তাম্রলিপ্ত রাজ্যের কিছু ইতিহাস – দ্বিতীয় পর্ব


শিখিধ্বজ রাজা তবে নিজ অশ্ব লয়ে।

যজ্ঞ করিলেন যুধিষ্ঠির আজ্ঞা পেয়ে।।

যত আয়োজন ধর্ম্ম হইতে পাইল ।

তুষ্ট হইয়া শিখিধ্বজ যজ্ঞ সমাপিল।।


যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞ শেষ হলে পুরোহিত ধৌম দক্ষিণা পাওয়া পর, দ্বিতীয় অশ্বমেধ যজ্ঞ শুরু করলেন। তাম্রলিপ্ত বা রত্নাবতীপুরের মহারাজ ময়ূরধ্বজ আপন অশ্ব বহন করে যজ্ঞভূমিতে নিয়ে আসেন।
শিখিধ্বজ বীরব্রহ্মা গেল নিজপুরে।

মণিভদ্র চলিলেন আপন নগরে।।
যজ্ঞ শেষ হলে ময়ূরধ্বজ পুনরায় তাম্রলিপ্তে ফিরে যান।


এই ঘটনা প্রমাণ করে যে যুধিষ্ঠিরের হস্তিনাপুর  রাজ্য এবং ময়ূরধ্বজের তাম্রলিপ্ত বা রত্নাবতীপুর রাজ্য ধনে, মানে ও অনুশাসনে সমপর্যায়ে ছিল। কি ভাবে ? এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে আমাদের অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্বের যাত্রা পথের কিছুটা অনুসন্ধান করা যাক। কাশীদাসী মহাভারতকে যে যতই লৌকিক মহাভারত ইত্যাদি বলুন না কেন, কাশীদাসী মহাভারতের রচনা আজও কিন্তু ঐতিহাসিক প্রামাণ্য হিসাবে গ্রহণ করা হয় , যেমন করা হয় বাল্মীকি রামায়ণকে , আবার যেমন করা হয় বশিষ্ঠ, অদ্ভুত, সুন্দর, পাম্বন ইত্যাদি লৌকিক রামায়ণকে। কারণ লৌকিক রামায়ণগুলিতে নানা প্রক্ষিপ্ত অংশ যুক্ত হলেও তৎকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, নানা লৌকিক আচার নিয়ম, ভাষা ইত্যাদি বহু তথ্য প্রাপ্ত হয়। তো, কাশীদাসী মহাভারত মতে, হস্তিনাপুরের যজ্ঞের ঘোড়া উত্তর থেকে দক্ষিণে মাহেষ্মতীপুরীতে প্রবেশ করে।
কহেন বৈশম্পায়ন, শুন জন্মেজয়।

দক্ষিণ দিকেতে গেল পাণ্ডবের হয়।।

পশ্চাতে চলিল সৈন্য নানা অস্ত্র ধরি।

প্রবেশ করিল গিয়া মাহেষ্মতীপুরী।।


সেখানের রাজা ছিলেন #নীলধ্বজ_রায়। তাঁর দুর্বিনীত পুত্র প্রবীর। প্রবীরের প্রধানা স্ত্রী মদনমঞ্জরীর অনুরোধে প্রবীর যজ্ঞের ঘোড়া আটক করেন। ফলে , অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবীর পরাজিত এবং নিহত হন। নীলধ্বজের স্ত্রী ছিলেন #জনা এবং কন্যা ছিলেন #স্বাহা। স্বাহার স্বামী ছিলেন #অগ্নি বা #বৈশ্বানর। কথিত আছে, মহালক্ষ্মীর শাপে জনার গর্ভে বসুমতি অর্থাৎ ধরণী স্বাহা রূপে জন্মগ্রহণ করেন। এই বংশেই জয়ধ্বজ, তালজঙ্ঘ, বিতীহোত্র, মধুধ্বজ প্রমুখ খ্যাতিমান রাজা তথা মহারথী জন্মগ্রহণ করেন। এঁরা প্রত্যেকেই বিষ্ণুভক্ত ছিলেন। মধু বা মধুধ্বজের স্মরণে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে মাধব বলতেন। মধু বা মধুধ্বজের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন বৃষ্ণি। এই বৃষ্ণির স্মরণে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং নিজেকে #বার্ষ্ণেয় বলতেন।


কালযবন অত্যন্ত অত্যাচারী এবং অহংকারী ব্যক্তি ছিলেন । এই কালযবন একটা সময় নিজের রাজ্যে দাপিয়ে বেরিয়ে ছিলেন। সম্মুখে কোন ব্রাহ্মন কে দেখলেই জিজ্ঞেস করেতেন  , “এমন বীর  কে আছে যার সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় ? ” ……..একদিন নারদ কে সামনে পেয়ে সেই প্রশ্ন করলেন..তখন তার প্রশ্নের উত্তরে নারদ মুনি বলেছিলেন ” তোমার উপযুক্ত যুদ্ধবীর হলেন #বৃষি যাদবেরা…”  ” #বৃষ্ণয়ন্ধককুলং তস্য নারদেন নিবেদিতম”।

