ষোলো বছর আগের কথা। ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাস। কলকাতা থেকে বদলি হয়ে সবে দিল্লি গিয়েছি। সাংবাদিক হিসাবে একেবারেই নবীন। মহাকরণের বারান্দা, তার ঘরও সব চিনে উঠতে পারিনি। তুলনায় দিল্লি, আড়ে বহরে অনেক বড় ব্যাপার। খাল থেকে সমুদ্রে পড়ার মতোই।
ইদানীং টিভির সঙ্গে যে সেট টপ বক্স ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে, সে সময়ে তা নিয়ে বেশ টানাটানি দিল্লিতে। একদিকে টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি (ট্রাই)। বিপরীতে কেবল অপারেটর, টিভি চ্যানেলগুলোর মালিক। আর মাঝে সরকার তথা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক।
মাস্টারমশাইয়ের মতো তখন রোজ সকালে-বিকেলে বরুণবাবু (বর্তমান পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক প্রয়াত সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত) বোঝাতেন কোন খবর কতটা গুরুত্ব দিয়ে জানতে হবে। মনে পড়ে, দিল্লি যাওয়ার পর পরই উনি একদিন সকালে ফোন করে বললেন, সেট টপ বক্সের ব্যাপারটা (কন্ডিশনাল অ্যাকসেস সিস্টেম- ক্যাস) যতটা বিশদে পারবে খোঁজ নেবে। তার পর গুছিয়ে লিখবে।
একে সম্পাদকের নির্দেশ, তার উপর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের অফিস, ‘শাস্ত্রী ভবন’ বাড়িটা ছাড়া তখন কিছুই চিনি না। সরকারের কাকে জিজ্ঞাসা করব, সচিব বা তাঁর অধস্তন কারও সঙ্গে দেখা করতে পারব কিনা কোনও ঠিক নেই। মেঘ না চাইতেই জলের মতো দুপুরে জানা গেল, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বিকেলে ‘ক্যাস’ নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করবেন।
সুষমা এলেন। তার পরের পনেরো মিনিট গড় গড় করে গোটা বিষয়টা যে ভাবে ব্যাখ্যা করলেন, ফিরতি প্রশ্ন করার সুযোগ কম। যেন জানতেন কী প্রশ্ন আসতে পারে। সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখে প্রকাশ করা কঠিন বইকি। কোনও মন্ত্রীর তাঁর মন্ত্রকের বিষয় নিয়ে এতটা স্পষ্ট ও স্বচ্ছ ধারনা থাকতে পারে, আমলাদের কোনওরকম সাহায্য না নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে তস্য টেকনিক্যাল বিষয় এতো খুঁটিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারেন— আগে দেখিনি। পরেও বিশেষ দেখিনি।
সাংবাদিক সম্মেলন হয়ে যাওয়ার পর আমাদের সাত-আট জনকে সুষমা ডেকে নিলেন তাঁর ঘরে। বললেন, চলো খেতে খেতে বাকি আড্ডা হবে। সেই প্রথম তাঁকে অত কাছ থেকে দেখা, শোনা! একজন মন্ত্রী অত সহজ, সাবলীল ভাবে মিশতে পারেন, ধারনাও ছিল না।
মঙ্গলবার রাতে সুষমা স্বরাজের মৃত্যু হয়েছে। শোনার পর থেকেই খারাপ লাগছে। কিছু দিন আগে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির মৃত্যুর পর এতটাই খারাপ লেগেছিল। প্রিয়দার মতোই সুষমাও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। দিল্লিতে সাংবাদিক মহলে সবাই প্রিয়দা-কে বলতেন, ‘মিডিয়া ডার্লিং’। সুষমাও তাই। অপ্রিয় প্রশ্ন শুনেও কখনওই মেজাজ হারাতে দেখিনি। যেন বড় দিদি-র মতো।
জাঠ সম্প্রদায় অধ্যুষিত হরিয়ানায় জন্ম সুষমা-র। পড়াশুনাও সেখানে। কিন্তু শাড়ি, কপালে বড় টিপ, সিঁদুর আর টান টান করে বাঁধা চুলে সুষমার মধ্যে যেন একটা বাঙালি ঘরানার ছাপ ছিল। সোম থেকে রবি তাঁর রাশি অনুযায়ী রঙ মিলিয়ে শাড়ি পরতেন। কখনও হেরফের হয়নি।
