আচ্ছা বল তো দেখি , জ্ঞান না বল কোনটি শ্রেষ্ঠ ? আচ্ছা তোমার শরীর যদি খারাপ থাকে দীর্ঘ কাল তবে কি তুমি জ্ঞান চর্চা করতে পারবে, যদি তোমার মনোবল বা মানসিক বল কঠিন না হয় ? শরীর চর্চা করলে দেহ যেমন সুস্থ থাকে , তেমন মনের বল , একাগ্রতা বৃদ্ধি পায়। ওই যে স্বামীজী ফুটবল খেলতে বলেছিলেন। তার মানে কি উনি শাস্ত্র পাঠ করতে মানা করেছেন ? না মোটেই না। এর অর্থে উনি বলেছেন , ” তুমি যদি দুর্বল হও তবে তুমি শাস্ত্রের সহজ অর্থ করতে গিয়ে ভুল অর্থ করবে, গীতার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারবে না। ” ,মুন্ডক উপনিষদ্ তাই বলেছেন – ” নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ”….. বাস্তবিক , আত্মজ্ঞান দুর্বলের জন্য নয়।
শরীর , মন , বুদ্ধি সকল স্তরের বল একজন বীরপুরুষ গঠন করে। একজন প্রকৃত বীরপুরুষকে সবাই অনুসরণ করে। সুভাষ তেমনই একজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি যা করবেন বলে সংকল্প করতেন তাই তিনি করতেন। এমনকি সেই কাজ যদি তাঁকে একাকে করতে হয় তাও তিনি কোনোদিন পিছপা হন নি। তাই নারদকে সনৎকুমার বলেছেন – মনের থেকেও শ্রেষ্ঠ হল সংকল্প। লোকে প্রথমে সংকল্প করে, তারপর সে চিন্তা করে, পরে বাককে পরিচালনা করে, সবশেষে বাককে নাম উচ্চারণে প্রবৃত্ত করে। সমস্ত মন্ত্র নামে এবং সমস্ত কর্ম মন্ত্রে একীভূত হয়।
সুভাষ চন্দ্র, ঋষি অরবিন্দ , সূর্য সেন, বিনয় – বাদল – দীনেশ , যতীন দাস, ক্ষুদিরাম, চন্দ্রশেখর আজাদ, রামপ্রসাদ বিসমিল্, ভগৎ সিং, বালগঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায় প্রমুখের মতো বীরপুরুষ এ সংসারে খুবই কম জন্মেছেন। কিন্তু এই ভারতের বুকে বহু জন্মেছেন। তাঁদের মনমুখ এক ছিল।সংকল্পের এই দৃঢ়তার জন্য বিশ্ব তাঁদের শ্রদ্ধা করে। অনেক সময় আমরা যা ভাবি তা মোটেই করি না। মন ও মুখ এক করে কর্ম করতে হবে। দুর্বল মানুষেরা তা কখনো পারে না।
নারদকে তাই সনৎকুমার বলছেন , – একজন প্রকৃত বীরপুরুষের সামনে একজন প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তিও ভীত থাকেন। যাঁর বল আছে তাঁর উদ্যমও আছে।দুর্বল মানুষ উদ্যমহীন হন। একজন উদ্যমী ব্যক্তি কখনো সময় নষ্ট করেন না।
জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় উন্নতির জন্য মানুষকে বহু পরিশ্রম করতে হয়। হঠাৎ করে কিছুই হয় না। যেমন হঠাৎ করে সুভাষ নেতাজী হন নি। তাঁর জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়ন শৈশব থেকে ধাপে ধাপে লক্ষ্যে এগিয়েছে। তাঁর মতো নেতা এ দেশে খুব , এই পৃথিবীতে খুব কমই জন্ম নিয়েছেন। ভয় ডর বলতে কিছু ছিল না তাঁর মধ্যে। যদি আমার তোমার নজর দিয়ে তাঁকে দেখি ,তিনি ছিলেন জীবন্ত মহাকাল, অসীম ক্ষমতার অধিকারী , তিনি মহাশক্তিধর। যদি বল , তিনি কি বিবেকানন্দের মতো শক্তিধর ছিলেন ? তবে বলি কি গুরুশিষ্যের তুলনা করা উচিত নয়। এক বিবেকানন্দ কত যে দেশমাতৃকার সেবক আজও নির্মাণ করে যাচ্ছেন তার কোনো হিসাব নেই।
সুভাষচন্দ্র মাঝে মাঝেই বলতেন , স্বাধীনতার জন্য বড় বড় বক্তা এবং বাক্ যোদ্ধার বিশেষ দরকার। তাঁর বন্ধু দিলীপ একদিন সেই প্রসঙ্গে বললেন, ” শ্রীরামকৃষ্ণ তো বলেছেন তর্কে সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। ”
উত্তরে সুভাষ বললেন , ” আমরা চিরকাল অতীতকে আঁকড়ে থাকব না । আমাদের গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যৎ। আধুনিক দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।”
