“…..ভারতবাসী কোনও দিনই ব্যক্তিগত সাধনা ভুলিয়া যায় নাই। ব্যক্তিত্ব বিকাশের চেষ্টা আমরা কোনও দিনই ত্যাগ করি নাই। …. আমাদের বর্তমান পরাধীনতা ও সকল প্রকার দুর্দশার মধ্যে যে আমাদের দেশে কত মহাপুরুষ জন্মাইয়াছেন এবং এখনও জন্মাইতেছেন তাহার একমাত্র কারণ এই যে, খাঁটি মানুষ সৃষ্টির প্রচেষ্টা আমাদের জাতি কোনদিন ভুলে নাই। কিন্তু আমরা ভুলিয়া গিয়াছিলাম Collective Sadhana বা সমষ্টিগত সাধনা; আমরা ভুলিয়া গিয়াছিলাম যে জাতিকে বাদ দিয়া যে সাধনা – সে সাধনার কোন সার্থকতা নাই। তাই সমাজ- গঠন- বিরোধী বৃত্তি আমাদের মানসক্ষেত্রে জন্মিয়াছে এবং ঐরূপ প্রতিষ্ঠান পরগাছার মত আমাদের জাতীয় জীবনকে ভারগ্রস্ত ও শক্তিহীন করিয়া তুলিয়াছে।
মনে রাখিবেন আমাদের সমবেত চেষ্টায় ভারতবর্ষে নতুন জাতি সৃষ্টি করিতে হইবে। পাশ্চাত্য সভ্যতা আমাদের সমাজে ওতপ্রোতভাবে প্রবেশ করিয়া আমাদিগকে ধনে প্রাণে মারিতে চেষ্টা করিতেছে। আমাদের ব্যবসায়-বাণিজ্য, ধর্ম-কর্ম, শিল্প কলা মরিতে বসিয়াছে। তাই জীবনের সকল ক্ষেত্রে আবার মৃতসঞ্জীবনী সুধা ঢালিতে হইবে।
ভারতবর্ষ একটি ছোটখাটো পৃথিবী- জগতের সকল সমস্যা ভারতবর্ষে বর্তমান আছে। তাই ভারতের সমস্যা সমাধানের অর্থই জগতের সমস্যার নিরাকরণ। অবর্ণনীয় দুঃখ-বেদনা ও অগণিত বিরোধ-সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ আজিও বাঁচিয়া আছে। তাহার কারণ, তাহার একটি বিশিষ্ট সাধনা আছে। জগতকে রক্ষা করিতে হইবে বলিয়াই ভারতবর্ষের আজ নিজেকে বাঁচাতে হইবে। স্বাধীন ভারতবর্ষ জগতের শিক্ষা দীক্ষা ও সভ্যতাকে তাহার আপন অতুলনীয় অবদানটি দিবে , তাই তাহার মুক্তিলাভের প্রয়োজন আছে। জগত আজ ভারতের দানের জন্য উদ্বিগ্ন হইয়া চাহিয়া আছে- তাহা না পাইলে জগত দিনতর থাকিবে।
“ভারতীয় জাতি একাধিকবার মরেছে – কিন্তু মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভ করেছে। তাঁর কারণ এই যে, ভারতের অস্তিত্বের সার্থকতা ছিল এবং এখনও আছে। ভারতের একটা বাণী আছে সেটা জগত সভায় শুনাতে হবে; ভারতের শিক্ষার (culture) মধ্যে এমন কিছু আছে যাহা বিশ্বমানবের পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় এবং যা গ্রহণ না করলে বিশ্বসভ্যতার প্রকৃত উন্মেষ হবে না। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞান, শিল্প, কলা, সাহিত্য, ব্যবসা বাণিজ্য- এসব ক্ষেত্রেও আমাদের জাতি জগতকে কিছু দেবে ও কিছু শেখাবে। তাই ভারতের মনীষীগণ কত তমোময় যুগের মধ্যেও নির্ণিমেষ নয়নে ভারতের জ্ঞানপ্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন। তাঁদের সন্ততি আমরা, আমাদের জাতীয় উদ্দেশ্য সফল না করে কি মরতে পারি? “
আজ স্বাধীনতার 75 বছর পরেও ভারতবর্ষে আঞ্চলিকতাবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রতিটি প্রান্ত বা রাজ্যের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, অস্মিতা আছে। সেটাকে বজায় রেখেই প্রতিটি প্রান্ত বা রাজ্যের মানুষ নিজের নিজের প্রান্ত বা রাজ্যকে সমৃদ্ধ করবেন। কিন্তু তাদের সম্মিলিতভাবে লক্ষ্য হবে ভারতবর্ষের সমৃদ্ধি ও গৌরবময় ভবিষ্যত। প্রত্যেকটি প্রান্তের নিজের স্বার্থ যেন পরস্পরবিরোধী হয়ে ভারতের সমৃদ্ধির পথে অন্তরায় না হয় বা কেন্দ্র – রাজ্যের ক্ষমতার টানাপোড়েনের ফলে দেশ ও রাজ্যের উন্নতি যেন ব্যাহত না হয়- এটার নামই জাতীয়তাবাদ এবং এই শিক্ষা নেতাজি আমাদের দিয়ে গিয়েছেন যা তাঁর নিচের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় :-
” আজ বাঙালিকে আবার দুর্জয় আত্মবিশ্বাস লাভ করতে হবে। আদর্শে বিশ্বাস, নিজের শক্তিতে বিশ্বাস, ভারতের গৌরবময় ভবিষ্যতে বিশ্বাস…..”
অর্থাৎ ভারত বাদ দিয়ে বাংলা নয়। তিনি তার ভারতবোধ বা জাতীয়তাবোধ- কে আঞ্চলিক ভাবাবেগের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন।