তমলুক রাজবাড়ির ময়ূরধ্বজ এবং তাঁর পুত্র তাম্রধ্বজ মহাভারত প্রসিদ্ধ। দ্রুপদ কন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় বহু রথী মহারথী রাজদের নামের সঙ্গে তাম্রলিপ্ত ও কলিঙ্গ নাম দুটি প্রাপ্ত হয়। সভাপর্বে বঙ্গবিজয় প্রসঙ্গে তাম্রলিপ্ত রাজার নাম পাওয়া যায়। জৈমিনী মহাভারতে আশ্বমেধিক পর্বে ৪১ তম – ৪৬ তম অধ্যায় তাম্রলিপ্তরাজ ময়ূরধ্বজের নাম মেলে। তাঁর বংশধরেরা নিজেদের #মাহিষ্য বলে পরিচয় দিতেন।
ধনঞ্জয় দাস মজুমদার রচিত , ভারত ও ভারতের বাহিরে বাঙালীর অবদান গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, উক্ত তাম্রলিপ্তরাজের বংশধরেরা বলির তথা শুহ্ম বংশজ। তবে তমলুক রাজবাড়ীর বংশধরগণ নিজেদের মাহিষ্য বলেন সেটা ঠিক , তবে তাঁরাই বলির বংশজ কিনা তা নিয়ে দ্বিমত আছে।
এর সঙ্গে আরও কিছু অংশ শুধু জানিয়ে রাখি – বলির পুত্র অঙ্গের বংশধরগণ অঙ্গরাজ্যের রাজধানী বর্তমান বিহারের ভাগলপুর জেলার চম্পায় স্থাপিত করেন।
বলির পুত্র বঙ্গ , তাঁর আবার তিন পুত্র ছিলেন। সেই তিন পুত্রের একজন কমলাঙ্কে রাজধানী স্থাপন করেন। পরে যেকোনো কারণে , এখানের রাজা হন সমুদ্রসেনের পুত্র চন্দ্রসেন। এই রাজধানীর ধ্বংসাবশেষই #ময়নামতী নামে প্রসিদ্ধ। এই রাজ্যের রাজা চন্দ্রসেনকে মহাভারতের অনেক পর্বেই দেখা গেছে।
অংশুমাংশ্চেকিতানশ্চ শ্রেণিমাংশ্চ মহবলঃ
সমুদ্রসেনপুত্রশ্চ চন্দ্রসেনঃ প্রতাপবান।।
( ১৭৯ অধ্যায় , আদিপর্ব, মহাভারত , হরিদাস সিদ্ধান্ত বাগীশ)
অর্থাৎ অশুমান , চেকিতান, মহাবল শ্রেণিমান, সমুদ্রসেনের পুত্র প্রতাপশালী চন্দ্রসেন (দ্রৌপদীর সয়ম্বর সভায়) উপস্থিত হয়েছেন।
সমতটের চন্দ্রদ্বীপ তাঁর পবিত্র স্মৃতি বহন করছে। কেদারনাথ মিশির লিখছেন – “The then sea washed the southern shores of Trihoot or Tirbhukti and Samatat extended from here eastwards to Chachar and Chandradwip, where reigned in those days King Chandra Sena who fought with Bhima the second Pandava, in the Ashwameda era of Mahabharata.”