দিলীপের মুখ থেকে রা সরে না। রামকৃষ্ণ ভক্ত সব কথা হারিয়ে ফেললেন।
সুভাষ দৃপ্ত কন্ঠে বললেন, ” দেশের জন্য জীবন দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রাখব। কেবল ভাবপ্রবণতায় তা সম্ভব নয়। বিবেকানন্দের মতো কথা বলতে হবে। তাঁর মতো ভাষণ দিয়ে মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে হবে।আমি শ্রীরামকৃষ্ণকে অসম্মান করছি না। তবে আমার গুরুর থেকে শিষ্যকেই বেশি ভালো লাগে। স্বামীজী আমার জীবনের আদর্শ।
দিলীপ বললেন, ” কিন্তু বিবেকানন্দ তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের কাছাকাছি স্তরে পৌঁছেছিলেন এ কথা আমি মানিনা ।তাছাড়া এ কথা বিবেকানন্দ নিজেই বহুবার স্বীকার করেছেন। “
সুভাষ বললেন, ” সেখানেই তো তাঁর মহত্ব। এই জন্যই নরেন বিবেকানন্দ। তিনি এইভাবেই গুরুর প্রতি নিজের শ্রদ্ধা ভক্তি প্রদর্শন করেছেন। নিজের গুরু, গুরুর আদর্শ ও বাণীকে বিশ্বময় বিখ্যাত করেছেন। “
সুভাষের দেশে শাসকের অভাব ছিল না।অভাব ছিল না সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা সাধকেরও। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু, তৈলঙ্গস্বামী, লোকনাথ ব্রহ্মচারী, বামাখ্যাপা প্রমুখ সকলেই সাধনার উচ্চমার্গে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু কেউ কি বিবেকানন্দের মতো শিষ্য পেয়েছিলেন?
তাই তেজোদ্দীপ্ত বীরসন্ন্যাসীর প্রতি সুভাষের এত ভক্তি। তিনি মনে করতেন স্বামীজীই ভারতাত্মার মূর্ত প্রতীক। স্বামীজী ব্যতীত ইতিপূর্বে কেই বা এই দেশের কথা , এই পোড়া জাতির কথা এমন করে ভেবেছেন? স্বামীজীই একমাত্র মহাপুরুষ যিনি ভাবজগতের সাধক হয়ে মাটি ও মানুষের নিকট ছিলেন। তিনিই গেয়ে গেছেন জীবনের গান। আর পাঁচজন সাধকের মতো তিনি কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক জগতে বিচরণ করেন নি। তাঁর বিবেক বাণী জাগ্রত করে তুলেছিল শত সহস্র মানুষকে। নবীন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে তাদের মধ্যে।
তাই তো সুভাষ তাঁকে আদর্শ গুরু হিসাবে গ্রহণ করেছেন। বিবেক বাণীই সুভাষকে অত উদার আর নির্ভীক করে তুলেছিল। সুভাষের সব কিছুর মূলেই ছিলেন বীর সন্ন্যাসী। তাই তো জীবন – মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি থাকতেন নির্বিকার হয়ে। তুচ্ছ জ্ঞান করতেন মৃত্যুকে। আধ্যাত্মিক বলে বলীয়ান হলে তবেই এমন চিন্তাভাবনা করা সম্ভব। বিবেকানন্দের মানসপুত্র সুভাষ ছিলেন সত্যিকারের সাধক। জন্মগত সাধক।
সুভাষ স্বার্থসিদ্ধি বা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করেন নি। আধ্যাত্মিক চেতনাবোধ ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল তাঁর জীবনে। ভারতবাসীর মুক্তি কামনার সঙ্গে জাগ্রত হয়ে উঠত তাঁর মননে মানব মঙ্গলের কথা। তাই তিনি বিশ্বযুদ্ধের বোমা বর্ষণ, গুলি বৃষ্টি, দুর্যোগের মধ্যেও চলে যেতেন সিঙ্গাপুর রামকৃষ্ণ মিশনে।
শৈশবকাল থেকে আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল সুভাষের। বিবেকানন্দকেই তিনি আদর্শ গুরু হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।
সুভাষ বলতেন, ” এমন একটা আদর্শের তখন আমার প্রয়োজন ছিল , যার উপর ভিত্তি করে সকল জীবনটাকে গড়ে তুলতে পারব। সকল প্রলোভন তুচ্ছ হয়ে যাবে। এমন একটা আদর্শ খুঁজে বের করা সহজ ছিল না। ..
