বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা কি আদৌ ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা? বিগত পঁচাত্তর বছরে ব্রিটিশ অক্সব্রিজ সিস্টেম ক্ষয় পেতে পেতে পশ্চিমবঙ্গে এখন যেটুকু টিকে আছে,তা কোনো সভ্য সমাজের শিক্ষা ব্যবস্থা হতে পারে না। এই ব্যবস্থা, প্রতিবছর কয়েক লক্ষ উচ্চ ডিগ্রিধারী বেকার তৈরি করে চলেছে। বিগত চৌত্রিশ বছরের বাম শাসন ও দশ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায় দলতন্ত্রের সার্থক প্রবেশ ঘটিয়েছে। কিভাবে? জানতে হলে, আপনাকে চোখ রাখতে হবে নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। বিগত দুই দশক ধরেই, ম্যানেজিং কমিটি ও প্রধানশিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শাসক দল হস্তক্ষেপ করে, যত বেশি সম্ভব নিজেদের তাবেদার ঢুকিয়েছে।
এরফলে, যে পদে একসময় রামতনু লাহিড়ী, রসিক কৃষ্ণ মল্লিক, কুমুদ মল্লিক বসতেন, সেখানে শাসক ঘনিষ্ট ক্ষুদ্র ফ্যাসিস্টরা বসছেন। ‘ফ্যাসি’ অর্থ আকর্ষণী ক্ষমতা। এটা থেকেই ‘ফ্যাশন’ শব্দটি এসেছে। নিজেদের প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে কিছু শিক্ষক নিয়ে প্রধান শিক্ষকরা ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী তৈরি করেন। এনারা স্কুলগুলোতে একাধিক গ্রুপ তৈরি করে বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পড়াশোনার রেওয়াজটাকেই প্রায় তুলে দিয়েছেন। প্রধান শিক্ষক ঘনিষ্ঠ, প্রধান শিক্ষক বিরোধী, কাছে বাড়ি, দূরে বাড়ি ইত্যাদি। স্বাভাবিক ভাবেই, প্রধান শিক্ষক ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুবিধা লাভ করেন। এই গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শর্ত কর্মদক্ষতা নয়, প্রধান শিক্ষকের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য। ক্ষমতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার চারপাশে ‘ফ্যাসিস্ট সার্কেল’ তৈরি করে,যা তাঁর চারপাশের কিছু মানুষকে ওই বৃত্তে টেনে আনে। অথচ,প্রধান শিক্ষকের মুখ্য দায়িত্ব হওয়া উচিত স্কুলের শিক্ষার মান উন্নয়ন।
এখানেই আসে আন্তোনিও গ্রামসির হেজিমনি তত্ত্ব। গ্রিক ‘হেজেমন’ থেকে ‘হেজিমনি’ কথাটা এসেছে; অর্থ ‘কর্তৃত্ব’ বা ‘dominance’। প্রতিটি মানুষ, তাঁর পারিপার্শ্বিকতার প্রতিফলন। পারিপার্শ্বিকতা তাঁকে প্রভাবিত করে, সে অন্যদের প্রভাবিত করতে চায়। সচেতন ভাবে, এই চক্র থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। মাননীয় শিক্ষক মহাশয়দের যথা যোগ্য সম্মান দিয়েই বলছি, স্কুলে শিক্ষকদের নিজেদের পড়াশোনার পরিবেশ উন্নততর হলে পড়ানোর মানও আরো বৃদ্ধি পেত। শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি প্রবেশ করলে, শিক্ষার মান যে কমবে, তাতে আর আশ্চর্য কি!
