জন্ম ও জীবনী:
আজ সেই পবিত্র ১২ই জানুয়ারি – যুগপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের ১৬0 তম শুভ জন্মদিন। ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি, (১২৬৯ সালের ২৯ পৌষ), সোমবার মকর সংক্রান্তির দিন সকাল ৬টা ৩৩ মিনিটে উত্তর কলকাতার শিমুলিয়া পল্লিতে ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটের এক উচ্চবিত্ত পরিবারে স্বামী বিবেকানন্দ জন্ম গ্রহন করেন । তিনি বিশ্বনাথ দত্ত ও ভুবনেশ্বরী দেবীর ষষ্ঠ সন্তান, তিন পুত্রের মধ্যে প্রথম । তাঁর মধ্যম ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন পরবর্তী কালের বিশিষ্ট লেখক ও বিদেশ ভ্রমণে বিবেকানন্দের সঙ্গীএবংকনিষ্ঠ ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বিশিষ্ট সাম্যবাদী নেতা ও গ্রন্থকার।তাঁর নামকরণ করা হয় নরেন্দ্রনাথ দত্ত । তাঁর ডাক নাম ছিল বীরেশ্বর বা বিলে, এবং নরেন্দ্র বা নরেন।জননী ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন ধর্মপ্রাণা নারী । বহু কৃচ্ছ্রসাধন করে তিনি কাশীর বিশ্বেশ্বর শিবের নিকট পুত্রকামনা করেন । কথিত আছে, তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন শিব ধ্যান থেকে উঠে তাঁকে বলছেন যে তিনি তাঁর পুত্ররূপে জন্ম নেবেন । ছেলেবেলা থেকেই আধ্যাত্মিকতার দিকে নরেন্দ্রনাথের আগ্রহ ফুটে ওঠে। এই সময় শিব, রাম, সীতা ও মহাবীর হনুমানের মূর্তির সামনে তিনি প্রায়শই ধ্যানে বসতেন। সাধুসন্ন্যাসীদের প্রতিও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। ছেলেবেলায় বিবেকানন্দ অত্যন্ত দুরন্ত ছিলেন। তাঁর পিতামাতার পক্ষে তাকে সামলানো মাঝে মাঝেই দুঃসাধ্য হয়ে উঠত। তাঁর মা বলতেন, “শিবের কাছে ছেলে চাইলুম। তা তিনি নিজে না এসে পাঠালেন তার চেলা এক ভূতকে।”পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবি । তিনি ছিলেন দানশীল এবং সামাজিক ও ধর্মীয় চিন্তার ক্ষেত্রে প্রগতিবাদী। পিতার যুক্তিবাদী মন ও জননীর ধর্মীয় চেতনা স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তা ও ব্যক্তিত্বকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্রথম জীবনেই পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি ঘটেছিল। এই কারণে অকাট্য প্রমাণ ও ব্যবহারিক পরীক্ষা ছাড়া কোনো বক্তব্যই তিনি গ্রহণ করতেন না । অন্যদিকে অতি অল্পবয়সেই ধ্যান ও বৈরাগ্যের আধ্যাত্মিক আদর্শের প্রতি তাঁর মন আকৃষ্ট হয়।প্রচণ্ড রকম মেধার অধিকারী নরেন্দ্রনাথ ১৮৭১ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনে ভর্তি হন। পরে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন। সেই বছর তিনিই ছিলেন ওই পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ একমাত্র ছাত্র।এ ছাড়া তিনি জেনারেল এসেমব্লিজ ইন্সটিটিউশনে পড়েছেন।১৮৮১ সালে এই ইনস্টিটিউশনে পড়ার সময়ই অধ্যাপক হেস্টির কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধির বিষয়ে শুনলেন। নভেম্বর মাসে সুরেন মিত্রের বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ । ডিসেম্বর মাসে প্রথমবার দক্ষিনেশ্বরে গেলেন । তারপর দক্ষিনেশ্বরে যাতায়াত শুরু ।১৮৮১ সালে তিনি চারুকলা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।এবং ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে অর্জন করেন স্নাতক ডিগ্রি । নরেন্দ্রনাথের ছিল প্রচুর বই পড়ার নেশা। তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্য বিষয়ে বইপড়ায় । তিনি ডেভিড হিউম, জর্জ ডব্লিউ. এফ. হেগেল, আর্থার সোফেনহায়ার, ওগুস্ত কোঁত, জন স্টুয়ার্ট মিল ও চার্লস ডারউইনের রচনাবলি পাঠ করেছিলেন। হারবার্ট স্পেনসারের বিবর্তনবাদের প্রতি তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সে সময়ে স্পেনসারের সঙ্গে তার চিঠিপত্র বিনিময়ও চলত। স্পেনসারের “এডুকেশন “ (১৮৬১) বইটি তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন।