হঠাৎ সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবেই যেন সমস্যার সমাধান খুঁজে পেলাম।আমাদের এক আত্মীয় সুহৃদচন্দ্র মিত্র নতুন কটকে এসেছিলেন। আমাদের বাড়ির কাছেই থাকতেন। একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বই নিয়ে ঘাঁটছি। সহসা নজরে পড়ল স্বামী বিবেকানন্দের বইগুলি। কয়েক পাতা উল্টেপাল্টেই বুঝলাম যে এই জিনিসই আমি চাইছিলাম। বইগুলি বাড়ি নিয়ে এসে গোগ্রাসে গিলে ফেললাম। পড়তে পড়তে আমার হৃদয় মন আছন্ন হয়ে গেল। প্রধানশিক্ষকমশাই আমাদের সৌন্দর্যবোধ , নৈতিকতাবোধ জাগিয়ে দিয়েছিলেন।জীবনে এক নতুন প্রেরণা এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু এমন আদর্শের সন্ধান দিতে পারেননি যা আমার সমগ্র সত্তাকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। এই আদর্শের সন্ধান দিলেন বিবেকানন্দ।”
সুভাষচন্দ্র বিবেকানন্দের আদর্শকে সামনে রেখেই সারা জীবন নিরন্তর কর্ম করে গেছেন। বীরসন্ন্যাসী বিবেক – বাণীই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল সবচেয়ে বেশি। নেতাজী বলতেন – ” ধর্মচর্চা বলতে আমি কেবল যোগাভ্যাসকেই জানতাম – এ কথা বললে ভুল বলা হবে। অবশ্য কিছুদিন আমি যোগ নিয়ে একটু অধিক মেতে উঠেছিলাম, কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য জনসেবাও অপরিহার্য। এই ধারনাই বিবেকানন্দ আমাকে দিয়েছেন। তিনিই জনসেবা তথা দেশসেবার প্রচার করেছিলেন।
বীরসন্ন্যাসীর অভয় মন্ত্রের জন্যই একদিন বঙ্গের বীরকুলের শিরোভূষণ হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। ত্যাগে কর্মে চরিত্রে পৌরুষে স্বপ্নে এবং সংগঠনে সুভাষচন্দ্র আজ একেশ্বর সূর্য -শাণিত তলোয়ারের মতো উজ্জ্বল।
এই হলেন বিবেকানন্দভক্ত সুভাষ। এই তাঁর আধ্যাত্মিক জগতের পরিচয়। তাই তো তিনি বিবেকানন্দের মানসপুত্র।
জাগতিক বা আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যও মানুষকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। অকস্মাৎ কিছুই হয় না।অতএব যা, সত্য, যা শিব, যা সুন্দর তাকে লাভ করার জন্য যে আমাদের আরো অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে। তা আর বিচিত্র কি?
