“তোমরা ওঠ, মোহনিদ্রা হতে জাগ্রত হয়ে শ্রেষ্ঠ আচার্যের নিকট গমন করে আত্মার সম্যকজ্ঞান লাভ কর।বিবেকবান ব্যক্তিগণ বলেন, ক্ষুরের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ যেমন দুরতিক্রমনীয় আত্মজ্ঞান লাভের পথও তেমনি দুর্গম।”- স্বামীজি
১২ই জানুয়ারি শুধু একটা দিন নয়, সংকল্পের দিন সমস্ত যুব সম্প্রদায়ের , যুবনায়ক স্বামী বিবেকানন্দের শুভ জন্মদিন।স্বামী বিবেকানন্দের জন্মজয়ন্তী ১২ জানুয়ারি। স্বামী বিবেকানন্দের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ডাকনাম ছিল বীরেশ্বর বা বিলে এবং নরেন্দ্র বা নরেন।১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তি উৎসবের এক পবিত্র দিনে উত্তর কলকাতার সিমলা পল্লীর ৩ নং গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।তাঁর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন কলকাতা উচ্চ আদালতের একজন খ্যাতনামা আইনজীবী। তিনি ছিলেন তার নয় ভাই-বোনের অন্যতম।স্বামী বিবেকানন্দ একটি আদর্শ। এমন এক আদর্শ তিনি, যাঁর কোনো জন্ম নেই, কোনো মৃত্যু নেই। স্বামী বিবেকানন্দ শুধু ব্যক্তি মানুষ নন, তিনি একটি প্রগতিশীল সত্তা। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর জীবনীতে বলছেন- “বিবেকানন্দের আদর্শ যে সময়ে জীবনে গ্রহণ করলাম তখন আমার বয়স বছর পনেরােও হবে কি না সন্দেহ। বিবেকানন্দের প্রভাব আমার জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল। তাঁর আদর্শ ও তাঁর ব্যক্তিত্বের বিশালতাকে পুরােপুরি উপলব্ধি করার মতাে ক্ষমতা তখন আমার ছিল না—কিন্তু কয়েকটা জিনিস একেবারে গােড়া থেকেই আমার মনে চিরকালের জন্য গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। চেহারায় এবং ব্যক্তিত্বে আমার কাছে বিবেকানন্দ ছিলেন আদর্শ পুরুষ। তাঁর মধ্যে আমার মনের অসংখ্য জিজ্ঞাসার সহজ সমাধান খুজে পেয়েছিলাম”।একবার স্বামীজী বিদেশ থেকে জাহাজে করে ভারতে ফিরছেন। জাহাজে দুজন খ্রিস্টান মিশনারি গায়ে পড়ে স্বামীজীর সঙ্গে খ্রিস্টধর্ম ও হিন্দুধর্মের তুলনামূলক আলােচনা করতে আসলেন। আলােচনার এক পর্যায়ে যখন তারা তাদের সকল যুক্তি হারিয়ে স্বামীজীর কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হল; সে সময়ে তারা অন্য পন্থা অবলম্বন করলেন। অত্যন্ত জঘন্য কুরুচিপূর্ণ ভাষায় হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির নিন্দা শুরু করলেন। স্বামীজী যথাসম্ভব ধৈর্য ধারণ করে থাকলেন। অবশেষে ধীর পদক্ষেপে তাদের একজনের কাছে গিয়ে হঠাৎ শক্ত করে তার জামার কলার চেপে ধরলেন। এরপর দৃঢ় গম্ভীস্বরে বললেন “আবার আমার ধর্মের নিন্দা করলে জাহাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেব”। হতভম্ব মিশনারি তখন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলছেন, “ছেড়ে