হায় প্রেম – তুমি রিক্ত কেন বলো?

আলিপুর বোমা মামলার বিচারের রায় বেরিয়েছে | উল্লাসকর দত্ত আর বারীনের ফাঁসির সাজা হয়েছে | উল্লাস অবশ্য ভাবলেশহীন | এজলাসে দাঁড়িয়ে হা-হা করে হাসতে হাসতে পাশে দাঁড়ানো বিভূতি সরকারের গায়ে একটা চিমটি কেটে বলছে,”যাক,বাঁচা গেল।” উল্লাসকে হাসতে দেখে বিচারক বলে উঠলেন অর্ডার অর্ডার | উল্লাসের অট্টহাসি থামল না | কজন ইউরোপীয় সার্জেন্ট ব্যাটন উঁচিয়ে উল্লাসের দিকে তেড়ে গেল।ব্যারিস্টার নর্টনকে পাশে দাঁড়িয়ে একজনকে বলতে শোনা গেল,”Look,Look! The man is going to be hanged and be laughs ।” উল্লাস গেয়ে উঠল বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান | এরই মধ্যে পুলিশ সকল অভিযুক্তদের লকআপ ভ্যানে তুলে আলিপুর জেলে নিয়ে যেতে তৎপর হল | উল্লাস গেয়ে উঠল সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে |

খবর পৌঁছালো বিপিনবাবুর মেয়ে লীলার কাছেও । খবর পেয়েই লীলা আত্মহত্যা করতে চেয়ে আফিম খেল। শেষমেশ কবিরাজের চিকিৎসায় সুস্থ হল | কে এই লীলা ? বিপ্লবী বিপিনচন্দ্র পালের ছোট মেয়ে সে | ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার কাজের জন্যে বিপিনবাবুর কাছে যেতেন উল্লাস | সেই সূত্রেই লীলার সঙ্গে আলাপ উল্লাসের | ধীরে ধীরে যা পরিণত হয় ভালোবাসায় | দুজনের বিয়েও হবে ঠিক ছিল | এরই মাঝে উল্লাস বারীন ঘোষের সংস্পর্শে আসে | সশস্ত্র বিপ্লবে যোগ দেয় সে | শিবপুরের কোয়ার্টারে উল্লাসের বাবার নিজস্ব একটা লাইব্রেরী ও ল্যাবরেটরি ছিল।উল্লাস লাইব্রেরি ঘেঁটে বিস্ফোরক তত্বের ওপর লেখা অনেক বিদেশি বই পায়।সেসব পড়ে বোমা তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে নিজের জ্ঞান বাড়ায়।আর বাবার ল্যাব থেকে বোমার মালমশলা সংগ্রহ করে,যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পিকরিক এসিড আর ক্লোরেট অব পটাস । কয়েকদিনের মধ্যেই বোমা বানিয়ে ফেলে উল্লাস | বিভিন্ন জায়গায় বিপ্লবীরা সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করে | কিন্তু ততদিনে ব্রিটিশ পুলিশ তৎপর হয় | আলিপুর বোমা মামলায় গ্রেফতার হয় অরবিন্দ ঘোষ,বারীন ঘোষ,উল্লাসকর দত্ত,কানাইলাল দত্ত ও আরও অনেকে | সেই মামলাতেই প্রথমে ফাঁসির আদেশ হয় উল্লাসকর দত্তের |

এদিকে মেয়েকে মানসিকভাবে সুস্থ করতে বিপিনবাবু লীলাকে নিয়ে গেলেন পাঞ্জাব | কয়েকদিন পর খবর এল পাঞ্জাবেই এক পাত্রের সাথে লীলার বিয়ে দিয়ে দিলেন বিপিনবাবু | এদিকে মায়ের জেদাজেদিতে উল্লাস আপিলে সই করল | ফাঁসির সাজা বদলে গেল দ্বীপান্তরের সাজায় | সংসার পেতে ফেলেছে লীলা আর উল্লাস তখন আন্দামান সেলুলার জেলের নির্জন কুঠুরিতে রাত কাটায় | সেখানেই উল্লাস লীলার বিয়ের খবর পায় | উল্লাস তিনদিন কারো সাথে একটাও কথা বলল না | খাবার থালাও উল্টে দিল | একদিকে জেলে অকথ্য অত্যাচার আর অন্যদিকে লীলাকে হারানোর যন্ত্রনায় উন্মাদের মত হয়ে গেল উল্লাস | একদিন সকলে দেখল উল্লাস উন্মাদের মতো তলোয়ার খেলার ভঙ্গিতে হাত ঘোরাচ্ছে আর দেওয়ালে জোরে জোরে ঘুসি মারছে | উল্লাসের চোখ লাল | হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে | উল্লাস পাগল হয়ে গেল |