অনেকেই ভাবেন , “কবে ব্রহ্ম জ্ঞান লাভ করব?” কিন্তু তার জন্য যে অক্লান্ত পরিশ্রম দরকার তা করতে কি সকলে প্রস্তুত? প্রাচীনযুগে কেউ বেদ অধ্যয়ন করতে চাইলে তাকে গুরুগৃহে গিয়ে বাস করতে হত। পড়াশুনা ছাড়াও তিনি গুরুর সেবা করতেন। সারাদিন তাঁকে নানা ধরনের কাজ করতে হত। খুব কঠোর ছিল সেই জীবন।
বেলুড় মঠে স্বামী ব্রহ্মানন্দের নিকটে এক ভক্ত তার এক সহপাঠীর সঙ্গে আসতেন। ভক্তটি লক্ষ্য করতেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ তাঁর সেবককে কখনো একটু জল আনতে বলেন, কখনো বা ছোটখাটো দু একটা কাজ করে দিতে বলেন। এই ভক্তটিরও বড় ইচ্ছা হত, সে যদি কখনো স্বামী ব্রহ্মানন্দের সেবা করার সুযোগ পায়। খুব শীঘ্রই সে সুযোগ এল। একদিন এক পিওন স্বামী ব্রহ্মানন্দকে একটি পার্সেল দিয়ে গেলেন। ভক্তের ইচ্ছা পূরণ করতেই স্বামী ব্রহ্মানন্দ তাঁকে কৃপা করলেন। পার্সেলটি তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, ” এটি খুব সাবধানে খুলে নিয়ে এস। এমনভাবে খুলবে যাতে এর বাইরের কাগজ বা দড়ি কোনটাই না কাটে।” ভক্তটিও খুব সতর্কভাবে কাজটি সম্পন্ন করলেন।
যে কর্ম করবে নিখুঁত করে কর। হয়তো সেই কাজ দিয়েই ইতিহাস তোমাকে মনে রাখবে। যেমন মনে রেখেছে স্বামীজীকে , নেতাজীকে। সত্যকে জানতেও খুঁটিনাটি সকল বিষয়ে নিখুঁত হও। আমরা মনে করি ত্যাগ – তপস্যা ও ধ্যানধারণার দ্বারাই আত্মজ্ঞান লাভ করা যায়। কিন্তু মন যদি খুঁটিনাটি প্রতিটি ব্যাপারে সতর্ক না হয় , তবে সেই মন দিয়ে ধ্যান করা সম্ভব নয়।
গুরুগৃহে শিষ্য সেবা করার সুযোগ পান। সেই সেবার মধ্য দিয়ে মধ্য দিয়ে গুরু শিষ্যকে লক্ষ্য করেন – শিষ্যর মনোযোগ, একাগ্রতা, কর্মক্ষমতা এবং সতর্কতাকে। যুগ যুগ ধরে এটাই নিয়ম। গুরুকে সেবা করার সময় শিষ্য গুরুর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করে। গুরু যদি তাঁর শিষ্যকে হৃদয় এবং মস্তিষ্ক দিয়ে গ্রহণ করেন , তবে তিনি তাঁর নিজের জ্ঞানভাণ্ডার উজাড় করে দেন। উত্তম আচার্য সর্বদা উত্তম শিষ্য সন্ধান করেন। মনোযোগী, বিনয়ী, প্রকৃত জিজ্ঞাসু এবং গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা আছে এমন শিষ্যকে গুরু যখন খুঁজে পান তখন তাঁর আনন্দের সীমা থাকে না।
স্বামী ব্রহ্মানন্দের সেবকদের মধ্যে স্বামী নির্বাণানন্দকে সর্বোত্তম বলে মনে করা হতো। অল্পবয়সী যুবকরা স্বামী ব্রহ্মানন্দকে খুব ভালোবাসতেন। সর্বদা তাঁকে ঘিরে থাকতেন। কিন্তু স্বামী নির্বাণানন্দকে অতিক্রম করে তারা সেবা করার সুযোগ পেত না। কেননা স্বামী ব্রহ্মানন্দ কিছু বলার আগেই স্বামী নির্বাণানন্দ তাঁর যা প্রয়োজন তা হাতের কাছে গুছিয়ে রাখতেন। সেটা হয়তো এককাপ চা হতে পারে বা একগ্লাস জল বা অন্য কিছু। কিন্তু স্বামী ব্রহ্মানন্দকে কখনো কিছু মুখ ফুটে চাইতে হতো না। অধিকাংশ সময় স্বামী ব্রহ্মানন্দের মন উচ্চ আধ্যাত্মিক ভূমিতে বিচরণ করত। তাই তাঁর কখন কি প্রয়োজন সে ব্যাপারে খেয়াল থাকত না। এ অতিসাধারণ একটি ঘটনা বললাম এই কারণ বোঝাতে যে, শিষ্যকে বুঝে নিতে হয় গুরু কি চান? সেই ভাবেই তাঁকে গুরুসেবা করতে হয়।
