্গা। এক জ্ঞান-গঙ্গা। কারণ এই ভাষার মাধ্যমে রচিত হয়েছে, লিপিবদ্ধ হয়েছে অসংখ্য সংবিৎ, অসংখ্য উপলব্ধি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অজানা বহু তথ্য। যে সময়ে সারা পৃথিবী অজ্ঞানের অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। মানুষ অসভ্য-বর্বর জীবনযাপন করতো, তখনই ভারতবর্ষে রচিত হয়েছিল সংস্কৃতি সাহিত্যের সম্ভার। তার মধ্যে কী না নেই! সে সব কি আমরা ইদানীং পড়েছি। রাশি রাশি পাণ্ডুলিপি তো হয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, না হয় বিনষ্ট করা হয়েছে। এই সংস্কৃত-গঙ্গাকে জোর করে, বাঁধ দিয়ে রাখা হয়েছে, হয়েছিল।
সাধারণ মানুষ তাতে অবগাহন স্নান করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। কেন হয়েছিল, কেন সংস্কৃতকে ব্রাত্য করে রাখা হয়েছিল, তা নিয়ে একদিন গবেষণা হবে। তবে আজ এই জ্ঞান-গঙ্গা, এই বোধ-গঙ্গাকে যারা অজস্র ভগীরথ বানিয়ে রহস্যজাল থেকে মুক্ত করে মানুষের কাছে আবারও সুখপাঠ্য করছেন, সহজপাঠ করছেন, সহজলভ্য করে তুলছেন, সংস্কৃত-গঙ্গায় অবগাহনের ব্যবস্থা করছেন; সংস্কৃত-ভারতীর সেই হাজার হাজার কার্যকর্তা, স্বয়ংসেবককে আমার অন্তরের প্রণতি জানাচ্ছি।
অন্দরে, অন্তরে, অলিন্দে এই যে নিঃশব্দ-বিপ্লব সংস্কৃত শিক্ষার মাধ্যমে হয়ে চলেছে, তা এক ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
সংস্কৃত ভাষাকে ‘মৃতভাষা’ বলে থাকেন কোনো কোনো ভাষাবিজ্ঞানী। কোনো ভাষাকে অশুভ প্রচেষ্টায় মেরে ফেলে, তাকে মৃতভাষা বলা সহজ। আমার কিন্তু মনে হয়, সংস্কৃত ভাষার মৃত্যু নেই। ভারতবর্ষে বিগত এক হাজার বছর ধরে কম চেষ্টা হয় নি, ভাষাটিকে মেরে ফেলার, পুঁথি জ্বালিয়ে দেবার, টোল চতুষ্পাঠী বন্ধ করে দেবার। কিন্তু সংস্কৃত ভাষা বট-অশ্বত্থের ফেকরির মতোন; যতই কাটো না কেন, আবার ফেকরি বা নতুন বিটপ গজিয়ে উঠবে। ব্রিটিশ শাসনের মধ্যেই বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর জন্য লর্ড আমহার্স্টের উৎসাহে ১৮২৪ সালে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ স্থাপিত হয়েছিল, যা আজকের সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশাই সংস্কৃত শিক্ষা নবতর মাত্রা দিলেন। প্রায় দু’শ বছর হতে চললো সংস্কৃত কলেজের।
মনুষ্য-জাতির প্রথম সাহিত্য ও ইতিহাস ঋগ্বেদ সংস্কৃত ভাষায় রচিত। ভারতবর্ষের প্রাচীনতম চিন্তাধারা, সভ্যতাকে জানবার জন্য বেদের মন্ত্রগুলি অপরিহার্য। যেমন ঋগ্বেদের ১০.৮৫ সূক্ত। সেখানে সূর্যের কন্যা সূর্যার সঙ্গে সোমের বিবাহ মূল প্রতিপাদ্য।
প্রাচীন ভারতের বিবাহ পদ্ধতি, তাতে বরবধূর স্থান জানবার জন্য সহায়ক এই সূক্ত। ঋগ্বেদের যুগে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কীভাবে সম্পন্ন হত, তার তথ্য জানা যায় ঋগ্বেদের চারটি সূক্ত থেকে ১০.১৪-১৮.