পাশ্চাত্য দার্শনিকদের রচনাবলি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ ও বাংলা সাহিত্য নিয়েও চর্চা করেন। বেদ, উপনিষদ, ভাগবদগীতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পাঠেও ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ । জেনেরাল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশনের প্রিন্সিপাল উইলিয়াম হেস্টি লিখেছেন, “নরেন্দ্র সত্যিকারের মেধাবী। আমি বহু দেশ দেখেছি, কিন্তু তার মতো প্রতিভা ও সম্ভাবনাময় ছাত্র দেখিনি; এমনকি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দর্শন ছাত্রদের মধ্যেও না।” কয়েকটি স্মৃতিকথায় নরেন্দ্রনাথকে ‘শ্রুতিধর’ হিসেবে উল্লেখ করতেও দেখা যায়।এ ছাড়া তিনি হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম এবং নিয়মিত অনুশীলন, খেলাধুলা ও সমাজসেবামূলক কাজকর্মে অংশ নিতেন।২৫ ফেব্রুয়ারী, ১৮৮৪-র রাতে হঠাৎ তাঁর পিতার মৃত্যু হয় । শুরু হল তাঁর জীবন সংগ্রাম সঙ্গে জুটল আর্থিক সংকট ও আত্মীয়স্বজনের নিষ্ঠুরতা । শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশে মা-কালীর কাছে প্রার্থনা করতে যাওয়ায় তিন বার-ই তিনি প্রার্থনা করলেন জ্ঞান, ভক্তি, বিবেক ও বৈরাগ্য । অতঃপর শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্বাস দিলেন যে তাঁদের মোটা ভাত কাপড়ের অভাব হবে না । তিনি কিছুদিন এটর্নী অফিসে কাজ করে ও বই অনুবাদ করে সংসার যাত্রা নির্বাহ করেন এবং পরে কিছুদিন মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে চাঁপাতলা শাখায় হেডমাস্টারও হয়েছিলেন ।১৮৮৬, ১১ ফেব্রুয়ারী নরেন্দ্রকে শ্রীরামকৃষ্ণ লোক শিক্ষার ‘চাপরাস’ দিলেন । ঐ বছরই ১৬ আগস্ট শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধির পরে ১৯ অক্টোবর প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ‘বরানগর মঠে’র প্রতিষ্ঠা করেন।১৮৮৬, ২৪ ডিসেম্বর ক্রীসমাস ইভের রাতে আঁটপুরে গুরুভাইদের সঙ্গে সমবেতভাবে সন্ন্যাস গ্রহণের সংকল্প নেন এবং ১৮৮৭ র জানুয়ারীতে সন্ন্যাসগ্রহণ করেন । ১৮৮৭-১৮৯৩ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কাছে দীক্ষালাভের পর নরেন্দ্রনাথ দত্ত ‘সচ্চিদানন্দ’ নামটি ব্যবহার করছিলেন এবং গুরুদেবের মৃত্যুর পর বিবেকানন্দ বিভিন্ন দফায় বিভিন্ন ছদ্মনামে ভারতীয় উপমহাদেশ ভালোভাবে ঘুরে দেখেন এবং ব্রিটিশ ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞানার্জন করেন।এই ভারত-পরিক্রমা আসলে ভারত-আবিষ্কার -ভারতের শক্তি ও দুর্বলতা উভয়কেই নিজের চোখে দেখা । যেখানে ভারতের শক্তি – ধর্ম ও ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতি; সেখানে ভারতের দুর্বলতা-দারিদ্র্য , অশিক্ষা , সাধারণ মানুষ ও নারীজাতিকে অবহেলা । ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দের বড়োদিনের প্রাক্কালে পায়ে হেঁটে কন্যাকুমারী পৌঁছান। বিবরণ অনুসারে স্বামীজি “ভারতীয় পাহাড়ের শেষ প্রান্তে” তিন দিন ধরে ধ্যান করেন যা পরে বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। কন্যাকুমারীতে বিবেকানন্দ “এক ভারতের স্বপ্ন” দেখেন, যাকে সচরাচর বলা হয়ে থাকে “১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের কন্যাকুমারী সঙ্কল্প”। তিনি লিখেছিলেন, “ক্যামোরিন অন্তরীপে মা কুমারীর মন্দিরে বসে ভারতীয় পাহাড়ের শেষ প্রান্তে বসে – আমি এক পরিকল্পনা করি: আমরা এতগুলো সন্ন্যাসী ঘুরে বেড়াচ্ছি এবং মানুষকে অধিবিদ্যা/দর্শনশাস্ত্র শেখাচ্ছি – এ সব কিছুই পাগলামি। আমাদের গুরুদেব কী বলতেন না, ‘খালি পেট ধর্মের জন্য ভালো নয়?’ জাতি হিসেবে আমরা আমাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হারিয়েছি এবং এটাই ভারতের সকল অনিষ্টের কারণ। আমাদের জনসাধারণকে জাগাতে হবে।”এইভাবে ঘুরতে ঘুরতেই তিনি খেতরি রাজ্যে পৌঁছেছিলেন। তখন খেতরির রাজা ছিলেন অজিত সিং।