সময়ের সাথে সাথে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানের অবনতিকে তপন রায়চৌধুরীর চোখে মনে হয়েছিল,’শিক্ষা ব্যবস্থায় ধারাবাহিক অবনমন’। এই অবনমনের দায় কি তবে স্কুলের একার? না। যখন থেকে বামফ্রন্ট স্বশাসিত ম্যানেজিং কমিটিগুলি নিজের অধীনে আনা আরম্ভ করল, তখন থেকেই স্কুল শিক্ষার অবনমনের ত্বরণ শুরু হয়। আর,বর্তমান সরকার তো বিভিন্ন প্রকল্পর চাপে স্কুলগুলোকে বিডিও অফিসের শাখা করে তুলেছে। গত দশ বছরে শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ায় যে বিরাট শূন্য পদের সৃষ্টি করছে, তা স্কুলগুলির পঠন পাঠনকে আরো ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর সাথে আছে, ঢালাও নাম্বার ও পাশের সংস্কৃতি। একসময় শিক্ষার্থীরা জানত, তাদের পড়াশোনার মান অনেক অতি উন্নত না হলে তারা মাধ্যমিকের গন্ডিও পার করতে পারবে না। শিক্ষকদেরও মাধ্যমিকের জন্য শিক্ষার্থীদের যত্ন সহকারে তৈরি করতে হত। এখন,প্রায় বিনা আয়াসে,ঢালাও নাম্বার সহ মাধ্যমিক পাশ মাধ্যমিক ও স্কুল শিক্ষার গুরুত্ব কমিয়েছে সন্দেহ নেই।
বামফ্রন্ট সরকারের সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুল শিক্ষার সমান্তরালে গড়ে ওঠা, বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল শিক্ষা, শিক্ষা ব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট করেছে। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিটি শিশুর অধিকার। কোনো সভ্য দেশ তার শিশুদের বিদেশী ভাষার মাধ্যমে শিখতে বাধ্য করছে, এটা বিস্ময়কর। এই ব্যবস্থা, শিশুর প্রতি মানসিক নির্যাতনের চূড়ান্ত। যে শিশু শিক্ষা আরম্ভই করছে মাতৃভাষার তুলনায় ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা উন্নততর জেনে, তারমধ্যে আমাদের পরিবার, সমাজ ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা কিভাবে আসবে! মাতৃভাষার মাধ্যমে কিভাবে আধুনিক শিক্ষা দিতে হয়, তা আমাদের চীন,জাপান,জার্মানির থেকে শেখা উচিত। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার মাধ্যমেও ভালো ইংরেজি শেখা সম্ভব। ভুলে যাবেন না, এন. সি.চৌধুরী, গায়েত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকও বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থী ছিলেন। শিক্ষার মাধ্যমে IQ(ইন্টেলিজেন্ট কসয়েন্ট), EQ(ইমোশনাল কসয়েন্ট ), MQ(মরাল কসয়েন্ট), SQ(সোশ্যাল কসয়েন্ট), এবং PQ(ফিজিক্যাল কসয়েন্ট)এর বিকাশ হওয়া উচিত। প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষায় সামাজিক ও নৈতিক বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্ব পেত। সরকারি স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থাও বহুদিন পর্যন্ত সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কিন্তু, বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঁচটা কসয়েন্টএর বিকাশই কি যথাযথ হয়? ভেবে দেখবেন।
কোনো সন্দেহ নেই, বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা খাতের অর্থ সাশ্রয় করছে। কিন্তু, অনিয়ন্ত্রিত, সমান্তরাল এই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলি শিক্ষার্থীদের অবচেতনে ভারতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি- সমাজ সম্পর্কে নিচু ধারণা তৈরি করছে। সোসালিসম এর বদলে গড়ে উঠছে ইন্ডিভিজুয়ালিসম এর ধারণা। ফলে, এদের মধ্যে সমাজ তো বটেই পরিবারের প্রতি একাত্ম বোধও গড়ে উঠছে না। আমরা সমাজবদ্ধ জীব। আমরা একত্র হলে তৈরি হয় ‘সমূহ’। ‘সমূহ’ থেকে গড়ে ওঠে ‘সমাজ’। প্রতিটা মানুষের সমাজের প্রতি নির্দিষ্ট কর্তব্য থাকে। আমরা যদি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সামাজিক রীতিগুলির প্রতি শ্রদ্ধাশীল না করতে পারি, তবে তারা ভবিষ্যতে আত্মলীন, বিচ্ছিন্ন হতে হতে সামাজিক কাঠামোকেই ভেঙ্গে ফেলবে; এই প্রক্রিয়াকে মহান চিন্তাবিদ দত্তপন্থ থেংরে বলেছেন, ‘এলিয়েনাইজেশন’।
তবে,এর সমাধান কি? শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার সাধনে আমরা তাকাতে পারি জ্যাক দেরইদা র ‘থিওরি অফ ডিকনস্ট্রাকশন’এর দিকে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ভারতীয় ঘরানা মার্জিনাল ও পাশ্চাত্য ঘরানা সেন্ট্রাল হয়ে পড়েছে। ডিকনস্ট্রাকশনের তত্ব বলছে, অবিলম্বে অবহেলিত মার্জিনাল ব্যবস্থাকে সেন্ট্রাল করতে হবে। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থায় ফিরে আসুক ভারতীয় মূল্যবোধ সহ ভারতীয় শিক্ষা পদ্ধতি। পরীক্ষার মান এত উন্নত হোক যে, পরীক্ষার বাঁধা পার হতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। আর, শিক্ষার মাধ্যম বাধ্যতামূলকভাবে মাতৃভাষা হোক, সঙ্গে বিদেশি ভাষাটাও আরো গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হোক। সরকারি স্কুলগুলোতে প্রকল্পের থেকে বেশি গুরুত্ব পাক শিক্ষার মানোন্নতি। শিক্ষার্থীদের মননেও শ্রদ্ধা আসুক আমাদের পরিবার-সমাজ -সংস্কৃতি সম্পর্কে।
সুমন চক্রবর্তী