মানুষ যতদিন এই পৃথিবীতে বসবাস করছে, ততদিন মুগ্ধ হয়ে চাদের শোভা উপভোগ করেছে। প্রথমে আমরা এই উপগ্রহকে খালি চোখে দেখেছি, তারপর টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখেছি। পরবর্তীকালে ১৯৬৯ সালে ২০ জুলাইনীল আর্মস্ট্রংসশরীরে চাঁদের মাটিতে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখেছেন। ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থাও (ISRO) থেমে থাকেনি। ২০০৮ সালে ২২ অক্টোবর পিএসএলভিসি-১১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ যানের সাহায্যে চন্দ্রযান-১ কেচাদে পাঠায় এবং ২০০৯ সালের ১৪ নভেম্বর চাঁদের মাটিতে অবতরণ করে। এই প্রকল্পের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল চাদের পৃষ্ঠতলের মাটি এবং আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য অনুসন্ধান করা। ১৩৮০ কেজির চন্দ্রযান-১ কে শ্রীহরিকোটায় সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র শার থেকে উৎক্ষেপণ কথা হয়েছিল।
প্রায় সাড়ে তিন বছরের প্রচেষ্টায় ইসরো ২২ জুলাই, ২০১৯ বিকেল ২টা ৪৩ মিনিটে শ্রীহরিকোটা থেকে জিএসএলভি (জিওসিনোম স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল)এম কে-৩ এর সাহায্যে চন্দ্রযান-২ উৎক্ষেপণ করেছে। এটি তিনটি যন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত অরবাইটার, ল্যান্ডার এবং একটি রোভার। প্রায় ২৩৭৬ কেজি ওজনের অরবাইটারের ৩০০০ ওয়াট সৌরশক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা আছে। এই যন্ত্রটি মূলত দুধরনের কাজ করবে। প্রথমত ইসরোর পরীক্ষাগারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করবে। বিভিন্ন যন্ত্রের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য পাঠাবে এবং তাদের অবস্থান ও পরিস্থিতি জানাবে। এই কাজ করার জন্য অরবাইটারে ৮টি যন্ত্র বসানো হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভূখণ্ড পরিমাপ করার জন্য ক্যামেরা, তিন ধরনের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র। সৌরমণ্ডল থেকে নিঃসৃত এক্স-রে মাপার যন্ত্র, চাদের ভূকম্পন মাপার যন্ত্র এবং পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য উচ্চ ব্যান্ডউইথ সম্পন্ন রিলে ব্যবস্থা।
ল্যান্ডারটির মহাকাশ গবেষণার স্থপতি ড. বিক্রম সারাভাইয়ের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে ‘বিক্রম। ১৪৭১ কেজি ওজনের এই যন্ত্রটির ৬৫০ ওয়াট সৌরশক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা আছে। এই যন্ত্রটি একদিকে যেমন অরবাইটার, রোভার এবং ভূপৃষ্ঠের অবস্থিতি পরীক্ষাগারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে, অন্যদিকে অবতরণে সহায়তা করার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন নেভিগেশন ক্যামেরা, দুর্ঘটনা এড়াবার জন্য ক্যামেরা এবং গতিমাপার যন্ত্র এবং চন্দ্রযানের সঙ্গে পাঠান সমস্ত যন্ত্রের সমন্বয় ঘটানোর জন্য সফটওয়্যার বহন করে।
রোভার একটি ছয় চাকাযুক্ত রোবোট, যেটি চাঁদের মাটিতে অন্বেষণের কাজ করতে পারে। সংস্কৃত ভাষায় ‘জ্ঞান’এর অর্থ প্রজ্ঞা, সেই সূত্রে এই রোভারের নামকরণ করা হয়েছে প্রজ্ঞা। এর ৫০ ওয়াট সৌরশক্তি তৈরির ক্ষমতা আছে। এবং এটি ৫০০ মিটার পর্যন্ত চলাফেরা করতে সক্ষম। রোভার কেবলমাত্র ল্যান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করে। এটি চঁাদের পৃষ্ঠতলের অবস্থা, তেজস্ক্রিয়তা, চন্দ্রপৃষ্ঠের আশেপাশে অবস্থিত অতি সংবেদনশীল আয়োনস্ফিয়ার ও বায়ুমণ্ডলের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ল্যান্ডারকে তথ্য প্রদান করবে। এর ওজন ২৭ কেজি যেটি ল্যান্ডারের মধ্যে বেশিরভাগ সময় অবস্থান করে। সামগ্রিকভাবে চন্দ্রযান-২ এর মুখ্য উদ্দেশ্য হলো চাদের পৃষ্ঠতল এবং বায়ুমণ্ডলের ভৌত, রাসায়নিক তেজস্ক্রিয় ও খনিজ ভাণ্ডারের অনুসন্ধান করা।
চন্দ্রযান-২ এর প্রেরণাভিযান ভারতবর্ষের কাছে একটি গুরত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ পরীক্ষামূলক অভিযান। এই অভিযান সফল হলে বিশ্বের দরবারে আমেরিকা, রাশিয়া ও চীনের পর ভারত হবে চতুর্থ দেশ, যে সফল চন্দ্রাভিযান করতে সক্ষম। একই সঙ্গে ভারতের আত্মবিশ্বাস ও সম্মান বহুগুণ বেড়ে যাবে। এর ফলে ভারত যে অর্থনৈতিক সুফল লাভ করবে বলাই বাহুল্য। এই অভিযান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে এই মিশনটির দুই পরিচালক মুথিয়া ভ্যানিথা ও ঋতু কারিবলে, দুজনেই মহিলা। ভারতবর্ষের সংস্কৃতি যেমন মাতৃশক্তিতে বিশ্বাস করে তেমনি মহিলাদের সশক্তিকরণের জন্য সদা সচেষ্ট থাকে। এই অবস্থায় দুজন মহিলা বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে শুধু সফল চন্দ্রাভিযান – নয়ই এই অভিযান নারীশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করবে এবং গবেষণা মূলক কাজে অনুপ্রাণিত করবে তা আশা করাই যায়।
ড. নিশীথ দাস
2019-08-02