ভারতের প্রথম রাজধানী শহর কলকাতার মর্যাদা এখনও অটুট অনেকক্ষেত্রেই। কলকাতা পুরসভাও ঐতিহাসিকভাবে বেশ সমৃদ্ধ। আর আগামী ১০ মাসের মধ্যেই কলকাতা-সহ রাজ্যের ১০০টি পুরসভার নির্বাচন। এর মধ্যে কলকাতা পুরসভা জয়ের ওজন নিশ্চিতভাবে জাতীয় রাজনীতিতে মাইলেজ দেবে পদ্ম শিবিরকে। ১৮ জন সাংসদ পাওয়ার পর ১৮০ জন বিধায়ক (যদিও সরকার গঠনে প্রয়োজন ১৪৮ বিধায়ক) পাওয়ার স্বপ্ন দেখতেই পারে বিজেপি। আর এই স্বপ্নকে বাস্তব আকার দিতে তাই কলকাতা পুরসভা-সহ যেসব পুরসভায় নির্বাচন হবে তা জয়ের রূপরেখা তৈরি করতে হবে এখনই। ঘরে বসে নয়, নির্দিষ্ট পথে এগোতে সর্বাগ্রে দরকার নিচ্ছিদ্র সংগঠন। কলকাতা পুরসভার ১৪৪টি আসনের মধ্যে ১০০টি আসনে জয় পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনাও রয়েছে বিজেপির। যদিও লোকসভার ফল ধরলে প্রায় ৬৫টি পুর কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল বিজেপি। এর মধ্যে কলকাতা পুরসভার অনেক দাপুটে মেয়র পারিষদও ধরাশায়ী হয়েছে বিজেপির কাছে। স্বয়ং মেয়র ফিরহাদ হাকিমও জিতেছেন কান ঘেষে। এমতাবস্থায় রাজ্যে তৃণমূল বিরোধী মনোভাব বিগত দু’মাসে আরও অনেকটাই বেড়েছে। ফলে ৬০-৬৫টি পুর আসনের লিড দু’অঙ্কে পৌঁছতে যে সময় নেবে না তা বলাবাহুল্য। কিন্তু এই সংখ্যাটা তখনই সত্যতা পাবে যখন বিজেপি কর্মীরা বুথ স্তর থেকে তৃণমূলের সন্ত্রাস ও রিগিং রুখে দিতে পারবে। একটা কথা এখন থেকেই মাথায় ঢুকিয়ে নিতে হবে কলকাতা পুরসভায় যাদবপুর, বেহালা-সহ একটা বড়ো সংখ্যক অ্যাডেড এরিয়া রয়েছে। আর তৃণমূল ঠিক তার পূর্বসূরি বামেদের বিদ্যা ধার করে এসব এলাকায় ভোট লুঠের চেষ্টা চালাবে।
গতবার এইসব এলাকায় ভোটার কার্ড কেড়ে নিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ না করতে দেওয়ার এক নােংরা খেলা চালানো হয়েছিল। অনেকটা পঞ্চায়েত ভোটের মতো গণতন্ত্রকে হত্যা করার ব্যবস্থা। সুতরাং এখন থেকেই সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে নিজ নিজ পুর এলাকায় গণতন্ত্রের দুর্গ গড়তে হবে সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে।
সাফল্য শব্দটা শুনতে যতটা ভালো লাগে ততটাই চাপও তৈরি করে সফলতা অর্জনকারীর কাছে। কয়েকদিনের মধ্যেই সাফল্যের উদ্ভাসিত ঘোর কাটলে বোঝা যায় কত বড়ো বোঝা চাপল নিজেদের ওপর। আর তখনই শুরু হয় এই সাফল্য আগলে রাখার লড়াই। গত লোকসভা নির্বাচনে সারা দেশের মানুষ দু’হাতভরে ভোট দিয়েছেন বিজেপিকে। আস্থা রেখেছেন নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদীর ওপর। প্রত্যাবর্তন ঘটেছে এনডিএ সরকারের। এই নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে হাজারো অপপ্রচার, কুৎসা সত্ত্বেও কীভাবে দেশের নানা প্রান্তে পদ্ম ঝড় উঠেছে। উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম বা উত্তর-পূর্ব ভারতের মতো দেশের পূর্বে প্রান্তেও বিজেপি ঝড় কোনও অংশে কম ছিল না। ব্যতিক্রম থাকেনি পশ্চিমবঙ্গও। ৪২-এ ৪২ পাওয়ার শাসক দলের আস্ফালনকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ১৮টি আসন এই রাজ্য থেকে জিতে বিজেপি বুঝিয়ে দিয়েছে তারা হাওয়ায় ভেসে রাজনীতি করে। না। দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহজী যে ২৩টি আসনের লক্ষ্যমাত্রার কথা বলেছিলেন তা প্রায় ফলপ্রসূ গিয়েছে। অন্তত আরও ৭-৮টি কেন্দ্রে শাসক দলের সন্ত্রাস ও জুলুমের কাছে হার মানতে হয়েছে গণতন্ত্রকে। না হলে ২৫-এর বেশি সাংসদ এ রাজ্য থেকে পাঠাতে পারত বিজেপি।
যাইহোক ১৮ সংখ্যাটাও কোনও অংশে কম নয়। আঠেরোর টগবগে শক্তি নিয়ে এখন বাকি কাজ সম্পূর্ণ করার পালা। বাকি কাজ বলতে যে রাজ্যের এই অপদার্থ সরকারকে হটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠা করা সেটা সবাই জানেন। লোকসভা ভোটের বিরাট সাফল্যকে সেমিফাইনাল বলছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন সেমিফাইনালে বিজেপি নিশ্চিতভাবে লেটার মার্কস পেয়েছে। এখন অগ্নিপরীক্ষা হতে চলেছে আগামী ২০২১-এর বিধানসভা ভোট। সেমিফাইনালের সাফল্যের পর এখন ফাইনাল পর্যায় হলো বিধানসভা ভোট। স্টেজ রিহার্সালের মার মার কাট কাট সাফল্য যাতে মূল পর্বেও ধরে রাখা যায় তার জন্য এখন থেকেই আদা জল খেয়ে নেমে পড়তে হবে রাজ্য বিজেপিকে। সুখের কথা বিজেপি রাজ্য নেতৃত্ব এখন জেলায় জেলায় লড়াই করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও অভিভাবকের মতো আগলে রাখার চেষ্টা করছে রাজ্য বিজেপিকে। তা সত্ত্বেও সময়ের দাবি মেনে রাজ্য বিজেপিকে সংগঠন মজবুত করায় আরও মনোনিবেশ করতে হবে এটা বলাইবাহুল্য। আবেগ নয় অঙ্ককে হাতিয়ার করে এগোতে হবে। মনে রাখতে হবে লোকসভার সাফল্য এখন অতীত। অর্থাৎ শুরু করতে হবে শুন্য থেকে।
আগামী বছর কলকাতা-সহ রাজ্যের ১০০টি পুরসভায় নির্বাচন হওয়ার কথা। যদিও এর মধ্যে একটা কথা চাউর হতে শুরু করেছে রাজ্য রাজনীতির আকাশে বাতাসে। তা হলো তৃণমূল যদি দেখে পুরভোটেও তাদের প্যাপক ভরাডুবি ঘটতে চলেছে, তবে সেক্ষেত্রে প্রশাসক বসিয়ে বিধানসভা ভোট পর্যন্ত উতরে দেওয়ার অপচেষ্টা চালাতে পারে তৃণমূল। কিন্তু আপাতত সেই চিন্তায় ভাবান্বিত না হয়ে বুথ ভিত্তিক শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার কাজ চালাতে হবে পুরোদমে। যাতে তৃণমূল আর কোনওভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এমনিতেই কাটমানির ক্যান্সার ঘাসফুলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে বিষাক্ত করে তুলেছে আপাদমস্তক। এরপর পুরভোটের পরাজয় তৃণমূলের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেওয়ার কাজ করবে জোরকদমে।
পার্থসারথি গুহ
2019-08-02