ভারতবিখ্যাত তন্ত্রসাধিকা ময়নামতী ছিলেন চন্দ্রসেনের বংশধর মানিক চাঁদ অর্থাৎ মানিক চন্দ্রের রাণী এবং ভারত বিখ্যাত গোবিন্দ চন্দ্র বা গোপী চাঁদের জননী। জ্ঞাতব্য যে চন্দ্রসেনের বংশধররা বর্তমানে মাহিষ্য জাতি নামে সুপরিচিত।
বঙ্গের অপর এক পুত্র সমবঙ্গের ভূষণায় ( বঙ্গভূষণায় ) রাজধানী স্থাপন করেন। তাঁর বংশধর এই রাজ্যের রাজা সমুদ্রসেনের নামও মহাভারতের বহু পর্বে দেখা যায়। ” পুন্ড্ররাজ বাসুদেব’ বা “পৌন্ড্রবাসুদেব” পুত্র পৌত্রগণ সহ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে সবংশে নিহত হন। তখন তাঁর পুন্ড্র রাজ্যের উত্তরাধিকারী হয়ে সমুদ্রসেনের বংশজ রাজাগণ রাজত্ব করতে থাকেন।
এই সমুদ্রসেনের বংশেই #শ্রীগুপ্তের জন্ম। ঐতিহাসিক ধনঞ্জয় দাস মজুমদার মহাশয়ের মতে শ্রীগুপ্ত ছিলেন পুন্ড্ররাজ। শ্রীগুপ্তের পুত্র প্রথম চন্দ্রগুপ্ত মগধ জয় করে গুপ্ত বংশ এবং রাজত্বের সূচনা করেন। এই বংশের সন্তান #রাজভট সমতট রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
উক্ত রাজভটের বংশেই ভারত প্রসিদ্ধ পন্ডিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ #অতীশ_দীপঙ্কর_শ্রীজ্ঞানের জন্ম। রাজভট বংশে পন্ডিত #দ্বয়িত_বিষ্ণুর পৌত্র ও রাজা ব্যাপটের পুত্র #গোপাল জন্মগ্রহণ করেন এবং দীর্ঘ মৎস্যন্যায়ের পর তিনিই পাল বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গ ও পুন্ড্রবর্ধনে তিনিই হন অধীশ্বর।
বঙ্গের তৃতীয় পুত্র সমতটের #দেবলায়ের রাজা ছিলেন। যার পরবর্তী সময়ে নাম হয় চন্দ্রকেতুগড়। জাহাঙ্গীর সেনাপতি কপট যুদ্ধে মহারাজ চন্দ্রকেতুকে সপরিবারে কিভাবে নিহত করে সেই ইতিহাস আশা করি আজ সকলেরই অবগত আছে!
বলির পুত্র কলিঙ্গের বংশজদের মধ্যে শ্রুতায়ুর নাম মহাভারতে দেখা যায়। তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নিহত হন। ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গের কেশরীবংশের অবসানে বলিপুত্র সুহ্মের বংশধর #প্রসুহ্ম বা বীরভূমের রাজনগরের গজপতি গঙ্গাবংশের #চোড়গঙ্গো বা অনন্তবর্মা সমগ্র কলিঙ্গরাজ্যের রাজা হন।
বলিপুত্র পুন্ড্রের নামেই ছিল পুন্ড্রবর্ধন। বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী , রংপুর , ঢাকা, পশ্চিমবঙ্গের পিশাচ দিনাজপুর জেলা নিয়ে গঠিত ছিল পুন্ড্রবর্ধন। রাজধানীর নাম ছিল পুন্ড্রনগর। এটি বর্তমান বাংলাদেশের বোগরা জেলার অন্তর্গত মহাস্থানগড়ে অবস্থিত ছিল। পুন্ড্রনগরই মহাস্থানগড় নামে পরিচিত ছিল।
বলিপুত্র সুহ্মের রাজধানী ছিল বর্তমান বর্ধমান জেলার কাঁকসা থানার সেন পাহাড়ীতে। এই রাজ্যের রাজাগণ #নন্দ এবং #শুঙ্গ বংশের রাজা বলে প্রসিদ্ধ। এই বংশের রাজা #বিশ্বস্ফানি মগধে বলিবংশের প্রথম সম্রাট। এই বংশের যুবরাজ প্রথম লাউসেন (৮১৫ – ৮৫৪ ) সেনাপতি ছিলেন। ইনি মঙ্গলকাব্যের লাউসেন নন অর্থাৎ মেদিনীপুরের ময়নাগড়ের সামন্ত রাজা কর্ণসেনের পুত্র ( ১০৪১- ১০৭১ ) লাউসেন নন।