তিনি ১৮৯৩ সালে নরেন্দ্রনাথ দত্তকে বারবার ছদ্মনাম না নিয়ে শুধু “স্বামী বিবেকানন্দ” নামটি ব্যবহার করতে বলেন এবং সে বছরের ২১ এপ্রিল থেকে তিনি এই নামই ব্যবহার করেছেন। ‘বিবেকানন্দ’ এর নির্মাণ সম্পূর্ণ হল এই ভারত – পরিক্রমার সঙ্গে সঙ্গে । ভগিনী নিবেদিতা বলেছেন, গুরু, শাস্ত্র ও মাতৃভূমি এই তিনটে মিলে বিবেকানন্দ তৈরী হয়েছেন ।১৮৯৩ সালে স্বামী বিবেকানন্দের আমেরিকা যাওয়ার সব ব্যবস্থা খেতরির রাজা অজিত সিংই করেছিলেন ।রাজার পোশাকে তিনি বিবেকানন্দকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন । তাই ৩১ মে শিকাগো ধর্মমহাসভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে প্রথম আমেরিকা যাত্রার সময় বিবেকানন্দ বম্বে থেকে পেনিনসুলার জাহাজে উঠেছিলেন কারণ খেতরির রাজার সন্তানকে আশীর্বাদ করে তিনি ভারতত্যাগ করেন।তার পরের ঘটনা তো ইতিহাস । ১১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ শিকাগো ধর্মমহাসভায় তাঁর প্রথম ভাষণ, ১৯ সেপ্টেম্বর ‘হিন্দুধর্ম’ ভাষণ ও ২৭ সেপ্টেম্বর শেষ ভাষণ ।১৮৯৩- ১৮৯৬ স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রচার করেন। আমেরিকা থেকে দু-বার তিনি ইংল্যান্ডে গেছিলেন । প্রথমবার ৩ মাসের জন্য ১৮৯৫-এর আগস্ট থেকে ১৯৯৫-এর নভেম্বর পর্যন্ত । এই সময়ে লন্ডনে মিস মার্গারেট নোবেল (ভগিনী নিবাদিতা) প্রথম তাঁর সংস্পর্শে আসেন । দ্বিতীয়বার গেছিলেন ভারতে ফেরার আগে: ১৮৯৬-এর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত – ৭ মাস । ১৮৯৬, ১৬ ডিসেম্বর ভারতে প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন এবং রোম ও কলম্বো হয়ে ২৬ জানুয়ারী, ১৮৯৭ তিনি মূল ভারত ভুখন্ডে (পাম্বান-এ) পৌঁছালে ভারত জুড়ে অভুতপূর্ব উদ্দীপনা ।২৭ জানুয়ারী : রামেশ্বর মন্দিরে ভাষণ : ‘Real Worship’ ।৬ – ১৪ ফেব্রুয়ারী : মাদ্রাজে (চেন্নাইয়ে ) পৌঁছালে গোটা মাদ্রাজ উত্তাল । খবরের কাগজে বর্ণনা । মাদ্রাজে এ যেন নতুন নবরাত্রি ।১৯ ফেব্রুয়ারী : তিনি কলকাতায় পৌঁছান। ৭ মার্চ : দক্ষিনেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি উদযাপন ।৮ মার্চ : স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য দার্জিলিং-এ ।১ মে, ১৮৯৭ : কলকাতায় বলরাম বসুর বাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা । ঐ সভাতেই শ্রীমা সারদাদেবীকে ’ সঙ্ঘজননী ’ রূপে স্বামীজির ঘোষনা ।৬ মে : আলমোড়ার পথে যাত্রা । আট মাস ধরে আলমোড়া, বেরিলি লাহোর অমৃতসর ,রাওয়ালপিন্ডি, শ্রীনগর , জম্মু,শিয়ালকোট , আলোয়ার ,জয়পুর ,ক্ষেত্রী— এই সব স্থানে ভ্রমণ ও বক্তৃতা । রোমাঁ রোলাঁর মতে এ তাঁর দ্বিতীয়বার ভারতপরিক্রমা , এবার বিজয়ীর বেশে , ‘কুম্ভকর্ণে’র ঘুম ভাঙ্গাতে ।১৮৯৮ , জানুয়ারী ৩য় সপ্তাহ : কলকাতায় ।২৮ জানুয়ারী : ভগিনী নিবেদিতার বিদেশ থেকে কলকাতায় আগমন ।২৭ ফেরুয়ারী: বালিতে পূর্ণচন্দ্র দাঁ-র ঠাকুর বাড়িতে রামকৃষ্ণ জন্মোৎসব পালিত ।২৫ শে মার্চ : নিবেদিতাকে ব্রহ্মচর্য দীক্ষা ও নিবেদিতার নাম প্রদান ।৩০ শে মার্চ: দার্জিলিং-এ । এপ্রিলে কলকাতায় প্লেগ । প্লেগ দমনের জন্য ৩ মে কলকাতায় ফিরে এলেন । তাঁর নির্দেশে নিবেদিতা ও সদানন্দের পরিচালনায় কলকাতায় রামকৃষ্ণ মিশনের প্লেগ-সেবা কাজ ।১১ মে : নিবেদিত, স্বামী তুরিয়ানন্দ , স্বামী সদানন্দ, স্বামী স্বরূপানন্দ , মিস ম্যাক্লাউড , ওলি বুল.স্বামী নিরঞ্জনানন্দ প্রভৃতি সহ আলমোড়া, নৈনিতাল , কাশ্মীর ও অমরনাথ যাত্রা ।২ আগস্ট : অমরনাথ দর্শন ।১৮ অক্টোবর : কলকাতায় ফেরা ।১৮৯৯ , ২০ জুন : দ্বিতীয়বার পাশ্চাত্য যাত্রা । ১৯ জুন বেলুড় মঠের সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারীদের উদ্দেশ্যে ‘সন্ন্যাসের আদর্শ’ সম্বন্ধে উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতা । বললেন : সন্ন্যাসের অর্থ মৃত্যুকে ভালোবাসা । মৃত্যুকে ভালোবাসার অর্থ মৃত্যুকে নিশ্চিত জেনে গোটা জীবনকে হাসিমুখে পরার্থে নিয়োজিত করা । রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীকে একই সঙ্গে গভীর আদর্শপরায়ণ ও বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন হতে হবে । সে একই সঙ্গে ধ্যানে ও কর্মে কুশল হবে ।