আনন্দবাজারকে ধন্যবাদ। মেরুকরণের রাজনীতির যুগে ভারতের অন্যতম শাশ্বত সত্যটিকে আরও একবার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। দুর্গাপুরের উদয়ন মাস্টারের স্বভাব ঔদার্য আরও একবার দেখালো যে যুগ-যুগান্তর ধরে এমনভাবেই দু’বাহু মেলে ভারতবর্ষ গ্রহন করেছে যে এসেছে তাকেই। অতঃপর বহিরাগত সকলেই বিলীন হয়েছে ভারতের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের অন্তঃস্থলটিতে। এদেশের মাটি প্রীতিরসে সিক্ত এবং সেই সম্প্রীতিরই নতুন এক উদাহরণ উদয়ন মাস্টার। বিষয়টি আমাদের সামনে তুলে ধরেছে গত ১৪ই ফেব্রুয়ারীর আনন্দবাজার পত্রিকা। দুর্গাপুরের কোনো এক ম্যানেজমেন্ট স্কুলের বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের শিক্ষক উদয়ন মৈত্রের একই সঙ্গে হিন্দু ও মুসলিম দুই-ই হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে তাতে। “গত আড়াই দশক ধরে রেড রোডে রোজা শেষের ইদের নমাজে কামাই নেই দুর্গাপুরের ব্রাহ্মণসন্তান শিক্ষকের। কাকভোরে খিদিরপুর, হেস্টিংসের বন্ধুদের ঘুমও ভাঙান, ফজরের নমাজ আদায় না-করলে কিন্তু ইদের নমাজ কবুল হবে না! উর্দু, আরবি পড়তে পারেন না। তবে ইদের নমাজের নিয়ত বাঁধা (সঙ্কল্প মন্ত্র) বা কেউ মারা গেলে উচ্চারণের দোয়াটুকু উদয়নের কণ্ঠস্থ। আল্লার অজস্র বন্দনাগীতি ‘নাথ শরিফ’ শোনাতে তাঁর ডাক পড়ে বিভিন্ন ধর্মীয় আসর বা মিলাদে। আবার বাড়িতে লক্ষ্মী, সত্যনারায়ণ পুজোতেও উদয়ন স্বচ্ছন্দ। সরস্বতী পুজো, দুর্গাপুজোর অঞ্জলিতেও যান খোলা মনেই। হেসে বলেন, “ধর্ম পাল্টানোর ইচ্ছে নেই। কিন্তু আমি মনেপ্রাণে মুসলিমও। এক সঙ্গে দু’টো ধর্ম মেনে চলাটা আমার কাছে সহজ ও স্বাভাবিক বলেই মনে হয়।”— লিখেছে আনন্দবাজার।
ভারতের সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণের জমিটিও দান করেছিল হিন্দুই। নচেৎ আরব দেশে উৎপন্ন ধর্ম এদেশে প্রসারিত হতে পারত না। কথিত আছে যে সপ্তম শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে কেরল রাজ্যের রাজা চেরমান পেরুমল গিয়েছিলেন আরব দেশে যেখানে তাঁর সাক্ষাৎ হয় হজরত মহম্মদের সঙ্গে এবং রাজা পেরুমল গ্রহন করেন ইসলাম ধর্ম। চেরমান পেরুমলই চিঠি লিখে ভারতে প্রেরণ করেন পারস্যের পণ্ডিত মালিক ইবনে দিনারকে যে চিঠিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তাঁর রাজ্যে যেন ইবনে দিনারকে জমি দান করা হয় মসজিদ নির্মাণের জন্য। রাজার আদেশ মেনে দান করা হয় জমি এবং ৬২৯ সালে গড়ে ওঠে ভারতের প্রথম মসজিদ চেরমান জুমা মসজিদ, কেরালার মালাবার উপকূলে অবস্থিত ত্রিচুরের কোডাঙ্গাল্লুরে। বস্তুতঃ এইভাবেই ভারতের সঙ্গে প্রথম স্থাপিত হয় আরবের সম্পর্ক এবং বাণিজ্য উপলক্ষে ভারতে যাতায়াত শুরু করে আরবদেশীয়রা। এদেশের হিন্দু রাজারা নিজেদের বৈষয়িক উন্নতির জন্য নানা সুযোগ সুবিধাও দিয়েছিলেন আরব বণিকদের। অর্থাৎ ঔদার্য ভারতের স্বভাববৈশিষ্ট্য। দুর্গাপুরের উদয়ন মাস্টার সে কথা মনে করালেন আর একবার। আরব ধর্মের ভাবধারা ভারতীয় ভাবধারা থেকে পৃথক। তাদের ভাবসাব, প্রকাশভঙ্গিও ভিন্ন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সে ভিন্নতাকে ধারণ করার অসুবিধা ভারতবর্ষের হয় নি। বেদ উপনিষদের ভারতবর্ষ অনাদি অতীতকাল থেকে আত্মস্থ করেছিল “একম্ সৎ বিপ্র বহুধা বদন্তি”র তত্ত্ব। তাই ইসলামীয় প্রকাশভঙ্গির ভিন্নতা সে গ্রহন করেছিল। আরব ধর্মের প্রবেশে ভারতবর্ষের অসহযোগিতা ছিল না। আনন্দবাজারকে সে কথা আর একবার মনে করানোর জন্য ধন্যবাদ।
আরবরা অবশ্য মসজিদ স্থাপনের পর শুরু করে ধর্মবিস্তার। হিন্দু রাজারা অতিরিক্ত বাণিজ্যশুল্কের লোভে আরব বণিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছিলেন। কিন্তু বাণিজ্যের পাশাপাশি তারা বহু হিন্দুকে ধর্মান্তরিতও করে যারা আরব ধর্ম গ্রহন করার সাথে সাথে আরবদেশীয় আচার-আচরণও অনুকরণ ও অনুসরণ করতে থাকে। কেরালার এই আরব উপনিবেশগুলি এবং সেখানকার ধর্মান্তরিত হিন্দুরা পরবর্তীকালে আফগানিস্তানের গজনীর থেকে তুর্কী আক্রমণের সময় সবুক্তিগীন, সুলতান মাহমুদ এবং মহম্মদ ঘোরীর প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিল। ভারতের হিন্দু রাজারা ধর্মপালন বা বিষয়চিন্তার সঙ্গে রাজনীতিকে মিলিয়ে ফেলেন নি। দুর্গাপুরের উদয়ণ মাস্টারের যে উদারতা আজ দেখা যাচ্ছে, এদেশে তা চিরকাল ছিল। মসজিদ স্থাপনার্থে জমি দান করতে অথবা আরব দেশীয় বণিকদের সঙ্গে বৈষয়িক লেনদেনের সিদ্ধান্ত নিতে তাঁরা সাতপাঁচ ভাবেন নি। কিন্তু এই সহজস্বভাব উদারতার প্রতিদানে পাল্টা সহজস্বভাব ঔদার্য আরবদেশীয়দের মধ্যে দেখা যায় নি কারণ তারা কেবল বৈষয়িকতা বা বাণিজ্যে থেমে থাকেনি, বিস্তার করেছিল ভিন্ন ধর্ম শুধু নয়, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন আচার ব্যবহারও। হিন্দু রাজাদের যে উদারতার ফলে এদেশের মাটিতে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে তারা পেরেছিল, সেই একই উদারতা হিন্দু সমাজের প্রতি দেখাতে তারা পারে নি। ধর্মান্তরের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত্যান্তর (সংস্কৃতি-অন্তর) এবং মতান্তরের সঙ্গে সঙ্গে মননান্তরও ঘটিয়ে দিয়েছিল বরং। ফলে এদেশে তুর্কী শাসন কায়েম হওয়া মাত্র দেশের শাসনবিধি হয়ে পড়েছিল শরিয়ৎ-ভিত্তিক। প্রজারা হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু স্মৃতিশাস্ত্রভিত্তিক শাসনবিধি চালু রাখতে অস্বীকৃত হন তুর্কী শাসকরা। অর্থাৎ বাণিজ্য