দিন, আর কখনও এমন করব না”। এরপরে জাহাজে যখনই সেই খ্রিস্টান মিশনারীদের স্বামীজীর সঙ্গে দেখা হত; তারা স্বামীজীকে আর না ঘাটিয়ে যথাসম্ভব ভাল ব্যবহার করতেন। তিনি প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোগী, তিনিই আধুনিক ভারতের শ্রেষ্ঠ কর্মবীর। স্বামী বিবেকানন্দের কথায়, “প্রত্যেক জীব শক্তি প্রকাশের এক-একটি কেন্দ্র। পূর্বের কর্মফলে সে শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে, আমরা তাই নিয়ে জন্মেছি।” সুভাষ লিখছেন, “বারানসীতে স্বামী ব্রহ্মানন্দ আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন, তিনি আমার বাবা ও পরিবারের অনেককেই চিনতেন। এখানে আমরা কয়েকদিন রইলাম।”
সেসময়েই একদিন ক্ষণ করে সুযোগ মতো স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে সন্ন্যাস ভিক্ষে করে নিজের মনোগত সুপ্ত বাসনাটি প্রকাশ করেই ফেলেন সুভাষ। সুভাষের প্রার্থনা শুনে সিদ্ধসাধক স্বামী ব্রহ্মানন্দ সেই তরুণের তেজোদৃপ্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সম্ভবত আশু ভবিষ্যতের এক মহানায়কের আবির্ভাব লগ্নকে প্রত্যক্ষ করেন। এই ঘটনার অল্প কিছুদিন পরেই সুভাষের দেশসেবা তথা রাজনীতির প্রভাব প্রকট হয়ে দেখা দেয়। স্বামী ব্রহ্মানন্দের দর্শনে সুভাষ অপার শান্তি পান। তাঁর তৃষিত বুকে শান্তিবারিধারা নেমে আসে। সুভাষের কথায়, “কৃপা যে পায়, তার জীবনটাও ঠিকই বদলে যায়ই। আমিও পেয়েছি এ কৃপার আভাস।” বন্ধু দিলীপকুমার রায়ের দু’হাত চেপে ধরে তিনি বলেন, “ঐ রাখাল মহারাজই আমাকে কাশী থেকে ফিরিয়ে পাঠান। বলেন, আমাকে দেশের কাজ করতে হবে। সন্ন্যাসজীবন নয়, অন্তরে বৈরাগ্য রেখে দেশের কাছে নিজেকে আত্মোৎসর্গ করতে হবে।”এই ছিল সুভাষের প্রতি স্বামী ব্রহ্মানন্দের উপদেশ।বিবেকানন্দের উপলব্ধি ছিল যদি ভারতবর্ষকে বদলাতে হয় তাহলে হিন্দুধর্মকে বদলাতে হবে, হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন ধর্ম সৃষ্টি করে কোনো লাভ হবে না। ১৮৯৯ সালের ২৭ জানুয়ারি, দিনটা ছিল শনিবার। স্বামী বিবেকানন্দের ইচ্ছানুযায়ী একটি চায়ের আসর বসিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমন্ত্রণ জানালেন ভগিনী নিবেদিতা। সেই প্রথম প্রত্যক্ষ সামনাসামনি সাক্ষাৎ ঘটলো দুই ভবিষ্যতের মনীষীর।
সেই ঐতিহাসিক চায়ের আসরের কিছু বিবরণ পাওয়া যায় মিসেস ম্যাকলাউডকে লেখা ভগিনী নিবেদিতার চিঠি থেকে : “He (Swamiji) is just divine. Almost everyday I take a meal with him and yesterday he came to the party. .It was quite a brilliant little gathering for Mr. Tagore sang 3 of his own compositions in a lovely tenor, and Swami was lovely.” ” It is the hour that they call “candlelight” – the hour of worship – I cannot forget the lovely poem ‘Come O Peace’ (Escho Shanti) – with its plaintive minor air that Mr. Tagore composed and sang for us the other day at this time.”