একইভাবে মানুষের মনে প্রাচীন রাজাদের, লোকোত্তর বীরপুরুষদের, দেবতুল্য মানুষের কাহিনি শোনবার প্রবৃত্তি ছিল। সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ মহাভারত এজন্যই সুসম্পূর্ণ সংকলন হয়েছিল। তাকে স্থায়ীরূপ দিয়ে, পরে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছিল ব’লেই তা সংস্কৃত ভাষায় লিপিবদ্ধ হল।
সংস্কৃত মানে হল সংস্কার-সাধিত, পরিমার্জিত ভাষা৷ সংস্কৃত একটি ক্রিয়া বিশেষণ। যে ভাষার নামের মধ্যেই সংস্কারিত, পরিমার্জিত হবার অর্থ; তার মধ্যে জীবনের ধারাপাত থাকবেই। সে কেন মৃত হবে? সংস্কৃত ভারতের ২২ টি সরকারি ভাষার অন্যতম, সংস্কৃত উত্তরাখণ্ডের অন্যতম সরকারি ভাষা৷ যে ভাষার মন্ত্রে ঈশ্বরের প্রাণদান, চক্ষুদান করা হয়, তা মৃতভাষা হতেই পারে না। সংস্কৃত বহু পাণ্ডুলিপি পাঠ করে আমাদের সংবিৎ বাড়িয়ে তোলা উচিত।
রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “(ভারতের) শোচনীয় আত্মবিচ্ছেদ ও বর্হিবিপ্লবের সময়ে ভারতবর্ষে একটিমাত্র ঐক্যের মহাকর্ষশক্তি ছিল, সে তার সংস্কৃত ভাষা।” সংস্কৃতের প্রাক-বৈদিক রূপ ‘বৈদিক সংস্কৃত’। এই বৈদিক সংস্কৃতের সঙ্গে বহু প্রাচীন ও ধ্রুপদী ভাষার নিকটাত্মীয়। কেবল কাব্য আর নাট্য যে সংস্কৃতের ঐতিহ্য নয়; গণিত, বিজ্ঞান, কারিগরি, দর্শন ইত্যাদিতে সে রচনা সমৃদ্ধ সেটা আমরা ভুলে গেছি।
বিশুদ্ধ তামিল আন্দোলনের নামে একসময় সংস্কৃত শব্দগুলিকে অপসারণের প্রয়াস চলেছিল। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে বাংলাভাষায় সংস্কৃত তৎসম ও তদ্ভব শব্দের ব্যবহার দূরে রেখে যে অনাবশ্যক বিদেশী শব্দের আকছার ব্যবহার হচ্ছে, সেটাও কিন্তু এক গভীর ষড়যন্ত্রের চিত্রনাট্য। ঘটনাক্রমে আগামী ভাষা দিবস। মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য হওয়া উচিত ভাষার মা, ভাষার পিতামহী/ মাতামহীকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়া, নিজের ভাষার ঐতিহ্যে আস্থাশীল হওয়া এবং ভাষার প্রকৃত ইতিহাস জানা। বাংলা যদি আমাদের মাতৃভাষা হয়, সংস্কৃত মাতামহীর ভাষা৷
তাই সকল শিক্ষার্থীকে আজ এই কথাই বলবো, আপনারা সংস্কৃত চর্চাকে এখানেই থামিয়ে দেবেন না। আরও গভীরে, আরও অন্তরে, আরও অন্দরে নিয়ে আসুন। আরও গভীরভাবে সংস্কৃতে অবগাহন করুন। তাকে সমৃদ্ধ করুন, তাকে সম্প্রসারিত করুন। আর সংস্কৃত ভাষাচর্চাকারীদেরও সংহত করুন। সংস্কৃত ভাষায় নাটক রচিত হোক, পথনাটিকা সংগঠিত হোক, চলচ্চিত্র নির্মাণ হোক, মানুষের সুভাষণে সংস্কৃত ব্যবহার তাকে মার্জিত ও সংস্কারিত করে তুলুক।
জয় সংস্কৃতের জয়, জয় মহাভারতের জয়। সংস্কৃত-ভারতীর জয়।”
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
Sanskritabharati, Dakshin Banga and Ritam Bangla Convene a webinar.
সংস্কৃতভারতী দক্ষিণবঙ্গ – ঋতম লাইভ এই রবিবার ২০/০২/২০২২, বিকাল ৩ টা |
Sanskritabharati
Dakshinbanga: Ritam Live on Sunday 20th February 2022 at 3 PM.
বিষয়: সম্ভাষণ বর্গের সমারোপ সমারোহ ।
Topic: SambhashanbargaSamaropSamaroh
স্বাগত ভাষণ: শ্রী রাজকুমার কয়াল : শিক্ষক, পত্রাচার বিভাগ, সংস্কৃতভারতী দক্ষিণবঙ্গ।
Welcome Address: Shri Rajkumar Kayal , Teacher, Patrachar Bivhag
মূল বিষয় উপস্থাপনা:
প্রধানাতিথি:
মাননীয় ড. কল্যাণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক, কৃষি-বিজ্ঞানী ও প্রাবন্ধিক, ।
Hon. Chief Guest: Dr. Kalyan Chakrabarti, Professor, scientist of cultivation and Easy writer :
মুখ্যবক্তা
শ্রী জয়প্রকাশ গৌতম, অখিল ভারতীয় সহ-সঙ্ঘটনমন্ত্রী,সংস্কৃতভারতী ,দিল্লী।
Hon. Speaker: Shri Jayprakash Goutam, Akhilbharat saha-sanghathan Mantri , SanskritaBharati, Delhi