করতে এসে এদেশের মানুষের সংস্কৃত্যান্তরে প্রবৃত্ত হয়েছিল তারা। “বণিকের মানদণ্ড পোহালে শর্বরী, দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে”— রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও বৃটিশ শাসন কায়েম হওয়ার বিষয়ে। কিন্তু আরব-তুর্কীরাও ব্যতিক্রম ছিল না। রাজদণ্ড হাতে নিয়ে তারা প্রবৃত্ত হয়েছিল মানুষের ভাবধারা ও চিন্তনপদ্ধতি পরিবর্তনে। “৮৯৯ শকাব্দে সবুক্তিগীন আসিয়া লাহোর পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করিলেন। ৯২০ শকাব্দে আসিলেন মামুদ গজনী। ৯৪৬ হইতে ৯৪৮ শকাব্দের মধ্যে সোমনাথের মন্দির লুন্ঠিত হইল। ১১১৫ শকাব্দে মহম্মদ ঘোরী দিল্লি অধিকার করিলেন। মহারাত্রির অন্ধকার ঘনাইয়া আসিল”। — লিখেছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর “তুমি সন্ধ্যার মেঘ” উপন্যাসে। মহারাত্রির অন্ধকার। কেবলমাত্র ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ নয়, আরব সংস্কৃতির তাৎপর্যপূর্ণ ভিন্নতাই এর কারণ।
শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরানগরীর কয়েকশত ছোট বড় মন্দির ধ্বংস করেছিল গজনীর মামুদ। ভারতবর্ষের সম্পদ অপরিমেয়। লুন্ঠনই মূল উদ্দেশ্য হলেও কেবলমাত্র সম্পদ লুঠ করে ‘গাজী’ হতে সে পারত না। ‘গাজী’ অর্থাৎ পৌত্তলিকদের ধ্বংসসাধন করে যে। তাই ধ্বংস করেছিল শ’য়ে শ’য়ে ভারতের মন্দির। মথুরা ছাড়াও সোমনাথ এবং সোমনাথ মন্দিরের গ্রন্থশালা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল মামুদের হাতে। ধনরত্ন ছিল কাঙ্খিত দ্রব্য আর ‘গাজী’ উপাধি উপরি পাওনা। সোমনাথ মন্দির থেকে মামুদ লুঠ করেছিল দুই কোটি স্বর্ণমুদ্রা ও প্রচুর অলঙ্কারাদি। উদয়ন মাস্টারের উদারতার কানাকড়িও ছিল না মামুদের অথচ আজ সেই গজনভি মামুদের নামে নামাঙ্কিত হয়েছে শহর কলকাতার একটি ব্রিজ। গজনভী ব্রিজ। আর জি কর হাসপাতালের কাছাকাছি এলাকায়। ঠিক যে প্রকারে ৬২৯ খ্রীষ্টাব্দে রাজা পেরুমলের দেওয়া জমিতে এদেশে প্রথম মসজিদ স্থাপনের পর থেকে আরবরা কেরালায় ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছিল আরবীয় বাণিজ্যিক উপনিবেশ, অতঃপর ধীরে ধীরে ধর্মান্তরিত করেছিল স্থানীয় হিন্দুদের এবং তুর্কী আক্রমণের সময় তারাই সমর্থন করেছিল সবুক্তিগীন, মামুদ এবং মহম্মদ ঘোরীকে, ঠিক সেই একইভাবে কলকাতার ধর্মান্তরিত হিন্দুরা আজ গৌরবায়িত করছে সংস্কৃতি-ধ্বংসকারী গজনীর মামুদকে। কি অদ্ভুত না? হিন্দুর স্বভাবসিদ্ধ উদারতা নিয়ে নামে হিন্দু হয়েও দুর্গাপুরের উদয়ন মাস্টার নিষ্ঠাভরে মুসলিম ধর্ম পালন করছেন গত আড়াই দশক যাবৎ। অথচ তা সত্ত্বেও গত মাত্র এক দশককালের মধ্যে কোনো এক সময়ে এই শহর গৌরবান্বিত করেছে সুলতান মামুদকে। অর্থাৎ উদয়ন মাস্টারের উদারতার উপযুক্ত প্রতিদান পাওয়া যাচ্ছে না আজও। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বার বার। যে সমাজ উদয়ন মাস্টারকে মাথায় করে রেখেছে বলে রিপোর্ট করেছে আনন্দবাজার পত্রিকা, সেই একই সমাজ গজনভি মামুদকে স্মরণ করে গৌরবান্বিত হয় কি করে? এ প্রশ্ন আনন্দবাজার তোলে নি।
