সমস্ত কার্যকর্তাকেই তিনি স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। যে কোনো ব্যক্তি তার সংস্পর্শে এলে তাঁর ব্যক্তিত্বের দ্বারা অনুপ্রাণিত হতেন। অন্তহীন কৌতুহল ও যুক্তিবাদী মানসিকতার এই প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিকে নিয়ে রইল সামান্য কিছু আলোচনা।
-বিজয় চৌথাইওয়ালে
গতকাল ছিলো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ৪র্থ সরসঙ্ঘচালক শ্রী রাজ্জু ভাইয়ার জন্মশতবার্ষিকী। তিনি ছিলেন একজন বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সমস্ত কার্যকর্তাকেই তিনি স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। রাজ্জু ভাইয়া ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। যে কোনো ব্যক্তি তার সংস্পর্শে এলে তাঁর ব্যক্তিত্বের দ্বারা অনুপ্রাণিত হতেন। অন্তহীন কৌতুহল ও অনুসন্ধিৎসু মানসিকতার এই প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিকে নিয়ে রইল সামান্য কিছু আলোচনা
এটা ১৯৭৮ কিংবা ‘৮৯ সালের কথা। আমি তখন জুনিয়র কলেজে আছি। রাজ্জু ভাইয়া তখন আরএসএস-এর সর-কার্যবহ (সাধারণ সম্পাদক) হিসাবে বিদর্ভ সফরে এসেছিলেন। আমি তখন আমাদের কলেজে বিজ্ঞান ক্লাবের সদস্য ছিলাম। কলেজে আমাদের পরামর্শদাতা এবং শিক্ষক, শ্রী বিশ্বাস লাপালকর আমাদের বিজ্ঞান ক্লাবে শ্রী রাজ্জু ভাইয়ার একটি বক্তৃতার ব্যবস্থা করেছিলেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এই বিশ্বাস লাপালকর পরে বিবেকানন্দ কেন্দ্রের ফুল টাইমার হিসেবে অরুণাচল প্রদেশে গিয়েছিলেন। রাজ্জু ভাইয়ার বক্তব্যের বিষয় ছিলো “সংবেদনশীল যন্ত্র”। যেহেতু তিনি পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন‚ তাই আমরা সবাই ভেবেছিলাম যে পদার্থবিজ্ঞানের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির বিষয়েই তিনি কথা বলবেন।
কিন্তু দেখলাম তিনি ঈশ্বরপ্রদত্ত সংবেদনশীল অঙ্গগুলি যেমন‚ চোখ, কান এবং নাক সম্পর্কে কথা বলছিলেন। তিনি বর্ণনা করছিলেন যে নিজের নিজের কাজে তারা কতটা শক্তিশালী। কিভাবে অন্যসব প্রাণীরা এই যন্ত্রগুলির সম্ভাব্য ব্যবহার সবথেকে বেশি পরিমাণে করে আর মানুষ এগুলোকে কত কম পরিমাণে কাজে লাগায়।
পরবর্তীতে আমি যখন পিএইচডি করার জন্য পুনেতে ছিলাম‚ তখন তাঁর সাথে তিন দিন কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন তিনি পুনে সফরে ছিলেন। এবিভিপি এর কার্যকর্তা, শ্রী বিশ্বাস এবং শ্রীমতি অঞ্জলিতাই দেশপান্ডের বাড়িতে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর আমাকে বলা হয়েছিল সেই পরিবারকে সাহায্য করতে। সঙ্ঘের পরিভাষায় এই দায়িত্বপ্রাপ্তকে বলা হয় প্রবন্ধক। প্রতিদিন তিনি তাঁর নির্ধারিত কর্মসূচীর জন্যে খুব ভোরে বাড়ি থেকে বের হতেন এবং রাতের খাবারের আগে ফিরে আসতেন। আমি খাওয়ার সময় তাঁকে সঙ্গ দিতাম। কখনো কখনো তিনি তাঁর ঘরে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত তাঁর সাথেই থাকতাম। এই সময়, আমি তার কৌতূহলী এবং অনুসন্ধিৎসু মানসিকতা সম্পর্কে ধারণা পাই। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে তিনি আমায় অসংখ্য প্রশ্ন করতেন। আমার পিএইচডি সম্পর্কে , জীবতত্ত্ব সম্পর্কে তার নিজের ধারণা নিয়ে‚ বিবর্তন তত্ত্ব এবং জিন এবং ডিএনএ নিয়ে আমাদের অনেক কথা হত। তারপরে তিনি আবার সেইদিনের সংবাদপত্র খুলতেন। তবে তা কোনো রাজনৈতিক খবরের জন্যে নয় বরং ক্রিকেট ম্যাচের খবরাখবর নিতে। তার অন্তহীন প্রশ্ন দেখে আমি একদিন তাকে মজা করে বলেছিলাম যে আমি এখন পিএইচডি ভাইভার ( মৌখিক পরীক্ষা) জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আমি নিশ্চিত যে সেটা তাঁর প্রশ্নগুলোর মতো কঠিন হবে না। বহুবছর পর তাঁর সাথে দেখা হওয়ার পর দেখেছিলাম সেই কথাগুলো তিনি মনে করে রেখেছেন আর আমায় মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
তাঁর সফরের শেষ দিনে, তিনি পুনের শনিওয়ার পেঠে আরএসএস অফিসে (মতিবাগ) চলে যান। তিনি কিছু ওষুধ কেনার জন্যে ফার্মেসীতে যেতে চাচ্ছিলেন। আমি নিজে সেগুলো এনে দেওয়ার কথা বললে তিনি না করেন এবং আমাকে তাঁর সাথে যেতে বলেন। আমরা একটা নির্দিষ্ট ওষুধ কেনার জন্যে ৮-১০ টা দোকানে ঘুরেছিলাম। তিনি “র্যানবাক্সি” এর তৈরী ওষুধ কিনতে চাচ্ছিলেন। যদিও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর তৈরী সমমানের ওষুধ সবজায়গাতেই পাওয়া যেত তবে তিনি এদের ওষুধই চাচ্ছিলেন। যাইহোক‚ অবশেষে তাঁর কাঙ্খিত ওষুধ আমরা পেয়েছিলাম।
বেশ কয়েক বছর পর, ১৯৯৯ সালে আহমেদাবাদে আমরা একটা নতুন অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলাম। কাকতালীয়ভাবে শ্রী রাজ্জু ভাইয়া ( তখন তিনি সর সঙ্ঘচালক হয়ে গিয়েছেন) আমাদের বাড়ির গৃহপ্রবেশের দিন আহমেদাবাদেই ছিলেন। আগের দিন তাঁকে আমরা নিমন্ত্রণ করেছিলাম আমাদের বাড়িতে গিয়ে আমাদের আশীর্বাদ করার জন্যে। তিনি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়েছিলেন। সব অতিথিরা দুপুরে আসবে বলেসেই সময় বাড়িতে অনেক ভীড় থাকবে‚ তাই পরিকল্পনা করা হয়েছিলো যে তিনি সন্ধ্যে বেলায় আসবেন। কিন্তু আপত্তি জানিয়ে তিনি বলেছিলেন যে তিনি অন্যদের সাথেই দুপুর বেলায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাবেন।
পরের দিন তিনি সময়মতো পৌঁছেছিলেন আর দুপুরে খাওয়ার আগে বাড়ির প্রতিটি কোণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। রান্নাঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে বাথরুমের জিনিসপত্র পর্যন্ত, সকালের সূর্যের আলো কোথা থেকে আসবে বা গ্রীষ্মকালে কোন ঘর সবথেকে বেশি গরম হবে – এইসব বিস্তারিতভাবে দেখেছিলেন তিনি। কোনো কিছু দেখে পছন্দ হলে তিনি তার প্রশংসাও করছিলেন।
- এই মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলী