শিক্ষাঙ্গনের হিজাব বিতর্কে কে, কোথায়

হিজাব-বিতর্কে এবার নয়া মোড়।  কর্ণাটকের ছাত্রী ভিভি মুসকানের পাশে দাঁড়াল রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস)। সংগঠনের মুসলিম শাখার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, পর্দা ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ। আরএসএসের মুসলিম শাখা, মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ হিজাব পরা নিয়ে মুসকানের আর্জিকেই সমর্থন জানিয়েছে। তাঁকে ঘিরে গেরুয়াধারীদের বিক্ষোভের নিন্দা করেছে মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ। 

বিষয়টি নিয়ে শুরু হয়েছে দেব্যাপী প্রতিক্রিয়া। 

“হিজাব কোথাও পোষাক বিধি হতে পারে না“
— ডঃ সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (দক্ষিণবঙ্গ প্রান্ত) রাজ্য সভাপতি

হিজাব কোথাও পোষাক বিধি হতে পারে না। শিক্ষা মানুষের মনের সংকীর্ণতা দূর করে। শিক্ষাঙ্গনের মত পবিত্র স্থানে, পোষাকবিধির বিরোধিতা করে এক ধরনের সংকীর্ণ মনের পরিচয় দিয়েছেন হিজাব পড়ে যাঁরা কলেজে এসেছিলেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলে নিজস্ব নিয়মে। সেখানে পোষাকবিধি থাকলে তা মানাই উচিত। 

যে কোনও প্রতিষ্ঠানের পোষাকবিধিকে সম্মান করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সেনাবাহিনীতে নিজস্ব পোশাক বিধি আছে, একজন মুসলিম মহিলা হিজাব পরতে পারেন না। মুসলিম মহিলা ডাক্তারও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কাজের সময়ে তার পোশাক বিধি মেনে চলেন। সেই ভাবে শিক্ষাঙ্গনের বিধি মেনে চলা প্রত্যেকটি নাগরিকের কর্তব্য হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিধি নিয়মকে ছোট করে দেখা উচিত নয়। শৃঙ্খলাই  হলো যে কোনও প্রতিষ্ঠানের মেরুদন্ড।”
(ইন্ডিয়ান ইন্সটিট্যুট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির খননবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক)
*
অশোক ঘোষ
— সমাজকর্মী, শ্রমিকনেতা

এক জন ছাত্রী আর বেশ কিছু ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’। যে ছবি ভাইরাল হয়েছে— উৎকট অঙ্গ ভঙ্গি করে বেশ কিছু যুবক ছাত্রীটির পশ্চাৎধাবন করছে।

যে বিষয় ভাবার মত তাহলো একজন ছাত্রী মুসলিম বলেই তাকে উত্যক্ত হতে হবে। পোষাকের ওপর এদেশে কোনও সরকারি  নিষেধাজ্ঞা জারি হয়নি।

কপালে তিলক কাটা, টিকিধারি ছাত্র যদি কলেজে ক্লাস করতে পারে, তাহলে হিজাব থাকলে অসুবিধা কোথায়? কোনও ছাত্রছাত্রী অশালীন পোষাক পরলে আপত্তি থাকতে পারে কিন্তু সর্বাঙ্গ ঢাকা পোষাকের ক্ষেত্রে আপত্তি কেন?

রাজনীতি, খাদ্যাভাস, পোষাক আর ধর্ম একসঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে জন জীবনে সন্ত্রাস সৃষ্টির মহড়া দিচ্ছে শাসকদের বাহুবলী বাহিনী। নির্দিষ্ট পোষাক বিধি না থাকলে যে কোনও ছাত্র-ছাত্রীর পছন্দের পোষাক পরা অধিকারের মধ্যেই পড়ে। হিজাব যদি ধর্মীয় পোষাক হয় তাহলেও সেই পোষাক পরায় আপত্তি করার অধিকার কারো নেই। হিজাব পরিহিত প্রতিবাদরত ছাত্রীকে আমার নমস্কার।
(ইউনাইটেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক)

*

“পোষাকবিধি দরকার, তবে সরকারের তার মধ্যে যাবার দরকার কি?”
— গৌতম ভট্টাচার্য,
ইন্ডিয়ান পোস্টাল সার্ভিসের প্রাক্তন আধিকারিক

স্কুল- কলেজে ইউনিফর্মের একটা গুরুত্ব আছে। ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক পরিবেশ থেকে ছাত্রছাত্রীরা আসলেও, শিক্ষায়তনের ভেতরে সকলেই সমান, সবাইকেই একইরকম অনুশাসনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে – এই ভাবনাটা মাথায় রেখেই পোষাক-বিধির উৎপত্তি। প্রশ্ন হচ্ছে সেটা ঠিক করবে কে ?

আমার মতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম বা ড্রেস-কোড সেই প্রতিষ্ঠানেরই ঠিক করা বাঞ্ছনীয়, সরকারের এর মধ্যে কোনও ভূমিকা না থাকলেই ভালো। ছাত্রছাত্রীদের সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিচার করে শিক্ষায়তনের কর্তৃপক্ষ যদি ড্রেস-কোড ঠিক করে দেন, সকলকেই সেটা মেনে চলতে হবে। স্কুল- কলেজে ভর্তি হবার আগেই সবাই জেনে গেলো সেখানে ভর্তি হলে কি সাজে যেতে হবে। এর মধ্যে সরকার ঢুকলেই মুস্কিল। কেউ তাতে ‘চাপিয়ে দেওয়া’র অভিযোগ আনবে, কেউ বা তাতে ‘সিঁদুরে মেঘ’ দেখবে। কর্ণাটকে ঠিক এইটাই হলো। সরকারের আরও হাজারটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, কার হিজাব পরাতে জীবনের সার্থকতা আর কার ঘোমটা টানায়, সরকারের তার মধ্যে যাবার দরকার কি?
(অবসরপ্রাপ্ত চিফ পোষ্ট মাস্টার জেনারেল)

*

অর্পিতা বন্দ্যোপাধ্যায় 

— আইনজীবী, কলকাতা  হাইকোর্ট 

কলকাতা হাইকোর্টের একজন আইনজীবী হিসেবে পোষাক সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে নানা সময়ে নানা জাজমেন্ট আমাকে নাড়াচাড়া করতে হয়েছে। হিজাব সংক্রান্ত বিভিন্ন রায়ের মধ্যে কেরল হাইকোর্টের রায়টি এখানে তাৎপর্যপূর্ণ। সমাজ মাধ্যমে দেখলাম যে মেয়েটি একদিকে হিজাবের অধিকার নিয়ে লড়াই করছে। অপরদিকে ততোধিক বৈপরীত্য  সূচকের জিন্সও পড়ছে যা তার কাছে  ‘শয়তানের পোষাক’ নয়। এর থেকে মনে হচ্ছে যে দীর্ঘদিনের নিয়ম ভাঙার এই আকস্মিক ঘটনার পিছনে একটি বড়সড় ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা অবশ্যই  রয়েছে। এখান থেকেও তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। একটি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আইন ভাঙা একজন আইনজীবী হিসেবে আমি কখনোও সমর্থন করতে পারি না।

অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.