উদয়ন মাস্টার কি আজকের দিনের রাজা চেরমান পেরুমল? চেরমান পেরুমলের মসজিদ স্থাপনের অনুমোদন আরবদের দিয়েছিল এদেশের মানুষকে ধর্মান্তরিত করার সুযোগ। ধর্মের প্রসারার্থে সেটি ছিল অতি কার্যকরী এক বিপণনকৌশল। রাজা চেরমান পেরুমল হয়েছিলেন এদেশে আরব ধর্মের সর্বপ্রথম ব্র্যাণ্ড অ্যাম্বাসাডর। সেকালের মানুষ ‘ভিন্ন ধর্ম’ বিষয়টি জানত না, ধর্মান্তরের সঙ্গেও ছিল না তেমন পরিচিত কারণ আরবদের আগে অন্য কোনো ভিন্নধর্মী ঔপনিবেশিক শক্তির পা এদেশে পড়ে নি। তাই ধর্মান্তরিত হওয়ার অর্থ যে সংস্কৃত্যান্তর ও মননান্তর, তা জানত না সপ্তম শতাব্দীর মালাবার উপকূলের মানুষ। বৌদ্ধ বা জৈন ধর্ম ভারতধর্মী ও ভারতীয় চিন্তনেরই স্পেশালাইজেশন হওয়ার কারণে সে সব ধর্ম গ্রহন করলে সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন ঘটতে তদবধি ভারতীয়রা দেখে নি। কিন্তু আরব ধর্ম গ্রহনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অন্তরে বাহিরে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল। সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সরাসরি বিরোধ বাধিয়েছিল আরব ও তুর্কীদের ধর্মীয় ভাবধারা। অতঃপর গত ১২০০ বছরের অভিজ্ঞতায় আজকের মানুষ ধর্মান্তরের অর্থ জানে। তাই সেকালের মত সহজে আরব ধর্মের বিস্তার করতে একালে পারা সম্ভব নয়, বিশেষতঃ বিস্তারের প্রয়োজন ও প্রবণতা যদি হয় খুব বেশি। উপরন্তু, ধর্মবিস্তারের জন্য বল ও ছলের প্রয়োগ এদেশের আইনের দৃষ্টিতে ক্রমশঃই হয়ে উঠছে অপরাধ। তাই এমন কোনো পদ্ধতি চাই যাতে ছল বা বল নয়, বরং মানুষকে মুগ্ধ করার মাধ্যমে, মানুষের আবেগকে স্পর্শ করার মাধ্যমে তাঁদেরকে প্রভাবিত করা যায়। উপরন্তু প্রয়োজন নিন্দার ভার লাঘব করাও। আরব ধর্ম সম্পর্কিত অস্বস্তিকর বহুবিধ তথ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষের কাছে আজ সহজলভ্য। তাই উদয়ন মাস্টারের মত অনেক হিন্দু মানুষ যদি নামে-পরিচয়ে হিন্দু থাকতে থাকতেই ঈদের নামাজ পড়তে আরম্ভ করেন, তাহলে আরও কয়েক বছর পরে কিংবা অন্ততঃ এক প্রজন্ম পর তাঁরা হয়ত পুরোপুরিভাবেই গ্রহন করবেন আরব ধর্ম এবং সে পরিবর্তন হবে সংঘর্ষহীন— এমত আশা ও কৌশলী চিন্তা আরব ধর্মের প্রচারকরা যে করতে পারেন ইতিহাস তার সাক্ষী দেয়। হিন্দুর মন দিয়ে ভাবলে অবশ্য একজন মানুষ যে কোনো পন্থা অবলম্বন করে