আজ ৫ই আগস্ট আকাশে ভালোই মেঘ, সাথে হালকা ঠান্ডা। জম্মু থেকে লাহোরগামী রাওলপিন্ডির রাস্তাটা যদিও আজ ঠিকঠাকই আছে। তাই গান্ধীজি এই পথেই লাহোর এর দিকে যাচ্ছেন।
রাস্তায় ছিল একটি শরণার্থী শিবির। ওয়াহা শিবির এটি ছিল দাঙ্গাপীড়িত হিন্দু ও শিখদের শরণার্থী শিবির। এই শিবিরে ঢুকলেই জানা যাবে স্থানীয় মুসলিমদের দ্বারা এরা কতটা অত্যাচারিত হয়েছিল। অনেক সম্ভ্রান্ত ধনী ঘরের লোকেরাও এই শিবিরে গাদাগাদি করে আছে। তাদের প্রতিষ্ঠা অর্থ কোন কিছুই তাদের রক্ষা করতে পারে নি। গান্ধীজির ইচ্ছা ছিল এই শিবিরটি একবার ঘুরে দেখা। কিন্তু সঙ্গের লোকেরা ঠিক ইচ্ছুক ছিলেন না। কারন তারা জানে শিবিরের শরণার্থীরা তখন কংগ্রেস ও গান্ধীজির ওপর কতটা খাপ্পা। গান্ধীজিকে সামনে পেলে যদি কিছু করে বসে। কিন্তু গান্ধীজি গোঁ ধরেছেন। ওই শিবিরে তিনি যাবেনই।
এক মাস আগেও ওয়াহা শিবিরে প্রায় পনের হাজার শরণার্থী ছিল। কিন্তু যত দিন গেছে শিবির থেকে লোক পালিয়েছে। কারন ইতিমধ্যে শিবিরে খবর পৌঁছে গেছে ভারত ভাগ হলে শিবির পাকিস্তানের দিকে পড়বে। তাই যাদেরই সম্ভব হয়েছে তারাই এখান থেকে পূর্ব পাঞ্জাবের দিকে পালিয়ে গেছে। অধিকাংশ বয়স্ক লোকেরাই থেকে গেছেন এবং তারাও অধিকাংশই পুরুষ । কারন কিছু কম বয়সী ও মাঝবয়সী মহিলারা আগে সুযোগ বুঝে পালিয়েছে আর বাকিরা মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড ও খান সেনাদের হাতে অত্যাচারিত ও ধর্ষিত হয়ে মারাই গেছে।
গান্ধীজি শিবিরে পৌঁছাতে সেখানকার সবথেকে পরিষ্কার জায়গায় গান্ধীজিকে নিয়ে গিয়ে বসান হল এবং শিবিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার খানেক লোককে যোগাড় করে গান্ধীজির সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হল। গান্ধীজির সামনে এদের প্রাথমিক প্রার্থনা ও বক্তব্য পর্বের পর এদের মধ্যে দুজন শিখ যুবক সাহস করে গান্ধীজিকে বলেই বসলেন আপনি অবিলম্বে আমাদের এই শিবিরটিকে পূর্ব পাঞ্জাবে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। কারন আমরা জেনে গেছি যে এই জায়গাটি দেশভাগ হলে পাকিস্থানে পড়বে। ইংরেজ শাসনেই যদি মুসলিমরা এত বেপরোয়া হয়ে আমাদের হত্যা করতে পারে তবে খান সেনার শাসনে কি হতে পারে ভাবলেই শিউরে উঠছি।
গান্ধীজি কিন্তু ভাবলেশহীন ভাবে বললেন, আপনারা মিথ্যেই ভয় পাচ্ছেন। মুসলিমরা নিজেদের দেশের দাবী নিয়ে একটু বেশিই চিন্তিত তাই বিক্ষিপ্ত ভাবে এরকম ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছে। ভারত ভাগ হয়ে ওদের হাতে যদি হোম ল্যান্ড তুলে দেওয়া হয় তখন ওরা আর এরকম কিছু করবে না। তাছাড়া স্বয়ং জিন্না সাহেব বলেছেন পাকিস্তানে সমস্ত হিন্দু ও শিখরা সুরক্ষিত থাকবেন। আমি যদি পনেরই আগস্ট নোয়াখালি যাওয়ার প্রতিশ্রুতি না দিতাম তাহলে আমি আপনাদের এই শিবিরেই থাকতাম।
কিন্তু গান্ধীজির আশ্বাস বাণীতেও কেউ এখন আর আশ্বস্ত হতে পারছেন না। গান্ধীজি যেন বুঝতেই চাইছেন না যে রক্তের স্বাদ পাওয়া নেকড়ের কাছে এই দুর্বল ভীত লোকগুলোর কি আর ক্ষমতা। যাইহোক ওখানকার লোকেদের আশ্বস্ত করতে নিজের প্রতিনিধি হিসাবে ডা. সুশীলা নায়ারকে গান্ধীজি ওখানে রেখে গেলেন।