ধনঞ্জয় মহাশয় লিখেছেন , কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বের মহাভারতীয় যুগে ভারতের সভ্যতার এক চরম বিকাশ হয়েছিল। মহাভারতে বহু প্রপথ , পরিরথ্যা এবং বাণিজ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্গের তাম্রলিপ্ত সেই যুগ হতেই এক বিশিষ্ট স্থল ও নৌবাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই জন্য জৈমিনী মহাভারতে তাম্রলিপ্ত রত্নগড় বা রত্নপুর নামে অভিহিত করেছেন।
বলেন বৈশম্পায়ন, শুন জনমেজয়।
রত্নাবতীপুরে গেল পান্ডবের হয়।।
রত্নাবতীপুরে রাজা শিখিধ্বজ নাম।
বড়ই ধার্ম্মিক সেই সর্ব্ব গুণধাম।।
কাশীদাসী মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্বে লেখা হয়েছে উত্তর পূর্ব ভারতের মণিপুর থেকে যুধিষ্ঠিরের আশ্বমেধের ঘোড়া তাম্রলিপ্ত নগরে প্রবেশ করে। এখানে তাম্রলিপ্ত রাজ্যকে রত্নাবতীপুর নামে অভিহিত করা হয়েছে। উক্ত পংক্তিতে হয় অর্থে ঘোড়াকে বোঝানো হয়েছে।
শিখি কথাটির অর্থ হল ” ময়ূর” ; তাই তমলুক রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রাজার নাম #ময়ূরধ্বজ হিসাবেই রাজবাড়ির বংশতালিকায় উল্লেখিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থেও ঐ নাম দেখা যায়। তিনি অর্থাৎ ময়ূরধ্বজও অশ্বমেধ যজ্ঞের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সময়টা পাণ্ডবদের অশ্বমেধ যজ্ঞের প্রস্তুতির সময়েই ছিল। উক্ত কারণে তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ আনয়নের কার্যও সমাপ্ত করে রেখেছিলেন। সেই অশ্ব রক্ষার দায়িত্ব ছিল ময়ূরধ্বজ পুত্র তাম্রধ্বজের উপর।
অশ্বমেধ যজ্ঞ করিবেন নরপতি।
অশ্বরক্ষা করে তাম্রধ্বজ মহামতি।।
জ্ঞাতব্য যে পবিত্র নর্মদা নদীর একটি অংশ হয়ত অখণ্ড ভারতের পূর্ব উপকূল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল ,যা এখন লুপ্ত অথবা ময়ূরধ্বজের রাজত্ব নর্মদার তীর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।
কাশীদাসী মহাভারতে তাই বলা হয়েছে –
অশ্ব লয়ে আছে সেই নর্ম্মদার তীরে।
দৈবে অর্জ্জুনের ঘোড়া গেল সেই পুরে।।
দৈবের খেলায় দুই অশ্বমেধের ঘোড়াই তাম্রধ্বজের হাতে এলো। সেই সময় তাম্রলিপ্ত রত্নাবতীপুর নামেই ভারতে পরিচিত। হস্তিনাপুরের অশ্বমেধের ঘোড়া আটকানোর জন্য পাণ্ডব পক্ষের সঙ্গে তাম্রধ্বজের প্রবল সংগ্রাম হয়।
সেই সংগ্রামে তাম্রধ্বজ একা পরপর কর্ণপুত্র বৃষকেতু, রাজা যুবনাশ এবং তাঁর পুত্র সুবেগ, দৈত্যরাজ অনুশাল, ভদ্রাবতীপুরের রাজা হংসধ্বজ, মণিপুরের রাজা অর্জুনপুত্র বভ্রুবাহন, কৃষ্ণ -নন্দন প্রদ্যুম্ন, কৃষ্ণ সারথী সাত্যকি, ভীম, অর্জুন একে একে সকলকে পরাজিত করেন।
অবশেষে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাম্রধ্বজের পিতা পরম বৈষ্ণব ময়ূরধ্বজের মিলনে হস্তিনাপুরের অশ্ব মুক্ত হয় এবং ময়ূরধ্বজ সসম্মানে পাণ্ডববাহিনীতে যোগদান করেন। অতঃপর দুইটি অশ্বই হস্তিনাপুরে আনীত হয়। তাম্রলিপ্তের অশ্বটির সঙ্গে হস্তিনাপুরে রাজা ময়ূরধ্বজ স্বয়ং আসেন এবং হস্তিনাপুরে একই দিনে দুইটি অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়।
তারপর কি হল ?
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. কাশীদাসী মহাভারত
২. চন্দ্রবংশের ধারায় মহারাজ শশাঙ্কের অনুসন্ধান