মোঘল কারাগার থেকে রাতের আঁধারে অর্ন্তধান করলেন শিব্বারাও। এবার তাঁকে অনেক দূরে যেতে হবে। কিন্তু আওরঙ্গজেব এখন আঘাত প্রাপ্ত পশুর ন্যায় ক্ষোভে ফুঁসছে। শিবাজী নিজের দাঁড়ি গোঁফ খৌর করে ফেলেছেন। নাইলে শিব্বারাও কে চিনতে মোঘল সেনাদের কতক্ষন? হাতে একটা বাঁশের ফাঁপা লাঠি । তাতে যেটুকু ধন রত্ন কাছে ছিল তা আছে মোম দিয়ে ভর্তি করে। সঙ্গে আছেন গুটি কয় সঙ্গী। এখনি পুনে গেলে চলবে না। দাক্ষিণাত্যে এখন মোঘলরা শ্যেন দৃষ্টি দিয়ে বসে। মথুরা ,হ্যাঁ শ্রী কৃষ্ণ লীলা স্থল মথুরা যাবেন তারপর চলে যাবেন দেবাত্মা হিমালয়ের কোলে। তারপরে সেখান দিয়ে ঘুর পথে পুনে। কিন্তু সঙ্গে কচি শাম্ভ। সে এই গরমে কেমনে নেবে এত পথশ্রম? মথুরা উপস্থিত হয়ে রাত্রি অতিবাহিত করলেন। পরদিন প্রাতে হঠাৎ খুঁজে পেয়ে গেলেন মারাঠার পরিচিত তিন ব্রাহ্মন তীর্থ যাত্রীকে। তাদের সঙ্গে শাম্ভকে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি পুনশ্চঃ রওনা হলেন অজানার উদ্দেশ্যে।
এবার তিনি যাবেন এলাহাবাদ। ত্রিবেণী সঙ্গম। পথে তিনি কখনো ভিক্ষারী ,কখনো নিম্নমানের বৈশ্য , কখনো সন্ন্যাসী – তাঁর ও তাঁর সঙ্গীদের ছদ্মবেশ ধারন করতে হল। দিনে বিশ্রাম , রাতের গভীর আঁধারে পথ চলা। মোঘলদের হাতে ধরা দেওয়া যাবে না।অখন্ড হিন্দু সাম্রাজ্য তাঁকে গঠন করতেই হবে। জয় ভবানী…
এভাবে শিব্বারাও এসে পৌঁছলেন উত্তরপ্রদেশের পূর্ব দিকে। কনৌজ , এলাহাবাদ , বারাণসী হয়ে বিহারের গয়া। কেউ চিনতে পারে না শিব্বা কে। শিব্বা এখন রাজা নন। হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন ভর্তি চোখের একজন সাধারন তীর্থ যাত্রী। পেলে খান না পেলে না খান। নিজের রাজচিত সব ভাবকে তিনি বিসর্জন দিয়েছেন।
এসব অঞ্চলেও যথাসময়ে বাদশাহের ফরমান এসেছে বটে, কিন্তু মহারাষ্ট্রগামী পলাতকের আসবার কথা নয় ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তে। অতএব দক্ষিণাপথের মত এই পথে মোগল সিপাহিগণ অধিক সক্রিয় ছিল না আর শিবাজীও সেটা বিলক্ষণ জানতেন।
তবুও শিব্বারাওকে একদিন চিনতে পেরে গেল ফৌজদার আলী কুলি। ফরমান পেয়েছিল আলী কুলি। ঠিক সেসময় শিব্বারাও এলেন আলীর এলাকায়। বড় অদ্ভুত সুপুরুষ শিব্বা ও তাঁর সঙ্গীরা। সন্ন্যাসী ভিক্ষা করে খায়। তাঁদের এখন সুবলিষ্ঠ দেহ ,এমন রাজচিত রূপ আসে কেমনে? আলী কুলির সন্দেহ হলে। রাতের আঁধারে সেপাইরা তাঁদের আটক করে কারাগারে নিয়ে গেলে। কিন্তু শিব্বা বললেন , “আমি শিবাজী। আমাকে মোঘলদের কাছে প্রেরণ করে আপনি কত উপহার পাবেন? তার দ্বিগুন অর্থ আমি প্রদান করব।”
“কি দেবেন? যদি দিতে পারেন আমি আপনার গমনের পথ প্রশস্ত করব। কিন্তু আপনার তো পোশাক ছেঁড়া ফাটা। ভিক্ষারী আপনি।”
” আমি ভিক্ষারী । কিন্তু ভাগ্য লক্ষী আমাকে ত্যাগ করেন নাই।”
শিব্বারাও একটি অমূল্য হীরা ও একটি দুর্লভ পদ্মরাগ মনি ফৌজদারের হস্তে প্রদান করলেন।
রাতের আঁধারে কারাগার হতে বাহির হয়ে পুনরায় পথ চলা শুরু করলেন শিব্বা। ঊষা কাল আগত হল। শিব্বারাও উপস্থিত হলেন এলাহাবাদ। ত্রিবেণী সঙ্গম। ত্রিবেণীর পবিত্র জলে স্নান সুসম্পন্ন করলেন। এবার পূজাদি প্রদান করে চললেন ভারতের সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক নগরী বারাণসী। বিশ্বনাথে পূজা দেবেন মনে বড় বাসনা। গঙ্গায় পূজা অর্পণ করবেন। দুটি ভোগ খাবেন । মনে বাসনা নিয়ে গঙ্গার তীরে খৌর করলেন । তারপর ডুব দিলেন গঙ্গায়। সবে পূর্ব দিকে রাঙা করে সূর্য নারায়ন পৃথিবীর আঁধার ঘোচাতে শুরু করেছেন। দূর থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ আসছে কানে। এক নয় । একাধিক। কাছেই এক পূজারী ব্রাহ্মন বসে ছিলেন। শিব্বারাও গিয়ে বললেন , ” হে ব্রাহ্মন দেবতা আমি বাবা বিশ্বনাথ ও মা গঙ্গা উভয়কর পূজা দিতে ইচ্ছুক। আপনি বিধি কর্তব্য পালন করান।”