ঈশ্বর আরাধনা করতেই পারেন। এ বঙ্গভূমিই পৃথিবীকে শিখিয়েছে “যত মত তত পথ”। উপরন্তু হিন্দু থাকাকালীন আরব ধর্মের নমাজ পড়লে বা ‘নাথ’ গাইলে কেউ তাঁর প্রাণ নেবে এমন ভয় পাওয়ার কারণও উদয়ন মাস্টারের নেই। তিনি তাই এ যুগে এ রাজ্যে হয়েছেন আরব ধর্মের এক নব্য ব্র্যাণ্ড অ্যাম্বাসাডর। আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহন না করেও কেউ যদি তার প্রচার করেন তবে ধর্মটি আগ্রাসী এমন নিন্দার ক্ষেত্রও সঙ্কুচিত হয় কিঞ্চিৎ। এর দ্বারা প্রচারটি হয় মসৃণভাবে এবং তুলে ধরা যায় ঔদার্যের এক ভিন্নতর প্রর্দশনীও। আরব ধর্ম গ্রহন করেও ইতিপূর্বে সুমন চট্টোপাধ্যায়দের মত বর্ণহিন্দুরা দাগা দিয়েছে বড্ড বেশি। আরব ধর্মের অধিকতর নিন্দার কারণ হয়েছে তারা। তাই বর্ণহিন্দুদের মধ্যে থেকে দরকার ধর্মবিস্তারের এক পৃথক সময়োপযোগী মডেল। উদয়ন মৈত্র।
৬ই ফেব্রুয়ারী লতা মঙ্গেশকরের শেষকৃত্যে যোগ দিয়ে বলিউড অভিনেতা শাহরুখ খান ভারতকন্ঠী শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানালেন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায়, আরব ধর্মের প্রার্থনা পদ্ধতিতে। আরব ধর্মীয় না হয়েও আরও বহু ভারতীয় মনে করেছেন শাহরুখ খান যা করেছেন তা যথার্থ। শেষ শ্রদ্ধা জানানোর কাজটি তাঁর আপন ধর্মভাব অনুযায়ী হলেই শুদ্ধ, প্রকৃত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সম্পন্ন হতে পারত এবং হয়েছেও তাই। শাহরুখ খানের ভঙ্গিমা অসংখ্য মানুষের চোখে যে বিসদৃশ ঠেকেছে তার কারণ আরব ধর্মের আচরণগত ভিন্নতা যে ভিন্নতা খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর আগে ভারতবর্ষ প্রত্যক্ষ করে নি। কিন্তু শাহরুখ খানের ভিন্নতর প্রার্থনা ভঙ্গিমা নিয়ে সম্যক আলোচনার ঝড় ওঠার অনতিপূর্বে, জানুয়ারী মাসের ২৫ তারিখে নিজের ইষ্ট দেবতাকে সর্বশ্রেষ্ঠ দাবী করায় গুজরাটে হত্যা করা হয়েছিল কিষণ ভারওয়াড়কে। হত্যার অপরাধে অভিযুক্ত ও গ্রেফতার হন আরব ধর্মের ধর্মগুরুরা। বেশ কিছু বছর আগে একটি রিফাইণ্ড ভোজ্য তেলের টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে নিজের বাবার শারীরিক ফিটনেস দেখে গর্বিত এক শিশুকন্যাকে বলতে শোনা যেত “মাই ড্যাডি স্ট্রংগেস্ট”। কিষণ ভারওয়াড়ও পোস্ট করেছিল সেরকমই একটি দাবী। “আল্লা বা জেসাস নন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণই শ্রেষ্ঠ”। তা-ও কেবলমাত্র তাঁর নিজের সোশ্যাল মিডিয়া স্পেসে। শ্রীকৃষ্ণ যাঁর ইষ্টদেবতা তাঁর দিক থেকে একথা অস্বাভাবিক কিছু ছিল কি? ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানতেন বলেই না শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ইষ্ট দেবতা ছিলেন! অথচ তাঁর সেই সহজ বিশ্বাসের কথাটি ব্যক্ত মাত্র করার জন্য প্রাণ হারাতে হল তাঁকে। আরব ধর্মের অভিযুক্ত মৌলানাদের পরিকল্পনায়—