৩১ জুলাই : লন্ডনে ।আগস্টের প্রথম দিকে : উইম্বলডনে ।১৭ আগস্ট : আমেরিকার পথে । ২৮ আগস্ট : নিউইয়র্কে । প্রায় এক বছর আমেরিকায় বাস । তারপর প্যারিস, ভিয়েনা, এথেন্স হয়ে কায়রো থেকে ভারত-যাত্রা ১৯০০-র ২৬ নভেম্বর ।১৯০০, ৯ ডিসেম্বর : বেলুড় মঠে পৌঁছানো । ক্যাপ্টেন সেভিয়ারের মৃত্যু সংবাদ প্রাপ্তি ।২৭ ডিসেম্বর : মিসেস সেভিয়ারকে সান্ত্বনা দিতে মায়াবতী যাত্রা ।২৯ ডিসেম্বর : মায়াবতীর পথে কাঠগোদামে ।১৯০১ , ৩ জানুয়ারী : মায়াবতী ।৫ জানুয়ারী : স্বামী স্বরূপানন্দের কাছে মায়াবতী আশ্রমের ভাবিষ্যৎ পরিকল্পনা বর্ণনা । দু-সপ্তাহ মায়াবতীতে থেকে ১৮ জানুয়ারী মায়াবতী ত্যাগ ।২৪, জানুয়ারী : বেলুড় মঠে ।১৮ মার্চ : সন্ন্যাসিশিষ্য সহ পূর্ববঙ্গ ও আসাম যাত্রা । ঢাকা জগন্নাথ কলেজে বক্তৃতা । পগোজ স্কুলের লাগোয়া মাঠে বক্তৃতা । দেওভোগে নাগ মহাশয়ের গৃহে ।৫ এপ্রিল : চন্দ্রনাথ মন্দিরের পথে ঢাকা ত্যাগ । কামাখ্যা দর্শন। গৌহাটিতে তিনটি বক্তৃতা। শারীরিক অবস্থার অবনতি । শিলং -এ স্যার হেনরি কটনের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বক্তৃতা ।১২ মে : বেলুড় মঠে উপস্থিতি , স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি । ৭ আগস্ট : দার্জিলিং যাত্রা । শেষ সপ্তাহে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন । স্বাস্থ্যের কারণে জাপান যাওয়ার আমন্ত্রণ ত্যাগ ।১৮ অক্টোবর : মঠে দুর্গাপূজা । শ্রীশ্রীমায়ের উপস্থিতি । সপ্তমীর দিন স্বামীজীর জ্বর । অষ্টমীর দিন সুস্থ হয়ে মা-কে অঞ্জলিপ্রদান । নবমীর দিন রাত্রে ভক্তিমূলক সঙ্গীত পরিবেশন । এই সময়েই শরীরের দ্রুত অবনতি । মা ভুবনেশ্বরী দেবীর ইচ্ছা পূরণার্থে কালীঘাট গমন ।২৩ ডিসেম্বর : কলকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন । এই সময় বাল গঙ্গাধর তিলক মঠে আসেন , স্বামীজী তাঁকে সাদরে গ্রহন করেন । মহাত্মা গান্ধীও এসেছিলেন – অনুপস্থিত থাকায় সাক্ষাৎ হয়নি ।১৯০২ , ২৭ জানুয়ারী : ম্যাকলাউড ও ওকাকুরার সঙ্গে বুদ্ধগয়ায় গমন । সেখানে এক সপ্তাহ অবস্থানের পর ফেব্রুয়ারী মাসে শেষবারের মতো বারানসী গমন । সেখানে শরীরের ক্রমাবনতি ।৮ মার্চ : বেলুড় মঠে প্রত্যাবর্তন ।১১ মার্চ : শ্রীরামকৃষ্ণ জন্মোৎসব । ১৬ মার্চ : শ্রীরামকৃষ্ণ জন্মতিথি উপলক্ষে সাধারণ উৎসব । অসুস্থতার জন্য স্বামীজী সারাদিন ঘর থেকে বের হাতে পারলেন না ।১৯ জুন : ভুবনেশ্বরী দেবীকে দেখতে কলকাতা গমন ।২৯ জুন : নিবেদিতার মঠে আগমন । সারাদিন নানা বিষয়ে আলোচনা ।২ জুলাই : একাদশী তিথি । নিবেদিতার মঠে আগমন । তাঁকে স্বহস্তে আহার্য্য দান এবং স্বয়ং যীশুর মতো আহারান্তে হাত ধোয়ার জন্য জল দান ।১৯০২ , ৪ জুলাই : সকালে গুরুভাইদের সঙ্গে চায়ের আসরে নানা গল্প ও পরদিন কালীপূজার নির্দেশ । আটটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত ধ্যান । ধ্যানের পর শ্যামাসঙ্গীত : ’ মা কি আমার কালো রে … ।’ এরপর পায়চারি করতে করতে স্বগতোক্তি : ” যদি আরেকটা বিবেকানন্দ থাকত তবে বুঝতে পারত , বিবেকানন্দ কি করে গেল । কালে কিন্তু এমন শত শত বিবেকানন্দ জন্মাবে । “ সকলের সঙ্গে মধ্যাহ্ণভোজন । দুপুরে তিন ঘন্টা ব্রহ্মচারীদের পড়ানো । বিকেলে স্বামী প্রেমানন্দের সঙ্গে ভ্রমণ ও ’ বেদবিদ্যালয়ের ’ পরিকল্পনা । সন্ধ্যারতির পরে এক ঘন্টা ধ্যান । রাত ৯ টা ১০ মিনিটে মহাসমাধি ।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষণে স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা:স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রধান শিষ্য। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে হিন্দুধর্ম তথা ভারতীয় বেদান্ত ও যোগ দর্শনের প্রচারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক স্থাপন এবং হিন্দুধর্মকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্ম হিসেবে প্রচার করার কৃতিত্ব শুধু নয় ভারতে হিন্দু পুনর্জাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতে তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণাটি প্রবর্তন করে। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে জাতীয়তাবাদী ধারণার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে স্বামী বিবেকানন্দ জাতীয়তাবাদী আদর্শটিকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। সমাজ সংস্কারক চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজের ভাষায়, “স্বামী বিবেকানন্দের নির্ভীক দেশাত্মবোধ সারা ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। ভারতের নবজাগরণে স্বামী বিবেকানন্দ যতটা অবদান রেখেছিলেন, ততটা অন্য কেউ এককভাবে রাখতে পারেননি।” বিবেকানন্দ ভারতের সর্বব্যাপী দারিদ্র্র্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, এই দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্যই ভারতে জাতীয় নবজাগরণের প্রয়োজন আছে। তার জাতীয়তাবাদী ধারণা ভারতীয় দার্শনিক ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবিত করেছিল। শ্রীঅরবিন্দ বলেছিলেন, বিবেকানন্দ ভারতকে আধ্যাত্মিক চেতনায় জাগরিত করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধির মতে বিবেকানন্দ ছিলেন সেই অল্প কয়কজন হিন্দু ধর্মসংস্কারকদের একজন “যিনি হিন্দুধর্মের প্রথা ও রীতিনীতির মৃত শাখাপ্রশাখাগুলিকে ছেঁটে ফেলে হিন্দুধর্মের সৌন্দর্য রক্ষা করেছিলেন।”স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর-জেনারেল চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী বলেছিলেন, “বিবেকানন্দ হিন্দুধর্ম ও ভারতকে রক্ষা করেছিলেন।” বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, বিবেকানন্দ ছিলেন “আধুনিক ভারতের স্রষ্টা”।মহাত্মা গান্ধি বলেছিলেন, বিবেকানন্দের রচনা তার “দেশপ্রেম হাজারগুণ” বৃদ্ধি করেছিল। বিবেকানন্দ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিলেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, শ্রীঅরবিন্দ, বাল গঙ্গাধর তিলক ও বাঘা যতীন প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং অলডাস হাক্সলি, ক্রিস্টোফার ইশারউড, রোম্যা রোলাঁ প্রমুখ বুদ্ধিজীবীকে বিবেকানন্দের রচনা অনুপ্রাণিত করেছিল। বিবেকানন্দের মৃত্যুর বহু বছর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কারবিজয়ী ফরাসি সাহিত্যিক রোম্যা রোলাঁকে লিখেছিলেন, “ভারতকে জানতে চাইলে বিবেকানন্দের লেখা পড়ো। তার মধ্যে সব কিছুই ইতিবাচক। নেতিবাচক কিছুই নেই।” রোম্যা রোলাঁ লিখেছেন, “তার লেখাগুলি মহান সঙ্গীতের মতো এবং পঙ্ক্তিগুলি বেটোফেন শৈলীর মতো। চিত্তাকর্ষক ছন্দগুলি হ্যান্ডেল কোরাসের কুচকাওয়াজের মতো। আজ ত্রিশ বছর পরেও তাঁর বাণীগুলিকে স্পর্শ করলে আমার শরীরে বৈদ্যুতিক আঘাতের মতো শিহরণ জাগে। এই মহানায়কের মুখ থেকে যখন এই জ্বলন্ত শব্দগুলি উচ্চারিত হয়েছিল, তখন নিশ্চয় অনেকে এই শিহরণ অনুভব করেছিলেন!”জাতীয় শিক্ষা প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন—“ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ এবং কর্মশক্তিকে শুধুমাত্র অধ্যয়ন ও আত্মোন্নতির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখলে চলবে না, বরং প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে সমাজসেবার মহান উদ্দেশ্যে উদ্বুদ্ধ ও নিয়োজিত করতে হবে।” বিবেকানন্দের মতে, এই জাতীয় সেবাধর্ম ভারতীয়দের মধ্যে এক জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করবে। তাই ভারতীয়দের জাতীয় শিক্ষার জন্য তিনি নিম্নলিখিত পরিকল্পনাগুলির কথা উল্লেখ করেন— • আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ: শিক্ষার মধ্য দিয়ে প্রতিটি ব্যক্তির আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে।• আত্মচেতনার বিকাশ: এক্ষেত্রে প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীকে আত্মচেতনার মধ্য দিয়ে শিক্ষালাভ করাতে হবে।• নৈতিক চেতনার বিকাশ: ধর্মীয় শিক্ষার মধ্য দিয়ে প্রতিটি শিক্ষার্থীর মধ্যে নৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে।• গণশিক্ষার উপর গুরুত্ব প্রদান: গণশিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার কার্যক্রমকে একদিকে যেমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে গড়ে তুলতে হবে, অন্যদিকে তা যাতে সমাজের চাহিদাপূরণে সক্ষম হয় সে বিষয়েও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।• সহানুভূতিশীলতার বিকাশ: শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের সহানুভূতিশীল করে তুলতে হবে।• দেশাত্মবোধের বিকাশ: প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীকে দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।• স্বনির্ভরতা গঠন: প্রত্যেক শিক্ষার্থী যাতে স্বনির্ভর হয়ে ওঠে সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।• সক্রিয়তার নীতি অনুসরণ: শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সক্রিয়তার নীতি অনুসরণের ব্যবস্থা করতে হবে।• কর্ম অভিজ্ঞতা অর্জন: কর্ম অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।• দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ: দেশের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।ওপরের বিষয়গুলির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জাতীয় শিক্ষা সম্পর্কে বিবেকানন্দের পরিকল্পনা ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং বাস্তবসম্মত।স্বামী বিবেকানন্দ স্ত্রীশিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। স্বামীজি মনে করতেন, পুরুষ যদি ব্রহ্মজ্ঞ হতে পারে, তাহলে মেয়েরা হতে পারবে না কেন! তাই তিনি মেয়েদের জন্য গ্রামে গ্রামে পাঠশালা খুলে তাদের মানুষ করতে বলেছেন।তিনি বলেছেন যে, মেয়েরা মানুষ হলে তবেই তাদের সন্তানসন্ততি দ্বারা দেশের মুখ উজ্জ্বল হবে। তাই তিনি নারীশিক্ষা বিকাশের জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। সেই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, নারীদের আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশের জন্য মঠ গড়ে তুলতে হবে এবং মঠের সঙ্গে থাকবে নারীশিক্ষার জন্য বিশেষ বিদ্যালয়। নারীশিক্ষার পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হবে ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ব্যাকরণ, রান্না, সেলাই, মাতৃত্বের দায়িত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন পাঠ, সাংসারিক কাজকর্ম সম্পর্কে প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয় নারীদের এই সমস্ত বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানে সহায়তা করবেন ব্রহ্মচারিণীরা। বিবেকানন্দ মনে করতেন, জাতি গঠনের জন্য সুশিক্ষিতা ও সুমাতা বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়।স্বামী বিবেকানন্দ ভারতীয় শিক্ষার উন্নতিকল্পে যে পাঠক্রম নির্ধারণের কথা বলেছেন তাতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়—• শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা ও নৈতিকতা বিকাশের জন্য ধর্মশিক্ষা।• ব্যাকরণের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে মাতৃভাষা অধ্যয়ন।• বিদেশিদের সঙ্গে সংযোগসাধনের জন্য ইংরেজি ভাষা শিক্ষা।• সারা ভারতের জনগণের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদানের জন্য হিন্দি ভাষা শিক্ষা।• ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানলাভের জন্য সংস্কৃত ভাষা অধ্যয়ন।• গীতা-উপনিষদ থেকে পাঠ।• মহাপুরুষদের বাণী পাঠ।• সংগীতচর্চা এবং চিত্রাঙ্কন।• বিজ্ঞান এবং সাধারণ জ্ঞান বিষয়ে পাঠদান।• ভারত এবং ভারতবাসীকে জানার জন্য ইতিহাস ও ভূগোল। বিষয়ে পাঠ।শিক্ষার এই সাধারণ পাঠক্রম ছাড়াও শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশের জন্য সাহিত্য আেলোচনা, ভ্রমণ, বাগান তৈরি, উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রভৃতি সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির কথা বলা হয়। এ ছাড়াও বিবেকানন্দ শিক্ষার্থীদের সাবলম্বী করে তোলার জন্য কারিগরি ও বৃত্তিমুখী শিক্ষা প্রসঙ্গেও অভিমত ব্যক্ত করেন। শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেদের রুচি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন বৃত্তি বা কারিগরি শিক্ষায় অংশ নিতে পারে—সে ব্যবস্থা করার কথাও তিনি বলেন।ভাবলে অবাক হতে হয় যে স্বামী বিবেকানন্দের মতো একজন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর সঙ্গে ভারতীয় শিল্পের অন্যতম কারিগর জামশেদজি টাটার একটি হার্দিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আর এই যোগাযোগের অন্যতম ফসল বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স বা আই আই এস সি-র প্রতিষ্ঠা।১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে পাশ্চাত্যে স্বামীজির প্রথম ভ্রমণের সময় যখন তারা একত্রে ইয়োকাহামা থেকে শিকাগো যাত্রা করেছিলেন তখন বিবেকানন্দ স্যার জামশেদজি টাটাকে একটি গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। শোনা যায়, প্রায় কপর্দকশূন্য বিবেকানন্দ জামশেদজিকে দেশের মাটিতে কারখানা গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, দেশলাইয়ের মতো জিনিস কেনাবেচায় কমিশন থাকলেও নিজের দেশে কারখানা গড়ে তুলতে পারলে তুলনায় অনেক বেশি লাভ হবে৷ আর সে কারখানায় যদি পশ্চিমের প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তাছাড়া কারখানা গড়লে দেশের মানুষেরও নিশ্চিত কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। সেবার জামশেদজি নানা ওজর-আপত্তি দেখিয়ে কথাটা উড়িয়ে দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তরুণ সন্ন্যাসীর কথাটা তাঁকে নিশ্চিত নাড়া দিয়েছিল। বছর পাঁচেক পর ১৮৯৮ সালের ২৩ নভেম্বর একটি চিঠি লিখে জামশেদজি টাটা স্বামীজিকে সেদিনের যাত্রার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন এবং জামশেদজি প্রতিষ্ঠিত ‘বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান’-এর প্রধান হওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। চিঠির প্রথম লাইনটির অনুবাদ ছিল অনেকটা এ রকম, ‘আমার বিশ্বাস, আপনি জাপান থেকে শিকাগোর পথে জাহাজের সহযাত্রীরূপে আমাকে মনে রেখেছেন।’ সেই সঙ্গে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর সদ্যপ্রতিষ্ঠিত টাটা রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর কর্মযজ্ঞকে সমর্থন করে স্বামীজি যেন একটা প্রচার পুস্তিকা প্রকাশ করেন। সে ক্ষেত্রে শিল্প-বাণিজ্যের উপযোগী গবেষণার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়বে। তাছাড়া স্বামীজির পরামর্শই তো তাঁকে ওই গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনে উৎসাহিত করেছে।১৯০২ সালের জুলাই মাসে স্বামী বিবেকানন্দ পরলোক গমন করেন এবং জামশেদজির মৃত্যু হয় তার দু’বছর পর। তাঁরা কেউই জানতেন না যে, তাঁদের যৌথ ভাবনা পাঁচ বছর পরে সফল হবে। টাটা ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯১১ সাল থেকে সেটি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আই আই এস সি) নামে পরিচিত হয়। আজ এটি ভারত ও বিশ্বের অন্যতম এক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীকালে আমাদের দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে টাটা গোষ্ঠীর উদ্যোগে টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্স (১৯৩০) এবং টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (১৯৪০)-এর মতো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকেন্দ্র গঠিত হয়েছে।তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ মে কলকাতায় বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠা করেন ধর্ম প্রচারের জন্য সংগঠন “রামকৃষ্ণ মঠ” এবং সামাজিক কাজের জন্য সংগঠন “রামকৃষ্ণ মিশন”। এটি ছিল শিক্ষামূলক, সাংস্কৃতিক, চিকিৎসা-সংক্রান্ত এবং দাতব্য কাজের মধ্য দিয়ে জনগণকে সাহায্য করার এক সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলনের প্রারম্ভ। রামকৃষ্ণ মিশনের আদর্শের ভিত্তি হচ্ছে কর্ম যোগ। স্বামী বিবেকানন্দের দ্বারা দুটি মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যার মধ্যে কলকাতার কাছে বেলুড়ের মঠটি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কার্যালয় করা হয়েছিল এবং অন্যটি হিমালয়ের মায়াবতীতে আলমোড়ার নিকটে অদ্বৈত আশ্রম নামে পরিচিত এবং পরে তৃতীয় মঠটি মাদ্রাজে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ইংরেজিতে প্রবুদ্ধ ভারত ও বাংলায় উদ্বোধন নামে দুটি সাময়িকী চালু করা হয়েছিল। একই বছর মুর্শিদাবাদ জেলায় স্বামী দুর্ভিক্ষের জন্য অখণ্ডানন্দ কর্তৃক ত্রাণ কাজ চালু করা হয়েছিল।তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিকাগো বক্তৃতা, কর্মযোগ, রাজযোগ, জ্ঞানযোগ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদান্ত, ভারতে বিবেকানন্দ, ভাববার কথা, পরিব্রাজক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, বর্তমান ভারত, বীরবাণী (কবিতা-সংকলন), মদীয় আচার্যদেব ইত্যাদি।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বামী বিবেকানন্দের প্রাসঙ্গিকতা:শতাব্দী পাল্টে গেছে, পাল্টায়নি সেই প্রেক্ষাপটের। স্বামী বিবেকানন্দ প্রাসঙ্গিক অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতে বারে বারে। দেশের চারপাশ যখন ধর্মান্ধ -কুসংস্কারীতে ছেয়ে যাচ্ছে, চারপাশ যখন ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়ে নোংরা রাজনীতির খেলায় নিজে মাতিয়ে রেখেছে, সেই ক্রান্তিকালে বিবেকানন্দ ভারতবাসী, বিশ্ববাসীর পথ প্রদর্শক। ধর্ম সম্পর্কে ধারণা ধর্ম ও কুসংস্কার নিয়ে স্বামীজির একটি অমর বাণী হল, ‘দর্শনবর্জিত ধর্ম কুসংস্কারে গিয়ে দাঁড়ায়, আবার ধর্মবর্জিত দর্শন শুধু নাস্তিকতায় পরিণত হয়। আমাদের নিম্নশ্রেণীর জন্য কর্তব্য এই, কেবল তাহাদিগকে শিক্ষা দেওয়া এবং তাহাদের বিনষ্টপ্রায় ব্যক্তিত্ববোধ গাইয়া তোলা।’ তিনি বিশ্বাস করতেন “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”। বিশ্বাসের বলে বিশ্বজয়ী হওয়ার পথ বাতলে দিচ্ছেন তেজস্বী যুগপুরুষ। “বিশ্বাস, বিশ্বাস, সহানুভূতি, অগ্নিময় বিশ্বাস, অগ্নিময় সহানুভূতি।… তুচ্ছজীবন, তুচ্ছ ক্ষুধা, তুচ্ছ শীত। …অগ্রসর হও। …পশ্চাতে চাহিও না। কে পড়িল দেখিতে যাইও না। এগিয়ে যাও—সম্মুখে। এইরূপেই আমরা অগ্রগামী হইব—একজন পড়িবে, আর একজন তাহার স্থান অধিকার করিবে। পৃথিবীর ইতিহাস কয়েকজন আত্মবিশ্বাসই মানুষেরই ইতিহাস। সেই বিশ্বাসই ভিতরের দেবত্ব জাগ্রত করে। তুমি সব কিছু করিতে পার। অনন্ত শক্তিকে বিকশিত করিতে যথোচিত যত্নবান হও না বলিয়াই বিফল হও। যখনই কোন ব্যক্তি বা জাতি আত্মবিশ্বাস হারায়, তখনই তাহার বিনাশ হয়।” আধ্যত্মকে এক অন্য পর্যায়ে উন্নতি করে স্বামীজী সকলের জীবনকে আরও বেশি করে আলোর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। নেতিবাচক ভাবনার অন্ধকার দিকটির পর্দা সরিয়ে তিনি ভারতবাসীর জীবনবোধকে আরও বেশি করে অনুপ্রাণিত করেছেন। উদ্বুদ্ধ হয়েছে যুব সমাজ, আর সেজন্যই বিবেকানন্দকে ‘বীর সন্ন্যাসী’ নামে অভিহিত করা হয় এবং তাঁর জন্মদিন ১২ জানুয়ারি ভারতে জাতীয় যুব দিবস হিসেবে পালিত হয়। তাই আজ স্বামী বিবেকানন্দের শুভ আগমণের দিনে উৎসব মুখর হয়ে উঠেছে বেলুড় মঠ-সহ সকল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন এবং জাতীয়তাবাদী সকল ভারতবাসী।
ডা: শিবাজী ভট্টাচার্য