শিব্বারাও যখন পূজা দিতে ব্যস্ত গঙ্গার ঘাটে উপস্থিত হল বিধর্মী মোঘল সেনার দল আর বার্তা বাহক। চিৎকার করে বলতে লাগল , ” শোনো শোনো শোনো , সবাই শোন।মুঘল শত্রু শিবাজী কারাগার হতে পলায়ন করেছে। তাকে যেখানেই দেখবে আমাদের তৎক্ষণাৎ সংবাদ পাঠাবে। ধরিয়ে দিতে পারলে ভালো পুরস্কার আছে। অন্যথা হলে রাজদ্রোহে র জন্য মাথা কাটা যাবে।”
ইতিমধ্যে শিব্বারাও পূজা সমাপন করেছেন। এবার ব্রাহ্মনকে দক্ষিণা দিয়ে প্রনাম করলেন। ” হে ব্রাহ্মণ দেবতা। আমার একটি অনুরোধ। আমি এস্থান পরিত্যাগ করবার পরেই আপনি আপনার দক্ষিণা অবলোকন করবেন। তার আগে নয়।” ব্রাহ্মন বললেন , ” তথাস্তু।” শিব্বা আবার চলতে শুরু করলেন। শিব্বা দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেলে পূজারী দক্ষিণার ছোট্ট পুঁটুলি খুললেন। অবাক হয়ে গেলেন ? এত গুলি স্বর্ণ মুদ্রা? কে ছিলেন তাঁর যজমান? নাঃ পূজারী কাউকেই শিব্বারাও এর কথা জানান নি। পূজারী নিজে সেদিন ধন্য হয়েছিলেন শিব্বা কে যজমান পেয়ে।
এরপর শিব্বা গেলেন গয়া ধাম। কাশী ধাম ছেড়ে গয়া। ক্রোশ থেকে ক্রোশ পদব্রজে অতিক্রম। যখন তিনি গয়াতে বিষ্ণুর পূজা দিতে ব্যস্ত ,সংবাদ এল তাঁর কানে। মোঘলরা পাহাড়ি ইঁদুরকে পুনশ্চঃ বন্দী করার আশা টুকুও পরিত্যাগ করেছে। মরুভূমিতে মরীচিকা আর মারাঠায় শিবাজী এখন সমার্থক মোঘলদের নিকট। শিব্বা উপলব্ধি করলেন এই হলহিন্দু সন্তানের তাঁর স্বদেশে প্রত্যাগমনের সুবর্ণ সুযোগ। শুরু হল বিহার থেকে দক্ষিণ পশ্চিম দিকের সুদূর পথে যাত্রা….
শিবাজির রাজত্বে একটা গিরিপথও সুরক্ষাহীন ছিল না। একটা গিরিশীর্ষও দুর্গহীন ছিল না। প্রত্যেকটি তালুক বা অঞ্চলে ছিল এক বা একাধিক রক্ষাকর্তা। সমগ্র রাজ্য জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে ছিল দুর্গ আর দুর্গ। শিবাজির রাজ্যে পুরনো ও নতুন মিলিয়ে দুশো চল্ল়িশটি দুর্গ ছিল। দুর্গগুলি কেবল পাহাড় বা জঙ্গল জুড়ে ছিল তা নয়, ছিল নৌবাহিনীর উপযোগী উপকূলবর্তী দুর্গও।
দুর্গ নির্মাণের স্থান নির্বাচনেও খুব সাবধানতা অবলম্বন করা হত। উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় যেখানে খাড়া রাস্তা উঠে গেছে এঁকেবেঁকে—সেই সব স্থান দুর্গ নির্মাণের আদর্শ হিসেবে গণ্য হত। থাকত বিশাল দুর্গপ্রাকার, যার জায়গায় জায়গায় থাকত সশস্ত্র প্রহরা। দুর্গগুলিতে শস্য মজুতের ব্যবস্থা থাকত সেনা ও অন্য আবাসিকদের জন্য। থাকত তেল ও ঘিয়ের সঞ্চয়। আর সুব্যবস্থা থাকত পানীয় জলের —এ জন্য প্রতিটি দুর্গেই ছিল অনেকগুলো করে তালাও।
এই সব দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এত জোরদার ছিল যে ১৬৮০ সালে শিবাজির মৃত্যুর পর এক-একটি দুর্গ জয় করতে মুঘলদের প্রচুর অর্থ, লোকবল ও সময় ব্যয়িত হয়েছে। শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য দুর্গজালিকা নিমাণ—এ শিবাজি মহারাজের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে।
মহারাষ্ট্রে শিবাজি মহারাজকে ভগবান জ্ঞানে পুজো করা হয়। এক জন মানুষের মধ্যে যদি এত অতি-মানবীয় গুণের প্রকাশ ঘটে, তবে তিনি সাধারণের কাছে দেবতায় উন্নীত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ শিবাজী : যদুনাথ সরকার