২০০৪ সালে তামিলনাড়ুর কোয়ম্বত্তূরে প্রথম স্যানিটারি প্যাড তৈরির যন্ত্রটি যখন আবিষ্কার করেন অরুণাচলম মুরুগনন্তম, তাঁর উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সংস্কারপন্থী সমাজ। মহিলাদের ঋতুস্রাব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন একজন পুরুষ, প্রকাশ্যে তৈরি করছেন প্যাড, এ কি রকম অনাসৃষ্টি কাণ্ড! বাধা যতই আসুক, ছিছিক্কার যতই বাড়ুক, মুরুগনন্তম জানতেন একদিন এই কাজে এগিয়ে আসবে বৃহত্তর সমাজ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। তাঁর ধারণা যে অমূলক ছিল না তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে বর্তমান সমাজেই। ঋতুস্রাব এবং মহিলাদের স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সার্বিক স্তরে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এ বার এই কাজে এগিয়ে এলেন এক মহিলাও।
চেন্নাইয়ের আন্না ইউনিভার্সিটির পিএইচডি স্কলার প্রীতি রামাডোস। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিস্টাল গ্রোথ সেন্টারের মেধাবী ছাত্রী প্রীতি বানিয়ে ফেলেছেন ‘ইকো-ফ্রেন্ডলি’ স্যানিটারি ন্যাপকিন। বায়োডিগ্রেডেবল সেই প্যাড তৈরি হয়েছে প্লাস্টিক জাতীয় উপাদান ছাড়াই। দামেও সস্তা আর ব্যবহারেও সম্পূর্ণ নিরাপদ। প্রীতির নতুন পরিচয় এখন ‘প্যাডওম্যান’।
‘‘পরিবেশকে ভালোবাসি। তাই মহিলাদের স্বাস্থ্যবিধির প্রচারের পাশাপাশি পরিবেশ সচেতনতাকেও ছড়িয়ে দিতে চাই মানুষের মধ্যে। তাই এই উদ্যোগ নিয়েছি। আমার গবেষণার বিষয়ও ছিল এটাই,’’ বলেছেন গর্বিত প্রীতি। তাঁর কথায়, মেয়েদের ঋতুচক্র চলার সময় যতগুলো প্যাড দরকার হয়, তাতে কিছু না হলেও দু’টো গাছের প্রাণ যায়। এটাই বন্ধ করতে চেয়েছেন তিনি।
তাহলে প্রীতির স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিশেষত্ব কী? প্যাডওম্যানের কথায়, এই প্যাড তৈরি হয়েছে সেলুলোজ জাতীয় উপাদান দিয়ে। হলুদ, ঘাস, নিম এবং লেবু এই প্যাড তৈরির অন্যতম উপাদান। প্লাস্টিকের সেখানে কোনও জায়গাই নেই, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদার্থ যেমন পলিস্যাকারাইড এবং পলিমার দিয়ে তৈরি হয়েছে স্যানিটারি ন্যাপকিন। প্রীতি জানিয়েছেন, এই প্যাড ‘সুপার থিন’, পুরুত্ব মাত্র ৩ মিলিমিটার।
২০১৫ সালের জুলাই থেকে বায়োডিগ্রেডেবল প্যাড তৈরির কাজ শুরু করেন প্রীতি। বলেছেন, ‘‘বাজার চলতি যে সব ন্যাপকিন ও ডায়াপার পাওয়া যায় সেগুলিতে প্লাস্টিকের পরিমাণ থাকে খুব বেশি। ওইসব প্যাডের উপরে থাকে হাইড্রোফোবিক সিট যা পলিপ্রপিলিন (প্লাস্টিক উপাদান) দিয়ে তৈরি হয়। এই সিট বেশিক্ষণ শরীরে সংস্পর্শে থাকলে র্যাশ, চুলকানির মতো ত্বকের সমস্যা হতে পারে। কিন্তু আমার তৈরি প্যাডের পুরোটাই প্রাকৃতিক।’’ সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব প্লাস্টিক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (CIPET) এই ন্যাপকিনকে সুরক্ষিত ঘোষণা করেছে। তা ছাড়া আন্না ইউনিভার্সিটির গবেষণাগারেও অসংখ্য বার এই স্যানিটারি ন্যাপকিনকে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রীতি।
গবেষণার কৃতিত্বটা একা নিতে চাননি প্রীতি, জানিয়েছেন এই কাজে তাঁর পাশে ছিলেন তাঁর শিক্ষক, গাইড ডঃ আরিভৌলি দক্ষিণামূথি। প্রীতির কাজের প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, ‘‘এখন ইউনিভার্সিটির সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ থেকে প্যাড তৈরির টাকা তোলা হয়েছে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংস্থা যদি আমাদের আর্থিক সহযোগিতা করে, তাহলে দেশের নানা প্রান্তে আরও বেশি সংখ্যক মহিলাদের মধ্যে এই প্যাড পৌঁছে দেওয়া যাবে।’’
লড়াইটা শুরু করেছেন প্রীতি। সমাজের নানা স্তরে তাঁর গবেষণাকে মুক্ত হাওয়ার মতো ছড়িয়ে দিতে কোমর কষেই নেমেছেন তিনি। কিন্তু, মুশকিল হল, কুসংস্কার যে দেশের শিরায়-উপশিরায় বিদ্যমান, সেখানে সচেতনতা শুধুই একটা শব্দ মাত্র। ঋতুস্রাব নিয়ে খোলামেলা আলোচনা এখনও সমাজের অনেক স্তরেই গর্হিত অপরাধ। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দেশে ১৫-২৪ বছর বয়সী মেয়েদের বেশিরভাগই ঋতুকালীন সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেন না। একই ছবি এ রাজ্যেও। ঋতুস্রাবের সময় আদিবাসী গরিব মেয়ে, বৌয়েদের ভরসা এক টুকরো কাপড় অথবা ছাই। ঋতুমতী নারী মানেই সে অচ্ছুত। সচেতনতার প্রচারকে সেখানে বাঁকা চোখে দেখা হয়। শান্ত-সুশীলা, শত চড়েও রা না কাটা, গাভীর ন্যায় আজ্ঞাপালনকারী মেয়ে-বউ ছিলেন যাঁরা, তাঁরা নাকি নেবে ঋতুস্রাব নিয়ে সচেতনতার পাঠ? নৈব নৈব চ। তবে থেমে থাকলে তো চলবে না। তা থেমে থাকেননি সমাজের অধিকাংশ মানুষ।
প্রধানমন্ত্রী ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ প্রকল্পে হাতে হাতে মোবাইল। কিন্তু মহিলাদের ঋতুকালে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে দেশ সেই তিমিরেই। মাত্র ৫০ শতাংশ মেয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে পারেন। তা-ও দীর্ঘমেয়াদি সচেতনতা প্রসারের পরে। ‘প্যাডম্যান’ ছবি মুক্তি পাওয়ার পর কিছুটা হলেও জনমানসে একটা ধাক্কা লেগেছে। মেয়েদের নিয়মিত ঋতুস্রাব হয় এবং সেটা লুকিয়ে রাখার নয়, তার জন্য লজ্জার কিছু নেই— এই সরল কথাটা বাঁধ ভাঙা জলের মতোই শহর থেকে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। পিতৃতন্ত্রের দরজা ভেঙেই হোক কিংবা তিরতিরিয়েই হোক, কোথাও একটা সাহস ধীরে ধীরে দানা বেধেছে মানুষের মনে। পরিবর্তনের এই হাওয়াকেই হাতিয়ার করে এগিয়ে যেতে চান প্রীতি।