“বুড়ুলের চক্রবর্তী পরিবারের সেই বাড়ি এখনো আছে। কিন্তু টালির ছাউনি দেওয়া যে মাটির ঘরটায় অনুরূপ থাকতেন, সেটার অস্তিত্ব আর নেই—লীন হয়ে গেছে কালের গর্ভে। ১৯৯৭-এর জুন মাসে ঠিক ঐ স্থানে স্থাপন করা হয়েছে একটা স্মৃতিফলক। তাতে লেখা আছে, বিপ্লবী বীর অনুরূপচন্দ্র সেনের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে। প্রয়াণ—৩.৪.১৯২৮
ক্ষণিক উদয় হয়ে জ্যোতি লেখা মিলালো আকাশে চিরস্থির গাঁথা থাক অনাহত গণক্ষুব্ধ শ্বাসে।
মৃত্যুর অতীত তীরে, অনুরূপ লভিও সান্ত্বনা,
নিরাশার অন্ধ অমা চিরদিন মোরা সহিব না।” (কৃষাণু দেব, ‘অগ্নিরূপ অনুরূপ’)
১০০ বছর হল সেকালের জলা জঙ্গলে ঘেরা চব্বিশ পরগনার বুড়ুলে এসেছিলেন যুগান্তর দলের অন্যতম নেতা অনুরূপচন্দ্র সেন। আজ আমরা ক’জন মনে রেখেছি অনুরূপ সেনকে?
অনুরূপচন্দ্র সেনের জন্ম অবিভক্ত বাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশ) চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ার এক গরিব পরিবারে। বাবার নাম কমলকুমার সেন। চট্টগ্রাম মাদ্রাসা থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ৭৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে আই.এ এবং ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বি.এ পাশ করেন। অনুরূপচন্দ্র সেন এম.এ. ক্লাসের ছাত্র থাকাকালে বিপ্লবী দলের সভ্য হন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ও তিনি দুজনেই চট্টগামের নোয়াপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। তাঁরা ছিলেন পরস্পরের সমবয়েসী বন্ধু। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার বুড়ুল হাইস্কুলে শিক্ষকতাকালীন নানা সামাজিক কাজে নিজেকে ও ছাত্রদের জড়িয়ে রাখতেন। ছাত্র ছাত্রীরা তাঁর উৎসাহে হাতে লেখা জাতীয়তাবাদী ‘সাধনা’ পত্রিকা বের করে। অস্ত্র প্রশিক্ষন, লাঠি খেলা, দেহচর্চা ইত্যাদির গোপন আখড়া গড়ে তুলে স্থানীয় ছাত্র-যুবদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।
১৯১৮ সনে যে পাঁচজনকে নিয়ে চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের কেন্দ্র গঠিত হয় অনুরূপচন্দ্র সেন তার অন্যতম ছিলেন। যদিও তিনি অন্তরালেই থেকে গেছেন ভারতের বৈপ্লবিক আন্দোলনের ইতিহাসে। অপর চারজন হচ্ছেন সূর্য সেন, নগেন সেন (জুলু), অম্বিকা চক্রবর্তী ও চারু বিকাশ দত্ত। চট্টগ্রাম বিপ্লবীদের গোপন সংবিধান তাঁরই রচিত। প্রথমে
অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবরণ করেন।
অনুরূপচন্দ্র সেন ১৯২২ সালে দলের নির্দেশে চব্বিশ পরগনা জেলার বুড়ুল হাই স্কুলে শিক্ষকতার কাজ নিয়ে এসে সেখানে সমাজসংস্কারমূলক কাজের সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবীদের এক ঘাঁটি তৈরি করেন। মজুত করে রাখা হতো আগ্নেয়াস্ত্র এবং নিষিদ্ধ বই ও পত্রপত্রিকা। অনুরূপবাবুর হাত ধরে সশস্ত্র বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলেন স্থানীয় যুবকরা। সঙ্গে পান প্রিয় ছাত্র প্রভাস রায়, মুরারীশরণ চক্রবর্তী প্রমুখকে।
সন্ধ্যা হলে হুগলি নদীর পাড় লাগোয়া বাতিঘরের মাঠে তাঁদেরকে নিয়ে চলত অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ। চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠনের অনেক আগেই স্থানীয় বিড়লাপুর-মায়াপুরে অস্ত্রভাণ্ডার লুন্ঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু এর মাঝে দক্ষিণেশ্বর বোমার মামলায় তাঁর নাম জড়ায়।
১৯২৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর বুড়ুল থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিস। এরপর তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় নলদাঁড়ি ঘাটে। সেখান থেকে কলকাতায়। সেদিন ব্রিটিশ পুলিসের বিরুদ্ধে জড় হয়ে আওয়াজ তুলেছিলেন এলাকার মানুষ। শিক্ষক অনুরূপচন্দ্রকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে একদিন গোটা এলাকায় হয় অরন্ধন।
এর পরের ছবিটা দেখি কৃষাণু দেবের ‘অগ্নিরূপ অনুরূপ’-এ (একাদশ অধ্যায়, ‘নিভিল তারার আলো’)— “অনুরূপের অসুখ দিন কে দিন বেড়েই চলেছে। ১৯২৭-এর নভেম্বরে ওঁর যেন বিছানা থেকে উঠে বসারই ক্ষমতা নেই। এই অবস্থায় একমাত্র পথ্য বার্লি। সেটাও নিজেকেই রেঁধে খেতে হয়। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়লে তার প্রভাব মনের ওপর পড়তে বাধ্য। সেই ছাত্রাবস্থাতেই মনে আধ্যাত্মিকভাব জাগ্রত হয়েছিল। বিবাগী হয়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন হিমালয়ে। তবে বিপ্লবীদলে যোগ দেওয়ার পর বেশ কয়েক বছর বৈরাগ্যভাব স্তিমিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯২৫-এর পর থেকে মনের মধ্যে শ্রীঅরবিন্দের প্রভাব ব্যাপকভাবে কাজ করেছে। তারপর দীর্ঘদিন রোগে ভুগে জীর্ণ হয়ে অনুরূপের বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাও যেন নষ্ট হয়ে গেছে। তাই এখন মন চাইছে ভগবানের শরণ নিতে।
“ওপরমহল থেকে অর্ডার এসেছে। বাংলায় আর থাকতে পারবেন না। আপনাকে এক্সটার্নমেন্টে যেতে হবে। কোথায় যেতে চান আপনি?” প্রশ্নটা শুনে হেসে ফেললেন অনুরূপ। প্রহসন আর কাকে বলে! আবার একই প্রশ্ন, “আপনি কোথায় যেতে চান বলুন?”
“বেনারস।” অনুরূপের মুখ দিয়ে যেন আপনা আপনি বেরিয়ে এল শব্দটা। তাই কথাটা বলে হেসে ফেললেন উনি, সে হাসি তাচ্ছিল্যের! অবাক কাণ্ড! অনুরূপের আবেদন সরকার মেনে নিল। তাই কদিন বাদেই পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে ভগ্ন-শরীরে কোনোমতে উনি পৌঁছলেন কাশীধামে। উঠলেন ‘পার্বতী আশ্রম’ নামের একটা হোটেলে।
“আপনার যে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে”, একজন ডাক্তার ডেকে দিতে পারো ভাই?” “দেখছি।” বলেই হোটেলের কর্মচারীটি বেরিয়ে গেল অনুরূপের কামরা থেকে।” কাশীতে পাঠানো হয়। সেখানে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় শ্রীরামকৃষ্ণ অনাথ আশ্রমে মারা যান অনুরূপচন্দ্র সেন। পরবর্তীকালে তৈরি শহীদ অনুরূপচন্দ্র মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানের পরিচিতিতে অবশ্য লেখা আছে, “Sri Sen died in jail while in protest-fasting. In a teaching career of merely four years, Anurup Chandra Sen performed the task of weaving dreams in the minds of students. “
হুগলি নদীর পাড়ে নলদাঁড়ি ঘাটে ভিড়ত স্টিমার। অতি দুর্গম এলাকা হওয়ায় এ ঘাটে নেমে বুড়ুলে আশ্রয় নিতেন চরমপন্থীদের অনেকেই। বন্ধু পুলকেশ ঘোষের সঙ্গে নলদাঁড়ি ঘাটে গেলাম যদি অনুরূপ সেনের কোনও স্মৃতির ফলক থাকে। না, পেলাম না। অথচ, ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা কেড়ে নিতে দেশ জুড়ে যে সংগ্রামের আগুন জ্বলেছিল, তার আঁচ এসে পড়েছিল কলকাতা থেকে প্রায় ৪০ কিমি দূরে বুড়ুলেও। সংস্কারের অভাবে আগাছায় ঢেকেছে ঘাটের ধারে বিপ্লবীদের আড্ডাস্থল। এককালে বহু বিপ্লবীরই পা পড়েছিল এ ঘাটে। তবে কালের নিয়মে আজ স্মৃতির অতলে নলদাঁড়ি ঘাট!
অনুরূপচন্দ্র বুড়ুল ছাড়লেও থেমে থাকেনি আন্দোলন। তাঁরই শিষ্য প্রভাসচন্দ্র রায়, গণেশ ঘোষ, নগেন সেন এবং সুরেশচন্দ্র ঘোষের মতো বিপ্লবীর হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে সশস্ত্র আন্দোলনের মন্ত্র। তবে স্বাধীনতার ৭৫ বছরে সে ইতিহাস যেন ক্রমশ ধূসর। অনুরূপচন্দ্রকেও যেন ভুলতে বসেছে বুড়ুল।
গত ১০০ বছরে বুরুল অনেক বদলে গিয়েছে। বিস্তীর্ণ কানা দামোদর ও ভাগিরথীর তীরে তৈরি হয়েছে প্রচুর ইঁটভাটা। অনুরূপচন্দ্র সেনের একটি আবক্ষমূর্তি বসেছে বুরুল বালিকা বিদ্যালয়ের কাছে, রাস্তার ধারে। রজনীগন্ধার শুকনো মালা ঝুলছে মূর্তির গলায়। তাঁর কোনও স্মরণ অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়েছিল। তাঁর নামে এলাকায় গড়ে উঠেছে শহীদ অনুরূপচন্দ্র মহাবিদ্যালয়। সেখানেও রয়েছে একটি আবক্ষ মূর্তি। তবু স্থানীয় বাসিন্দাদের সিংহভাগের জানা নেই অনুরূপচন্দ্র সেনের কথা। তাঁর জন্ম ১৮৯৮-এ, মৃত্যুদিবস ৪ এপ্রিল ১৯২৮। নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে ব্রাত্যই থেকে গিয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থানীয় ইতিহাস!
নলদাঁড়ি ঘাটও হারাতে বসেছে স্মৃতি থেকে। বুড়ুল এলাকার বাসিন্দা অভিজিৎ বেরা কলকাতা পুলিসের এএসআই। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা বই ‘বিপ্লবী পদধূলি ধন্য নলদাঁড়ি ঘাট’। সেখানে তুলে ধরেছেন স্মৃতিবিজড়িত সেই জায়গাগুলিকে, কীভাবে অবহেলা ও সংস্কারের অভাবে সেগুলি আজ ধ্বংসের মুখে। সাতগাছিয়ার বিধায়ক মোহন নস্কর জানিয়েছেন, শহিদ অনুরূপচন্দ্র সেনকে নিয়ে একাধিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
স্রোতস্বিনী ভাগিরথী আর তার সূর্যাস্ত স্মরণীয় করে রাখল বুড়ুলে গত ১৩ ফেব্রুয়ারির প্রেস ক্লাবের চড়ুইভাতিকে। তার সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল স্বাধীনতার ৭৫ বছর আর অনুরূপ সেনের বুড়ুলে পদার্পনের ১০০ বছর।
(ঋণ— উইকিপিডিয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান)
বুড়ুলের নলদাঁড়ি ঘাটে প্রকল্পটির কাজ শেষ। তালাবন্ধ অবস্থায় উদ্বোধনের অপেক্ষায়। কবে থেকে তালাবন্ধ, স্থানীয় কেউ সেভাবে জানাতে পারলেন না। কয়েক মাস তো হবেই। ‘সিএজি (বা ক্যাগ) প্রায়শই অসন্তোষ প্রকাশ করে হিসেবপত্র নিয়ে। সরকারি অর্থে জনপ্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে সেই কাজ শুরু ও শেষের তারিখের প্রকাশ্য উল্লেখ বাধ্যতামূলক। এটায় কেন উল্লেখ নেই? কে দেখবেন? এসব নিশ্চয়ই মুখ্যমন্ত্রীর দেখার কথা নয়! স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান, বিধায়কদের কি কোনও দায়িত্ব নেই? আমরা সাংবাদিকরা অধিকাংশই চোখ বুঁজে থাকি। হিসেব করি, এ সব না লিখে কেবল গুন গাইলে কোন দিক থেকে, কতটা লাভ হতে পারে? লিখলে কী অসুবিধা হতে পারে? সাংবাদিক সত্বা— কথাটা কি আজ নিছকই সোনার পাথরবাটি হয়ে উঠেছে? এ নিয়ে বিতর্ক চলুক। আসুন, আমরা কেবল দেখি স্বচ্ছ সমাজ তৈরির আর্থিক স্বচ্ছতার একটা নমুনা।
অশোক সেনগুপ্ত