 সমগ্র চতুর্বর্ণের সনাতনীদের প্রাতঃস্মরণীয় #মাহিষ্যকুলতিলক মহারাজ #কার্তবীর্যার্জুন ছিলেন যযাতি পুত্র যদুর বংশধর। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন চন্দ্রবংশের মহারাজ যযাতি জ্যেষ্ঠ পুত্র যদুর বংশের অধঃস্তন পুরুষ।


কার্তবীর্যার্জুনের ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ ছিলেন মহারাজ #মহিষ্মান। তিনিই মহিষীবংশ তথা মাহিষ্যবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। শিখিধ্বজ বা ময়ূরধ্বজ এই বংশের অধঃস্তন পুরুষ ছিলেন। সেই কারণেই শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছাতে এবং যুধিষ্ঠিরের অনুমতিক্রমে হস্তিনাপুরে একই দিনে দুটি অশ্বমেধ যোগ্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল। 


মাহিষ্মতীপুরের উপরই পরশুরাম প্রথম আক্রমণ করেন। সেই কারণেই ময়ূরধ্বজের পূর্বপুরুষ নর্মদার তীর থেকে উদ্বাস্তু হয়ে পূর্ব ভারতের মেদিনীপুর তমলুক অঞ্চলে নতুন রাজধানী স্থাপন করেছিলেন এবং পরে উত্তরাধিকার সূত্রে মাহিষ্মতীপুর রাজ্যের -বর্তমান ওঙ্কারনাথধাম রাজ্যের কিছু অংশের রাজা হয়েছিলেন বলে অনুমান করা হয়। কেদারনাথ মিশিরও তাঁর রচনায় সেকথা বারংবার উল্লেখ করেছেন। আপনারা তাঁর লেখা  The Mahishyas and Their Bhahmins পড়ে দেখতে পারেন।

মনে রাখতে হবে যে,  মহাভারতের যুদ্ধে বহু শত বর্ষ পূর্বেই মাহিষ্য জাতির উদ্ভব ঘটে। বেদেও এই জাতির উল্লেখ আছে। এদের পদবিগুলিও প্রাচীন শাসক শ্ৰেণীর। 


 মাহিষ্য জাতির উদ্ভব নর্মদাতীরের মাহিষ্মতীপুর রাজপরিবার থেকেই। মাহিষ্য শব্দটির অর্থ হলো #মহানবংশ জাত। ঋগ্বেদীয় #মহিষ শব্দ হতে উদ্ভূত মাহিষ্য শব্দ। যার অর্থ হলো মহান বা মহৎ। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় #টি_গ্রিট। এর জন্য আপনারা বাঙ্গালার ইতিহাস, শ্রী গদাধর কোলে রচিত গ্রন্থটি পড়তে পারেন। 
কপিল সাংখ্য দর্শনে মহৎ তত্ত্বকে মহিষ তত্ত্বও বলা হয়েছে। অখণ্ড বঙ্গে মহিষ পদবী এবং মহিষ শব্দ যোগে নানা গ্রামনাম বহু প্রাচীন কাল হতে প্রচলিত। মহিষ বা মাহিষিক বা মাহিষক রাজ্যও প্রাচীন ভারতে সুবিখ্যাত ছিল। গান্ধারের নিকটেও মাহিষিক নামক একটি রাজ্যের কথা জানা যায়। দক্ষিণ ভারতেও মাহিষ বা মাহিষক রাজ্যের উল্লেখ মহাভারতের সময়কাল হতে প্রসিদ্ধ।


তত্রাপি দ্রাবিড়ৈরান্ধ্রৈ, রৌদ্র‍্যর্মাহিষকৈরপি।

তথা কোল্লগিরেয়ৈশ্চ যুদ্ধমাসীৎ কিরীটিনাঃ।।

অর্থাৎ, এই স্থানেও ভীষণ প্রকৃতির দ্রাবিড়, অন্ধ্র, মাহিষ বা মাহিষক ও কোল্লগিরিদেশীয় বীরগণের সহিত অর্জুনের যুদ্ধ হল।
উল্লেখ্য এই স্থানে উল্লেখিত মাহিষক রাজ্যটি বর্তমানে কর্ণাটে অর্থাৎ কর্ণাটকে অবস্থিত। অদ্যপি যার নাম মহীশূর বা মাইসোর। এখানে অপর একটি জনপদ ব্যাঙ্গালোর। যেখানে #গৌড় নামক এক প্রাচীন জাতির বাস। এঁরা গৌড়কে উপাধি রূপে ব্যবহার করেন।


কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধেও মাহিষ্য বাহিনী কলিঙ্গ বাহিনীর পাশাপাশি যুদ্ধ করেছে। তাম্রলিপ্তের যুবরাজ তাম্রধ্বজ দুর্যোধনের পক্ষে ছিলেন। যদিও ময়ূরধ্বজ বা শিখিধ্বজ নিজে ছিলেন পরম বৈষ্ণব এবং কৃষ্ণভক্ত। নারায়ণরূপী শ্রীকৃষ্ণ উভয় পক্ষকেই নারায়ণী সেনা দান করেন।
 মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের সৈন্য ছিল ৭ অক্ষৌহিণী আর কৌরব দের ছিল ১১ অক্ষৌহিণী সৈন্য। তবে কৃষ্ণ উভয় দলের আবেদন রক্ষাহেতু অস্ত্রধারণ না করার প্রতিজ্ঞা করে পাণ্ডবদের পরামর্শদাতা রূপে নিজে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দেন এবং কৌরবপক্ষে দ্বারকার দুর্জয় নারায়ণী সেনা দান করেন। আপাতদৃষ্টিতে এতে কৌরবপক্ষই লাভবান হলেও স্বয়ং ধর্মরক্ষক ভগবান কৃষ্ণ নিজে পাণ্ডবপক্ষে থাকায় তারাই লাভবান হয়।


অক্ষৌহিণী হল প্রাচীন ভারতীয় রাজ্যসমূহে বা প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থে বর্ণিত সেনাশক্তি বিশেষ। যে সেনাদলে- ১,০৯,৩৫০ সংখ্যক পদাতিক সৈন্য, ৬৫,৬১০ সংখ্যক অশ্ব ও অশ্বারোহী সৈন্য, ২১,৮৭০ সংখ্যক গজ (হাতি) ও গজারোহী সৈন্য, ২১,৮৭০ রথ ও রথী থাকবে, তাকেই এক অক্ষৌহিণী বলা হবে। এক অক্ষৌহিণী সৈন্যদল গঠিত হতো বিভিন্ন একক সংখ্যক সৈন্যদল দ্বারা। নিচে এই সেনাশক্তির এককসমূহের বিবরণ তুলে ধরা হলো।


পত্তি : ১ গজ ও গজারোহী, ১ রথ ও রথী, ৩ অশ্ব ও অশ্বারোহী এবং ৫ পদাতিক।

সেনামুখ : পত্তির তিনগুণ। অর্থাৎ ৩ গজ ও গজারোহী, ৩ রথ ও রথী, ৯ অশ্ব ও অশ্বারোহী এবং ১৫ পদাতিক।

গুল্ম : সেনামুখের তিনগুণ। অর্থাৎ ৯ গজ ও গজারোহী, ৯ রথ ও রথী, ২৭ অশ্ব ও অশ্বারোহী এবং ৪৫ পদাতিক।

গণ : গুল্মের তিনগুণ। অর্থাৎ ২৭ গজ ও গজারোহী, ২৭ রথ ও রথী, ৮১ অশ্ব ও অশ্বারোহী এবং ১৩৫ পদাতিক।

বাহিনী : গণের তিনগুণ। অর্থাৎ ৮১ গজ ও গজারোহী, ৮১ রথ ও রথী, ২৪৩ অশ্ব ও অশ্বারোহী এবং ৪০৫ পদাতিক।

পৃতনা : বাহিনীর তিনগুণ। অর্থাৎ ২৪৩ গজ ও গজারোহী, ২৪৩ রথ ও রথী, ৭২৯ অশ্ব ও অশ্বারোহী এবং ১২১৫ পদাতিক।

চমূ : পৃতনার তিনগুণ। অর্থাৎ ৭২৯ গজ ও গজারোহী, ৭২৯ রথ ও রথী, ২১৮৭ অশ্ব ও অশ্বারোহী এবং ৩৬৪৫ পদাতিক।

অনীকিনী : চমূর তিনগুণ। অর্থাৎ ২১৮৭ গজ ও গজারোহী, ২১৮৭ রথ ও রথী, ৬৫৬১ অশ্ব ও অশ্বারোহী এবং ১০৯৩৫ পদাতিক।

অক্ষৌহিণী : অনীকিনীর দশগুণ। অর্থাৎ ২১৮৭০ গজ ও গজারোহী, ২১৮৭০ রথ ও রথী, ৬৫৬১০ অশ্ব ও অশ্বারোহী এবং ১০৯৩৫০ পদাতিক।


কাশীদাসী মহাভারতে দুর্যোধনের পক্ষে সাতকোটি নারায়ণী সেনা লড়াই করেছিলেন বলে জানা যায়। 
নারায়ণী সেনা যদি পাই কোটিসাত

করিব তুমুল যুদ্ধ পাণ্ডবের সাথ।।


এই সেনা বাহিনীর মধ্যে কলিঙ্গ এবং মাহিষ্য সেনাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন প্রশ্ন করুন যেখানে ময়ূরধ্বজ বা শিখিধ্বজ যেখানে স্বয়ং বিষ্ণুভক্ত ছিলেন , সেখানে তিনি কেন পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন?

ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. কাশীদাসী মহাভারত
২. চন্দ্রবংশের ধারায় মহারাজ শশাঙ্কের অনুসন্ধান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.