যখন রবীন্দ্রনাথের গান তাঁদের সমাজের বাইরে বিশেষ কেউ জানতো না তখন যুবক নরেন্দ্রনাথ দত্ত গেয়ে উঠেছিলেন “তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা “- তা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও অবাক করেছিল। স্বামীজী নিজে সুকন্ঠের অধিকারী ছিলেন। তালিম পেয়েছিলেন মৃদঙ্গবাদক মুরারীমোহন গুপ্ত ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতবিশারদ বেনীমাধব সর্বাধিকারীর কাছ থেকে। শোনা যায়, রাজনারায়ণ বসুর মেয়ে লীলাবতীর সাথে কৃষ্ণকুমার মিত্রের বিবাহের সময় স্বামীজী রবীন্দ্রনাথের ” দুই হৃদয়ের নদী” ও ” শুভদিন এসেছে দোঁহে” গান দুটি গেয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন সুন্দরীমোহন দাস, অন্ধ চুনীলাল ও কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তখনও নরেন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে ওঠেন নি। কল্পতরু দিবস অতিবাহিত হয়ে গেছে (১৮৮৬ সালের ১ লা জানুয়ারি); শ্রীরামকৃষ্ণ তখন খুব অসুস্থ। তাঁকে নরেন্দ্রনাথ বলছেন, এখন থেকে তাকে প্রত্যহ বলে দিতে হবে সেদিন সাধন ভজন কীভাবে করবেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন তাঁর আদরের নরেনকে নিজের কুলদেবতা রামের ইষ্টমন্ত্র দিলেন। নরেনের শ্রীরাম ভজনা এইভাবে শুরু হল। শ্রীম (মাস্টারমশাই)-র দিনলিপি উদ্ধৃত করে স্বামী প্রভানন্দ লিখেছেন সেই কথা। ১৩ ই জানুয়ারি শ্রীম দেখছেন, নরেন্দ্রনাথ পাগলের মতো রামনাম গাইছেন; অবশেষে ১৬ ই জানুয়ারি নরেনকে শ্রীরাম সন্ন্যাসীবেশে দর্শন দিলেন। আর ১৯ শে জানুয়ারি নরেন্দ্রনাথসহ নিরঞ্জন প্রমুখ সেই সন্ন্যাসী-রূপী রামের মতো রামাইৎ সাধুর বেশ ধারণ করলেন। নরেনের গেরুয়াবেশে মা ভুবনেশ্বরী যারপরনাই চিন্তিত হলেন। নরেন যে সপার্ষদ সন্ন্যাসী হতে চান এবং তা ক্ষত্রিয় রামের সন্ন্যাস-বেশী রূপে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর আদরের নরেনকে শক্তিমান পুরুষ, ধর্মযোদ্ধা, ন্যায়-পরায়ণ হয়ে ওঠার জন্যই কী রামনামে আবিষ্ট করলেন না!চিকাগো মহাসভার মূল মঞ্চের বাইরে স্বামীজী যে ভাষণগুলি দিয়েছিলেন, তার বেশীরভাগই ছিল বিজ্ঞান-শাখার মঞ্চে। তবে অন্য বিভাগের মঞ্চে যে ভাষণগুলি তিনি দিয়েছিলেন, তার অন্যতম ছিল ‘ ভারতীয় নারী ‘ বিষয়ে তাঁর একটি বক্তৃতা। তিনি প্রাচীন ভারতে নারীরা কেমন ছিল, তা থেকে শুরু করে বিবর্তনের ভিতর দিয়ে সাম্প্রতিক কালে যে রূপ পেয়েছে, তা পর্যালোচনা করেন। সর্বকালে ভারতীয় নারীদের ধর্মপ্রাণতার উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রাচীন যুগে নারীরা সার্বজনীন শিক্ষা ও ধর্মাচরণের প্রত্যক্ষ সুযোগ না