অন্য দিকে লাহোরের ছবিটা আবার অন্য রকম। আজ ৫ই আগস্ট ১৯৪৭। লাহোর বাজারের সমস্ত হিন্দু-শিখ দোকানীরা দোকান বন্ধ রেখে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন্। মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের লোকেদের জুলুম দিন দিন মাত্রা ছাড়াচ্ছে। যদিও এরা সামনে দেখায় এদের সাথে ‘মুসলিম লীগের’ কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু এরা মুসলিম লীগেরই মদতপুষ্ট একটি সংগঠন। এদের কাজই হল বিভিন্ন জুলুমবাজি করে স্থানীয় হিন্দু শিখদের ওপর এমন অত্যাচার করবে যাতে তারা সব কিছু ছেড়ে পালায়।
এদের মূল লক্ষ্যই হল এখানকার হিন্দু শিখদের মধ্যে এমন আতঙ্ক তৈরি করে রাখা যাতে দেশভাগের পর এরা কেউ যেন পাকিস্তান প্রদেশে থাকার সাহস না পায়। লাহোরের গভর্নর হাউসে গভর্নর ইবন জেনকিন্স আজ একটু বেশিই চিন্তিত । তিনি দীর্ঘদিন পাঞ্জাব প্রদেশে থাকার দরুন এখানকার নার্ভ ভালোই বুঝতে পারেন। তিনি বুঝতে পারছেন শিখ –হিন্দুদের নির্দিষ্ট বাজার বন্ধকে কেন্দ্র করে মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের লোকেরা ভালোই উসকানি দিচ্ছে, যাতে দাঙ্গা লাগতে পারে। আবার এর মধ্যে এখানে গান্ধীজিও আসতে চলেছেন।
এদিকে বাজার বন্ধের প্রভাব লাহোরের বেশ কিছু জায়গায় ভালোই পড়েছে । গত মার্চের পর থেকে এখানে হিন্দু শিখদের একত্রীকরনের কাজ আর এস এস ভালোই করছে। এলাকায় এখন ২০০ এর ওপর সঙ্ঘের শাখা চলে। ফলে এখন আর আগের মত হিন্দু-শিখরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করেন না। যদিও মার্চের দাঙ্গার পর অনেক হিন্দু-শিখ এই এলাকাছাড়া।
করাচী – লাহোর থেকে প্রায় ৮০০ মাইল দূরে করাচী। সেখানে আজ আবার অন্য উন্মাদনা । আজ সেখানে আর এস এস এর সরসঙ্ঘচালক মাধব গোলওয়ালকর গুরুজীর আসার কথা। অখন্ড করাচীতে গুরুজীর সুরক্ষার ভার সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা নিজেরা নিয়েছে। করাচী মহানগরের কার্যবাহ তখন লালকৃষ্ণ আদবানীজী। ওনার নেতৃত্বে অনেক স্বয়ংসেবক জড়ো হয়েছেন করাচী বিমান বন্দরে কয়েকজন স্বয়ংসেবক আবার এদিকওদিক সাধারন যাত্রীর ছদ্মবেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পরিস্থিতি নজর রাখার জন্য। তিনজন বোরখা পরে আছেন। যাতে প্রয়োজনে ওই বোরখার ঘেরাটোপে গুরুজীকে নিয়ে বেরতে সুবিধা হয়।
যে করাচী শহর আর ৭ থেকে ১০ দিন পরেই পাকিস্তানে চলে যাবে, যাকে পাকিস্তানের অস্থায়ী রাজধানী বলে ভাবা হচ্ছে আজ সেখানেই গুরুজীর উপস্থিতিতে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের পথ সঞ্চলন ও জনসমাবেশের প্রোগ্রাম রাখা হয়েছে। বিশাল স্বয়ংসেবক সমাবেশের মাধ্যমে মাধ্যমে এলাকার হিন্দু-শিখদের মনে সাহস সঞ্চার করা। বিকেল ৫টায় প্রায় দশ হাজার স্বয়ংসেবকের এই পথ সঞ্চলন সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিল যে হিন্দুরা আর মার খেতে রাজী নয় বরং মোকাবিলার জন্য পুরোপুরি তৈরি। লাহোর করাচী ওয়াহা শিবিরের টেনশন থেকে অনেক দূর মধ্য দিল্লীতে তখন নেহরু মগ্ন তার আগামী মন্ত্রীসভার দায়িত্ব বণ্টনের প্রস্তুতি নিয়ে। গান্ধীজি গুরুজী যখন অশান্ত এলাকায় ঘুরে সেখানকার মানুষদের শান্তি ও সাহস যোগাচ্ছেন তখন ভারতের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী তার রাজ্যপাটের স্বপ্নে বিভোর। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ইতিমধ্যে নেহরুকে আগ্রহ জানিয়েছেন যে বর্তমান ভারত সরকারের এডিটর জেনারেল বরটি স্টেগকে যেন স্বাধীন ভারতের সরকারেও গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়। নেহরু তার সম্মতি বার্তা পাঠানোতে এখন ব্যস্ত। লর্ড মাউন্টব্যাটেন নেহরুকে আরও জানতে চেয়েছেন যে স্বাধীন ভারতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন নিয়ে সরকারের অবস্থান কি হবে, কি হবে অন্যান্য আধিকারিকদের নিয়ে সরকারের ভাবনা। নেহরু এখন তারই জবাব দিতে ব্যাস্ত। তিনি চিঠি লিখে স্পষ্ট করলেন যে মাউন্টব্যাটেনকে ভাইসরয় হিসাবে ভারতে রাখতে নেহরুর নেতৃত্বাধীন সরকারের কোন আপত্তি নেই।