হ্যাঁ , তো শুরুতেই যা বলছিলাম, বুদ্ধির কচকচানিই ধর্ম নয়। প্রকৃত ধর্ম মানুষের মন দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়। গুরু একটি ছাঁচ। সেই ছাঁচে আপনাকে গড়ে নিতে হয়। যেমন , – সুভাষ নিজেকে নরেনের ছাঁচে গড়েছিলেন বলেই তিনি নেতাজী হয়েছিলেন। তার জন্য গুরুর বাণী হৃদয়ঙ্গম করতে হবে, গুরুকে নিপুণ ভাবে লক্ষ্য করতে হবে। তবেই খুব শীঘ্র আমরা গুরুর উপদেশের অন্তর্নিহিত অর্থ আমাদের নিকট প্রকাশিত হবে এবং তত দ্রুত আমরা সেই অনুযায়ী নিজেদের জীবন গড়ে তুলতে পারব।
বল বা শক্তি কি করতে পারে তা আমরা এই পৃথিবীকে দেখেই বুঝতে পারি। পৃথিবী নিজের শক্তিতেই সব কিছুকে ধরে রেখেছে। বাস্তবিক, প্রকৃতিতে সবাই যে যার নিজের শক্তিতেই চলছে। এই শক্তি বাইরে থেকে ঋণ করা জিনিস নয়। আমাদেরও তেমনি নিজেদের শক্তির ওপরই ভরসা করে চলতে হবে।
তাই সনৎকুমার নারদকে বলছেন , উদ্যমী হও। অর্থাৎ বলতে চাইছেন, ” তুমি যখন স্থির করেই ফেলেছ আত্মজ্ঞানলাভ তোমার জীবনের উদ্দেশ্য , তবে আর এক মুহূর্তও বৃথা সময় নষ্ট করো না। কর্ম কর নিরন্তর। “
বলং বাব বিজ্ঞানাভূয়োঽপি হ শতং বিজ্ঞানবতামেকো বলবানাকল্পয়তে স যদা বলী ভবত্যথোখাতা ভবত্যুত্তিষ্ঠন্ পরিচরিতা ভবতি পরিচরগ্রুপসত্ত্বা ভত্যুপসীদন্ দ্রষ্টা ভবতি শ্রোতা ভবতি মদ্ভা ভবতি বোদ্ধা ভবতি কর্তা ভবতি বিজ্ঞাতা ভবতি বলেন বৈ পৃথিবী তিষ্ঠতি বলেনান্তরিক্ষং বলেন দ্যৌবলেন পর্বতা বলেন দেবমনুষ্যা বলেন পশবশ্চ বয়াংসি চ তৃণবনস্পতয়ঃ শ্বাপদান্যাকীট পতঙ্গপিপীলকং বলেন লোকস্তিষ্ঠতি বলমুপাম্বেতি ॥
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন –
তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর ।অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ ॥কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ ।লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্তুমর্হসি ॥
অতএব, কর্মফলের প্রতি আসক্তি রহিত হয়ে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন কর৷ অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার ফলেই মানুষ পরতত্ত্বকে লাভ করতে পারে ৷ জনক আদি রাজারাও কর্ম দ্বারাই সংসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন ৷ অতএব, জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমার কর্ম করা উচিত।