পেলেও ব্যক্তিগত পরিসরে, তাঁরা ছিলেন ধর্মভাবাপন্না। ঋষি-পত্নী ও ব্রাহ্মন-কন্যারা স্বামীর পাশে প্রত্যক্ষ ধর্মাচরণের ও শিক্ষার সুযোগ পেতেন। গার্গী, মৈত্রয়ীর মত বিদূষী নারীর পরিচয়ও আমরা পাই। বৈদিক যুগের পর পৌরানিক যুগে উন্নাসিক পুরোহিত-তন্ত্র জন্ম নেওয়ার ফলে সমাজে নারীরা মর্যাদা হারালেও, তাঁদের ধর্মভাব অটুট থাকে। এই সময় নারী-শিক্ষার পরিসরও সংকুচিত হয়। সুদীর্ঘ কাল বঞ্চনার শিকার ভারতীয় নারীদের অবস্থার পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে সাম্প্রতিক নবজাগরণে। তবে নারীদের মধ্যে সর্বকালে সতীত্ব, পবিত্রতাকে যে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়ে আসছে,তার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ধর্মভাব ও পবিত্রতা , এই দুটি ভারতীয় নারীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। শিক্ষার আলোকে আলোকিত হলেই তাঁদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠবে এবং সম্পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হবে।১৯০১ সালে বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো শুরু হয়। মূলত স্বামী বিবেকানন্দর উদ্যোগেই এই পুজো শুরু হয়েছিল। দুর্গাপুজোর বেশ কিছু আগে যেখানে স্বামীজির মন্দিরের কাছে যে বেলগাছ রয়েছে, তার নিচে বসেছিলেন স্বামীজি। সেই সময়ই মঠে দুর্গাপুজোর করার ইচ্ছা জাগে বলে জানা যায়। কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা আনা হয়েছিল। কোনও অর্ডার দেওয়া না থাকলেও, একজন প্রতিমা আনতে না আসায় পঞ্চমীর দিন প্রতিমা আনা হয় বেলুড় মঠে। প্রতিমা আনতে গিয়েছিলেন কৃষ্ণলাল মহারাজ। প্রাচীন বৈদিক মতে পুজোর বিধি মেনে পুজো করা হবে ঠিক হয়েছিল। পুরনো ঠাকুরে মন্দির এবং বর্তমান মঠ ম্যানেজারের অফিসের মধ্যবর্তী জায়গায় পুজোর আয়োজন করা হয়েছিল। স্বামী বিবেকানন্দ যাঁদের সন্ন্যাস দিয়েছিলেন, এমন সাত-আটজন এই পুজো করতে স্বামীজিকে সাহায্য করেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন, সুকুল, গোবিন্দ, কালিকৃষ্ণ, সুধীর, সুশীল। এই দুর্গাপুজোয় প্রথম পূজারি হয়েছিলেন ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল। সারদা মাকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সারদা মাকে ১০৮ টি পদ্ম দিয়ে আলাদা করে জ্যান্ত দুর্গার পুজো করেছিলেন স্বামীজি। সংকল্প কার নামে হবে সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। কেননা, সন্ন্যাসীদের নামে তো সংকল্প হতে পারে না। সেই সময় সারদা মায়ের কাছে যাওয়া হয়। স্বামী বিবেকানন্দ উপায় বাতলে দেন। বলেন, সারদা মায়ের নামে সংকল্প করতে। বেলুড়ের কুমারী পুজোর প্রচলন শুরু করেছিলেন স্বামীজিই। রামলালদাদার কন্যাকে স্বামীজি কুমারী পুজোর জন্য বেছে নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। কোনও ব্রাহ্মণ কন্যাকেই কুমারী পুজোর জন্য বেছে নেওয়া হয়। রোববার মহাষ্টমী। মঠে অসংখ্য নর-নারী পুজোয় ভিড় করেছে। কেউ কেউ স্বামীজীকে দর্শন করতে এসেছেন। চারদিকে আনন্দ আর আনন্দ আনন্দ যেন আর ধরে না। হাজার হাজার লোক বসে প্রসাদ গ্রহণ করছে। বিশেষ করে দরিদ্র নারায়ণের বিশেষ যত্ন এই ছিল স্বামীজীর আদেশ। কিন্তু তিনি মহাষ্টমীর দিন জ্বরে শয্যাশায়ী হলেন।‘শ্রী শ্রী মায়ের কথায়’ (প্রথমভাগ) আছে শ্রী মা বলছেন, ‘পুজোর দিন লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। ছেলেরা সবাই খাটছে। নরেন এসে বলে কি, ‘মা, আমার জ্বর করে দাও।’ ওমা, বলতে না বলতে খানিকবাদে হাড় কেঁপে জ্বর এল। আমি বলি, ‘ওমা একি হলো, এখন কি হবে?’ নরেন বললে, ‘কোন চিন্তা নাই মা। আমি সেধে জ্বর নিলুম এই জন্যে যে, ছেলেগুলো প্রাণপণ করে তো খাটছে, তবু কোথাও কি ত্রুটি হবে, আমি রেগে যাব বকব, চাই কি দুটো থাপ্পড়ই দিয়ে বসব। তখন ওদেরও কষ্ট হবে। আমারও কষ্ট হবে। তাই ভাবলুম কাজ কি, থাকি কিছুক্ষণ জ্বরে পড়ে।’পরদিন সোমবার। প্রাতে সন্ধিপূজা ভোর সাড়ে ছয়টার কিছু পরে সন্ধিপূজা আরম্ভ স্বামীজী পূজাম-পে এসে বসলেন। শ্রীদুর্গা মায়ের রাঙ্গা চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিলেন। উজ্জ্বল, জ্যোতির্ময় সহাস্য মুখমণ্ডল ভাবগম্ভীরভাবে বসে আছেন। যথাবিধি কুমারী পূজাও হলো। স্বামীজীও কুমারী পূজা করলেন। সে এক অপূর্ব দৃশ্য : শ্রী মা তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সাধারণত অষ্টমীতেই কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু স্বামীজী অসুস্থ ছিলেন বলে পরে পুজো করলেন। বিবেকানন্দ না থাকলে চিকাগো ধর্ম সম্মেলনে কেউ বক্তৃতা দিত না । কুসংস্কার , দারিদ্র , অসহায়তার নিচে ঘুমিয়ে ছিল যে ভারতাত্মা , তাকে চিনিয়ে দেওয়ার কেউ থাকতো না । ভিক্টোরীয় যুগের গোঁড়া খ্রিস্টান মূল্যবোধে জারিত পাশ্চাত্য দেশে দাঁড়িয়ে ভারতকে ভালোবাসতে শেখানোর কেউ থাকতো না । বিদেশির চোখে ভারত থেকে যেত একটি সাপ , বাঘ , হাতি , ধনরত্ন , মহারাজা , স্নেক চার্মার , ফকির , সাধু , সতীদাহ , অস্পৃশ্যতা , নরবলি , পৌত্তলিকতা অধ্যুষিত এক রহস্যময়ি exotic প্রাচ্য দেশ হয়ে । বিবেকানন্দ না থাকলে শুধু হিন্দু ধর্ম নয় , ভারতীয় সংস্কৃতিও বাইরের দেশে পারি জমাতে পারত না । আজ যে আমেরিকার ৫৫ মিলিয়ন মানুষ যোগ অভ্যাস করে তার কৃতিত্ব বিবেকানন্দের প্রাপ্য । না , তিনি ৫৫ মিলিয়ন আমেরিকাবাসিকে জনা জনা যোগ শিক্ষা দেন নি বটে , কিন্তু তাঁরই প্রদর্শিত পথে পরবর্তীকালে একের পর এক ধর্মগুরু আর যোগ প্রচারক পাশ্চাত্যের মাটিতে পাড়ি জমিয়েছেন । পরমহংস যোগানন্দ থেকে ইস্কনের স্বামী প্রভুপাদ , ইনারা সকলেই বিবেকানন্দের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভারতের সংস্কৃতি বিদেশের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিয়েছিলেন । তার সম্মিলিত ফলে আজ পাশ্চাত্যের ঘরে ঘরে যোগ চর্চা , হলিউডের সিনেমার নাম ‘অবতার’ ! বিবেকানন্দই প্রথম ব্যাক্তি যিনি হিন্দু ধর্মকে বিদেশের মাটিতে ছড়িয়ে দিলেন । “ম্লেচ্ছ” জাতকেও বেদ মন্ত্র জপের অধিকার দিয়ে প্রাচ্য পাশ্চাত্যের দেওয়াল ভেঙ্গে দিলেন । কালাপানি পারের কুসংস্কার খণ্ডন করে সন্ন্যাসী হয়েও সমুদ্রপারে গেলেন ! আবার উনিই প্রথম বারের জন্য জাতি প্রথাকে জন্মগতভাবে নয় , গুণবাচক ভাবে ব্যাখ্যা করলেন । বিবেকানন্দ বলছেন-” যখন মুসলমানেরা প্রথমে এদেশে আসিয়াছিলেন, তখন প্রাচীনতম মুসলমানের ঐতিহাসিক ফেরিস্তার মতে ভারতে ৬০ কোটি হিন্দু ছিল, এখন আমরা বিশ কোটিতে পরিণত হইয়াছি। আর, কোন লোক হিন্দুসমাজ ত্যাগ করিলে সমাজে শুধু যে একটি লোক কম পড়ে তাহা নয়, একটি করিয়া শত্রু বৃদ্ধি হয়!তারপর আবার হিন্দুধর্মত্যাগী মুসলমান বা খ্রীষ্টানের মধ্যে অধিকাংশই তরবারিবলে ঐ-সব ধর্ম গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছে ।” বিবেকানন্দের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর যে সুবিশাল প্রভাব , সে কথা আশা করি মনে করিয়ে দিতে হবে না । প্রায় প্রতিটি ভারতীয় দেশ নায়ক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী তাঁর অবদান মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে গেছেন ! নেতাজী তো বলেই বসলেন – ‘ তিনি বেঁচে থাকলে আজ আমি তাঁর পায়ের কাছে বসে থাকতাম । ‘ রবি ঠাকুর বললেন – ‘ভারতকে চিনতে হলে বিবেকানন্দ কে চেনো ।‘ সে যুগের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রধান অনুপ্রেরনা ছিল তিনটি বস্তু – স্বামীজির বাণী , বঙ্কিমের আনন্দমঠ আর ভগবৎ গীতা । বিবেকানন্দ নিজে রাজনীতি থেকে শতহস্ত দূরে থাকলেও পরাধীনতার গ্লানি ভালই বুঝতেন । তিনি প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক শিক্ষা দেন নি । কিন্তু রাজনৈতিক চেতনার যে ভিত্তি সেটা নির্মাণ করে দিয়েছিলেন । তিনি বুঝেছিলেন যে জাতি যদি নিজের ঐতিহ্যে একবার গর্ব বোধ করতে সক্ষম হয় , আর সঙ্কীর্ণতা ভুলে এক ভারতবাসি হিসেবে নিজেকে দেখতে শেখে , তাহলে পরাধীনতার শৃঙ্খল ঘোচা শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র ! স্বামী বিবেকানন্দের প্রতিটি বাক্য কে জীবনে আ্যপ্লিকেশন এর প্রতিরূপ হিসে প্রয়োগ করতে পারলে তবেই জীবন সার্থক হবে ।এবার কোভিড-আবহে স্বামীজীর পৈতৃক ভিটেয় দর্শকদের প্রবেশ নিষেধ। দর্শকছাড়াই এবার হবে স্বামীজীর জন্মদিনের অনুষ্ঠান। ১২ জানুয়ারির জন্মদিনের অনুষ্ঠান হবে ভার্চুয়ালি। ভক্তরা ওইদিন ঢুকতে পারবেন না স্বামীজীর বাড়ি।
সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য্য।।