২০০৩ সালের ওই জানুয়ারি মাসেই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক থেকে সুষমাজিকে সরিয়ে কেন্দ্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রী করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। পদোন্নতি বলা যায়। মনে পড়ে, সে বছরই সার্স-এর সংক্রমণ শুরু হয়েছিল এ দেশে। নির্মাণ ভবনের তাঁর অফিসে তখন নিয়ম করে রোজ বিকেলে আমাদের সঙ্গে দেখা করতেন সুষমাজি। প্রয়োজনে রবিবারও। কোথায় কী ভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, সরকার কী করছে, কোথায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে, হিসেব পরিসংখ্যান সব যেন ঠোঁটস্থ ছিল তাঁর। এও মনে পড়ে, সে সময়েই কোনও একদিন বিকেলে আড্ডার পর আলাদা করে ডেকে বলেছিলেন, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজকে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেসের স্তরে উন্নীত করব আমরা। চাইলে খবর করতে পারো। শিগগির কলকাতায় গিয়ে বুদ্ধদেববাবুর সঙ্গে কথা হবে।
রাজনীতিক সুষমা স্বরাজ বরাবর ক্ষুরধার। সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক যোগ ছিল। অনেকে বলেন, সুষমা-র রাজনৈতিক সম্ভাবনার কথা গোড়াতেই জহুরির মতো চিনে নিয়েছিলেন জর্জ ফার্নান্ডেজ। সুষমা তখন সুপ্রিম কোর্টে জুনিয়র আইনজীবী। পরে মাত্র ২৫ বছর বয়সে হরিয়ানায় জনতা সরকারের মন্ত্রী হওয়া এবং সেখান থেকে ক্রমশই জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর উত্থানের কাহিনী শুনতে রূপকথার মতো হলেও, তা নয়। গোটাটাই তাঁর অধ্যবসায় ও নিষ্ঠা।
সুষমার ব্যাপারে সে জন্য বরাবরই স্নেহশীল ছিলেন বাজপেয়ী-আডবাণী। সংসদের ভিতরে বাইরে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বক্তৃতায় এগিয়ে দিতেন তাঁকে। প্রমোদ মহাজনের সঙ্গে যেন এ ব্যাপারে সমানে টক্কর ছিল তাঁর। বিষয়ের উপর দখল থাকায় বক্তৃতায় সুষমা শুধু সাবলীল ছিলেন তা নয়, রাজনৈতিক ভাবে ক্ষুরধারও ছিলেন বটে। রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রশ্নে আপোসহীন এবং আগ্রাসী। বিদেশিনী প্রশ্নে সনিয়া গান্ধীর বিরোধিতায় তিনি যে মাথা মুড়িয়ে ফেলার কথা বলেছিলেন, তাঁর পরিজনেরা বলতেন তাতেও কৌশলের তুলনায় আবেগই ছিল বেশি।
তা নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সে জন্য পরে সনিয়া গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলেন সুষমা। ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন। এ হেন আচরণের জন্য দল নির্বিশেষে এই ‘সেরা সাংসদের’ গ্রহণযোগ্যতা ছিল অসীম।
দ্বিতীয় মনমোহন সরকারের সময়ে লোকসভায় বিরোধী দলনেত্রী ছিলেন সুষমা। পরে মোদী সরকার গঠনের পর বিগ-ফোরে নিজগুণে জায়গাও হয়েছিল তাঁর। যদিও হয়তো কোথাও একটা অভিমান ছিল। তা হয়তো পদের জন্য নয়। তিনি বিদেশমন্ত্রী হলেও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকেই যাবতীয় নির্ধারিত হত। তৎকালীন বিদেশ সচিব জয়শঙ্করও ছিলেন ‘ম্যান অফ মোদী’। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী এতো সক্রিয় হলে বিদেশ মন্ত্রীর প্রাসঙ্গিকতা যে কমে যায়, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
সেই অভিমান বাইরে কোনও ভাবে প্রকাশ করেননি সুষমা। বরং হয়ে উঠেছিলেন সাধারণের বিদেশমন্ত্রী। টুইটার ও সোশাল মিডিয়ায় সক্রিয় থেকে মানুষের ত্রাতা হয়ে উঠেছিলেন। কোথাও কারও পাসপোর্ট খোয়া গিয়েছে, কেউ ভিসা পাচ্ছেন না, কেউ বিদেশে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন- বিদেশমন্ত্রীকে ট্যাগ করে একটা টুইট করলেই হল। তিনিই মুশকিল আসান। তাতে ব্যক্তি সুষমা স্বরাজের জনপ্রিয়তা পৌঁছে গিয়েছিল অন্যমাত্রায়।
সোমবার রাত থেকে টুইটারে দুঃখপ্রকাশ ও শোক জ্ঞাপনের ঢলেই তার প্রমাণ মিলেছে।
বিজেপি-র অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও সুষমা ছিলেন সম্পদ। গেরুয়া শিবিরে তিনিই প্রথম মহিলা, যিনি দুর্গম পথ পেরিয়ে এই রাজনৈতিক উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন।
লুটিয়েন দিল্লি, রাইসিনা পাহাড়, সংসদ ভবন— তার রাজনীতি সুষমাজিকে মিস করবে। মিস করবেন বহু সাংবাদিকও।