ওদিকে করাচীর চৌরাস্তার কাছের বড় মাঠে গুরুজীর সভার আয়োজন করা হয়েছে। ১০ হাজারের বেশি স্বয়ংসেবক ও বিশিষ্ট মানুষদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। সভার সভাপতি হিসাবে এসেছেন সিন্ধী সমাজের প্রমুখ সন্ত সাধু বাসবানী জি । নিজের বক্তব্য রাখার সময় উনি স্পষ্ট করে দিলেন যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সঙ্গে সিন্ধী সমাজও সামিল হবে। এরপর গুরুজী বক্তব্য রাখতে উঠলেন। গুরজীর ভাষণে উপস্থিত জনতার গায়ে কাঁটা দিতে থাকে। সকলের মধ্যে আরও সাহসের সঞ্চার করে গুরুজী বললেন “ইংরেজরা যে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি নিয়েছিল তারই ফলশ্রুতি আমাদের এই দেশভাগ কংগ্রেসি নেতাদের ভুলের কারনেই আজ মুসলিম লীগ এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আজ ওরা আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি জানাচ্ছে ওরা আমাদের দেশিয় পরম্পরা ভুলে আরবী পরম্পরায় নিজেদের অংশীদার করতে চাইছে। অথচ ওদের এবং ওদের পূর্বজদের রক্ত আমাদের এদেশীয় রক্ত। এখন এটা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে যে আমরা একটা খন্ডিত স্বাধীনতা পেতে চলেছি।
রাজা দাহিরের প্রদেশ মরুতীর্থ হিংলাজের এলাকা আজ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছে। আজ এই দুর্যোগের দিআর সমস্ত হিন্দুদের এক হয়ে থাকতে হবে, তবেই আমাদের অস্তিত্ব থাকবে। সংকটময় এই পরিস্থিতি শীঘ্রই কেটে আবার আমরা সুন্দর দিন দেখতে পাব। গুরুজীর ভাষণ শেষ হলে সেখানকার অনেক প্রমুখ লোক গুরুজীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। যাদের মধ্যে ছিলেন স্বামী রাজনাথানন্দজী, প্রফেসর মালকানী, লালজী মেহরত্রা, প্রফেসর ঘনশ্যাম, গিররতন মেহতা, ‘সিন্ধ অবজারভারের’ এর সম্পাদক কে গুলাইয়া ও এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তিনি গুরুজীকে বললেন ঝামেলা এড়িয়ে শান্তিতে থাকার জন্য বিভাজন মেনে নিলেই তো ভাল। পচে যাওয়া পা কেটে ফেললেই তো বাকি দেহ ভাল থাকবে। কিন্তু গুরুজী সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানান, । সিন্ধু প্রদেশের মহিলারাও সেদিন গুরুজীকে তাদের দুর্দশার কথা জানান। হিন্দুরা সেই সময় অত্যন্ত পীড়িত এবং হতাশ হয়ে পড়েছিল । গুরুজীর সাথে তাদের আরও অনেক কিছু আলোচনা করার ছিল, কিন্তু সেই দিন গুরুজীর হাতে আরও অনেক কাজ ছিল। ওই অঞ্চলের প্রচারক এবং কার্যবাহকদের সঙ্গে তাঁর বৈঠক করার কথা ছিল, এছাড়াও অনেক অন্যান্য কাজ ছিল তাও তিনি ধৈর্য ধরে সব অভিযোগ শোনেন।
৫ই আগস্টের দিল্লী যখন শান্তিতে নিদ্রামগ্ন ছিল সেই সময় তখন পাঞ্জাব, সিন্ধ এবং বাংলার বিভিন্ন প্রান্তরে দাঙ্গার আগুন জ্বলছিল। এই সময় গুরুজী তপস্বীর মত বিভাজনের এই ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথ খুঁজছিলেন।