উল্লাসকে মাদ্রাজের মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হল | দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর একটু সুস্থ হল সে | ১৯২০ সালে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায় সে | কিন্তু হারিয়ে গেল পুরোনো উল্লাস | শুরু হল বেঁচে থাকার লড়াই | একের পর এক ব্যবসায় ব্যর্থ হলেন উল্লাস | সাইকেল চালিয়ে উল্লাস চলে গেল পন্ডিচেরী | অরবিন্দ ঘোষের কাছে | কিন্তু সেখানেও জায়গা হল না উল্লাসের | বিপ্লবী মানুষটি একের পর এক হার মানতে লাগলো জীবন সংগ্রামের ময়দানে |

কিছু বন্ধু বিপ্লবীর চেষ্টায় ব্রাহ্ম সমাজের সিঁড়ির নিচের ঘরে থাকার জায়গা পেলেন | বাবা-মা একে একে মারা যাবার পর উল্লাস এখন ভবঘুরে | হঠাৎ একদিন কালীঘাটের কাছে তার দেখা হয়ে গেল বিপিনবাবুর মেজো ছেলে জ্ঞানাঞ্জনের সাথে | তার কাছ থেকেই উল্লাস জানতে পারে লীলার বিধবা হওয়ার খবর | জ্ঞান বলল,”জানো উল্লাসদা,এখনো তোমার কথা আলোচনা হলে দিদি সবার অজান্তে কাঁদে।” উল্লাস ঘরে ফিরে আসে | কয়েকদিন পর খবর পায় লীলা খুব অসুস্থ, পি জি হাসপাতালে ভর্তি | উল্লাস ছুটে যায় সেখানে | লীলাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় | শেষপর্যন্ত লীলা বিয়ে করতে রাজি হলো উল্লাসকে। ব্রাহ্ম মতে যখন তাদের বিয়ে হলো তখন উল্লাস ৬৪ আর লীলা ৬১ | বিয়ের পিঁড়িতে বসে উল্লাস গাইলো-“আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়, আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথ যে জন ভাসায়।” যখন তিনি বিয়ে করছেন তখন তাঁর প্রেম একপ্রকার শয্যাশায়ী, পরে হয়ে যান পঙ্গু। এদিকে বিধবা বিয়ে .. তাই জায়গাও কেউ দিল না। যৌবন পেড়িয়ে যাওয়া দুই প্রেমিক নব দম্পতি – একজন নি:স্ব সমাজ চ্যুত প্রেমিক অপরজন তাঁর পঙ্গু প্রেমিকা। আর যেদিন বিয়ে হ’ল সেইদিনই প্রেমিকাকে ভর্তি করতে হ’ল হাসপাতালে।

কিছুদিন পর স্ত্রী কিছুটা সুস্থ হলে উল্লাস স্ত্রী কে নিয়ে চলে যান দেশের বাড়ী শ্রীহট্টে | উল্লাসকর পাগলের মতো সেবা করেছেন অসুস্থ পঙ্গু স্ত্রী’র। কোনও সরকারী সাহায্য তিনি নিতে চাননি। ১৯৪৮ সালে ভারত সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদানের জন্য ভাতা মঞ্জুর করলে, তিনি তা অস্বীকার করেন। ১৯৫১ সালে দুজনে চলে আসেন শিলচর | শিলচরের মানুষই তখন তাঁদের থাকা-খাওয়া-চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আর তাঁর বিপ্লবী বন্ধুরাই নিয়মিত অর্থ সাহায্য করে গেছেন। ১৯৬২ সালে মারা যান স্ত্রী | উল্লাস বিশ্বাস করতেন না | ঘরের দরজা বন্ধ রাখতেন না, খোলা রাখতেন .. বলতেন, দরজা বন্ধ দেখলে যদি স্ত্রী ফিরে যান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের খাবার থেকে এক ভাগ স্ত্রীর নামে রাখতেন, যদি স্ত্রী ফিরে এসে খেতে চায়। এগুলো বাস্তব ঘটনা, সিনেমার গল্প নয় | ভাবা যায় !

১৯৬৫ সালের ১৭ মে মারা যান উল্লাসকর দত্ত | উল্লাসকর দত্ত কাকে বেশি ভালোবেসে ছিলেন – দেশ কে……না স্ত্রী কে ? শুধু জানি শত্রুকে ঘৃণা না করলে সৈনিক হওয়া যায় না, আর মানুষকে ভালো না বাসলে বিপ্লবী হওয়া যায় না | প্রণাম !

©️ অহর্নিশ
তথ্য : রিক্ত উল্লাস (অধ্যাপক শুভেন্দু মজুমদার), সোমনাথ সিনহার লেখা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.