স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন , ” ওঠ , জাগো এবং লক্ষ্যে পৌঁছনো না পর্যন্ত থেমে যেও না। ”
সুভাষ থেকে নেতাজী হবার পথে এই তো ছিল মূল মন্ত্র।
তু সের হিন্দ আগে বড়মরণে সে তু কভি না ডরউড়াকে দুসমনো কা সরযশ এ বতন বাড়ায়ে যা
যিনি ব্রহ্মকে বল অর্থাৎ শক্তিরূপে উপাসনা করেন তিনি তাঁর ইচ্ছানুযায়ী যে কোন কর্ম করতে পারেন।
তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – ” বলা বাহুল্য, যে দারিদ্র্য শক্তিহীনতা থেকে উদ্ভূত সে কুৎসিত। কথা আছে : শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা। তেমনি বলা যায়, সামর্থ্যবানেরই ভূষণ অকিঞ্চনতা। অতএব সামর্থ্য শিক্ষা করাই চাই ভোগের অভ্যাস বর্জন ক’রে। সামর্থ্যহীন দারিদ্র্যেই ভারতবর্ষের মাথা হেঁট হয়ে গেছে, অকিঞ্চনতায় নয়। অক্ষমকে দেবতা ক্ষমা করেন না।
“আমি সব পারি, সব পারব’ এই আত্মবিশ্বাসের বাণী আমাদের শরীর মন যেন তৎপরতার সঙ্গে বলতে পারে। “আমি সব জানি’ এই কথা বলবার জন্যে আমাদের ইন্দ্রিয় মন উৎসুক হয় তো হোক, কিন্তু তার পরেও চরমের কথা “আমি সব পারি’। আজ এই বাণী সমস্ত য়ুরোপের। সে বলে, “আমি সব পারি, সব পারব।’ তার আপন ক্ষমতাকে শ্রদ্ধা করার অন্ত নেই। এই শ্রদ্ধার দ্বারা সে নির্ভীক হয়েছে, জলে স্থলে আকাশে সে জয়ী হয়েছে। আমরা দৈবের দিকে তাকিয়ে আছি, সেইজন্যে বহু শতাব্দী ধরে আমরা দৈবকর্তৃক প্রবঞ্চিত।
…………..কিন্তু আমরা সব-কিছু পারব’ এই কথা সত্য ক’রে বলবার শিক্ষাই আত্মাবমাননা থেকে আমাদের দেশকে পরিত্রাণ করতে পারে, এ কথা ভুললে চলবে না। আমাদের বিদ্যালয়ে সকল কর্মে সকল ইন্দ্রিয়মনের তৎপরতা প্রথম হতেই অনুশীলিত হোক, এইটেই শিক্ষাসাধনার গুরুতর কর্তব্য বলে মনে করতে হবে। জানি এর প্রধান অন্তরায় অভিভাবক; পড়া মুখস্থ করতে করতে জীবনীশক্তি মননশক্তি কর্মশক্তি সমস্ত যতই কৃশ হতে থাকে তাতে বাধা দিতে গেলে তাঁরা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। কিন্তু মুখস্থ বিদ্যার চাপে এই-সব চির-পঙ্গু মানুষের অকর্মণ্যতার বোঝা দেশ বহন করবে কী করে? উদ্যোগিনং পুরুষসিংহমুপৈতি লক্ষ্মীঃ। আমাদের শিক্ষালয়ে নবীন প্রাণের মধ্যে অক্লান্ত উদ্যোগিতার হাওয়া বয়েছে যদি দেখতে পাই তা হলেই বুঝব, দেশে লক্ষ্মীর আমন্ত্রণ সফল হতে চলল। এই আমন্ত্রণ ইকনমিক্সে ডিগ্রি নেওয়ায় নয় : চরিত্রকে বলিষ্ঠ কর্মিষ্ঠ করায়, সকল অবস্থার জন্যে নিজেকে নিপুণভাবে প্রস্তুত করায়, নিরলস আত্মশক্তির উপর নির্ভর ক’রে কর্মানুষ্ঠানের দায়িত্ব সাধনা করায়। অর্থাৎ কেবল পাণ্ডিত্যচর্চায় নয়, পৌরুষচর্চায়। “…..
©দুর্গেশনন্দিনী