“এই বাংলায় নিরামিষভোজী জগন্নাথ-গবেষক বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক শেখ মকবুল ইসলামের কথা অনেকে জানেন।“— লিখেছে আনন্দবাজার। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে এই ব্যক্তির কথা আমার অন্ততঃ জানা নেই। অথচ জানতে যে চাই সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ। কারণ এরাজ্যে একদিকে যেমন আছেন আরব ধর্মের নব্য ব্র্যাণ্ড অ্যাম্বাসাডর উদয়ন মাস্টাররা, অন্যদিকে তেমনই আছেন বীরভূমের মামুন শেখরা, পশ্চিমবঙ্গের ভোট পরবর্তী হিংসায় যারা বেছে বেছে অত্যাচারের টার্গেট বানিয়েছিল হিন্দু মেয়েদের। মেয়ের বাপের কাকুতিমিনতিতে হেসে উঠে যে মামুন শেখ বলেছিল “তোকেই বরং ছেড়ে দিচ্ছি, আমাদের দরকার তোর মেয়েকেই” সেই অসংখ্য মামুন শেখরা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে আরব সংস্কৃতি অত্যন্ত ভিন্ন। অতলান্তিক সংস্কৃত্যান্তরের মুখে দিশাহীন আমরা। উদয়ন মাস্টার যেখানে অনায়াসে বসতে পারেন ঈদের নমাজে, সেখানে কোনো মুসলমান শিক্ষক এসে অঞ্জলিবদ্ধ করপুটে দাঁড়াতে পারেন না মাতৃমূর্তির সামনে, গেয়ে ওঠেন না চণ্ডীস্তোত্র, বলেন না উপনিষদ মন্ত্র কিংবা মহাশিবরাত্রির অন্ধকারে বসেন না সচ্চিদানন্দ শঙ্করের ধ্যানে। উপরোক্ত বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক জগন্নাথ-গবেষক শেখ মকবুল ইসলাম কি তাঁর ধর্মের পাশাপাশি বিষ্ণুপূজাও করেন? পাঠ করেন বিষ্ণু সহস্রনমনমন্ত্র সৈয়দ মুজতবা আলীর মত? शुक्लाम्बरधरं विष्णुं शशिवर्णं चतुर्भुजम्। प्रसन्नवदनं ध्यायेत् सर्वविघ्नोपशान्तये॥ কিংবা সরস্বতী পূজা করেন বাবা আলাউদ্দীন খাঁ’এর মত? নাকি মা গঙ্গার পূজায়ও কখনও নিমগ্ন হন যেমন হতেন উস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ? মেরুকরণের রাজনীতির এই উত্তাল সময়ে আমরা হাতড়ে হাতড়ে খুঁজছি এমন সব মানুষদের। নিরন্তর আমাদের সেই অনুসন্ধানের মধ্যে নিঃশব্দে হিন্দুশূন্য হয়ে যায় এ শহরের বহু স্থান। হিন্দু শূন্য হয় গ্রামের পর গ্রাম আর গ্রামের শেষ হিন্দু গৃহস্থের শেষকৃত্য করে মুসলমান প্রতিবেশীরা। আনন্দবাজার পত্রিকা আবেগ-বিহ্বল হয়ে ছাপে সে খবর, কিন্তু কেউ প্রশ্ন তোলে না কেন হিন্দু শূন্য হল সেই গ্রাম, কেন একত্রে সম্প্রীতিতে থাকতে পারল না দুই সম্প্রদায়। নীরবে দখল হয় একের পর এক হিন্দু সম্পত্তি, অথচ নিঃশব্দ সেই বদল দৃষ্টিগোচর হয় না কারুর। আরও প্রবলতর একমুখী বদলের অভিসন্ধি নতুন রূপ পরিগ্রহ করে আপাত-সম্প্রীতির নয়া ফেরিওলা উদয়ন মাস্টারদের মধ্যে।
দেবযানী ভট্টাচার্য্য